আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমেরিকা বনাম সিংগাপুরের শিক্ষা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বৈষম্য বাড়তে থাকলেও সব দেশ ও অঞ্চলে সমস্যাটি সমান তীব্র নয়। যেসব দেশে বৈষম্য সবচেয়ে বেশি, সেসব দেশের মধ্যে আরো দ্রুত বৈষম্য বাড়ছে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে; এটি স্বীকার করে নিয়েছে দেশটি। অন্যদিকে সিঙ্গাপুর গত ৩০ বছর ধরে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করছে, একইসঙ্গে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারভিত্তিতে যেই সাম্যভিত্তিক সমাজ রচনা করতে পেরেছে এই দেশটি- তা প্রমাণ করে যে, বৈষম্য শুধু সামাজিক ন্যায়বিচারের বিষয় নয় বরং এটি অর্থনীতির কাজের চরিত্রের ওপর নির্ভর করে। কম অর্থনৈতিক বৈষম্যের সমাজ ভালোভাবে এগোয়। এটা এমন নয় যে, যারা সমাজের তলানিতে আছে শুধু তাদের জন্য অথবা যারা চূড়ায় আছে তাদের জন্য এতে সুবিধে হয়, বরং সার্বিকভাবেই সবার জন্যই একটি মঙ্গলজনক সমাজ রচনা করে।

এশিয়ার অন্যতম অর্থনৈতিক‘টাইগার’ হওয়ার জন্য সিঙ্গাপুর অনেক কিছুই করেছে। এসব কিছুর মধ্যে অন্যতম হল, বৈষম্য কমানোর পদক্ষেপ। সরকার এটা নিশ্চিত করেছিল যে, তলানির লোকদের মজুরি যাতে ‘শোষণে’র স্তরে নেমে না যায়। সরকার আইন করেছিল যে, রাষ্ট্রের সব ব্যক্তিকেই ‘প্রভিডেন্ড ফান্ডে’ একটা নির্দিষ্ট অংশ সঞ্চয় করতে হবে। যেমন যুবক কর্মীদের বেতনের ৩৬% ‘প্রভিডেন্ড ফান্ডে’ সঞ্চয় করতে হত- যেই সঞ্চয়ের অর্থ পরে যথেষ্ট মাত্রায় স্বাস্থ্যসুরক্ষা, আবাসন এবং অবসর ভাতা দেয়ার কাজে ব্যয় হয়েছে।

আর এটা নিশ্চিত করেছে সার্বজনীন শিক্ষা, নিজেদের সর্বোতকৃষ্ট শিক্ষার্থীগুলোকে বিদেশে পাঠানো এবং তারা যাতে আবার দেশে ফিরে আসে- সেই অবস্থা দেশে তৈরি করা। সিঙ্গাপুরিয় এই আদলের চারটি প্রধান দিক আছে যেগুলোর থেকে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র শিক্ষা নিতে পারে। অবশ্য আমেরিকার সন্দেহবাদী বিশ্লেষকদের কাছে এগুলো বিষম মনে হতে পারে। প্রথমত; সব ব্যক্তিকে নিজ নিজ প্রয়োজনের মেটানোর দায়িত্ব বাধ্যতামূলকভাবে নিতে হয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, এই বাধ্যতামূলক সঞ্চয় দ্বারা ৯০% সিঙ্গাপুরিয় বাড়ির মালিক হতে পেরেছিল, যেখানে ২০০৭ সালের যুক্তরাষ্ট্রের ‘আবাসনের বুদবুদ’ মিলিয়ে যাবার সময় মাত্র ৬৫% আমেরিকার লোকের নিজেদের বাড়ি ছিল।

দ্বিতীয়ত; সিঙ্গাপুরিয় নেতারা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে তাদেরকে আপনা থেকেই বৈষম্য চিরস্থায়ী হওয়ার যেই পশ্চিমা উন্নয়ন চক্র তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সরকারের সার্বজনীন কর্মসূচিগুলো ছিল ‘প্রগতিশীল’, এই অর্থে প্রগতিশীল যে সবাই কিছু না কিছু অবদান রাখবে, তবে যারা বেশি আয় করবে তারা বেশি অবদান রাখবে অর্থাত তাদেরকে প্রভিডেন্ড ফান্ডে বেশি জমা দিতে হবে। তৃতীয়ত; কর পূর্ববর্তী আয়ের বন্টনে সরকার হস্তক্ষেপ করেছিল, যাতে করে তলানিতে পড়ে থাকা লোকজনের কাছে সম্পদের প্রবাহ যায়। অথচ যুক্তরাষ্ট্রে এটা করা হয় চূড়ার লোকেদের সুবিধা দেয়ার জন্য। সিঙ্গাপুরে এটা সম্ভব হয়েছে কর্মী এবং শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকদের মধ্যে দরকষাকষিতে সরকারি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে, অথচ উল্টোভাবে আমেরিকাতে সরকার এই হস্তক্ষেপ করে শিল্প মালিকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য।

চতুর্থত; সিঙ্গাপুর বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে ভবিষ্যত দিনগুলোর সফলতার প্রধানতম সূত্রই হল, সামাজিক অবকাঠামো তথা শিক্ষাক্ষেত্রে মোটা অংকের বিনিয়োগ। একইসঙ্গে খুব সম্প্রতি তারা বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং জাতীয় অগ্রগতি বলতে বোঝায়- সব নাগরিক তাদের মান অনুযায়ী সবচেয়ে ভালো শিক্ষাটা পাচ্ছে কিনা, তাকে। সিঙ্গাপুরের প্রথম রাষ্ট্রপতি লি কান ইউ এবং তার অনুসারীরা জিডিপিকেন্দ্রীক উন্নয়নকে ‘ফোকাস পয়েন্ট’ ধরেই (যদিও এটি খুব ভালো একটা পরিমাপ নয়, তারপরও তারা সেটাকে বিস্তৃত অর্থে নিতে পেরেছিলেন) এগিয়েছেন। ১৯৮০ এর দশক থেকে আমেরিকার চেয়ে ৫.৫ গুণ দ্রুত হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আসছে দেশটি। সিঙ্গাপুর এটা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল যে একটি অর্থনীতির বেশিরভাগ জনগণকে প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ না করিয়ে; বিশেষত আবাসন, স্বাস্থ্য এবং অবসর ভাতা বঞ্চিত করে জাতীয়ভাবে সফল হওয়া যায় না।

ব্যক্তিকে নিজেদের সামাজিক নিরাপত্তায় অংশগ্রহণ করিয়ে এটি নিজেকে একটি হস্তক্ষেপমূলক রাষ্ট্র হয়ে যেতে দেয়নি। কিন্তু ব্যক্তির বিভিন্ন সক্ষমতা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃতি দিয়ে তারা একটি অধিকতর সম্প্রীতিমূলক সমাজের সৃষ্টি করেছেন। সিঙ্গাপুরের সাফল্য অন্যান্য সূচকেও সহজেই ধরা পড়ে। সিঙ্গাপুরের প্রত্যাশিত গড় আয়ু হল ৮২ বছর, যেখানে আমেরিকায় এটা ৭৮ বছর। শিক্ষার্থীদের গণিত এবং বিজ্ঞানে কৃতিত্ব সব দিক থেকেই আমেরিকার থেকে এগিয়ে।

এরপরও অনেকেই তর্কে জড়াতে পারেন এই মর্মে যে, সিঙ্গাপুরে এটা সম্ভব ছিল কেননা ‘লি’ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নিবেদিত ছিলেন না। এটা সত্য যে সিঙ্গাপুর একটি উচ্চমাত্রায় কেন্দ্রীভূত দেশ, যেটি দশকের পর দশক লি’র ‘পিপলস একশন পার্টি’ কর্তৃক শাসিত হয়ে আসছে। সমালোচকেরা বলেন এটার চরিত্র অনেকটা ‘কর্তৃত্ববাদী’ ধরণের, নাগরিক স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা, কড়া শাস্তির ব্যবস্থা, বহুদলীয় প্রতিযোগিতার অভাব এবং এর বিচার বিভাগ পুরোপুরি স্বাধীন নয় ইত্যাদি। তবে এটাও সত্য যে সিঙ্গাপুর দুর্নীতির কমতি ও স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে পৃথিবীর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এবং সম্প্রতি এর গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের প্রক্রিয়া সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অন্যান্য অনেক দেশ আছে যারা গণতন্ত্র এবং সুশাসনের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেও আমেরিকার চেয়ে ভালোভাবেই সামাজিক সূচকে এগুচ্ছে।

‘নরডিক’ অঞ্চলের প্রত্যেকটি দেশেই সাম্যভিত্তিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠা এবং প্রবৃদ্ধি হাত ধরাধরি করে চলছে। অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি ‘বৈশ্বিক’, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ঘটনা হল এর ফলগুলো বিশেষত বৈষম্যের প্রশ্নে স্থানীয় শক্তিগুলো- যাকে বলতে পারেন ‘রাজনৈতিক শক্তি’ নির্ধারিত করে দেয় বৈশ্বিক অর্থনৈতিক গতিবিধি কোন পরিমন্ডলে প্রবাহিত হবে। এশিয়ার সিঙ্গাপুর এবং ইওরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়া আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, কিভাবে রাজনৈতিক শক্তির দায়বদ্ধতা থাকলে প্রবৃদ্ধি ও সাম্য দুইটাই একসাথে অর্জন করা যায়। জোসেফ স্টিগলিজ নোবেলবিজয়ী আমেরিকান অর্থনীতিবিদ স্টিগলিজের এই লেখাটি সম্প্রতি দি নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশ হয়।

অনুবাদ: আলাউদ্দীন মোহাম্মদ, ২১-৬-১৩ Click This Link ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।