আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কয়েকজন পাগল কিংবা মহাসাধক

এটা আমার জন্য অনেক সুখকর যে, আমি এখন ব্লগ ও ফেইসবুক থেকে নিজেকে আসক্তিমুক্ত রাখতে পারছি। পরিবার ও পেশাগত জীবনের কর্মব্যস্ততা অনেক আনন্দের। ... ব্লগে মনোযোগ দিতে পারছি না; লিখবার ধৈর্য্য নেই, পড়তে বিরক্ত লাগে। প্রথম পর্ব সেদিন জুম্মাবার ছিল। কুটিমিয়ার বাবা আগেই মসজিদে চলে গেছেন; মাঠে গিয়েছিল বলে সে একটু দেরিতে ঘর থেকে বের হলো।

ঘর থেকে বাইরে কদম ফেলতেই এক জটাধারী পাগল এসে হাঁক দিল, ‘একটা ট্যাকা দে, নইলে ধ্বংস হইয়া যাবি। ’ কুটিমিয়া ভয় পেয়ে গেলো। তার জমানো কয়েকটা টাকা ঘরে আছে। সেখান থেকে একটা টাকা নিয়ে এসে পাগলের হাতে দিতে উদ্যত হয়েছে, এমন সময় তার মা এসে ধমকে উঠলো, ‘ট্যাকা কি গাছে দরছে নি? কোতাকর কুন্‌ পাগলে আইয়া কী না কী কইলো আর অমনি ট্যাকা বাইর কইরা দিলি? ট্যাকা থু। ’ কুটিমিয়া বিব্রত হয়।

সে পাগলকে টাকাটা না দিয়ে লুঙ্গির কোঁচড়ে গুঁজে রাখে। তবে তার মন সারাক্ষণ খুঁতখুঁত করতে লাগলো। সে মসজিদে গেলো, কিন্তু স্থিরভাবে নামাজে মনোনিবেশ করতে পারলো না। তার মনে হলো, এই একটি টাকা দান না করার জন্যই হয়তো এই পাগলের অভিশাপে গোয়ালের হালের গরু দুটি মরে যেতে পারে, তার ছোটো বোনটি অন্ধ হয়ে যেতে পারে, তার মা-বাবা, ভাইবোন, এমনকি সে নিজেও হয়তোবা ভয়ংকর কোনো বিপদে পড়তে পারে। লোকটা তো পাগল না-ও হতে পারে, ভিক্ষুকরূপী ঈশ্বর, মন পরীক্ষা করে দেখার জন্য এক টাকা ভিক্ষা চেয়েছে।

এরূপ নানাবিধ ভাবনা ভাবতে ভাবতে সে যখন নামাজ পড়ে বাড়ি ফিরছিল, হঠাৎ দেখে সেই পাগলটি থালা হাতে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে। সে ছুটে কাছে গিয়ে তার থালায় একটি টাকা রাখে, যেটি সে এই পাগলকে দেবার জন্য ঘর থেকে বের করে এনেছিল। সেদিন রাতে তার ছোটো বোন নুতুর পাতলা পায়খানা ও বমি হয়, ভোর হবার আগের মুহূর্তে নুতু মারা যায়। দুপুরের দিকে কুটিমিয়ার বাবা বিছানায় পড়েন, তাঁর গুঁটিবসন্ত হয়, সন্ধ্যারাতের দিকে তার মাও টের পায় যে, তার শরীর ভরে গুঁটি উঠছে; পরের দিন সকালে গোয়ালের সবচেয়ে বড় বলদটা একেবারে অকারণে হাম্বা হাম্বা রবে চিৎকার করতে থাকলো, তারপর নেতিয়ে পড়ে মারা গেলো। প্রায় বিশদিন পর্যন্ত কুটিমিয়ার মা-বাবা বিছানায় পড়ে থাকলেন।

কুটিমিয়ার মনে আর কোনো সন্দেহই থাকলো না যে, সেই পাগলের অভিশাপেই তাদের পরিবারে এতো বড় তাণ্ডব বয়ে গেলো। ওর মা পাগলের খোঁজে হন্যে হয়ে উঠলো। কুটিমিয়া নিজেও সেই পাগলকে খুঁজলো, কিন্তু তাকে আর কোথাও পাওয়া গেলো না। তবে অন্য আরেকজন পাগলের সাক্ষাৎ পাওয়া গেলো। একদিন টিফিন পিরিয়ডে স্কুল ছুটি হয়েছিল।

কুটিমিয়া বাড়ি না ফিরে দু শ গজ দক্ষিণে মেঘুলা বাজারে গেলো চুল কাটাতে। সেলুনের পাশে উঠোনের মতো খোলা একটা জায়গা। সেখানে অনেক মানুষের ভিড়। কুটিমিয়া সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। দেখে, তার দ্রুতপঠনের কাবুলিওয়ালার মতো বিশাল-দেহ এক পাগল— কালো রঙের ঢিলেঢালা কাবুলি তার পরনে, মাথায় কালো হ্যাট, চারধারে ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলে, শ্মশ্রূমণ্ডিত মুখমণ্ডল, তার হাতে বাঁশির মতো এক লাঠি, লাঠি নেড়ে নেড়ে সে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে আর মাঝে মাঝেই চিৎকার দিয়ে ধুয়া তুলছে: ‘এই দুনিয়া ফানা হবে কিছুই রবে না রে, কিছুই রবে না...’ ভিড় ঠেলে কুটিমিয়া পাগলের একদম কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

পাগলের গলায় লম্বা পুঁতির মালা কিংবা তসবি ঝোলে। সবচেয়ে আশ্চর্য তার ডান হাতের আঙ্গুলভর্তি আংটি— তিনটি আংটি তার তিন আঙ্গুলে শক্তভাবে এঁটে আছে, মাংস ফুলে এতোই স্ফীত হয়েছে যে আংটির পেঁচানো ধার দেখা যায় না। সবচাইতে বীভৎস ও ভয়ংকর দৃশ্য যা দেখে কুটিমিয়ার গা কাঁটা দিয়ে উঠেছিল তা হলো, পাগলের বাম হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির গোড়ায় মাংস ছিদ্র করে একটি বড় সাদা আংটি গেঁথে রাখা হয়েছে, পাগল হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলে, আংটিটা সেই সঙ্গে ঝুলতে থাকে। কী অদ্ভুত হাস্যলীলায় সেই পাগল সবাইকে মাতিয়ে তুলেছে। এ কোন্ পাগল? কুটিমিয়ার মনে প্রশ্ন জেগেছিল— নতুন বেশে সেই পাগল নয় তো যে একদিন তার কাছে একটা টাকা ভিক্ষা চেয়েছিল, যার অভিশাপে তার ছোটো বোন নুতু মারা গিয়েছিল, গোয়ালের সবচাইতে বড় বলদটা মরে গিয়েছিল, তার মা ও বাবা গুঁটিবসন্তে আক্রান্ত হয়েছিলেন? কিন্তু এই পাগল কোনো টাকা ভিক্ষা চাইছে না।

এর কি টাকার দরকার নেই? পেটের খিদে নেই? সে অনর্গল অট্টহাসি হাসছে, গলা ছেড়ে ধুয়া তুলছে- ‘এই দুনিয়া ফানা হবে—’, আরো কতো মজার মজার কথা বলছে, মানুষ প্রাণভরে তা উপভোগ করছে। কুটিমিয়ার বুক আনচান করতে লাগলো। তার বুকপকেটে দুটি টাকা আছে, চুল কাটানোর টাকা। আজ যদি এই পাগল টাকা চায় সবার আগে সে-ই তার হাতে টাকা দুটি তুলে দিবে। বেলা পড়ে যায়, আশ্চর্য পাগলের মেলা তবু ভাঙ্গে না।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো কুটিমিয়া সেই তখন থেকেই অনড় দাঁড়িয়ে আছে। তার মনে একবার একটু ইচ্ছেও জাগলো— পাগল যখন আসর ছেড়ে বের হয়ে যাবে, সে তার কাছে গিয়ে বলবে, সে যেন তার সাথে তাদের বাড়িতে যায়, তার মা-বাবা এমন একজন পাগলের জন্য অস্থির হয়ে আছেন। অনেক পরে জটলা ভেদ করে পাগল বের হয়ে গেলো, তার পিছে পিছে ছুটলো কিশোরের দল, অনেক যুবক, এমনকি বয়স্করাও। কুটিমিয়াও পিছু নিল। কুটিমিয়া ভাবে, পাগলের একদম কাছাকাছি হবে সে, তার হাত ধরে গা ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে সে পাগলকে অনুনয় করে বলবে, তাদের বাড়িতে তাকে যেতেই হবে, যেতেই হবে— তার মা-বাবা একজন পাগল খুঁজছেন।

বাজারের ভিতরের গলি দিয়ে পাগল তার ধুয়া তুলতে তুলতে পশ্চিম দিকে ছুটছে। দেখতে দেখতে তার পেছনে প্রচুর মানুষ জড়ো হলো, কেউ জানে না তারা কেন কী উদ্দেশে এই পাগলের পিছে ছুটে চলেছে, মানুষ ছুটছে তো ছুটছেই। যেন এক হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা, সব মানুষ এক বংশীবাদকের পিছে ছুটে চলেছে। এখন মানুষের মুখেও সেই ধুয়া। পাগল সুর তুলে গেয়ে ওঠে- এই দুনিয়া ফানা হবে কিছুই রবে না, সঙ্গে সঙ্গে ছুটন্ত মানুষের মুখেও প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো— এই দুনিয়া ফানা হবে কিছুই রবে না।

কিশোর কুটিমিয়া জানে না এই ধুয়ার অর্থ কী। সবে সে ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র, এই আধ্যাত্মিক ধুয়ার গূঢ়ার্থ তার বোধগম্য নয়, তবু সে সবার সাথে সুর তুললো— এই দুনিয়া ফানা হবে কিছুই রবে না রে, কিছুই রবে না। যেন এক স্বপ্নাতুর ঘুমের ঘোরে আছে সে, সবাই যেদিকে ছুটছে সে-ও সেদিকে ছুটে চলেছে পাগলের পিছে পিছে। সে দৌড়ে পাগলের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করে, কিছুদূর অগ্রসর হয়, আবার মানুষের চাপাচাপিতে পেছনে পড়ে যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কুটিমিয়া পাগলের নাগালে চলে এলো।

তার বামপাশ ঘেঁষে সে হাঁটতে লাগলো, সুর করে সমবেত ধুয়া তুলতে লাগলো, সে বেমালুম ভুলে গেলো তার মনের সেই কথাটি, যে কথা বলার জন্য সে কতো উদগ্রীব ছিল— পাগলকে বলবে সে যেন তার সাথে তাদের বাড়ি যায়। মেঘুলা বাজার পার হয়ে খালপাড়ের সরু রাস্তা ধরে পশ্চিম দিকে নদীর পানে ছুটে চললো পাগল ও তার অনুসারীদের দল। কেউ জানে না কোথায় গিয়ে এই যাত্রা শেষ হবে। ছুটতে ছুটতে তারা পদ্মা নদীর তীরে চলে এলো। পাগলের দু পাশে জড়ো হয়ে দাঁড়ালো সবাই।

প্রমত্ত পদ্মার উত্তাল ঢেউ পাড়ে এসে আছড়ে পড়ছে, দড়াম দড়াম শব্দে ঝপাঝপ তীর ভেঙ্গে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে, নদীর ওপাড় যায় না দেখা, মাঝখানে শুধু ঢেউ আর ঢেউ। কুটিমিয়া ভাবে, পাগলের মনে কতোই না বিচিত্র শখ জেগেছে, তাই এই সর্বগ্রাসী পদ্মাকে দেখার জন্য এতোদূর ছুটে এসেছে। আরো সময় চলে যায়, পাগল একটানা তার ধুয়া গেয়ে যাচ্ছে, ফিরে যাবার কোনো মতিগতি নেই। কুটিমিয়া একবার ভাবে, তার হাত ধরে তাকে টান দিয়ে বলবে, চলো, তাড়াতাড়ি ফিরে যাই। কিন্তু তার সাহসে কুলায় না।

হঠাৎ পাগলের ধুয়া বন্ধ হয়ে যায়। সে স্থির হয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকায়— চোখ জোড়া ঈষৎ মুদিত করে। বিড়বিড় করে কী যেন বলতে থাকে, তারপর অকস্মাৎ ‘আল্লাহু আকবর’ বলে বিকট চিৎকারে চারদিক প্রকম্পিত করে এক লম্ফে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে আশ্চর্য পাগল। ঘটনার আকস্মিকতায় মুহূর্তকালের জন্য সবাই স্তম্ভিত হয়ে পড়ে, পরক্ষণেই ‘হায় হায়’ ধ্বনি ওঠে মানুষের, পাগলের মৃত্যু-আশংকায় সবার মুখ শুকিয়ে যায়— প্রবল ঘুর্ণিস্রোত আর ঢেউয়ের তোড়ে নিমিষেই পানির নিচে তলিয়ে যায় পাগল। পানির নিচে তলিয়ে গেছে পাগল— হতবাক মানুষের উদ্বিগ্ন চোখ ঢেউয়ের ভাঁজ ভেঙ্গে কাছ থেকে বহুদূর চলে যায়— যদিই বা পানির ভিতর থেকে ‘ভুউশ’ করে মাথা তুলে ভেসে ওঠে আশ্চর্য পাগলটি।

সময় পেরিয়ে যায়, সূর্য নামতে থাকে নিচে— একদল মানুষ গভীর উৎকণ্ঠায় অপলক তাকিয়ে থাকে, পাগলের ভাসমান মৃতদেহটি যদি ভেসে ওঠে— যদিই বা ভেসে ওঠে। পাগলের ভাসমান মৃতদেহটি ভেসে ওঠে না। ধীরে ধীরে মানুষ স্থান ছাড়তে শুরু করে— যেতে যেতে আফসোসে ফেটে পড়ে— হায়, অবলা পাগলটা চোখের সামনে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মারা গেলো! হঠাৎ কে একজন চিৎকার করে ওঠে, ‘ঐ যে, ঐ যে দেখা যায়...’ চকিতে সবাই ফিরে তাকায়। অবাক হয়ে দেখে— দূরে— বহুদূরে— পানির ওপর সটান চিৎ হয়ে ভেসে ঢেউয়ের সাথে দোল খাচ্ছে আশ্চর্য পাগল— তার সম্পূর্ণ শরীরখানি পানির ওপরে ভাসমান, পা আর হাতগুলো এলোমেলো ছড়ানো— মাঝে মাঝেই ডান হাতের লাঠিটি উঁচিয়ে আকাশের দিকে তুলে ধরে। তীরের মানুষ আশ্চর্য হয়ে ভাসমান পাগলের আজব কীর্তি দেখে।

ভাসতে ভাসতে পাগলের দেহখানি আরো দূরে চলে যায়। যতক্ষণ দেখা গেলো তীরের মানুষ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকলো। দূরে যেতে যেতে এক সময় অন্ধকারের ছাযায় সে অদৃশ্য হয়ে গেল— তখন পশ্চিমাকাশে লাল সূর্য পাটে বসেছে। বাড়ি ফিরে সে রাতে কুটিমিয়ার বহু রাত অব্দি ঘুম হলো না। সে কেবলই ভাবতে লাগলো, এ কি পাগল, নাকি অন্য কিছু? সে এরূপ আরেক পাগলের কথা শুনেছে, সেই পাগলের দেশ বহুদূরে নয়, তার দাদির বাপের বাড়ির গাঁয়ে সেই পাগলের বাড়ি ছিল, তাদের গ্রাম থেকে মাত্র সাতটি গ্রাম উত্তরে।

ছোটোবেলায় তার দাদি তাকে সেই পাগলের কথা বলতেন। সে আসলে পাগল ছিল না, ছিল ফকির। লোকে বলতো পাষাণ ফকির। এক রাতে পাষাণ ফকির ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। তার স্ত্রী কাঁদলো, মা কাঁদলো, কিন্তু তাকে ফেরানো গেলো না।

সে গৃহত্যাগী হয়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়াবে পরমের সান্নিধ্য লাভের জন্য। পাষাণ ফকির সবাইকে উপেক্ষা করে ছুটে চললো, পিছে পিছে তার ক্রন্দনরতা স্ত্রী ও জননী। পদ্মার পাড়ে এসে সে পানির ওপর কদম ফেললো। তার মা ও স্ত্রী অবাক হয়ে লক্ষ করলো, ডাঙ্গায় হেঁটে চলার মতো পাষাণ ফকির পানির ওপর দিয়ে অতি স্বাভাবিক পদক্ষেপে ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। বধূ ও জননী করুণ কান্নায় বুক ভাসালো, কিন্তু পাষাণ ফকির পিছুটানের কোনো ভ্রূক্ষেপই করলো না।

সেই যে সে ঘর ছাড়লো, ইহজনমে আর ফিরলো না। তারপর কেউ তার আর কোনো খবরও জানতে পারে নি। দ্বিতীয় পর্ব কার্তিকপুর-নুরুল্লাপুর গ্রামগুলো পীরফকিরদের আখড়া। নুরুল্লাপুরের শানাল ফকির, কার্তিকপুরের মাদাইর ফকির, শ্যামফকির এবং শারফিন ফকিরের ভক্তদের সংখ্যা গুনে শেষ করা যায় না। এঁরা পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে বংশ-পরম্পরায় ফকিরি লাভ করেছেন।

ফকিরি প্রাপ্তি অসামান্য সাধনার ব্যাপার। মুরিদ রূপে বছরের পর বছর বাবা-ফকিরের পদসেবা করতে হয়। মৃত্যুর সময় বাবা যাঁকে ফকিরি দান করে যান তিনিই পরলোকগত ফকিরের স্বত্বাপ্রাপ্ত উত্তরসূরি। ফকিরি প্রাপ্তিতে অনেক সময় অনেক মুরিদ ভাগ্যদোষে বঞ্চিত হয়ে থাকেন। জনশ্রুতি আছে, ডাইয়ারকুম গ্রামের জাবেদ হাওলাদার জনৈক করিম শাহ্‌ ফকিরের মুরিদ হয়েছিলেন।

কৈশোর-শৈশব থেকেই তিনি ফকিরি প্রাপ্তির বাসনায় বাবা করিম শাহ্‌’র চরণতলে ভক্তিরত ছিলেন। বাবার শুভ দৃষ্টিও তাঁর ওপরই ছিল এবং মানুষের ধারণা অমূলক ছিল না যে জাবেদ হাওলাদারই বাবার ফকিরি লাভে ধন্য হবেন। বাবা করিম শাহ্‌ যেদিন শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবেন, জান কবজ হবার আগের মুহূর্তে তিনি আঁখি মুদিত করে জড়ানো স্বরে টেনে টেনে ডাকলেন, ‘জাবেদ কইরে?’ জাবেদ হাওলাদার তখন বাবার পথ্য তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। পাশে বসে পাখায় বাতাস করছিলেন জাবেদ হাওলাদারের জ্যেষ্ঠ সহোদর আবেদ হাওলাদার। ফকিরি তাঁরও আরাধ্য ছিল আকৈশোর, কিন্তু তিনি কখনো উপযুক্ত রূপে বাবার সেবায় আত্মনিয়োগ করতে পারেন নি, অধৈর্য্য হয়ে পড়তেন।

আবেদ হাওলাদারের মাথায় কূটবুদ্ধি খেলে যায়; তিনি মাথা নিচু করে বাবার কাছে এগিয়ে এসে অস্থির কণ্ঠে বলেন, ‘বাবা, আমি তো আপনার পায়ের তলায়ই আছি। ’ বাবা শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে ডান হাত উঁচিয়ে আবেদ হাওলাদারকে স্পর্শ করেন, তারপর ঈষৎ কাত হয়ে তাঁকে লক্ষ করে মৃদু ফুঁ ছুঁড়ে দিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এরপর আবেদ হাওলাদার ফকির হলেন বটে কিন্তু তাঁর কনিষ্ঠ জাবেদ হাওলাদার জ্ঞানহারা পাগল হয়ে গেলেন। তিনি দু হাতে নিজের বুক ফাটান আর চিৎকার করে করিম শাহকে অশ্লীল ভাষায় গালি ঝাড়তে থাকেন, বাবা করিম শাহ্‌ তাঁর সাথে বেইমানি করেছেন, তাঁকে ঠকিয়ে তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাকে ফকিরি দান করে গেছেন। কতো দূর-দূরান্ত থেকে যে ভক্তরা ছুটে আসেন তার ইয়ত্তা নেই।

কোনো কোনো ফকিরের বিশেষ শ্রেণীর ভক্ত রয়েছে, যেমন রয়েছে মাদাইর ফকিরেরও। এদের মুরিদ হওয়ারও একটা আশ্চর্য জনশ্রুতি আছে। মাদাইর ফকির একবার তাঁর এক শিষ্যের নিমন্ত্রণে ঢাকা গিয়েছিলেন। লঞ্চ থেকে সদরঘাটে নেমে চিকন অলিগলি খুঁজে খুঁজে তিনি শিষ্যের বাড়ি যাচ্ছিলেন; হঠাৎ একদল মেয়ের কলকল হাসিতে ফিরে তাকান, তখনো তিনি বুঝতে পারেন নি এই ললনারা তাঁকেই উদ্দেশ্য করে রঙ্গহাস্যে গলে পড়ছিল। তাদের বিশ্রী আর অশালীন দেহভঙ্গি উপেক্ষা করে তিনি আপন মনে সামনে এগোতে থাকেন— অমন সময় এক মেয়ে দৌড়ে এসে তাঁর হাত টেনে ধরে।

বলে, ‘আমার ঘরে আসো গো নাগর। ’ হাত ছুটিয়ে নেবার আগেই লক্ষ করে দেখেন আরো অসংখ্য মেয়ে তাঁকে ঘিরে ফেলেছে, তাদের ইঙ্গিতপূর্ণ কুৎসিত হাসিতে মুখরিত চারদিক। তাঁর বুঝতে আর বিলম্ব হয় না যে তিনি বেজায় ভুল জায়গায় চলে এসেছেন। ‘তোরা কী চাস?’ মাদাইর ফকির এ কথা জিজ্ঞাসা করার সঙ্গে সঙ্গে বেশ্যাগণ আবারো কলকল হাসিতে ফেটে পড়ে। অশ্লীল ইঙ্গিতে বলে, ‘তোমারে চাইগো...ঘরে চলো, ঘরে চলো...।

’ অতঃপর কেউ তাঁর হাত ধরে টানে, কেউ টানে ধূতি, কেউ তাঁর চুলের বেণি ধরে টানে, কেউবা শ্মশ্রূ ধরে টানে। মাদাইর ফকির অস্থির হয়ে বলেন, ‘আমারে ছাইড়া দে তোরা, জ্বালাইস না, ছাইড়া দে। ’ বেশ্যাদের কেউ বলে, ‘আসো না নাগর, রস খাইয়া যাও। ’ ফকির বলেন, ‘তোরা কি চিনলি না আমারে? আমি তো তোদেরই জাত। ’ ‘আমাদের জাত?’ ওরা খিলখিল করে হেসে ওঠে, ‘আমাদের জাত হইলে তোমার দাঁড়ি আর গোঁফ গজাইলো ক্যান গো রসের নাগর?’ এমন সময় একজন সামনে এসে হঠাৎ ধূতির কোনা ধরে এক টানে তাঁকে উলঙ্গ করে ফেলে, তখনই সবাই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।

মাদাইর ফকিরের নিম্নদেশে কোনো পুরুষাঙ্গ নেই, সেখানে একটা পুষ্পের মতো ফুটে আছে শাশ্বত নারীর একখানি যোনি। ‘বাবা’ বলে বেশ্যারা তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ে। বাবা তাদেরকে ক্ষমা করেন। পৌষ মাসে যে চাঁদ ওঠে, সেই চাঁদের পূর্ণিমারাতে ফকির বাড়িতে ধামাইল বসে। দূর-দূরান্তের ভক্তরা পায়ে হেঁটে ধামাইলে এসে শরিক হয়।

মাদাইর ফকিরের বাড়িতে যতো ভক্ত আসে, তাদের এক চতুর্থাংশ হলো দেহপসারিণী। কীভাবে মাদাইর ফকিরের অলৌকিক ক্ষমতার কথা সারাদেশে এ নিষিদ্ধ নারীদের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল তা এক বিস্ময় বটে। পৌষ-চাঁদের ধামাইলও একটা দারুণ বিস্ময়। ফকির-বাবাদের অলৌকিক শক্তি-গুরু— অদৃশ্যে থেকে যিনি তাঁদের যাবতীয় ফকিরি সঞ্চালিত করেন, ভরা পূর্ণিমার টলমল লগ্নে তিনি বাবার সামনে আবির্ভূত হোন, সেটাই ধামাইলের লগ্ন। সন্ধ্যায় তেঁতুল গাছের কাঁচা ডাল ভেঙ্গে লাকড়ি করা হয়।

বা’র-বাড়ির প্রশস্ত উঠোনের মাঝখানে সেই লাকড়ি সাজানো হয়, তারপর পূর্ণিমা-লগ্নের জন্য অপেক্ষা। ফকির বাবা তাঁর বাবার মাজারের একধারে দরগা করেন; ভক্ত-মুরিদ পরিবেষ্টিত হয়ে আসনে জোড়াসিন দিয়ে বসেন, মাজারের চারপাশ জুড়ে ধূপদানি ও মোমবাতি জ্বলে, কুণ্ডলি পাকানো ধূপের ধোঁয়া ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে, গন্ধে ভারী হয়ে ওঠে বাবার আসন এবং সারা ঘর। বাবার সামনে পায়ের কাছে বড় কাষার থালায় সোনারুপার মোহর-অলঙ্কার, টাকাপয়সা; একটু দূরে চালডাল ভর্তি বৃহৎ কয়েকটা ঝাঁকা; দূরাগত ভক্তবৃন্দ সাধ্যমতো থালায় টাকাপয়সা বা গয়নাগাটি ফেলছে, গামছায় বাঁধা চালডাল ফেলছে ঝাঁকার ভিতর। দরগার বাইরে ভক্তদের মানত করা হাঁস-মুরগিতে বোঝাই কয়েকটা খুপরি, বাইরে খুঁটিতে বাঁধা ছাগল-ভেড়া, বা ষাঁড়। ভক্তগণ এসে সর্বাগ্রে বাবার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, তারপর মোলায়েমভাবে উপুড় হয়ে বাবার পায়ের কাছে মাথা রাখে, মাথা উঠিয়ে দু হাতে বাবার পদধুলি নিয়ে মুখমণ্ডলে মাখে।

তুষ্টমুখ বাবার ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে ওঠে। বাবার আসন ঘিরে চারপাশে ভক্তবৃন্দ সমবেত কণ্ঠে অনর্গল জিকির তুলতে থাকে। রাত্রি গভীর হয়, আর ধীরে ধীরে ধামাইলের লগ্ন ঘনিয়ে আসে, অর্ধ-নিমীলিত-আঁখি ফকির-বাবা উর্ধ্বপানে চেয়ে জোড়াসিনে স্থির ও গভীর ধ্যানে মগ্ন— জিকিরের তালে তালে ধূপগন্ধময় বাবার আসনটি যেন দুলতে থাকে। ধামাইল উপলক্ষে সাতদিন আগে থেকে বাঁশ নাচানো শুরু হয়। বাঁশ নাচানোর জন্য একই মাপের সাতটি লম্বা বাঁশ লাগে।

সাত বাঁশের মাথায় সাত রঙের পাটের জুটি বাঁধা হয়, তারপর বাঁশগুলোকে জুটির রঙের কাপড় দিয়ে আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত মুড়িয়ে দেয়া হয়। যারা বাঁশ নাচায় তাদেরকে বলা হয় বাঁইশা। ফকির-বাবার জন্য নিবেদিত-প্রাণ না হলে কেউ বাঁইশা হতে পারে না। সাতটি বাঁশের জন্য সাত জন বা তার বেশি সংখ্যক বাঁইশা লাগে। ক্লান্ত বাঁইশাকে বদল করার জন্য অতিরিক্ত বাঁইশার প্রয়োজন।

বাঁইশাদলের সাথে থাকে একদল ঢোলক ও বাদক। বাদ্যের তালে তালে বাঁশ নাচানো হয়। বাঁশ নাচানোর সময় বাঁইশাগণ খাড়া করে বাঁশ ধরে বাদকদল সমেত উঠোনের একটা নির্দিষ্ট গোলাকার স্থানে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে। প্রথমে দৌড়ে ঘুরতে শুরু করে, তারপর বাদ্যের তালে একসঙ্গে সবার পা থামে, এরপর ধীর তালে একবার ডান পা উঠিয়ে ভিতরের দিকে ফেলে, পরক্ষণেই উঠিয়ে বাইরে নেয়, এভাবেই আস্তে আস্তে সামনে এগোয়— ধীর তালে বাঁশ নাচানো শুরু করে বাঁইশাগণ ক্রমশ দ্রুত কদম ফেলতে শুরু করে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। এভাবেই বাঁইশারা বাঁশ নাচায়।

বাঁশ নাচানোর সময় প্রত্যেক বাঁইশা তাদের ঘুর্ণনের ক্রম বজায় রাখে, সেই ক্রমের ব্যত্যয় ঘটানো হয় না। এক নাগাড়ে আট-দশ মিনিট পর্যন্ত বাঁশ নাচানো চলে। তারপর উঠোনের মাঝখানে একটা বেতের ঝাঁপি রেখে তার ভিতরে বাঁশের গোড়া ফেলে ঘরের চালের সাথে কাত করে বাঁশ রাখা হয়। বাঁশ নামানো এবং উঠানোর সময় একই ক্রম বজায় রাখা হয়। সর্বাপেক্ষা গুণী ও একনিষ্ঠ বাঁইশাকে দেয়া হয় প্রথম বাঁশটি।

বেতের ঝাঁপিতে বাঁশ নামিয়ে রাখার পর জনৈক মুরিদ অন্দর বাড়ি থেকে সাজিভর্তি চালডাল এনে ফেলে সেই ঝাঁপির ভিতরে। ঝাঁপি টানার জন্যও একজন নিবেদিত ভক্ত থাকে। ধামাইলের সাত দিন আগেই বাঁইশাগণ দূর-দূরান্তের মুরিদগণের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ে। বহু পথ পাড়ি দিয়ে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে বাড়ি বাড়ি ঘুরে তারা বাঁশ নাচায়। বাঁশ নাচানো শেষে বেতের ঝাঁপিতে ভক্তগণ চালডাল।

সংগৃহীত বিপুল পরিমাণ চালডাল বহন করার জন্যও দলের সাথে সাগরেদ থাকে। বাঁশ নাচানো শেষে বাঁইশাগণ ক্লান্ত হয়ে পড়লে তারা কোনো এক সাগরেদের বাড়িতে রাত্রিযাপন করে—উঠোনে গোল সারিতে বসে কলাপাতায় পাতলা খিচুরি খায়, তারপর গভীর রাত পর্যন্ত মারফতি আর মুর্শিদি গান গায়। সকালে উঠে অন্য গাঁয়ের সাগরেদগণের উদ্দেশে পুনরায় বেরিয়ে পড়ে। দূরের মুরিদগণের বাড়িতে বাঁশ নাচানো শেষ করে ধামাইলের দু একদিন আগে বাঁইশাগণ ফকির বাড়িতে ফিরে আসে। ধামাইলের দিন সকালে বাড়ি হতে বেরিয়ে কাছের গাঁয়ের ভক্তদের বাড়িতে বাঁশ নাচাতে যায়।

ভক্তদের বাড়িতে বাঁশ নাচানো শেষে সৌজন্য স্বরূপ সতীর্থ ফকিরগণের বাড়িতেও বাঁশ নাচানো হয়। এভাবে বাড়ি বাড়ি বাঁশ নাচানোর মধ্য দিয়ে ধামাইলের লগ্ন ঘনিয়ে আসতে থাকে। সেই সাথে বাবা-ফকিরের বাঁশের নাচ দেখার জন্য ভক্তগণ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। লগ্নের ঘণ্টা দুয়েক আগে ফকিরের বাঁশ নিজ বাড়িতে ফিরে আসে। ততক্ষণে দরগায় বাবার আসন ঘিরে ভক্তগণের একটানা জিকিরে চারদিক আন্দোলিত হয়ে ওঠে।

বাঁশ নিজ বাড়িতে ফেরত আসার পর অন্য ফকিরের বাঁশ আসার নিয়ম নেই। অন্য ফকিরের বাঁশ খুব অল্প সময়ের জন্য নাচানো হয়। কিন্তু বাড়ির বাঁশ নাচানো হয় দীর্ঘ সময় ধরে— দুই ধাপে, ফেরত আসার পর থেকেই ভিতর বাড়ির উঠোনে প্রায় ঘণ্টাখানেক, মাঝখানে আধঘণ্টাার মতো বিশ্রাম, তারপর বার বাড়ির উঠোনে তেঁতুল গাছের কাঁচা লাকড়ি দিয়ে সাজানো ধামাইল-স্থানের চারধারে, পূর্ণিমার লগ্নে ধামাইল শেষ না হওয়া পর্যন্ত তা চলতে থাকে। বাঁশ বাড়িতে ফেরত আসার সঙ্গে সঙ্গে ভক্তদের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। তারা ছুটে এসে উঠোনের মাঝখানে ভিড় করে গোল হয়ে দাঁড়ায়।

বাঁইশাদের হাতে বাঁশ নাচে, দরগার ভিতরে একটানা জিকির ধ্বনিত হয়, পুরো আকাশ বাতাস যেন সেই সময় টলমল করতে থাকে পূর্ণিমালগ্ন রাত্রির শেষ প্রহরে সংঘটিত হলে ধামাইলপর্ব গভীরতর হয়। ক্লান্ত বাঁইশাগণ প্রথম পর্ব বাঁশ নাচানো শেষে বিশ্রামভোগ করতে থাকে, তখন একদিকে বা’র বাড়ির উঠোনে ধামাইলের জন্য তেঁতুল গাছের কাঁচা লাকড়ি সাজানো হতে থাকে, অন্যদিকে ভাবগম্ভীর ভক্তিগীতিতে দরগার ভিতরে সমগ্র পরিবেশ ভারী হয়ে উঠতে থাকে। ক্রমে বাবার শরীরে মৃদু কম্পন শুরু হয়, কিছুক্ষণ পরপর সেই শরীর আপনা থেকেই প্রবলভাবে ঝাঁকি দিয়ে ওঠে, ঝাঁকির সঙ্গে সঙ্গে ‘জয় বাবা’ বলে বিকট শব্দে ফকির-বাবা চিৎকার দিয়ে ওঠেন, সেই চিৎকারের ধ্বনি সমবেত জিকিরের ধ্বনিকে ছাপিয়ে অনেক উচ্চে ওঠে চারপাশ কাঁপিয়ে তোলে। ফকির বাবা তখন আর তাঁর নিজের মধ্যে নেই, ততক্ষণে তাঁর অলৌকিক গুরু তাঁর ওপর এসে ভর করেছেন। সেই গুরু যতক্ষণ তাঁর ওপরে ভর করে থাকবেন ততক্ষণ কী কী তিনি বলবেন, বা কী কী ঘটতে থাকবে তার কিছুই ফকির-বাবার স্মরণে থাকবে না, কেবল ভক্তবৃন্দই সেগুলো মনে রাখবে ও মেনে চলবে।

ফকির-বাবার ওপরে গুরুর ভর করার অবস্থাটাকে ‘ভার’ বলা হয়। ভার অনেক কঠিন অবস্থা। ভারের চাপ সহ্য করতে অনেক শক্তি ও ধৈর্য্যের প্রয়োজন। ফকির বাবা ইচ্ছে করলে অন্য কোনো ভক্তের ওপর ভার চাপাতে পারেন; ছোটোখাটো ভারের আসরে মাঝে মাঝে এরূপ করা হলেও ধামাইলের লগ্নে কখনোই ভার ফেরানো হয় না, কারণ ধামাইলের ভারই হলো ফকির বাবার প্রকৃত পরীক্ষা। ভারের সময় ফকির বাবা ভক্তদের সাথে সওয়াল-জবাব করেন।

আসলে এই সওয়াল-জবাব ফকির বাবার মুখ দিয়ে বেরুলেও এগুলো কিন্তু তাঁর কথা নয়, তাঁর ভিতরস্থিত শক্তি-গুরুই তাঁর মাধ্যমে এসব করে থাকেন। সওয়াল-জবাবের সময় ভক্তগণ গুরুর সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পায়। ভক্তরা বালামুসিবত হতে মুক্তি পাবার জন্য গুরুর কাছে পানা প্রার্থনা করে। গুরু তাদেরকে আশ্বস্ত করেন; অনেক সময় এর বিনিময়ে বড় একটা বর চেয়ে বসেন, অসমর্থ ও হতদরিদ্র ভক্তরা তখন বাবার পায়ের ওপর আছাড় খেয়ে পড়ে বাবার এহেন বড় দাবি থেকে মাফ পাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করতে থাকে; যতক্ষণ না বাবা একটা ষাঁড়ের বদলে একটা মোরগ নিতে রাজি হন ততক্ষণ পর্যন্ত সেই ভক্ত বাবার পা জড়িয়ে পড়ে থাকে। তবে কোনো কোনো সময় বাবা তাঁর দাবিতে একেবারে অটল থাকেন; ভক্তের সম্ভাব্য বিপদটা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, এ থেকেই তা আঁচ করা যায়।

অনেক সময় বাবা কোনো কোনো ভক্তের ওপর প্রচণ্ড ক্ষেপে যান। বাবার সাথে সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে দীর্ঘদিন ধামাইলে অনুপস্থিত থাকলে, কিংবা বর্তমান বাবার অগোচরে কেউ যদি অন্য বাবার শরণাপন্ন হয়, যা এ-বাবার ওপর অনাস্থার শামিল, পুনর্বার সামনে আবির্ভূত হওয়ামাত্র বাবা তাকে কঠিন অভিশাপ বর্ষণ করেন। সেই অভিসম্পাতে কেউ কেউ ধ্বংস হয়ে যায়, বাবা দয়া না করলে সেই ধাক্কা আর কেউ কাটিয়ে উঠতে পারে না। পূর্ণিমার লগ্ন সমাসন্ন, বাবার ভার ও ভক্তদের সাথে সওয়াল-জবাব চলমান— জিকিরের ধ্বনি, বাদ্যের বাজনা ও বাঁশির সুরের ঐকতান মূর্ছনা— হঠাৎ একসময় জোড়াসিন ভেঙ্গে সচিৎকারে বাবা উঠে দাঁড়ান, তারপর ভক্তদেরকে ডিঙ্গিয়ে দ্রুত ছুটে চলেন বা’র বাড়ির উঠোনে ধামাইল-স্থানের দিকে— স্বল্প বিশ্রাম শেষে বাদকদল ও বাঁইশাগণ আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল, বাবাকে ছুটতে দেখামাত্র তারা বাঁশ লয়ে বাবার পেছনে ধাবিত হয়ে ধামাইলের জন্য নির্ধারিত স্থানে গিয়ে হাজির হয়। শিষ্যসাগরেদ সমভিব্যাহারে সাজানো তেঁতুল লাকড়ির চারপাশে বাবা হাঁটু গেড়ে বসেন।

জোড়াবদ্ধ দুই হাত বার বার কপালে ঠেকান আর সমস্বরে ঘন ঘন গুরু-ধ্বনি করে ওঠেন। বাঁইশাগণ এখন নাচে না, বাঁশ হাতে দ্রুত ছুটে চলেছে তারা, যত দ্রুত দৌড়ে চলা সম্ভব। ঢোল ও বাঁশির ঐকবাদনে পূর্ণিমার চাঁদ তখন আকাশে টলমল করে। এরই মাঝে সাগরেদগণ মোমের আগুনে কাঁচা লাকড়ি জ্বালিয়ে দেয়। লাকড়ির ধোঁয়ায় তাদের চোখ নাক মুখ গলে জল ঝরতে থাকে।

তবু তারা থেমে থাকে না। ঠিক লগ্নের সময়টাতে অকস্মাৎ লাকড়ির স্তূপে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে, সেই আগুনের শিখা মানুষের মাথা ছাড়িয়ে বাঁশের মাথায় জুটি পর্যন্ত পৌঁছে যায়। বাদ্যের তাল ও বাঁশির সুরও তখন দ্রুততর লয়ে বাজতে থাকে। বাঁইশাদের গতি তখন পৌঁছে যায় শীর্ষে। লাকড়ি জ্বলতে জ্বলতে আগুনের শিখা নিচে নেমে আসে, যখন একেবারে নিভে যায়, দু হাতে এক খাবলা জ্বলন্ত কয়লা নিয়ে বাবা ছুটে যান কোনো এক পুকুরের পানে।

এক ঝাঁপে পানিতে নেমে দীর্ঘ এক ডুব দেন, তারপর শূন্য হাতে উঠে এসে অন্দর বাড়িতে উধাও হয়ে যান। তাঁর সাথে তখন অন্য কারো সঙ্গী হবার নিয়ম নেই। ভক্তরা ধামাইল শেষে পোড়া লাকড়ির কয়লা কিংবা ছাইয়ের জন্য এক কঠিন যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। মুহূর্তে ধূলাবালি আর মাটিসুদ্ধ সেই কয়লা নিঃশেষ হয়ে যায়। এই কয়লার অনেক ফজিলত।

যারা এই কয়লা লাভে ব্যর্থ হয় তাদের পরবর্তী ধামাইলের জন্য পুরো একটা বছর অপেক্ষা করতে হয়। ধামাইললগ্ন পরবর্তী চাঞ্চল্যের মধ্যেই একসময় ভোর হয়, তারপরই মানুষজন উঠোনের একপাশে জড়ো করে রাখা কলাপাতার জন্য ছোটে, অল্পক্ষণের মধ্যেই সিন্নি পরিবেশিত হবে। এই সিন্নি কখনো চালডালের খিচুরি, কখনো বা ভাত ও পাতলা ডাল। পুরো রাতের ধকল শেষে সিন্নি খেয়ে ভক্তগণ ক্ষুধা নিবারণ করে। এভাবে বাড়ি ফেরার সময় হয়ে যায়।

ফকির বাবা অন্দর মহল থেকে ফিরে এসে ভক্তদেরকে বিদায় জানানোর জন্য আসন গ্রহণ করেন। তাঁর জোড়াসিন নেই, চেহারায় সৌম্যভাব, তবু ধামাইলের ধকলে বিধ্বস্ত মনে হয়। ভক্তরা একে একে সভক্তি বিদায় গ্রহণ করে, তিনি মৃদু হেসে নিরুত্তর বিদায় জানান। সারা বছরে ধামাইল ছিল কুটিমিয়ার জন্য সবচাইতে বড় ও উপভোগ্য উৎসব। ছোটোবেলায় মা-বাবা, চাচা-চাচিদের সঙ্গে সে ধামাইলে যেত।

তাঁরা যে-ফকিরের মুরিদ ছিলেন তাঁর নাম শারফিন ফকির। শারফিন ফকির কার্তিকপুরের সবচাইতে বড় ফকির। তাঁর বাড়িতে বিশাল কয়েকটা টিনের ঘর ছিল, তাঁদের উঠোন দুটির মতো এত বড় উঠোন অন্য কোনো ফকিরের ছিল না। শারফিন ফকিরের ভারের আসনটা দরগার ঘরে না হয়ে অন্য আরেকটা ঘরে ছিল, যে-ঘরে কোনো বেড়া ছিল না, মাঝখানে ছিল ফকির বাবার আসনখানি, তার ওপরে মখমলে কাপড়ের ঝলমলে চাদোয়া, চাদোয়ার ঘেরে অতি চমৎকার করে লেখা ছিল- ‘ভক্তি বিনে মুক্তি নাই। ’ শারফিন ফকিরের দরগাটাও ছিল অতি মনোরম ও সুদৃশ্য।

এটি একটি চৌচালা টিনের ঘর ছিল, সামনে একটি বড় বারান্দা, চাল ও বেড়ার নতুন টিনগুলোই সবচাইতে চমৎকার। দরগার ভিতরে দুটি মাজার ছিল, একটি শারফিন ফকিরের বাবার, আরেকটি তাঁর দাদার। বাবার পাশে আরেকটা স্থান নির্দিষ্ট ছিল, সেটা শারফিন ফকিরের। এই ঘরটির অবস্থা আগে খুব জীর্ণ ছিল, কোনো এক মুরিদ সবকিছু পালটে নতুন করে গড়ে দিয়েছেন। সেই মুরিদ বড় কয়েকটা কার্গো লঞ্চের মালিক ছিলেন।

একবার তিনি পদ্মা নদীর মাঝখানে বোঝাই কার্গো সমেত প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়লেন। পাহাড় সমান ঢেউয়ের ওপর তাঁর কার্গো লঞ্চটি খড়ের মতো দলে-মুচড়ে দুলতে লাগলো— বাঁচবার আর কোনো ভরসা নেই। সেই মুহূর্তে মুরিদ চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, ‘দোহাই আলাহ্‌ রাসূলের, দোহাই বাবা শারফিন ফকিরের। ’ মুহূর্তে ঝড় থেমে গিয়ে পুরো আকাশ ঝরঝরে ফরসা হয়ে যায়, যেন এতক্ষণ কিছুই হয় নি। শারফিন ফকিরের নামের ওপর এই আশ্চর্য ফজিলত দেখতে পেয়ে তিনি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন।

তিনি বাড়ি ফিরে সপরিবারে বাবার দরবারে হাজির হয়ে বাবাকে সহস্র বার ভক্তি করেন এবং তাঁর সামান্য অর্থ দ্বারা বাবার পুরো দরগা ঘরটার সংস্কার করার অনুমতি গ্রহণ করেন। দরগা ঘরের সামনে বারান্দার বাইরে একটা দেয়ালঘড়ি ঝোলানো আছে, সেই মুরিদের দেয়া। এক ঘণ্টা পরপর সেটা ‘ঢং...’ করে বেজে উঠতো। এ শব্দটা কুটিমিয়ার কাছে দারুণ লাগতো। প্রথমবার যখন কুটিমিয়া এটা দেখেছিল তখন সে জানতো না এটা কী জিনিস।

জীবনে এমন আশ্চর্য জিনিস দেখতে পেয়ে তার গর্বের অন্ত ছিল না। সঙ্গীদের সে এটার কথা বলেছিল, তখন তারা ওর প্রতি খুব শ্রদ্ধাবনত হয়েছিল। ধামাইলে আসার খুব ছোটোবেলার দিনগুলোর কথা কুটিমিয়ার মনে নেই। যে-দিনটার কথা তার স্পষ্ট মনে পড়ে সে-সময় কুটিমিয়ার বয়স বড় জোর পাঁচ বছর ছিল। সূর্য মাথার ওপর থেকে সামান্য পশ্চিমে হেলে পড়লে তারা বাড়ি থেকে রওনা করে।

তার মায়ের কোলে দেড় বছরের বোন করিমন, কুটিমিয়া তার বাবার কাঁধে, কখনোবা কোলে। কিছুক্ষণ পরপরই বাবা তাকে নামিয়ে দিয়ে হাত ধরে হাঁটেন, তার আগের বছরও সে পুরোটাই বাবার কাঁধে ও কোলে চড়ে গিয়েছিল, সেবার হাঁটতে গিয়ে তার বেশ কষ্ট হচ্ছিল। ফকির বাড়িতে পৌঁছতে ভরসন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল। পথে তার প্রচুর খিদেও পেয়েছিল। বাবার হাতে গামছায় বাঁধা ভাতের থালা ছিল, সে খেতে চেয়েছিল।

কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে তাকে পথে খেতে দেয়া হয় নি। রাস্তার পাশে দোকান দেখে সে নেবুনচুষ খেতে চেয়েছিল, বাবা একটা লম্বা কাঠিওয়ালা নেবুনচুষ কিনে দিয়েছিলেন। তা দেখে করিমনও খেতে চেয়েছিল, মা জোর করে তার নেবুনচুষের এক কোনা ভেঙ্গে করিমনকে খেতে দিয়েছিল। করিমন খুব খুশি হয়েছিল, কিন্তু কুটিমিয়া সারাপথ গুনগুন করে কেঁদেছিল। ফকির বাড়িতে পৌঁছে বাবা তাকে নিয়ে ফকিরের সামনে গেলেন।

বাবা অনেকক্ষণ উপুড় হয়ে থেকে ভক্তি করলেন, মাথা উঠিয়ে দু হাতে ফকিরের পদস্পর্শ করলেন, সেই পদধুলি নিজ বক্ষ ও মুখমণ্ডলে মাখলেন, ডান হাত বাড়িয়ে কুটিমিয়ার সমস্ত শরীরে বুলিয়ে দিলেন। বাবা বলেছিলেন, ‘বাজান, বক্তি করো। ’ কুটিমিয়ার চোখে খুব লজ্জা। মাটিতে হাঁটু গেড়ে উপুড় হয়ে বাবার মতো ভক্তি করতে তার ভীষণ লজ্জবোধ হচ্ছিল। বাবা আবার বলেন, ‘বাজান, বক্তি করো তো দেহি।

বক্তি না করলে গুইন্যা অইবো। জলদি করো। ’ কুটিমিয়া গুনাহ্‌র ভয় কিংবা ভক্তির মাহাত্ম্য জানতো না, শুধু ভক্তির লজ্জাটুকুই তার সমস্ত চোখ জুড়ে ছিল। সেদিন কুটিমিয়াকে কোনোভাবেই ভক্তি করানো যায় নি, সে পাথরের মতো শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। ছেলেকে ভক্তি করাতে না পেরে কুটিমিয়ার বাবা ফকিরের সামনে খুব লজ্জিত হয়েছিলেন।

চলবে... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.