আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘চাকরি চাই দিতে হবে’…গেদু চাচাকে লেখা একজন চাকরি প্রত্যাশির আর্তনাদ।

চাচা, আমার নিজেরই শান্তি নাই তাই আপনাকে আর সালাম দিলাম না। পকেটে আছে মাত্র ১০০টাকা…যা দিয়ে আমাকে এই মাসের পুরাটা সময় পার করতে হবে। আজকাল সকালের নাস্তা করিনা… একবারে দুপুরে ভাত খাই…রাতে ভাত খেয়ে দুই গ্লাস পানি এবং সাথে সাথে ঘুমাতে চলে যাই। আমি জেগে থাকলেই ক্ষুধা লাগে… কিন্তু খাব কি? চাচা,আমাকে একটা চাকরি দিতে পারেন?… চাকরি চাচ্ছি আমার বেলা বোসের জন্যে না… ও আগেই চলে গেছে… চাকরি চাচ্ছি আমার ঘরে থাকা ছোট্ট বোনটার পরীক্ষার ফি দিব তাই… মা কে একটা শাড়ি কিনে দেব তাই। চাচা জানেন… আমার ছোট বোন টা খুব বুদ্ধিমতি; ওকে আমি বেকুবের মত প্রশ্ন করেছিলাম,‘তোর কি জামা লাগবে?… বোন আমার, ভাইয়ের কষ্ট না বাড়িয়ে বলে…,‘আমি তোর মত হাড় কিপ্টা?… আমার একই রংয়ের অনেক পোষাক’।

আসলে ওর একটাই পোষাক খুব যত্ন নিয়ে পরে। মা আর কিছু বলেন না আমাকে। শুধুই দোয়া করে যান…কবে মিলবে চাকরি…। চাচা, বাংলাদেশের এই বেকার অথচ তীব্র চাকরি প্রত্যাশিকে কেউ চিনল না অথচ চিনে ফেলল একজন মুচি দাদা। একটা ইন্টারভিউ দিতে যাব… মেস থেকে বের হয়েছি… দুই পা না হাটতেই জুতার তলা খুলে অন্যদিকে হাটা শুরু করল।

তাড়াতাড়ি করে তলাটা হাতে নিয়ে গেলাম মুচি দাদার কাছে… তলাটা লাগিয়ে দিয়ে বল্লেন চাকরি পাইলে টাকা দিতে… দেশের সেরা একটা সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফার্স্ট ক্লাস প্রাপ্ত এই আমি একটা ক্ষুদ্র পেশাজীবির ভালোবাসার কাছে হেরে গেলাম। গেটের বাইরে হাজারো আমার মত মানুষ… সবার চাই চাকরি… গেটের দারোয়ান ভাই ও এখন আমাদের কাছে অন্য রকম গুরুত্বপুর্ণ মানুষ… অবাক হলাম একজন ব্যাচেলর ডিগ্রী প্রাপ্ত মানুষ চাকরির জন্যে তাকে বলছে…‘স্যার, কয়জন নেবে জানেন কিছু?’ যেই লোকটা নিজেও জানেনা হয়ত কি চাকরির জন্যে সে এখানে আসছে। আচ্ছা চাচা,দেশের আনাচে কানাচে আমার মত কত মানুষ আছে বলতে পারেন? কি আমাদের পাপ? কেন এত মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে দিন যাপন করছি? মাঝে মাঝে মনে হয় মাছ কাটা বটি টা নিয়ে রাতের আঁধারে মাঝ রাস্তায় কোন প্রাইভেট গাড়িকে রুখে দেই… যদি পেয়ে যাই কোটি টাকা…। চাচা, বড় অদ্ভুত আমাদের প্রার্থী বাছাই পদ্ধতি। বিসিএস প্রিলিমিনারী পরীক্ষা… রাত দিন সমান করে গেলাম পরীক্ষা দিতে… প্রশ্ন পত্র হাতে নিয়ে দেখি ১০০টা প্রশ্নই ইংরেজিতে করা… ব্যাপারটা এমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্ম সাল কবে(উদাহরন দিচ্ছি শুধু)… সেটাও ইংরেজিতে করা হয়েছে।

আমার প্রশ্ন চাচা,… তাহলে সিলেবাসে বল্লি কেন বাংলা-ইংরেজি-অংক?… যেই প্রশ্ন বাংলায় দেখে দ্রুত উত্তর দেয়া সম্ভব ঠিক সেই প্রশ্ন ইংরেজি দেখে কি একই সময় উত্তর দেয়া সম্ভব? পরীক্ষাতে ভাষার মাধ্যম টা কি হবে কেন একজন পরীক্ষার্থী আগেই জানবেন না? যাইহোক লোক মুখে শুনি পরম নীতিবান পিএসসি প্রধান সাদত হোসেন স্যারের মেয়ে সেই দুর্যোগের সময় ফরেন এফেয়ার্সে চাকরি পেয়ে গেছেন… আর আমি আমার প্রয়াত আব্বাজানের উপর রাগ আটকাতে পারিনা। চাচা, বড় আজব এই দেশ। আমরা এস এস সি পর্যন্ত সর্বশেষ জ্যামিতি,পাটি গণিত,শতকরা বা অন্যান্য অংক করেছি… কিন্তু আজব শিক্ষা ব্যবস্থার কল্যানে বাকি ১০-১২ বছর ছুঁয়েও দেখতে পারিনাই(যারা প্রাইভেট টিউশনি করাতে পারেন তাদের কথা আলাদা…কিন্তু সবাই এই সুযোগটা পান না)… এখন প্রশ্ন হলো চাচা,কেন আমাকে কোন সময় না দিয়েই সেই ১০-১২ বছরের পুরাণ অংক করে চাকরি পেতে হবে? কেন জানতে হবে দেশের ইতিহাস? ইতিহাস কি মুখস্তের জিনিষ নাকি মনের ইচ্ছা নিয়ে জানার জিনিষ? আচ্ছা চাচা,একজন ডাক্তারি পড়া ছেলে-মেয়ের জন্যে সম্রাট আকবরের জন্ম সাল জানাটা কতটা জরুরি? আমার মাথায় এটা ঢুকেনা চাচা…জানিনা আমাদের মাথা মোটা নীতিনির্ধারকরা কি ভাবেন। শুনলাম পি এস সির কিছু দন্ডমুন্ড কর্তাব্যাক্তিরা নাকি দেশের টাকায় বাইশ টা দেশ ঘুরে আসছেন…কিভাবে চাকরির রিক্রুটমেন্ট প্রসেস পালটানো যায়…আজব লাগে…একটা দেশ স্বাধীন হবার ৪০ বছর পর এই চিন্তা? চাচা, ব্যাংক এর সিনিয়র অফিসার পদে পরীক্ষা দিতে গেলাম… সেখানে অনেক গুলা এন্টোনিম-সিনোনিম দিলো… যা আমি কোন কালে চোখেও দেখিনাই… শতকরার অংক করলাম ইংলিশ কোশ্চেন পড়ে। চাচা, বারো বছর আগে বাংলায় পাটি গণিত,শতকরা আরো নানা অংক করেছিলাম… সেই আমি বারো… বছর পরে কিভাবে তার উত্তর দেব ইংলিশে? কোন অধিকারে আমাকে এমন বঞ্চিত করা? আমি না হয় ইংলিশ মিডিয়ামে অনার্স করেছি কিন্তু যারা বাংলা মিডিয়ামে পড়েছে তাদের কি হবে? এটাকি তা হলে বাদ দেবার জন্যে পরীক্ষা নেয়া? চাচা, যদি বহির্বিশ্বের সাথে তাল মেলাতে এই ব্যাবস্থা তাহলে আমাদের প্রস্তুতির কেন সময় দেয়া হয়না? আমরা তো অনার্স করেই দৌড় দিতে থাকি চাকরির পেছনে… রক্তপানি করা হাজার হাজার টাকা দিয়ে।

চাচা, কোন ক্রমে একটা জায়গায় ভাইভা পর্যন্ত গেছিলাম… তো সেই বোর্ডে ছিলেন ষাটোর্ধ কিছু মানুষ… যারা আমাকে দেখেই বল্লেন…, ‘আপনার অনার্সে বিষয় কি ছিলো?…আমি উত্তর দিলাম, ‘কৃষি’…উনারা হো হো করে হাসি দিয়ে বল্লেন কৃষি সেক্টরের মানুষ তো আপনি এখানে কি করবেন? আপনাকে নিয়ে আমরা কি করব?…উনাদের হাবভাব দেখে মনে হলো মাঠের গরু এই আমি ভুল করে ভাইভা দিতে আসছি। আমি বল্লাম, ‘স্যার, বিজ্ঞাপনের কোথাও লেখা ছিলো না কৃষিতে পড়া একজন ছাত্র বা ছাত্রী এখানে আবেদন করতে পারবে না…উনারা বলে ফেললেন ‘কমন সেন্স থেকে আবেদন করতেন’। যাইহোক শুরু হলো আমাকে নিয়ে মশকরার খেলা…আমাকে বল্লেন, ‘বলেন,আপনি কিভাবে আমাদের এখানে সেবা দিবেন?…আমি আমার যুক্তি থেকে বুঝালাম। এবার উনারা বল্লেন আপনি তো এখানে থাকবেন না…আমাদের এমন কাউকে দরকার…যার চাকরি চাইই চাই। আমি চেয়ার ছেড়ে এবার উঠে দাড়ালাম এবং বল্লাম , ‘ঠিক আছে স্যার,আমার মাথার চুল হালকা হয়ে টাক পরে গেলে আমি আসব…উনারা আমার দিকে হা করে তাকায় থাকলেন!!!!…চাচা, এইসুত্রে একটা ঘটনা না বললেই না…ব্যাংক ড্রাফট করতে হবে…অগ্রণী ব্যাংকের কোন একটা শাখায় সদ্য নিয়োগ প্রাপ্ত একজনের সামনে এক ঘন্টা বসে আছি…আর উনি ব্যার্থ চেষ্টা করে যাচ্ছেন ড্রাফটে কি লেখবেন…তাই ভেবে।

একজন বয়স্ক লোক এসে সেই যাত্রায় উনাকে বাঁচালেন। আমি কাজ শেষ হলে বল্লাম , ‘ভাইয়া,কিছু মনে করবেন্না…অনার্স কোন সাবজ়েক্ট দিয়ে করেছেন?’…উনি আমাকে চমকে দিয়ে বল্লেন ‘রসায়ন’। চাচা, যেই দেশে রসায়নের ছাত্র-ছাত্রী ব্যাংকের কাজ করে…তাহলে ফিনাস্ন ব্যংকিংএর ছাত্র-ছাত্রী কি রাসায়নিক বস্তু নিয়ে গবেষণা করতেছে? দেশত উন্নয়নের তোড়ে ভাসবে না চাচা,রীতিমত উড়ে যাবে। চাচা, যখন মনে ছিলো দেশকে সেবা দেব…রক্ত গরম জান প্রাণ দিয়ে কাজ করব…পারলাম না। কারো কাছে মনে হলো না আমি তার অফিসে কাজ করতে পারি।

আর এখন আমার চামড়া কুচকে যাচ্ছে…চুল পেকে সারা… ঠিকই আমি বুঝতে পারছি বয়স আমাকে অনেক কঠিন কাজে বাধা দিচ্ছে… এখন হয়ত চাকরি পাব। আমি বয়সে বৃদ্ধ… কাজে অলস… আমার দ্বারা যেই ব্যক্তি সেবা পাবে তারো সময় নষ্ট হবে… সব কিছুতেই দেরি হবে… এভাবেই বাংলাদেশ পিছিয়ে আসছে… পিছিয়ে যাবে। ভালো থাকবেন চাচা। সূত্র : সদালাপ shodalap.com নভেম্বর 4, 2011 by গেদু চাচার খোলা চিঠি ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.