আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অনুভূতিহীন জীবন শব্দহীন থাকেনা, কখনোই

মানুষ তার আশার সমান বড়...

এই মৌসুমটা ভালো না। যদিও আমার খুব প্রিয়। এখন বুঝতে পারি, শৈশবটায় কেন এত সুখ ছিল। রাত চারটেয় শুয়ে সকাল ৭টায় ওঠা! বহুত কসরতের জীবন বৈকি। আমার সমস্যা হচ্ছে ঘুম সহজে আসে না, আবার যখন ঘুমাই তখন মরার মত ঘুমাই।

তখন এলার্ম হোক কিংবা গির্জার পাগলা ঘন্টি কোনটাই মগজে ঢুকে পিড়া দেয় না। মোবাইলের ভাইব্রেসন কিংবা এলার্ম এদের কাছে পান্তা ভাত। যদিও মোবাইলটা আমার মাথার কাছে কখনোই থাকে না, এটা কখনো পায়ের নিচে, কখনো কখনো বেডের নিচে, আবার কখনো কখনো পিঠের নিচে পড়ে ল্যাপ্টে থাকে। সেবার মামিটা হঠাৎ মারা গেলেন, সারারাত ১০৩ জ্বরে ভুগে সকালে ঘুমটা এলো। সকাল ৯টায় (কানা) নয়ন এসে যখন ঘুমটা ভাঙালো তখন মেজাজটা এতটাই খারাপ হয়েছিল যে ওকে এক প্রকার ঘর থেকে বের করে দেই অবস্থা।

কথা বলতে বলতে পিঠের চাপে অফ হয়ে যাওয়া মোবাইলটা যখন অন করলাম তখনই রিং! মা বললেন- সেই সকাল থেকে চেষ্টা করেও তোকে পাচ্ছি না, মোবাইল কিনেছিস কেন? ঘুম ঘুম লাল চোখ আর অপ্রস্তুত আমাকে তখনই দৌড় দিতে হয়েছিল। এবারের খবরটা পেয়ে নিজেকে ধন্য মনে হলো। ফুফু মারা গেছেন খবরটায় যতটা না দুঃসংবাদ বহন করছে তারও চেয়ে বেশি সুখ বহন করছিল। যদিও তখন আমার আমিকে আমি বুঝতে পারছিলাম এক বিন্দুও। আমার অনুভূতিটা তখন কেমন হয়েছিল? মাপতে গিয়ে দেখি আমি অনুভূতিশূন্য জগতে আছি।

মাকে ঘুম জড়ানো গলায় বলি- আমি যাব না মা; তোমরা ম্যানেজ করো... তিনি রাগান্বিত হয়ে বললেন- ছিঃ ছিঃ বাবা তোকে আসতে হবে, হাজার হোক তোর বাবা (আমাদের ফ্যামিলিতে ফুফুকে বাবা ডাকা হয়) হন। তোকে কত আদর করতো...। 'তুমি বলছো তাকে দেখার জন্য?' 'হাঁ বলছি' 'তোমরা সবকিছু হঠাৎ ভুলে যাও কেন?' 'কথা কম বল, জলদি গ্রামে চলে আয়, এটা আমার আদেশ!' ...আদেশ... মায়ের আদেশ... বিকল্প ১৭... মতিঝিল... রিক্সা... টিটি পাড়া... সৌদিয়া! পিচঢালা পথ ছেড়ে যখন মেঠো পথে এসে পা বাড়ালাম তখন বুকের ভেতর হাজার প্রতিশ্রুতির ভাসমান জোয়ার উথালি পাথালি ঢেউয়ের উপর ভর করে আমাকে ক্রমশ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ...পথের পাশের পাতা কুড়ানো মেয়েগুলোর খিলখিল হাসি, কিংবা শুকনো পাতার মচমচ শব্দ, বাঁশ বাগানের শিরশিরে বৈকালী সুর আর দিগন্ত বিস্তৃত সোনালী ধানের ঝনঝন শব্দ আমাকে পাগল করে তুলে, আমি হারিয়ে যেতে যেতে অনুভব করি, এদের ফেলে কি করে বিষন্ন নগরিতে পড়ে থাকি? পাশ দিয়ে মধুময় গন্ধ ছড়িয়ে কৃষাণ ফসল নিয়ে বাড়ি ফেরে, অল্প বয়সী কেউ বেসুরে অচেনা গান ধরে, মাঠের কোথাও কোথাও তিন চারজন জটলা করে বসে পরম সুখে বিড়ি ফুকছে। কেউ ছাতার ছায়ায় বসে খিদা নিবারনে ব্যস্ত।

কেউ ব্যস্ত নিজেদের মধ্যে হাসি ঠাট্টায়। চোখে তাদের স্বপ্নলতা। আমি কাউকেই তেমন চিনি না। হয়তো আমাকেও তারা তেমন চেনে না। তারপরও কেউ কেউ বিদু্যৎ গতিতে স্মৃতির ফ্রেমে এসে ধরা দেন।

যেমন সিদ্দিক মামা। দুগাল জুড়ে ধবধবে সাদা দাঁড়ি। কয়েকটা দাঁত নেই, ফোকলা হাসেন তিনি। সেটা এতটাই মিষ্টি যে একবার দেখলে বার বার দেখতে ইচ্ছা করে। মৃত বাড়ি আমার কাছে একদম ভালো লাগে না।

তারপরও ভালো লাগেনা'র কাজগুলোই মানুষকে বেশি করতে হয়। নিজের বাড়ি না গিয়ে সোজা ফুফুর বাড়ি গিয়ে উঠলাম। মানুষে গিজগিজ করছে পুরো বাড়ি, কেউ কাঁদছে, কেউ দেখছে, কেউ শুনছে। একজন এসে আমাকে জড়িয়ে হাউ মাউ করে কেঁদে একাকার! 'ওরে মা আর নাইরে...' মানুষ আমাকে অদ্ভুতরকম খুটিয়ে দেখছে। আমি কাঁদছি না কেন? এটাইতো তাদের প্রশ্ন।

সত্যি কথা হচ্ছে আমি মানুষের সামনে কাঁদতে জানিনা। আর ফুফুর মৃতু্যতে আমি দুঃখ পেয়েছি বলেও মনে হয়না। কিছু কিছু মৃতু্য আমাকে অনুভূতিশূন্য করে তুলে। এটা তেমনই একটা মৃতু্য। কিছু সময় ভাবি মানুষটাকে মনে হয় ভালোবাসি, কিছুন পর- নাতো, এদের কখনোই ভালোবাসিনি।

এদের ভালোবাসা উচিৎ নয়। দেলু ভাই সদ্য কুয়েত ফেরত। আমাকে জড়িয়ে এক পশলা কান্নার পর, বললো- 'আমাকে চিনতে পারছিস?' আমি নির্লিপ্ত ও অনুসন্ধানি দৃষ্টিতে বলি- 'না'। 'চিনবি কেমনে, তোকে 16 বছর পর দেখছি!' মা এসে আমার ব্যাগ নিয়ে গেলেন। কিছুন পর আমাকে বেশ আয়োজন করেই লাশ দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হলো।

আমি মৃত মানুষ দেখতে চাইনা। মৃত মানুষের হা করা মুখ, পিশাচি চোখ আর ভঙ্গুর চেহারা দেখে কি হবে? তারপরও সামাজিকতার খাতিরে উঠতেই হয়। আমি আগে কখনো মৃত মানুষ নিয়ে গবেষণা করিনি। এটা আমার কাজ নয়, আমার কাজ জীবিত মানুষ নিয়ে। তারপরও প্রথম বারের মত আমি এটাকে খুটিয়ে দেখলাম।

এর চেহারায় কি দেখলাম? নাহ কোন অপরাধবোধ নেই, আপসোসও নেই; বিষাধ আছে। কার প্রতি? উত্তর দিতে আসবে না কেউ। আমি সরে আসি। অনেক জোড়া চোখ আমাকে দেখছে। অর্ধেক শুনে চিনেছে, অর্ধেক চেনার চেষ্টা করছে।

আমিও বাড়ির ভিড়ের মাঝে বিশেষ একজনকে খুঁজছি। চোখ নাকি কথা বলে? কই ঢাকায়তো এত কষ্ট হয়না....! মাসে দুবার করে ফোন করে তার কি সুখ আমি বুঝিনা। বিশেষ সেই একজন নিশ্চয়ই এ ভীড়ে মিশে আছে। মৃত বাড়িতে মৃতের শোক পালনের মাঝে এ নিশ্চিত ছেলেমানুষী খেলা...! ---> চলবে, যদি মনে থাকে

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.