আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুনতাসির মামুনের ভাবনা মানি পানি বিরিয়ানি ও হেফাজতে জামায়াত ইসলামের রাজনীতি

ফার্স্ট রাউন্ডের খেলা এখন শেষ। দ্বিতীয় রাউন্ডের খেলা শুরু হলো মাত্র। আজকাল কোন একটি খেলা শেষ হলে, কম্পিউটার বিশ্লেষকরা ভিডিও দেখে প্রতিপক্ষের দুর্বল বা শক্তির জায়গাটা পরীক্ষা করেন। তারপর পরবর্তী খেলার কৌশল ঠিক করেন। এখন যে যত কথা বলুন, মেঠো বক্তৃতার দিন শেষ, দেশ দু’ভাগে বিভক্ত এবং পুরোটাই রাজনীতির অন্তর্গত।

এক পক্ষে বিএনপি-জামায়াত এবং জামায়াতের নতুন সংগঠন হেফাজতে ইসলাম, যার নতুন নামকরণ করা হয়েছে হেফাজতে জামায়াত ইসলাম ও জাতীয় পার্টি। আর এদের ক্ষুদকুঁড়ো খেয়ে বেঁচে আছে যারা অর্থাৎ তাদের সমর্থনকারী ছোটখাটো দল। এ দলগুলো এখন থেকে হেফাজতের প্ল্যাটফর্মও ব্যবহার করবে। অন্যপক্ষে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সমস্ত দল, গ্রুপ, মানুষ। দেশ বিভক্ত করার যে বিষবৃক্ষ জেনারেল জিয়া বপন করেছিলেন তা এখন মহীরুহ।

তাঁর স্ত্রী খালেদা এতদিন সেই মহীরুহের ডালে বসে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেই নিরাপদ ডালটি এখন জামায়াত-হেফাজত কাটার আয়োজন করেছে। জামায়াত অনেকটা মাফিয়া চক্রের মতো। একবার তার সংস্পর্শে এলে বেরোবার উপায় থাকে না। খালেদা চাইলেও এখন সেই চক্র থেকে বেরোতে পারবেন না।

তাঁকে জামায়াতের নির্দেশ মেনে কাজ করতে হবে। মতিয়া চৌধুরী ঠাট্টা করে বললেও, অবাক হব না, বাস্তবে যদি বেগম জিয়াকে জামায়াতে বিএনপির আমীরান হিসেবে ভার গ্রহণ করতে হয়। হেফাজতকেও এখন থেকে জামায়াত বা পাকিস্তান থেকে যে নির্দেশ আসবে তা মানতে হবে। জনাব শফি এতদিন প্রত্যক্ষ রাজনীতি করেননি, তাই আমাদের রাজনীতির অন্তর্নিহিত নোংরামিটা বুঝতে পারেননি। এখন তিনি রাজনীতিতে এসেছেন, বিভিন্ন সাক্ষাতকার দিচ্ছেন এবং তাতে একটি লাভ হচ্ছে হেফাজতের রহস্য ঘুচে যাচ্ছে।

স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে জামায়াতের মানি, বিএনপির বিরিয়ানি আর এরশাদের পানি ছাড়া তাঁর গত্যন্তর নেই। কিন্তু মজাটা হচ্ছে, হেফাজত বিএনপি ও জাতীয় পার্টির ভোটব্যাংক নষ্ট করছে। বিএনপির পক্ষের ‘নিরপেক্ষ’ ভোটও নষ্ট হবে। হেফাজত যত কথা বলবে, রাজনীতি করবে ততই আওয়ামী লীগ লাভবান হবে। তবে আওয়ামী লীগ ঘরে ফসল তুলতে পারবে কি না সন্দেহ।

এই দলে বিরোধী পক্ষের মৃদু সমর্থক একটি গ্রুপ আছে যারা পৃষ্ঠপোষকতার কারণে নেতা; যারা বিদ্যমান কাঠামো অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা করে থাকতে চায়Ñ কারণ, তাদের প্রতিপত্তি ও সম্পদ যাতে বিরোধী পক্ষ ক্ষমতায় এলে নষ্ট না হয়। সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমে তাদের সম্পর্কিত বিভিন্ন খবর ও বক্তব্য চৌদ্দ দল সম্পর্কে ঘোলাটে ধারণার সৃষ্টি করছে। এটি আবার চৌদ্দ দলের জন্য ক্ষতিকর। এঁরা বলেন, বাস্তব অবস্থা অত্যন্ত কঠিন যা তারা ছাড়া কেউ বুঝতে পারছেন না। হায়, বাকিরা সব অনভিজ্ঞ, নাদান, গজদন্ত মিনারে বাস করছেন! আমরা বরং বলব, বর্তমান পরিস্থিতিতে চৌদ্দ দলের যে কোন দোদুল্যমানতা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের শামিল।

অনেকে বলছেন, বিশেষ করে সরকারী দলের নেতারা যে, হেফাজত একটি সামাজিক সংগঠন। বৃহত্তর অর্থে সব দলই সামাজিক সংগঠন। হয়ত হেফাজত এক সময় তা-ই ছিল। কিন্তু এখন আর তারা সামাজিক সংগঠন নয়, বরং জামায়াতের মতো ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠন। যদি তা না হতো, তাহলে তারা ১৩ দফা দাবি ওঠাত না, যার চরিত্র রাজনৈতিক।

তারা জামায়াত, বিএনপি, জাতীয় পার্টির প্রতিনিধি পরিবেষ্টিত হয়ে সরকারকে হুমকি-ধমকি দিত না। ৬ তারিখ নির্মূল কমিটি ও গণজাগরণ মঞ্চে এবং ৮ তারিখ বিভিন্ন জায়গায় সহিংস ঘটনা ঘটাত না। সুতরাং সরকার যেভাবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সহিংস ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করে, হেফাজতকেও সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। হেফাজত কিভাবে রাজনৈতিক দল তা একটু বিশ্লেষণ করা যাক। শুধু ধর্মীয় সংগঠন হলে হেফাজত মাও সে তুংয়ের অনুসরণে ‘লংমার্চ’ কর্মসূচী গ্রহণ করত না।

কারণ হেফাজত কমিউনিজমের বিরুদ্ধে। কিন্তু কেউ যখন রাজনীতি করে শত্রুকেও তখন তারা বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে। হেফাজত গত ৪০ বছর লংমার্চ কর্মসূচী দেয়নি, রাস্তায়ও নামেনি। কখন নামল? যখন জামায়াত-বিএনপি-জাতীয় পার্টি বিষোদ্গার শুরু করল শাহবাগের বিরুদ্ধে। এসব দলের নেতারা ক্রমেই অপাঙ্ক্তের হয়ে উঠছিল।

আর তাদের নোংরা অতীত তো সবার জানা। তারা স্পেস ফিরে চাচ্ছিল। যুদ্ধাপরাধ বিচার বানচালে তারা সুবিধা করতে পারছিল না। ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে ইসলামের নতুন ঠিকাদার মাহমুদুর রহমান মিথ্যা খবর ছাপা শুরু করলেন। সরকারে তার শক্তিশালী বান্ধব হয়ত আছে।

না হলে মিথ্যা সংবাদ, মিথ্যা ব্লগিং ছাপার কারণে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় না, কিন্তু তিনজন তরুণ ব্লগার গ্রেফতার হয়। হয়ত তারা এমন কিছু লিখেছে যা রুচিবিরুদ্ধ। কিন্তু আমার দেশ ও নয়া দিগন্ত যা করেছে তা কি রুচিসম্মত? গ্রেফতারকৃত তিন ব্লগার যদি ধর্মানুভূতিতে আঘাত দিয়ে যাকে তাহলে কাবার ছবি বিকৃত করে, ঈদ-ই-মিলাদুন্নবীর ছবি বিকৃত করে ছেপে তো মাহমুদুর ও নয়া দিগন্ত শুধু ফেৎনা নয় গোমরাহ সৃষ্টি করেছে। জানি না তথ্যমন্ত্রী এত সদয় কেন তাদের ওপর! জামায়াত ও মাহমুদুর অনবরত একতরফা প্রচার করে শাহবাগের আন্দোলন নাস্তিকতার আন্দোলন হিসেবে তুলে ধরে। উল্লেখ্য, মিডিয়া তাদের টক শোতে এই প্রচারকে বিস্তৃত হতে আরও সাহায্য করে।

আরও উল্লেখ্য, সাগর-রুনীর হত্যাকা-ের বিচার চেয়ে যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের সঙ্গে দু’বছর ইকবাল সোবহান চৌধুরীর সুযোগ্য নেতৃত্বে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন’ সাংবাদিকরা আন্দোলন করলেও, ধর্ম বিকৃতকারী, দাঙ্গায় উস্কানিদাতা, মিথ্যা ও বিকৃত রুচির সংবাদ পরিবেশন করা সত্ত্বেও ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনাসম্পন্ন’ সাংবাদিকরা তার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন। এ পৃথিবীতে টাকা একমাত্র দলনিরপেক্ষÑ যাকে বলে নির্দলীয়। ওপর থেকে ছেড়ে দিলেই হলো, কেউ লুফে নিলে তো বলা যাবে না সে টাকা খেয়েছে। জামায়াত প্রচুর টাকা ছড়িয়েছে, পত্রপত্রিকায় এমনও খবর এসেছে যে, হেফাজতের অনেক নেতার ব্যাংক এ্যাকাউন্ট স্ফীত হয়ে উঠেছে। টাকা হলো এনার্জি ড্রিঙ্কের মতো।

হেফাজত নেতাদের হঠাৎ জামায়াত-বিএনপি-জাতীয় পার্টির মতো মনে হলো শাহবাগ নাস্তিকে ভরা, শেখ হাসিনা নাস্তিক; শুরু হলো তাদের ভাষায় ‘নাস্তিক’ ‘আস্তিকের’ লড়াইÑ ঠিক যেমনটি চেয়েছে জামায়াত। হেফাজত তখন চট্টগ্রামে তরুণদের জনসভা ভ-ুুল করে দেয় এবং জামায়াতের নির্দেশে লংমার্চ ও ১৩ দফার ঘোষণা দেয়। যখন ধর্ম নিয়ে কেউ ব্যবসা শুরু করে তখনই তার বিচ্যুতি শুরু হয়। টাকা খাওয়ার রাজনীতিটা তাই গোলমেলে। তখন ধর্মকে রাজনীতির হাতিয়ার বানাতে হয়।

হেফাজতের সভায় কী হয়েছিল? বাংলাদেশের চিহ্নিত সব ব্যভিচারী ও দুর্নীতিবাজ নেতাদের মঞ্চে সাদরে ডেকে নিয়েছে, স্বাগত জানিয়েছে। অথচ চরমোনাইর পীরের প্রতিনিধিকে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে বা উঠতে দেয়া হয়নি। রাজনীতি না করলে বিএনপির সর্বোচ্চ সভার দু’জন সদস্য ও জাতীয় পার্টির একজনকে মঞ্চে নিয়ে বসাত না। জামায়াত যেভাবে আচরণ করে হেফাজতও সেভাবে আচরণ করেছে। প্রথম দিন তারা লাঠিসোটা নিয়ে নির্দিষ্টভাবে নির্মূল কমিটির ও গণজাগরণ মঞ্চ আক্রমণ করেছে।

পরের দিন ককটেল ফুটিয়েছে, গাড়ি ভেঙ্গেছে, রেললাইন অবরোধ করেছে, রেলগাড়ি আক্রমণ করেছে, সংবাদপত্র পুড়িয়েছে। দু’দিনই তারা সাংবাদিক ও তাদের গাড়ি আক্রমণ করেছে। শিবির রগ কাটে। হেফাজত পা কেটে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, জানা গেছে, মফস্বলে এক এলাকায় রিকশা থামিয়ে স্বামী-স্ত্রীর ধর্ম পরিচয় জানতে চেয়েছে।

সবশেষে বলতে হয় লোক সমাগমের কথা। হেফাজত ৫০ লাখ লোক জড়ো করবে বলেছিল। দেড় লাখের বেশি লোক হয়নি। যদি স্কয়ার ফুট হিসাব করেন তাহলে লোক আরও কমবে। এক লাখ স্কয়ার ফুট জায়গা যদি ধরি (বেশি ধরলাম) তাহলে কত লোক হয়।

দুই স্কয়ার ফুটে ২ থেকে ৩ জন লোক ধরে। এটি অঙ্কের ব্যাপার, ভাবালুতার কোন অবকাশ নেই। এর মধ্যে ফখরুল বলেছিলেন এক লাখ দেবেন। সেটি হয়ত পারেননি। তবে বিএনপি-জামায়াত-জাতীয় পার্টি ও ধর্মব্যবসায়ীদের অন্যান্য দল কমপক্ষে ঢাকা থেকে এক লাখ লোক সাপ্লাই করেছে।

সে কারণে, মানি, পানি ও বিরিয়ানির বন্দোবস্ত করতে হয়েছে। তাহলে হেফাজতের লংমার্চে ৫০ থেকে ৭০ হাজার হেফাজতী এসেছে। এটি হলো বাস্তবতা এবং এ কারণেই একজন ব্যক্তিÑ যিনি ‘স্বৈরাচারী’, কামরুল হাসান কথিত ‘বিশ্ববেহায়া’, পত্রপত্রিকায় উল্লেখিত ‘লম্পট’ হিসেবে খ্যাত তাকে, দুর্নীতির বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত চোর ছ্যাচ্চোড় হিসেবে দু’জন বিএনপি ও চিনিচোর হিসেবে খ্যাত একজন স্বঘোষিত কমিউনিস্টকে মঞ্চে বসাতে হয়েছে। প্রতিটি জিনিসের একটি দাম আছে। হেফাজতকে রাজনীতি করতে হয়েছে; সুতরাং তাকে একটি দাম দিতে হয়েছে।

আরও কারণ আছে, অনেক আলেম-ওলামা অভিযোগ করেছেন, হেফাজতের নেতারা ১৯৭১ সালে মুজাহিদ বাহিনী গঠন করেছিল। এ অভিযোগের তদন্ত হওয়া বাঞ্ছনীয়। এটি ঠিক হলে বোঝা আরও সহজ হবেÑ কেন তারা বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টিকে পছন্দ করে।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.