আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রাজধানীতে ৮ ঘণ্টার ধ্বংসযজ্ঞ

‘ঢাকা অবরোধ’ করতে এসে রাজধানীতে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। গতকাল রোববার সকাল থেকে তারা প্রায় আট ঘণ্টা ধরে মতিঝিল-পল্টনের দুই বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ও গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুর, হামলা ও অগ্নিসংযোগ করে।
এ সময় হাজার হাজার গুলি, বোমা, ককটেল, কাঁদানে গ্যাস ও গ্যাস-গ্রেনেড বিস্ফোরণের বিকট শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সংঘর্ষের ঘটনায় ১০ জন নিহত ও পুলিশ সদস্যসহ দুই শতাধিক ব্যক্তি আহত হন বলে জানা গেছে।
হেফাজতের কর্মীরা জিপিওর প্রধান কার্যালয়, বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেট, পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের কার্যালয়, হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স করপোরেশনের ভবন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিবহন পুল, মুক্তি ভবন, র‌্যাংগস ভবনসহ আরও কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ফুটপাতের দোকানে আগুন ধরিয়ে দেন।

এ ছাড়া ফায়ার সার্ভিসের পানিবাহী গাড়িসহ সরকারি ও বেসরকারি বেশ কিছু যানবাহন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে দফায় দফায় হামলার চেষ্টা করা হয়। ভাঙচুর করা হয় শত শত যানবাহন। এর ফলে রাজধানীর জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। সন্ধ্যার পর সর্বত্র ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।


সংঘর্ষের সময় সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা জানিয়েছে, যারা বিশৃঙ্খলা করছে, তারা তাদের কর্মী নয়। হেফাজতে ইসলামের মোড়কে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরাই এটা করছে। ’ মন্ত্রী যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন সচিবালয়ের পাশেই কাঁদানে গ্যাসের শেল ও ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যাচ্ছিল।
হেফাজতের অবরোধ কর্মসূচি ছিল রাজধানীর প্রবেশমুখগুলোতে।

শাপলা চত্বরে সমাবেশের অনুমতির দেওয়ার পর তারা স্রোতের মতো রাজধানীর ভেতরে ঢোকে এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
সংঘর্ষের সূচনা হয় পল্টন এলাকায়। বেলা ১১টার দিকে যাত্রাবাড়ী থেকে আসা হেফাজতের কর্মীদের একটি দল বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেট থেকে পল্টন মোড়ে পুলিশের বাধা ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতে চায়। এ সময় পুলিশ বাধা দিলে শুরু হয় সংঘর্ষ। হেফাজতের কর্মীরা পেছনে সরে গিয়ে পুলিশের ওপর বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকেন।

পুলিশ রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়লে ব্যাপক সংঘর্ষ শুরু হয়। এর পর থেকে দফায় দফায় সংঘর্ষ চলতে থাকে। সংঘর্ষ একপর্যায়ে বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর ফটক, দক্ষিণ ফটক, মতিঝিল, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, দৈনিক বাংলা মোড়, জিরো পয়েন্ট ও বিজয়নগরেও ছড়িয়ে পড়ে।
বেলা দেড়টার দিকে হেফাজতের কর্মীরা গোলাপ শাহ মাজারের কাছে কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করলে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে থাকা আওয়ামী লীগের কর্মীরা তাঁদের ধাওয়া করেন। কয়েক মিনিট পর হেফাজতের কর্মীরা হকি স্টেডিয়ামের দিক থেকে আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে এগিয়ে আসেন।

তখন পল্টনের দিক থেকে এপিসি, জলকামানসহ পুলিশ ও র‌্যাব এসে তাঁদের হটিয়ে দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে বায়তুল মোকাররম, গুলিস্তানসংলগ্ন এলাকা ও ফুলবাড়িয়া এলাকায়। এ সময় পুলিশের গুলিতে একজন পরিবহনশ্রমিক নিহত হন।
আড়াইটার দিকে হেফাজতের বিশাল একটি মিছিল বংশাল রোড হয়ে আওয়ামী লীগের অফিসের দিকে এগোতে থাকে। এ সময় র‌্যাব ও পুলিশের সদস্যরা পিছু হটে আওয়ামী লীগের অফিসের সামনে গিয়ে অবস্থান নেন।

হেফাজতের কর্মীরা গোলাপ শাহ মাজার এলাকায় গাড়ি ভাঙচুর করেন এবং বোমা-ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান।
বিকেলের আগেই পুলিশ ও র‌্যাব বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, নূর হোসেন স্কয়ার, পল্টন ও জাতীয় প্রেসক্লাবসংলগ্ন রাস্তা দখল নিয়ে নেয়। অন্যদিকে হেফাজত অবস্থায় নেয় বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ও উত্তর গেট, বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের পূর্ব পাশ এবং বিজয়নগরের রাস্তায়। তবে হেফাজতের কর্মীদের ঠেকাতে পুলিশকে দুপুরের পর থেকে বিরতিহীনভাবে শটগান ও সাঁজোয়া যান থেকে হাজার হাজার গুলি ছুড়তে হয়েছে।
সোয়া তিনটার দিকে মতিঝিলের সমাবেশমুখী হেফাজতের কর্মীরা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর একপর্যায়ে পুরানা পল্টনে মুক্তি ভবনে হামলা চালান।

ওই ভবনে সিপিবির কার্যালয়। সেখানে ফুটপাতের দোকানগুলোতে আগুন দেওয়ার পর মুক্তি ভবনের নিচতলার সব দোকান ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁরা ভবনের একটি ফটকও ভেঙে দেন।
এ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এবং দুটি পত্রিকা সংবাদ ও সকালের খবর-এর সংবাদকর্মী এবং আশপাশের কয়েক শ ভবনের লোকজন অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। রাত আটটা পর্যন্ত এসব এলাকার অফিস ও বাড়ি থেকে লোকজন বের হতে পারেননি।


বিকেল চারটার পর পল্টন মোড়ের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ অবস্থা ধারণ করে। হেফাজতের কর্মীরা বংশাল, হকি স্টেডিয়াম, বিজয়নগর, বায়তুল মোকাররম দক্ষিণ ও উত্তর গেট থেকে আওয়ামী লীগ অফিসের দিকে এগোনোর চেষ্টা করেন। হেফাজতের সমর্থকেরা তখন পল্টনের আশপাশের বাড়ির ছাদে অবস্থান নেন এবং পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ও ককটেল ছুড়তে থাকেন।
সন্ধ্যার দিকে হেফাজতের কর্মীরা বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে অবস্থিত ফুটপাতের দোকানের কাঠের কাঠামোতে আগুন ধরিয়ে দেন।
রাজধানীর বিজয়নগরে গতকাল বেলা তিনটার দিকে ট্রাফিক পুলিশের (পূর্ব) উপকমিশনারের কার্যালয়ে আগুন দেওয়া হয়।

এতে গুরুতর আহত হন কনস্টেবল পেয়ারুল ইসলাম। তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়।
ট্রাফিক পুলিশের (পূর্ব) উপকমিশনার ইকবাল হোসেন বলেন, কার্যালয়ের নিচতলা ও দোতলায় অন্তত সাতটি কক্ষ আগুনে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
মতিঝিলের দিলকুশায় বেলা দেড়টার দিকে হেফাজতের সঙ্গে সংঘর্ষ হয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের। একপর্যায়ে তা আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

হেফাজতের মিছিল থেকে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের মাইক্রোবাসসহ বেশ কিছু গাড়ি ভাঙচুর করা হয়।
হতাহত: পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্র জানিয়েছে, সংঘর্ষে চারজন নিহত হয়েছেন। দুজন গুলিতে এবং দুজন মারধর ও গুরুতর জখমে মারা গেছেন। এ ছাড়া মতিঝিলে ককটেল বিস্ফোরণের পর স্ট্রোকে মারা যান আরেকজন। ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে দুই শতাধিক ব্যক্তিকে।

এঁদের মধ্যে এখনো ঢাকা মেডিকেলে ১৪ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ২৮ জন, পঙ্গু হাসপাতালে একজন চিকিৎসাধীন আছেন। পুলিশের আট সদস্য ভর্তি আছেন রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালে।
সিদ্দিকুর রহমান (৩২) নামের এক ব্যক্তিকে আহতাবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হলে বেলা তিনটার দিকে তিনি মারা যান। সন্ধ্যা সাতটার দিকে নাহিদ শিকদার (২৬) ও অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তিকে (৪০) ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাঁদের মৃত ঘোষণা করেন। একই হাসপাতালে রাত সোয়া ১২টায় আহত আরেক যুবক মারা যান।

তাঁর পরিচয় পাওয়া যায়নি।
সিদ্দিকুর হানিফ এন্টারপ্রাইজের একটি বাসের চালকের সহযোগী। তাঁর বাড়ি দিনাজপুরের বীরগঞ্জে।
নিহত নাহিদের গ্রামের বাড়ি বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে। বাবা দেলোয়ার শিকদার।

নাহিদ হেফাজতের সমাবেশে যোগ দিতে মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন। এ ছাড়া গুরুতর জখম অবস্থায় দৈনিক বাংলা মোড় এলাকা থেকে এক অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনার পর মৃত ঘোষণা করা হয়।
গুলিতে আহত আরও ছয়জনকে রাজারবাগে আল বারাকা হাসপাতালে নেওয়া পর মৃত ঘোষণা করা হয়। গত রাতে দুইটার পর টেলিফোনে যোগাযোগ করলে হাসপাতালের কর্মী জহিরুল হক সেখানে ছয়জন মারা যাওয়ার কথা প্রথম আলোর কাছে স্বীকার করেন। তবে তাঁদের নাম বলতে পারেননি তিনি।

বার্তা সংস্থা এএফপিও জানিয়েছে, গুলিবিদ্ধ ছয়জন এ হাসপাতালে মারা গেছেন।
সন্ধ্যা সাতটার দিকে মতিঝিলের মোহামেডান ক্লাবের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের শব্দে আতঙ্কিত হয়ে স্ট্রোকে মারা গেছেন কামাল উদ্দিন খান (৫২) নামের এক ব্যক্তি। তিনি দিলকুশায় একটি ইনস্যুরেন্স কোম্পানির ব্যবস্থাপক ছিলেন। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে ১৯ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.