আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অচেনা চীনে ১১

চীনের মসজিদ ২ মসজিদে তেমন কোন ভিড় ছিল না। বারান্দায় চেয়ারে বসে বই পড়ছিলেন জনা দুয়েক লোক। মসজিদের পূর্বদিকের মিনারের পাশে বাগান পরিচর্যা করছিলেন একজন। আমাদের দেখে এগিয়ে তিনি এগিয়ে এলেন। কেভিনের সাথে কুশল বিনিময়ের পর আমার দিকে হাত বাড়িয়ে ইংরেজিতে বললেন ‘ওয়েলকাম, আমি আব্দুর রহমান।

এই মসজিদের মুয়াজ্জিন’। ভদ্র লোকের বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে। আমরা লোঙ্গগাং থেকে এসেছি শুনে খুশি হলেন। তারও বাড়ি লোঙ্গাঙ্গে। এই মসজিদের মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করছেন প্রায় তিন বছর ধরে।

লোঙ্গাঙ্গে মুসলমানের সংখ্যা কম হওয়ায় ওখানে এখনও মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আব্দুর রহমানের কাছেই শুনলাম চীনে ইসলাম ধর্ম পালন, কোরান চর্চা এবং ধর্মীয় শিক্ষার প্রসারের জন্যে জাতীয় পর্যায়ের একটি কমিটি আছে। মসজিদ নিরমাণ, হজ্জ পালন সহ অন্যান্য ধরমীয় আচার আচরণ পালনে ষোল সদস্যের এই কমিটি যথেষ্ট ভুমিকা রাখে। ছোট খাটো গড়নের এইই মানুষটাকে প্রথম দর্শনেই আমার ভালো লেগে গিয়েছিল। তার সাথে আলাপচারিতা শুরু হল কেভিনের জবানিতে।

প্রথম বাক্যটি তিনি বলে ছিলেন ইংরেজিতে। তবে ইংরেজির জড়তার জন্যে এর পর আলাপ চলল কেভিনের মাধ্যমে। আব্দুর রহমান জানালেন ইংরেজিটা তার ঠিক মত আসেনা আর মন খুলে কথা বলতে হলে মাতৃভাষাতেই বলা ভালো। কেভিন কে বললাম “তোমাদের মুয়াজ্জিনের চেহারায় ধর্ম ভাব যতটা না প্রকাশিত সৈনিকের আদল তার চেয়ে বেশি। থুতনির নিচে আধ মুঠো দাঁড়ি, মেদহীন ছোটখাটো শরীর সব কিছু চাইনিজ বক্সিং জাতীয় সিনেমার গ্র্যান্ডমাষ্টারদের কথা মনে করিয়ে দেয়”।

কেভিনের অনুবাদ শুনে তিনি হেসে ফেলে বললেন ‘তোমার বিদেশি বন্ধুকে বল আমি উশু জানি’। আমি রোজা রাখিনি শুনে মন খারাপ করলেন কি না জানি না। খনিকের জন্যে একটু গম্ভীর দেখালো তাঁকে। কথা না বাড়িয়ে মসজিদ দেখাতে নিয়ে গেলেন। বললাম “ইন্টারনেটে আপনাদের মসজিদের চেহারা অনেক সুন্দরঃ।

জানা গেল ইন্টারনেটে যে ছবিটা দেয়া হয়েছে সেটাই মসজিদের আসল ছবি। কয়েকদিন আগে মসজিদের নতুন ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। নতুন মসজিদে গম্বুজ, মিনার ছাড়াও আরও অনেক কিছু থাকবে। কেভিনের সন্দেহ ছিল তাঁকে মসজিদে ঢুকতে দেওয়া হবে কিনা। আমি বললাম ‘ইসলাম ধর্ম অনেক উদার তুমিও ঢুকতে পার, তবে স্যন্ডেল টা বাইরে খুলে রেখে ঢুকো’।

আমার কথা ঠিক মত শুনতে না পেয়ে কেভিন স্যন্ডেল পায়ে মসজিদে ঢুকে পড়তেই তাঁকে আব্দুর রহমানের রোষানলে পড়তে হল। মুয়াজ্জিন সাহেবকে ঠান্ডা করতে হল আমাকেই। কেভিনও ভাল ছেলের মত স্যন্ডেল খুলে বাইরে রেখে এল। আব্দুর রহমানের কাছে চীনের মুসলমানদের গল্প শুনে অবাক হোয়ে গেলাম। চীনের প্রথম মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল সপ্তম শতকে।

নবীজীর ওফাতের আগেই চীনারা ইসলামকে বরণ করে নিয়েছিল। আমি জানালাম বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তন হয়েছিল প্রায় একই সময়ে, বাংলাদেশের প্রাচীনতম মসিজদটির বয়স প্রায় দেড় হাজার বছর। ইন্টারনেটের কল্যানে জেনেছি ৬১৮ সালে তিনজন সঙ্গী সহ ওয়াক্কাস ইবনে ওয়াহাব নামে একজন সাহাবি এসেছিলেন চট্টগ্রাম বন্দরে। তিনি কিছুদিন চট্টগ্রামে অবস্থান করে মায়ানমার হয়ে চীনে গিয়েছিলেন। আমার কথা শুনে মিট মিটিয়ে হাসলেন আব্দুর রহমান বললেন ‘অনেক আগে থেকে পারস্যের সাথে চীনের ব্যবসা বানিজ্য ছিল।

আমি যতদূর জানি পারস্য থেকেই সিল্ক রোড ধরে মুসলমানরা এদেশে এসেছিল প্রায় পনর শ’ বছর আগে। প্রথমবারের সে দলে ছিলেন সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস, সাইয়্যেদ ওয়াহাব ইবনে আবু কাবসা আর অন্য একজন সাহাবি। তবে প্রথম দিকে আরবরা এদেশে ধর্ম প্রচারে আসেনি। এসেছিল বানিজ্যক কারনে। সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাস ছিলেন বিবি আমিনা (রা)’র দূর সম্পর্কের ভাই।

যতদূর জানা যায় নবীজির আত্মীয় এবং সাহাবা সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাসের মাধ্যমেই চীনারা প্রথম ইসলাম ধর্ম এবং রাসুলুল্লাহ’(দঃ)র কথা জানতে পেরেছিল। দ্বিতীয়বার তিনি চীনে আসেন ৬৩৭ সালে, সে বার ফিরে যাবার সময় তিনি ইয়ুনান-মনিপুর হয়ে চট্টগ্রাম সফর করেন’। আমি বললাম ‘চট্টগ্রামে ওনার আসার কথা এর আগে শুনিনি’। - চট্টগ্রামে তিনি বেশিদিন ছিলেন না। চট্টগ্রাম থেকে সমুদ্র পথে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন আরবে।

সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস কিন্তু আরও একবার এসেছিলেন আমাদের দেশে। - আবার এসেছিলেন? - হ্যা। সেবার তিনি এসেছিলেন সরকারি সফরে। ৬৫১ সালে হযরত ওসমান তাঁকে সম্রাট গাওঝং এর কাছে পাঠিয়েছিলেন দূত হিসাবে। - তার পর? - গাওঝং এর কাছে তারা যথেষ্ট সমাদৃত হয়েছিল।

সম্রাট গাওঝং নবীজির সম্মানে ক্যন্টনে একটি মসজিদ নির্মাণেও সহায়তা করেছিলেন। ৬২৭ সালে নির্মিত এই মসজিদকে বলা হত হুইয়াশেং মসজিদ। - আপনি না বললেন সা’দ ইবন আবি ওয়াক্কাস গাওঝং এর কাছে এসেছিলেন ৬৫১ সালে? - এখানে একটা ভুল হলেও হতে পারে, তবে উনি যে ত্যং রাজত্ব কালে এসেছিলেন তার যথেষ্ট প্রমান আছে। এসব ইতিহাস কেভিনের খুব একটা ভাল লাগছিল না। সে নিচু গলায় জানাল সকালে নাস্তা খাওয়া হয়নি তার।

পেটে ছুচোর কেত্তন শুরু হতে দেরি লাগবে না। আমারও খিদে লেগে গিয়েছিল, তবে আব্দুর রহমানের গল্পও ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করছিল না। পথ বাতলে দিলেন আব্দুর রহমানই বললেন ‘নামজ শুরু পৌনে একটায়, তোমরা না হয় একটু ঘুরেই এস’। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি তখন মাত্র এগারটা বাজে। আব্দুর রহমান কে বিদায় জানিয়ে নাস্তার খোঁজে বেরিয়ে পড়লাম।

মসজিদের কাছে বেশ কয়েকটা রেস্তোরা ছিল। তার মধ্যে একটি ছিল উন্মুক্ত রেস্তোরা, আমাদের চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের পাশে যেমন সারি সারি টেবিল চেয়ার পাতা থাকে, সন্ধ্যার পর কাবাবের গন্ধ্যে মৌ মৌ করে অঠে পুরো এলাকা অনেকটা সে রকম। মেইলিনের এই রেস্তোরায় প্রায় তিনশ’জন লোক একসাথে বসতে পারে। পুরো রেস্তোরার ছাদ বলতে শুধুই গাছের ছায়া। উন্মুক্ত রেস্তোরাটি তখনও জমেনি।

অল্প কয়েকজন মানুষ এখানে সেখানে। কেভিনের পছন্দে অন্য একটি রেস্তোরায় ঢুকে ফ্রয়েড রাইস আর চিকেন নিয়ে বসলাম। কেভিন নিল বারগার। খেতে খেত কেভিন বলল ‘এখনওতো নামাজের অনেক দেরি। ‘বিরক্তির চিহ্ন স্পষ্ট তার চোখে মুখে।

আমি বললাম, আব্দুর রহমানের গল্প শুনে তো সময় মন্দ কাটছিল না। তোমার ত তেমন কোন মনযোগ দেখলাম না’। - দ্যাখোনি, কারন এই গল্প গুলো আমিও জানি। - তুমিও জান? - আমি তো তোমাকে বলেছি, তুলনা মূলক ধর্ম তত্ত্ব আমার পছন্দের বিষয়। মুসলমানরা এদেশে প্রথম এসেছিল ট্যং ডাইনেষ্টির সময়।

ধর্ম প্রচারের কোন মরীয়া উদ্যোগ তখন লক্ষ করা যায়নি। তাই ইসলামের প্রসারে বড় কোন বাঁধাও আসেনি। মুসলমান বনিকরা কনফুসিয়ান,তাওবাদী আর বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সাথে মিলেমিশে বসবাস করেছে। প্রাচীন ধর্মগুলির তুলনায় ইসলাম অনেক বেশি আধুনিক হওয়ায় জনগণ ধীরে ধীরে এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। আর ধর্ম প্রচারে বাড়াবাড়ি না থাকায় নবম শতকে যখন বৌদ্ধ ধর্মের উপর আইনের খড়গ নেমে এসেছে তখনও ইসলাম ধর্ম থেকে গেছে নিরাপদ।

শাসকরা বৌদ্ধদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ মনে করলেও মুসলমানদের কে ভাসমান বিদেশি হিসাবেই গণ্য করেছে। এই সুযোগে ইসলাম ছড়িয়ে পড়েছে চীনের বিভিন্ন প্রদেশে। সং রাজাদের সময় চীনের বৈদেশিক বানিজ্য ও আমদানি-রপ্তানি শিল্পে মুসলমানরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এসময় থেকে প্রায় নিয়মিত ভাবেই চীনের জাহাজ নির্মাণ শিল্পের মহা পরিচালক নিয়োগ করা হত মুসলমানদের মধ্য থেকে। একাদশ শতাব্দীর কোন এক সময় সম্রাট শেংজং বুখারা থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মুসলমানকে আমন্ত্রণ করে আনেন উত্তর পূর্বাঞ্চলের লিয়াও সম্রাজ্য আর চীনের মধ্যে বাফার অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষে।

পরবর্তীতে সুং রাজধানি কাইফেং আর ইয়েঞ্চিং এর মাঝামাঝি এলাকায় তাদের বসতি গড়ে ওঠে। নতুন বসতির নেতা ছিলেন সো-ফি’র। সো-ফি’রের মুসলিম নাম হল আমির সাইদ। তাঁকে চাইনিজ মুসলিমদের জনকও বলা হয়। তার আগ পর্যন্ত ইসলাম ধর্মকে চীনা ভাষায় বলা হত দা’শিফা অর্থাৎ আরবদের আইন।

আমাইর সাইদ ইসলাম ধর্মের নাম দেন হুইহুই জিয়াও বা হুইহুইদের ধর্ম। কেভিনের জ্ঞানের গভীরতা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। বললাম ‘প্রাচীন সেই মুসলিম বসতি গুলির এখ ন কি অবস্থা? আর ইসলাম ধর্মের নাম হুই হুইদের ধর্ম রাখার যুক্তিই বা কি?’ আমার প্রশ্নে কেভিন কিছু মনে করল না। বলল সেই বসতিই তো শেষ নয়। চীনের জনসংখ্যার প্রায় দেড় শতাংশ এখন মুসলিম।

তারা ছড়িয়ে আছে সর্বত্রই। ইয়েঞ্চিঙ্গের আধুনিক নাম বেইজিং, আমাদের রাজধানি। আর চীনা ভাষায় হুই হুই বলতে মধ্যপ্রাচ্যের মানুষদের বুঝায়, এ জন্যেই সম্ভবত এই নাম। একমাত্র কমিঊনষ্ট বিপ্লব আর সাংষ্কৃতিক বিপ্লবের কিছু দিন ছাড়া মুসলমানরা এদেশে সুখেই ছিল। সানিয়েত সেন এর যুগে মুসলমানরা কত শক্তিশালি হোয়ে উঠেছিল তুমি ভাবতেও পারবেনা।

কমিউনিস্ট বিপ্লবের পর চেয়ারম্যান মাওএর আমলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম অধ্যুসষিত অঞ্চলে দুই দুইবার স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদোগ নিয়েছিল তারা। মাও সেতুং শক্ত হাতে দমন করেছিলেন সে উদ্যোগ’। এসব তথ্য আমার কাছে সম্পূর্ণ নতুন, শুনতেও ভালো লাগছিল, নামাজের সময় হয়ে আসায় উঠতে হল। কেভিনের কাছে জানতে চাইলাম তুলনামুলক ধর্মের ছাত্র হিসাবে কোন ধর্মটি তার পছন্দের। গম্ভীর হয়ে গেল কেভিন, বলল- আমি মাঝে মাঝে ভাবি ধর্ম টরমের আসলে দরকার আছে কি না।

কি বলব ওকে বুঝতে পারছিলাম না। খবরে পড়েছি গত বছর রোজা রাখা নিয়ে উরঘু মুসলমানরা ঝামেলায় পড়েছে। সাংষ্কৃতিক বিপ্লবের ভুত এখনও পুরোপুরি দূর হয়নি চায়না থেকে। বললাম ‘ যতক্ষণ বিপদে না পড় ধর্ম তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়, বিপদে পড়লে এটি কাজে আসে। - কেন? ধর্ম কি বিপদ থেকে উদ্ধার করে? এদেশে তো ধর্মই বিপদ বয়ে আনে।

- আনতেও পারে, তবে আসলে আনে কি না সেটা নির্ভর করে যার যার বিষাসের উপর। - সোজা করে বল। একবার ভাবলাম, কেভিনের সাথে এসব কথা বলে লাভ নেই। তারপর মনে হল বললেই বা ক্ষতি কি? সময়তো কাটবে। বললাম শোন কেভিন, প্রতিটা মানুষেরই একটা আশ্রয় দরকার, বিপদে পড়লে বা মন খারাপ হলে যে তোমাকে সাহস যোগাবে, বিপদ কাটিয়ে ওঠার প্রেরণা যোগাবে।

ধর্ম হচ্ছে সেই আশ্রয়। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। ধর একটা লোক একা জংলের মাঝ দিয়ে হাটছে। জংলে জন্তু থাকতে পারে, ডাকাত থাকতে পারে আরও নানা রকম ভয় থাকতে পারে, এক জন সাধারন ধর্ম ভীরু মানুষ তখন যদি আল্লাহর নাম জপতে থাকে তাহলে অনেক সময়ই তার ভয় কেটে যায়। মনে হয় সে একা নয়।

তার সাথে আল্লাহ আছেন। কেভিনের কোন ভাবান্তর হল ব্লে মনে হল না। ভদ্রতার খাতিরে বলল ‘তোমার কথায় যুক্তি আছে, যদিও অত্যন্ত দুর্বল সে যুক্তি’। আমি আর কথা না বাড়িয়ে পা বাড়ালাম মসজিদের দিকে। পথে দেখা হল এক জন মালোয়েশিয় মুসলমানের সাথে।

চেহারা দেখে বাঙালি মনে করে এগিয়ে গিয়েছিলাম, বাংলায় নামও জিগ্যেস করে ছিলাম তাকে । ভুল ভাংলো তার উত্তরে বললেন নো হিন্দি। ভদ্রলোকের নাম জাফর। মেইলিনেই আছেন দু’বছর ধরে। প্রতি শুক্রবারেই নামাজ পড়তে আসেন এই মসজিদে।

জানালেন প্রায় হাজার খানেক লোক হয় জামাতে। প্রচুর বিদেশিও আসে। জাফরের কথা খুব একটা বিশ্বাস হল না। কারন তখন বাজে বারো টা চল্লিশ। ভীড় কিছু বাড়লেও সেটা বেড়েছে ফুটপাতে।

কয়েক জন লোক পশরা সাজিয়ে বসেছেন বিভিন্ন পন্যের। তার মধ্যে আছে নান রুটি, হালাল মাংস, জবাই করা মুরগি, নানান রকম ফল,বিভিন্ন ধরণের টুপি, পাজামা কুর্তা, ছাতা,প্লাস্টিক পন্য, খেলনা আর চেনা অচেনা অনেক কিছু। মসজিদের বারান্দায় বেশ কয়েক জন লোক বসেছিলেন। মুয়াজ্জিনের সাথে দেখা হয়ে গেল আবার। প্রথমে চিনতে পারিনি।

বেশ ভূষায় পরিবর্তন হয়েছে। নকশাদার আলখেল্লা আর টুপিতে তাকে মোটেও চাইনিজ বক্সারের গ্র্যান্ড মাস্টারের মত মনে হচ্ছেনা। আমাকে দেখে মৃদুহেসে ওজুখানা দেখিয়ে দিলেন। ওজুখানাটি মসজিদ থেকে গজ বিশেক দূরে। যাবার পথে চোখ পড়ল মসজিদের পেছনের ইসলামিক সেন্টারে, বেশ কয়েক জন মহিলা- পুরুষ বই পড়ছেন সেখানে।

অজু করে ফেরার সময় দেখা হল এন আর আই মুসলিম ইমরানের সাথে। তিনি আমেরিকা থেকে চীনে এসেছেন মোবাইল ফোনের স্পেয়ারস কিনতে। এই মসজিদে আজই প্রথম। জানতে চাইলেন সন্ধ্যার সময় মসজিদে ইফতার দেওয়া হয় কিনা। আমিও নতুন শুনে বললেন দুরের একটা হোটেলে উঠেছেন তিনি।

মেইলিনে কাটাতে চান মাগরিব পরযন্ত। কেভিনের সাথে বেশ খাতির হয়ে গেল তার। আমি জানালাম কেভিন এসেছে আমাকে মসজিদ দেখাতে। অবাক হয়ে গেলেন তিনি আর ইউ মুসলিম কেভিন? কেভিনের উত্তর মৃদু হাসি। যার মানে হতেও পারি।

দ্বিতীয়বার মসজিদে আসা অবধি কেভিনের মধ্যে একটু অস্থিরতা লক্ষ করছিলেম। তার কারণ বুঝা গেল কেভিনের প্রশ্নে – তুমি যখন নামাজ পড়বে তখন আমি কি করবো? প্রশ্নটা আমার মনেও যাএ আসেনি তা নয়। সমাধান দিল ইমরান, বললো তুমিও আমাদের সাথে মসজিদে ঢুকবে? - আমিও? - হ্য অসুবিধা কি? কেভিনের মুখে যুগপৎ বি ষ্ময় ও আনন্দের ছায়া খেলে গেল। বলল অনেক মজা হবে আমি কখনও মুসলমান্অদের প্রেয়ার দেখি নাই। আমাকে কি হাত পা ধুতে হবে? আমি বললাম হ্য মসজিদে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে ঢোকা ভাল।

কেভিন ওজুখানায় গিয়ে হাত পা ধূয়ে এল। মসজিদে তখন বয়ান শুরু হয়েছে। আস্তে আস্তে ভীড় বাড়ছে। কেঊ সুন্নত নামাজ পড়ছে কেউ বয়ান শুনছে। কেভিন জানতে চাইল নামাজ শুরু হয়েছে কিনা।

বললাম ‘শুরুতো হয়েছেই তবে আমি যে নামাযের কথা বলছি সেটা শুরু হবে আরও পরে’। বাইরে তখন প্রচন্ড গরম। আমি কেভিন কে নিয়ে ভিতরে ঢুকলাম। মসজিদের অর্ধেক ভরে গেছে ততক্ষ্ণনে। কেভিন জিগ্যেস করল সে ছবি তুলতে পারে কি না।

বললাম কোন অসুবিধা নেই তবে নামাজের সামনে যেওনা। পিছন অথবা পাশ থেকে তুলো। কেভিনের প্রশ্নের শেষ নেই। সে আর কি কি করতে পারে জানতে চাইল। বললাম মূল নামাজ শুরু হবার আগে ইমাম সাহেব কিছু কথা বলবেন।

আমি যেহেতু চাইনিজ বুঝিনা তুমি মন দিয়ে শুনে আমাকে বুঝিয়ে দিও। কেভিন কিছুক্ষণ চুপকরে থেকে বলল কোরান কিভাবে এল সে কথা বলা হচ্ছে। আমি বললাম ‘এখন কথা বল না। অন্যদের অসুবিধা হবে পরে আমাকে বুঝিয়ে দিও’। আরবীতে খুতবা শুরু হবার আগেই মসজিদ প্রায় পূর্ণ হয়ে গেল মুসল্লীতে।

আমি ভাবলাম কেভিন কে নিয়ে মাঝের কাতারে বসা ঠিক হবে না। তাকে বললাম ‘চল বাইরে কত লোক দেখে আসি’। বাইরে তখন মানুষের ঢল নেমেছে। কেভিনও বিষ্মিত। এত লোক মসজিদে আসে! হুজুর যখন কাতার শুরু করতে বললেন তখন মসজিদে ঢুকে পেছেনের কাতারে দাঁড়ালাম।

আমাদের পেছেনে পর্দা দিয়ে ঘেরা মহিলাদের কাতার। নামাজ শুরু হবার আগে কেভিন আবার জেনে নিল তার কি কি করনীয়। বললাম তুমি শুধু চুপ চাপ দাঁড়িয়ে থেক। ছবি তুলতে চাইলে আগে যা বলেছি মনে রেখ, নামাজের সামনে যেও না। রুকুতে যাবার পর কেভিনের প্রশ্ন শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম শ্যাল আই বো? প্রথমে খেয়াল করিনি কেভিন যখন আমার কনুইয়ে খোঁচা দিয়ে আবার জানতে চাইল বুঝলাম সে জানতে চাইছে সে সেজদা দেবে কি না।

সালাম ফিরানোর পর কেভিনের দিকে চোখ পড়ল। সে বলল সে অত্যন্ত অপমানিত হয়েছে এতবার প্রশ্ন করার পরও উত্তর না দেবার জন্য। তাঁকে নামাযের মনঃসংযোগের কথা বুঝিয়ে বলার পর সে শান্ত হল। বলল জানো এখানে তেরশ’ জনের বেশি লোক এসেছে কিন্তু নামাজের সময় ইমাম সাহেবের কথা ছাড়া আর কারো কথা শুনি নাই। বললাম তেরশ’ লোক কিভাবে বুঝলে? আই কাউন্টেড কভিনের উত্তর।

মসজিদে মোট ৩৫টি রো আছে, প্রত্যেক রো তে ৩০ জন করে দাঁড়ায় আর বাইরে ছিল অন্ততঃ তিন শ’। মসজিদের বাইরে এসে কেভিন বলল জানো আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ধর্ম জিনিষটা খারাপ নয়। আমার বাবা থাকলে জিগেস করতাম কোন ধ্রমটা আমার পালন করা উচিত। আমরা হাটতে হাটতে বাস স্টপের দিকে যাচ্ছিলাম। চমৎকার ছায়া ঢাকা পথ।

কেভিনের চোখ ছল ছল করছে। আমি জানতে চাইলাম কোন সমস্যা হয়েছে কিনা। সে বলল আমি কি তোমার বন্ধু হতে পারি? বললাম কেভিন প্রায় সারা দিন এক সাথে কাটাবার পর তোমার এই প্রশ্ন কেন? সে বলল মসজিদে আসার পর মনটা অন্য রকম হয়ে গেল। ইমাম সাহেব অনেক কথা বললেন যা টিপিক্যল প্রিষ্টদের মত নয়। আমি কি মুসলমান হতে পারি? বললাম তোমার যদি আগামীকাল পর্যন্ত এই কথা মনে হয় তাহলে চিন্তা করে দেখতে পার।

(অসমাপ্ত) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।