আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গণতান্ত্রিক ঐক্য ও গণমানুষের ভবিষ্যৎ

গণতান্ত্রিক ঐক্য ও গণমানুষের ভবিষ্যৎ ফকির ইলিয়াস ========================================= তিনি আগে মন্ত্রী ছিলেন। ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা। অনেক কথা থাকতে পারে তার পক্ষে-বিপক্ষে। আবারো তিনি আলোচনায়। বলেছেন, এই দুর্বিষহ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের শান্তি, সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের একটি মাত্র পথ আছে।

আর তা হলো ‘দুই নেত্রীর ঐকমত্য’। আরো বলেছেন, ‘এই ঐকমত্যের লক্ষ্যে আমি সুস্পষ্টভাবে আমার দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি অনুরোধ করছি আগামী ৫ জুনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংলাপে বসার আহ্বান জানান। ’ বেশ কড়া সুরেই ব্যা. হুদা বলেছেন, ‘আশা করি নেত্রী আমাকে পদত্যাগে বাধ্য করবেন না। ’ তার কথায় বেশ চমকই মনে হচ্ছে। তবে কি বিএনপিতে ভাঙনের সুর বাজছে? ভাঙন সমাগত? এমন খবর বেশ কিছুদিন থেকেই চাউর হচ্ছে বিভিন্ন মিডিয়ায়।

‘দলীয় অবস্থানের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখায়’ খালেদা জিয়া ২০১০ সালের ২১ নভেম্বর নাজমুল হুদাকে দল থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। এরপর ছয় মাস যেতে না যেতেই ‘অনুতপ্ত’ হন ব্যা. হুদা। তিনি বিএনপিতে ফেরার আবেদন জানালে ২০১১ সালের ৫ এপ্রিল তার প্রাথমিক সদস্যপদ ফিরিয়ে দেন খালেদা জিয়া। আমরা দেখেছি, বিএনপিতে ভাঙন ধরাবার চেষ্টা আগেও হয়েছে। কিন্তু তা খুব একটা হালে পানি পায়নি।

একটা কথা মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশে রেজিস্ট্রেশন করা রাজনৈতিক দলগুলোর আশি শতাংশেরই কোনো কার্যক্রম বাংলাদেশে নেই। তারপরও সভাপতি, সম্পাদক সর্বস্ব দলগুলো টিকে আছে কেন? কেন কিছু মানুষ এসব রাজনৈতিক দলের পিছু নিচ্ছে? আমি মনে করি বাংলাদেশে ৫/৭টির বেশি রাজনৈতিক দল থাকাই উচিত নয়। কারণ এতে নানা রকম কলহের, মতানৈক্যের পথ তৈরি হয়। দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হয়। বিশ্বের উন্নত গণতান্ত্রিক দেশগুলোর উদাহরণ আমরা দেখতে পারি।

আমরা খুব ভালো করেই জানি বর্তমান প্রজন্ম একটা পরিবর্তন চাইছে। একটি রাষ্ট্রে সৃজনশীল বিবর্তন সবসময়ই কাম্য থাকে। কারণ নান্দনিক পরিবর্তন, ক্রিয়াকর্মের মাধ্যমেই এগিয়ে যায় মানবসমাজ। গেলো এক যুগে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি ফিল্ডে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়েছে বলা যায়। এর পাশাপাশি অবশ্য নানা শঙ্কা-সংকটও বেড়ে উঠেছে নানাভাবে।

মনে পড়ছে প্রখ্যাত কথাশিল্পী শ্রদ্ধেয় শওকত ওসমান একটি সেমিনারে বলেছিলেন, সংস্কৃতির আবিষ্কার এবং আগ্রাসন দুটিই আছে। প্রজন্মকে ঠিক করতে হবে, সিদ্ধান্ত নিতে হবে তারা কোনটা গ্রহণ করবেন। আর অভিভাবককে গাইড দিতে হবে সে আলোকেই, তারা তাদের সন্তানদের কী শেখাতে চান। বাংলাদেশের একটি শ্রেণী আজ প্রজন্মকে বিপথে ঠেলে দিতে উদ্যত। রাজনৈতিক সন্ত্রাসের পাশাপাশি সামাজিক বখাটেদেরও লালন করছে কেউ কেউ।

দেশে মোবাইল ফোনে নির্দেশ দিয়ে অনেক অপকর্ম ঘটানো হচ্ছে। মোবাইল ফোনের বিল মেটাতে গিয়ে চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি করছে কিশোর-যুবকরা। ভাবলে অবাক হতে হয়, এমন দরিদ্রুতম একটি দেশে নাকি প্রায় পাঁচ কোটির কাছাকাছি মোবাইল গ্রাহক রয়েছে। কোনো কোনো মধ্যবিত্ত একের অধিক মোবাইল বহন করেন। আর উচ্চবিত্তের কথা না হয় বাদই দিলাম।

একটি দেশে প্রযুক্তি শিল্পের প্রসার বাড়বে, তা আনন্দের সংবাদ বৈকি। কিন্তু এর পাশাপাশি জনস্বার্থ সংরক্ষণ আইনগুলো কি কঠোরতর করা হচ্ছে? না, হয়নি। হচ্ছে না। মোবাইল ফোনে সংকেত দিয়ে মানুষ খুন পর্যন্ত করা হচ্ছে। অথচ সে ফোন দ্রুত এবং সহজে খুঁজে বের করার ট্র্যাকিং সিস্টেম বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে শক্তিশালী এবং পর্যাপ্ত নয়।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষও খুব জোরালো ভূমিকা রাখছে না। একটি দেশে দুর্বৃত্তপনা ছড়িয়ে দেয়ার অন্যতম উপায় হচ্ছে, সে দেশের তরুণ প্রজন্মকে নানাভাবে বিভ্রান্ত করা। আজ বাংলাদেশের রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে ফেনসিডিলের পর ‘ইয়াবা’ নামের নতুন মাদকদ্রব্য তৈরি, বাজারজাত করার খবর আমরা দেখছি। এদের নেপথ্য হোতা কারা, তাদের শিকড় কতো দূর পর্যন্ত বিস্তৃত, তা খতিয়ে দেখা দরকার সরকারের। এই যে রাজনৈতিক ম“পুষ্ট সামাজিক সন্ত্রাস, তা রুখবে কে? বাংলাদেশের রাজনৈতিক জীবন এবং সামাজিক জীবন দুটোই আজ এতোটা বিপন্ন যে, একটাকে বাদ দিয়ে অন্যটি নিয়ে ভাবলে লক্ষ্যবিন্দুতে পৌঁছা যাবে না।

বলার অপেক্ষা রাখে না, যদি রাজনৈতিক দলগুলোর, ক্ষমতাসীন সরকার পক্ষের জবাবদিহিতা করার মতো প্লাটফর্ম অতীতে থাকতো তবে হয়তো দেশ এতোটা লুটেরা বিপর্যয়ের মুখোমুখি পতিত হতো না। এই সুযোগে দেশে মৌলবাদী, জঙ্গিবাদীরা সংঘটিত হবার সুযোগ পেয়েছে। আর কিছুদিন পর হয়তো পরাজিত রাজাকাররা বলতে শুরু করবে, মুক্তিযুদ্ধ তাদের নেতৃত্বেই হয়েছিল! এই দেশ তারাই স্বাধীন করেছিল! এই যে সামাজিক আস্ফালন, তা তারা সম্ভব করতে পেরেছে শুধু প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর উদাসীনতার কারণে। বাংলাদেশে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি একটি জরুরি প্রয়োজন। এজন্য সরকার ও বিরোধী দলের সমন্বিত উদ্যোগ দরকার।

কারণ, ভূমি-মানুষ-সার্বভৌমত্ব-সমাজ রক্ষা এবং এর উন্নতি সাধন করা উভয় পক্ষেরই প্রধান দায়িত্ব। এর প্রয়োজনে তাদের যতোটা দরকার জবাবদিহি করতে কারোরই কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। শেষ পর্যন্ত দেশে যেসব দল টিকে থাকবে এবং যারা ক্ষমতায় যাবে, তাদের সবারই এ চিন্তাটি মাথায় রাখার সুযোগ উন্মুক্ত হলে পাল্টে যেতে বাধ্য দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। প্রখ্যাত সাহিত্যিক ড. হুমায়ুন আজাদের একটি বিখ্যাত কবিতা আছে, ‘আমি বেঁচেছিলাম অন্যদের সময়ে’। হ্যাঁ, নিজ সত্তা নিয়ে অন্যদের সময়ে বেঁচে থাকা বড় দুঃখজনক এবং কঠিন কাজ।

বাংলাদেশের বড় বড় নামকরা রাজনীতিক এবং শীর্ষ নেতানেত্রীরা অন্তরীণ হয়েছেন। আর তখন তারাও হয়তো ভেবেছেনÑ ‘আমি বেঁচে আছি অন্যদের সময়ে। ’ আজ ১৮ দলের নেতারা যারা অন্তরীণ হয়েছেন, তাদের অনেকেই ক্ষমতায় ছিলেন। এটাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ট্রাজেডি! সাধারণ মানুষ চোখে অন্ধকার দেখছেন। জিপিএ ৫ পেয়ে যেসব ছেলেমেয়ে এসএসসি পাস করেছে, তাদের অনেকেই কলেজে সিট পাবে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান হচ্ছে।

আর দরিদ্রতার করাল গ্রাস তো রয়েছেই। অথচ রাজনৈতিক মদদে প্রাইভেট কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির মহড়া অব্যাহত আছে আগের মতোই। বাঙালি জাতির এটা চরম দুর্ভাগ্য, একটি ভালো সিনেমার বদলে দলীয় পোষ্যদের নির্মিত চলচ্চিত্র, টেলিফিল্ম, নাটক বিভিন্ন চ্যানেলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে প্রায় গায়ের জোরে। ফলে সুস্থ, মেধাবী নির্মাতারা ক্রমেই মাঠ ছেড়েছেন। গ্রন্থ প্রকাশ এবং বিপণনেও দলীয় পক্ষপাত, পথে নামিয়েছে সৃজনশীল প্রকাশক- লেখকদের।

অন্যদিকে নগদকড়ি কামানোর ধান্ধায় প্লট, ফ্ল্যাট, মোবাইল ব্যবসা, ইজারাদারিসহ বিভিন্ন ‘হট’ ব্যবসায় দেশের রক্ষকদের এজেন্টরা বসিয়েছে কমিশনের ভাগ। একটি দেশে যখন রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি প্রশ্রয় পায় তখন সবাই লুটপাটে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। যা শতভাগই ঘটেছে বাংলাদেশের বেলায়। এই সুযোগে সব শ্রেণীর কালো শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। মানুষকে অশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিত করে রাখার এই যে বনেদি প্রচেষ্টা তা বাস্তবায়িত হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে।

প্রাইভেট স্কুল-কলেজ বনাম সরকারি স্কুল-কলেজের দুটি শ্রেণীবিভক্তি স্পষ্ট হয়ে উঠলেও সামাজিক শান্তি দুপক্ষের কেউই পায়নি কিংবা পাচ্ছে না। প্রজন্মের পথচলায় সংস্কৃতির বিবর্তন অবশ্যই অপরিহার্য। কিন্তু সে পথে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা দান এবং সামাজিক আইনি নিরাপত্তা বিধানও জরুরি। কারণ, একটি অন্যটির পরিপূরক। একটি কথা মনে রাখা দরকার চাপিয়ে দেয়া কোনো ‘নীতি’ দেশের মানুষ মেনে নেয়নি অতীতে।

আগামীতেও নেবে না। তাছাড়া দেশে শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বোধোদয় প্রজ্বলিত হচ্ছে। তারা নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভাবতে পারছেন। এই অবস্থায় যে কোনো পরিবর্তনই হওয়া দরকার সৃজনশীলতার আলোকে। দেশের মানুষ চাইছেন, সরকার ও বিরোধী দল ঐক্যে পৌঁছুক।

কারণ দেশটাকে আর কতো বিরানভূমিতে পরিণত করা যাবে! ২৪ মে ২০১২ -------------------------------------------------------------- দৈনিক ভোরের কাগজ / ঢাকা / ২৬ মে ২০১২ শনিবার প্রকাশিত ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.