আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জুতার প্রয়োগ অপপ্রয়োগ

বসে আছি পথ চেয়ে.... মিশরীয়রা হিলারি ক্লিনটনকে উদ্দেশ করে জুতা ছুঁড়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিষটি ভাবনা উদ্রেককারী। হিলারির প্রতি টমেটোও নাকি ছুঁড়ে মারা হয়েছে। এটা মানা যায়, কিন্তু তাই বলে জুতা? জুতার এই অপপ্রয়োগের কোনো মানে আছে? এ বিষয়ে একটু সাধারণ আলোচনা সেরে নেয়া যেতে পারে। মানুষের জীবনে জুতার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

পা ছাড়া মানুষ দেখা যায়, কিন্তু জুতা ছাড়া মানুষ বর্তমানে একেবারেই বিরল। কে, কবে, কোথায় প্রথম জুতা ব্যবহার করেছে তা নির্নয় করা দুরূহ ব্যাপার। তবে একথা ঠিক, মানুষের জুতা ব্যবহারের বয়স সভ্যতার বয়সের কাছাকাছি। বর্তমান যুগে কিছু কিছু ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতি-গোষ্ঠী (আদিবাসী) এবং অতিশয় দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ ছাড়া সবাই জুতা ব্যবহার করে। আধুনিক মানুষের জীবনে জুতা অনিবার্য হয়ে উঠেছে।

যে জাতি যতো উন্নত, সেজাতি ততো বেশি এবং আকর্ষণীয় জুতা ব্যবহার করে। সেদিক থেকে বিবেচনা করে দেখলে জুতা কোনো জাতির আয়-উন্নতি-সমৃদ্ধিরও পরিমাপক। ভারতবর্ষে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই সম্ভবত প্রথম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুতা ‘আবিস্কার’ করেন। ‘জুতা আবিস্কার’ নামক একটি কবিতায় এ বিষয়ে বিশদ বিবরন খুঁজে পাওযা যায়। তারও আগে অবশ্য ‘পাদুকা’ ব্যবহারে নজির রয়েছে।

তবে সেগুলো ঠিক জুতা নয়। রামায়নে বর্ণিত কাহিনী অনুযায়ী রামচন্দ্র যখন পিতার অঙ্গীকার রক্ষায় বনবাসে যান, তখন সদাশয় দাদাভক্ত অনুজ ভরতচন্দ্র রামের অনুপস্থিতিতে একজোরা পাদুকা বা খড়ম সিংহাসনে রেখে রাজ্য শাসন করেন। ভরতের কাছে ওই পাদুকাই ছিলো রামের প্রতীক। পাদুকা তথা জুতাকে মহিমান্বিত করার এমন দৃষ্টান্ত পৃথিবীর ইতিহাসে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এভাবে প্রাক-আধুনিক যুগে খড়ম বা পাদুকা (প্রাক-জুতা) রাজ্য শাসনে পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

তবে পরবর্তীকালে জুতা নিয়ে নানা কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটেছে। কথিত আছে পলাশির যুদ্ধে পরাজিত বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৈলা অত্যন্ত সাফল্যের সাঙ্গে পলায়ন করেছিলেন; কিন্তু পায়ের বিশেষ জুতার কারণেই তিনি শেষ পর্যন্ত ধরা পড়েন এবং নির্মমভাবে নিহত হন। আভিজাত্য ও মর্যাদার প্রতীক হিসেবে জুতা আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন টিকে ছিলো। জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে জমিদার পরিবারের বাইরের লোকদের জুতা পায়ে বেড়ানো নিষিদ্ধ ছিলো বহুকাল। আমাদের বাবা-দাদারা জুতাকে যক্ষের ধনের মতো আগলে রাখতেন।

তারা জুতা পায়ে দিতেন খুব কমই; হাতেই জুতা শোভা পেতো বেশি। উৎসবে-অনুষ্ঠানেই কেবল জুতা পায়ে দেয়া হতো। তাও আবার নির্দিষ্ট বাড়ি বা উৎসবস্থলের কাছাকাছি গিয়ে তা পায়ে চড়ানো হতো। তার আগে তা অত্যন্ত আদর ও যতেœর সঙ্গে হাতে বহন করার রীতি ছিলো। সমাজে ভোগ-বিলাসিতার চরম উৎকর্ষ বোঝাতেও জুতার সংখ্যা পরিমাপ করার রীতি সৃষ্টি হয়েছে।

মাত্র কয়েক বছর আগে ফিলিপাইনের স্বৈরশাসক মার্কোসের স্ত্রী ইমেলদার মার্কোসের হাজার হাজার জোড়া জুতা গোটা পৃথিবীতে খবরের শিরোনামে হয়েছিলো। ইমেলদার জুতার সংখ্যা দিয়েই তখন মার্কোসের অন্যায়-অপরাধ, ভোগদখলের মাত্রা চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে। মোট কথা, মানুষের জীবনে জুতার ভূমিকা অপরিসীম। বাঙালিরা ‘অস্ত্র’ হিসেবে জুতা ব্যবহার করছে বেশ কয়েক যুগ আগে থেকে। গ্রামের মোড়ল-মাতব্বরদের জুতা তো চিরকাল নিরীহ ও উদ্ধত লোকদের পিঠে দণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

পরিবারের ও অনেক রাগী অভিভাবক অশিষ্টদের শায়েস্তা করতে জুতা ব্যবহার করতেন। যুগে যুগে বেহায়া, বেয়াদব, এমনকি অপরাধিদের পর্যন্ত জুতিয়েই শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করা হতো। আধুনিক যুগে পুরুষের চাইতে মেয়েরাই জুতাকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। ‘অ্যাসিড নিক্ষেপ’ যুগের আগে অনাকাক্সিক্ষত ও বাহুল্য প্রণয়প্রত্যাশীকে তাড়াতে মেয়েদের জুতোই ছিলো প্রধান ভরসা। অবশ্য এর জন্য জুতাপেটার প্রয়োজন হতো না, দেখালেই কাজ হতো।

এক্ষেত্রে জুতা ছিলো ‘রেড সিগন্যাল’। কোনো মেয়ের পিছে কেউ যদি বেশি ঘুরঘুর করতো এবং বিষয়টিতে যদি ওই মেয়ের আপত্তি থাকতো, তাহলে একদিন সাহস করে জুতা দেখালেই ঝামেলা চুকে যেতো। প্রেমপ্রত্যাশী ওই জুতা দেখেই বুঝে যেতো ওদিকে আর এগুনো যাবে না। যা হয়েছে তা যথেষ্ট হয়েছে, এবার ফুলস্টপ। জুতা সে ক্ষেত্রে ট্রাফিকের রেড সিগন্যালের মতো কাজ করতো।

স্থান-কাল-পাত্রভেদে জুতার ভূমিকাও বিভিন্নরকম হয়ে থাকে। পশ্চিমা মেয়েরা কোনো পরিস্থিতেই নাকি জুতা খুলতে চায় না। অথচ আমাদের দেশের মেয়েরা জুতা খুলতে পারলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। স্বল্পদৈর্ঘ মেয়েদের কাছে জুতা নিজেদের উচ্চতা রাড়ানোর হাতিয়ার। আমাদের দেশে ‘ক্রমেই ছোট হয়ে আসা’ শহুরে মেয়েরা হাইহিল জুতা পরে দিব্যি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।

এখনো কেউ জুতা ছাড়া অর্থাৎ খালি পায়ে যদি হাঁটাহাঁটি করে, তাহলে আমরা তাকে ‘আতরাফ’ হিসেবে চিহ্নিত করি। তাকে আমরা মোটেই ভালো চোখে দেখি না। অথচ আমাদের দেশে কোনো ইবাদত বা উপাসনাই জুতা পড়ে করা যায় না। নামাজ, পুজা, মন্দির, মসজিদ সবখানে জুতা নিষিদ্ধ। কবর, শহীদ মিনার ও স্মৃতিসৌধেও জুতা নিষিদ্ধ।

তবে আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে জুতার সবচেয়ে ভারী সংস্করণ ‘বুট’ এর যথেষ্ট প্রভাব লক্ষ করা গেছে। এই ‘ভারী বুটের’ তলায় এদেশের গণতন্ত্র বহুবার বহু বছর পিষ্ট হয়েছে। যে কোনো ‘ভারী জুতা’ দেখলেই তাই বাঙালির সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। এমনকি জুতা চালাচালিকেও কেউ স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। জুতার অনেক মাহাত্ম থাকা সত্ত্বেও কী এক অজ্ঞাত কারণে জুতা দেখানো, জুতাপেটা ও জুতাচোরকে সমাজে খুব খারাপ চোখে দেখা হয়।

ক্ষমতাবানরা যুগ যুগ ধরে দুর্বলের বিরুদ্ধে জুতা ব্যবহার করেছে। এতে অবাক হওয়া কিছু নেই। কিন্তু দুর্বল যদি সবলের বিরুদ্ধে জুতা ব্যবহারের চেষ্টা করে, তাহলে সেটা সীমাহীন নৈরাজ্যেরই বহিঃপ্রকাশ। যা হোক, জুতা নিয়ে বাড়াবাড়ি না করাই ভলো। এতে কল্যাণের চাইতে অকল্যাণেরই আশঙ্কা থাকে।

আমরা চাই জুতা প্রত্যেকের পায়ে শোভা পাক। পায়ের জুতা হাতে উঠে আসুক, তা মোটেও কাম্য নয়। আর এমন কাজ করাও কারো উচিত নয় যাতে করে পায়ের জুতাটি হাতে উঠে আসে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৯ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।