আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুইসাইড

অনেক কিছুই বলতে চাই কিন্তু কিছুই বলতে পারছি না। আমার নাম জানার কোনো দরকার নেই। আমি অত্যন্ত নগন্য মানুষ। শুধু জেনে রাখুন আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজে পড়ি। নতুন বছর মানে ২০১২ শুরু হওয়ার কয়েকদিন পর আমি এক বন্ধুকে নিয়ে ক্যাম্পাস ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম।

ঘুরতে ঘুরতে আমি এমন একটা জিনিসের সন্ধান পাই যা আমাকে ভীষণ নাড়া দিয়েছিল এবং আজও দেয়। জিনিসটা কোথায় পেয়েছিলাম তা আর বললাম না। জিনিসটা কেনই বা ওখানে কেউ ফেলে রেখেছিল তাও বলতে পারব না। জিনিসটা ছিল এক হতাশাগ্রস্ত ছেলের ডায়রি। সারা ডায়রি জুড়ে ছেলেটার হতাশা আর আক্ষেপের করুন সুর বেজে উঠেছিল।

ছেলেটার হতাশাগুলোর সাথে আমারও বেশ কিছু হতাশার মিল খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু সেটা মূল বিষয় না। মূল বিষয় হল মানে আমি যেটা আপনাদের বলতে চাচ্ছি সেটা হল ডায়রিতে সর্বশেষ ছেলেটা কি লিখেছিল। ছেলেটা ডায়রিতে শেষ লেখাটা লিখেছিল নতুন বছর শুরু হওয়ার আগের রাতে মানে যে রাতকে আমরা থার্টি ফার্স্ট নাইট হিসেবে উদযাপন করি। ছেলেটা সেই রাতে ডায়রিতে যা লিখেছিল তা আমি হুবহু নিচে লিখে দিচ্ছি- ৩১ ডিসেম্বর, ২০১১।

রাত ১১ টা। আমার আর কিছুই ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। এতদিন ধরে লালন করা জীবন নিমেষেই পুরোপুরি অর্থহীন মনে হচ্ছে। এত কষ্ট হচ্ছে যে মনে হচ্ছে কোনো দানব আমাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে।

এখন যদি কোনো কাছের বন্ধু বা প্রেমিকা আমার পাশে থাকত তাহলে কি এমন অনুভূতি হত? হয়ত না। কাছের বন্ধু আর প্রেম এ দুটাই আমার জীবনে তাসের ঘরের মত এসেছে আর ভেঙ্গেছে। কেন যে আমি এসব ধরে রাখতে পারি না আমি নিজেও জানি না। আজ মনে হচ্ছে, সেটা যে কোন অশুভ ক্ষণ ছিল যখন আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলাম! প্রথমে তো চান্স পেয়ে বেশ খুশিই হয়েছিলাম। বাবা মাও খুশি হয়েছিলেন বেশ।

কিন্তু ক্লাস শুরু হওয়ার পর থেকে কি থেকে কি যে হয়ে গেল টেরই পেলাম না। শিক্ষকরা একেকজন দেড় দুই ঘন্টা ধরে ক্লাস নিতেন। আমার ক্লাসে মন বসত না। ক্লাস থেকে বেরিয়ে যেতাম আর বেশিরভাগ সময় ক্লাসে যেতামই না। হলে কম্পিউটার নিয়ে বসে থাকতাম আর এক দুইজন বন্ধুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম।

পড়াশোনা করতাম না মোটেও। ভাবতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া তো কঠিন কিছু না। পরীক্ষার আগে পড়লেই হবে। তখন জানতাম না সেটা কতবড় ভুল ধারনা ছিল। এভাবে দেখতে দেখতে ছয়মাসের মধ্যেই পরীক্ষা হয়ে গেল।

পরীক্ষা খুব খারাপ দিলাম। তিন বিষয়ে ফেল করলাম। আমাকে আবার প্রথম বর্ষেই থেকে যেতে হল। আমি ছোটবেলায় বেশ ভাল ছাত্র ছিলাম। ক্লাস টেন পর্যন্ত সবসময় ফার্স্ট সেকেন্ড হতাম।

তাই ইয়ার লসের ব্যাপারটা মেনে নিতে বেশ কষ্ট হল। বেশ হতাশ হয়ে পড়লাম। বন্ধুদের সাথেও তেমন যোগাযোগ রাখলাম না। বুকে চরম হতাশা নিয়ে নতুন ছাত্রদের সাথে প্রথম বর্ষে আবার ক্লাস শুরু করলাম। আমি যেন একটা জিন্দালাশের মত হয়ে গেলাম।

কারও সাথে কথা বলি না, কোনো দিকে তাকাই না, শুধু যেন কি এক ঘোরের মধ্যে একটার পর একটা ক্লাশ করে যাই। শিক্ষকদের লেকচারে আমি তখনও মনোযোগ দিতে পারতাম না। শিক্ষকরা প্রায় প্রতিদিনই আমাকে দাঁড় করিয়ে অপমান করত। খুব খারাপ লাগত, আমি সহজভাবে নিতে পারতাম না। ক্লাস শেষে আমি সোজা হলে গিয়ে শুয়ে পড়তাম।

জোর করে পরতে চেষ্টা করেও পড়তে পারতাম না। মনের ভিতর শুধু হতাশা আর বিক্ষিপ্ত চিন্তাই ঘুরে বেড়াত। প্রতিটা দিন আমার জন্য যেন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে লাগল। প্রতিটা দিনই চিৎকার করে কাদঁতে ইচ্ছা করত। কিন্তু কেন জানি কাদঁতে পারতাম না।

এভাবে আবার ছয়মাস পর পরীক্ষা এসে গেল। আমি নগন্য প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষা দিতে বসলাম। চোখ বন্ধ করে একের পর এক পরীক্ষা দিয়ে গেলাম। আর আজ সেই পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে। হা! হা! এবার আমি তিন বিষয়ে না, চার বিষয়ে ফেল করেছি।

এখন মনে হচ্ছে, কেন আমি পড়াশোনা করলাম না? কেন আমি সবকিছু হাসিমুখে মেনে নিতে পারলাম না? কেন আমি অন্যদের মত জীবনটাকে ভোগ করতে পারলাম না? অনেক ভেবে দেখলাম, কোনো কূলকিনারা পেলাম না। সবই এখন ভাগ্যের নির্মমতা মনে হচ্ছে। মানুষ কিছু না পারলে ভাগ্যেরই দোষ দেয়। তবে আমি দেখেছি, ভাগ্যকেও মানুষ কখনই এড়িয়ে যেতে পারে না। যাক, ফলাফলটা পাওয়ার পর বিভাগের চেয়ারম্যান আমাকে ডেকে নিয়ে বললেনঃ “তুমি তো শেষ।

পর পর দুই বার কেউ ফেল করে? তোমার মত নির্বোধ তো আমি একটাও দেখি নাই...” উনার আর কোনো কথা আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। মাথা নিচু করে বের হয়ে গেলাম উনার রুম থেকে। ফলাফল পাওয়ার পর মা ফোন করে বললেনঃ “তুমি এটা কি করলা? তোমাকে নিয়ে আমাদের কত আশা ছিল! তুমি সব শেষ করে দিচ্ছো। তুমি আর বাসায় এসো না। তোমার বাবা তোমাকে ঘরে ঢুকতে দিবে না।

” এরপর আমি অনেকক্ষন কাদঁলাম। তবু মনে হল কান্নার একশ ভাগের এক ভাগও বের হয় নাই। সারাটা দিন শুধু চোখের কোণে পানি জমে থাকল। এখনও জমে আছে। এখন আমার মনে হচ্ছে সেটা যে কোন অশুভ ক্ষণ ছিল যখন আমি জন্মেছিলাম! সবাই এখন নতুন বছরের উৎসবে মেতে আছে।

হলের চারদিক থেকে শুধু হই চই শোনা যাচ্ছে। বন্ধুরা আমাকে নানারকম সান্ত্বনা দিয়ে ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। আমি যাই নি। রাত বারোটার পর তাদের এই উৎসব আরও বাড়বে। সবাই ২০১২ আসার আনন্দে যেন পাগল হয়ে যাবে।

আমিও বারোটার পর একটা জরুরি কাজ করব। সেটা হল, হলের ছাদ থেকে লাফিয়ে নিজের জানটা দিয়ে দিব। শুধু শুধু এ জীবন টেনে নেয়ার কোনো মানেই খুঁজে পাচ্ছি না। অবশ্য মৃত্যুকে নিয়ে ভীষণ ভয় হচ্ছে। মৃত্যুর পর কোন ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে কে জানে।

মানুষ বলে মৃত্যুর পর নাকি সব যন্ত্রণা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু আসলেই কি তাই? এমন কি হতে পারে আমার আত্মা সবকিছু অনুভব করতে পারছে কিন্তু কিছুই করতে পারছে না? আর আত্মা অসীম যন্ত্রণা পেয়ে যাচ্ছে? তাহলে তো ব্যাপারটা অনেক ভয়ঙ্কর হবে। যদিও আমি ধর্মে বিশ্বাস করি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, আসলেই কি পরকাল বলে কিছু আছে? নাহ, আর ভাবতেই পারছি না। বারোটা বেজে গেছে। হলের নিচে ক্যাম্পফায়ার করে সবাই গান বাজনা আর হই চই করছে।

আমি এখন ছাদে চলে যাব। আশা করি ছাদ থেকে পড়ার পর পরই আমার মৃত্যু হবে, আশা করি মৃত্যুর পর আমি চিরশান্তি পাবো। আমি যাচ্ছি, বিদায়। ডায়রিটা এখানেই থাকুক। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ.............. [ ছেলেটার নাম ছিল শফিক।

এই লেখাটাই তার ডায়রির শেষ লেখা। শফিকের ডায়রিতে বিচিত্র কিছু লেখা আছে। সময় পেলে বা লেখার ইচ্ছা হলে আমি সেসব আপনাদের কাছে তুলে ধরব। যাই হোক, আমি শুনেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ নাকি অনেক উদার হয়, অনেক আনন্দের হয়। কিন্তু আমি জানতাম না যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় শিক্ষক আর উদার পরিবেশ শফিকের মত ছেলেকে আত্মহত্যা থেকে রোধ করতে পারে না।

] ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।