আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুনতাসির মামুনের ভাবনা, হেফাজতে জামায়াত ইসলাম ও টাকা খাওয়ার আন্দোলন

অধ্যাপক আবুল বারাকাত কয়েক বছর আগে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন, জামায়াত ও মৌলবাদীরা বিভিন্ন ব্যবসার মাধ্যমে বছরে প্রায় দেড়হাজার কোটি টাকা আয় করে এবং তার একটি অংশ ব্যয় করে তাদের ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ সমর্থনের জন্য নানা ফ্রন্ট করে। বিভিন্ন ব্যক্তিকে তারা নিয়মিত টাকা যোগায়। প্রশাসনের ব্যক্তিদের তো বটেই। রাজনৈতিক দলের নেতাদের পেছনেও তারা বিস্তর খরচ করে। ১৯৭৫ সালের পর থেকে এই টাকা তারা খরচ করছে।

এটি বহুল প্রচলিত অনুমান যে সৌদি আরব ও পাকিস্তান তাদের নিয়মিত টাকা সরবরাহ করে। যে কারণে জামায়াত বুদ্ধিজীবীরা যখন মুক্তিযুদ্ধ গৃহযুদ্ধ বলে তখন দেশজুড়ে প্রতিবাদ হয় না। এমনকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জামিল আহমেদও যখন ১৭৭১ সালে গৃহযুদ্ধ হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে জার্নালের সম্পাদকরা তা সানন্দে ছাপেন। সাংবাদিকরা দিনের পর দিন রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থকদের হাত ধরে আন্দোলন করেন এবং তাদের নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী গোলাম আযমের নাগরিকত্ব চান তখন আওয়ামীপন্থী পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদ তাকে সমর্থন জানায় বিভিন্ন প্রতিনিধি দলে তাকে অন্তর্ভুক্ত করে। আওয়ামীপন্থী ডাক্তারদের সংগঠন স্বাচিপের হুঙ্কারে স্বাস্থ্য বিভাগের দুই মন্ত্রী থর থর অথচ জামায়াতবিরোধী আন্দোলনে কিছুতেই তারা বলতে পারছেন না।

আমরা ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালে কাজ করব না, আমরা ইবনে সিনা হাসপাতালে কাজ করব না, আমরা ইবনে সিনা কোম্পানির ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে লিখব না। হঠাৎ আওয়ামী লীগের বদলি সম্পাদক হানিফ বিএনপিপ্রেমে খানিকটা উদাস হয়ে মনে করেন পুলিশ কেন এত বাড়াবাড়ি করছে বিএনপির প্রতি? মন্ত্রী ও চট্টগ্রামের নেতারা হেফাজতে ইসলামের নেতাদের পায়ে ধরে হুজুর হুজুর করেন। কয়েকটি টিভি প্রতিদিন, জামায়াত ও বিএনপিপন্থী লোকদের ধরে আনে টক শোতে, যাতে তারা মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে কথা বলতে পারেন। দেশে যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বলে পরিচিত তাদের একটি অংশ এ ধরনের কাজ করে যাচ্ছেন বহুদিন। এ ভাবে তারা দু’তরফের টাকা খেয়েছেন।

এখন সময় এসেছে এসব ভ-ের মুখোশ খোলার। না হলে, বর্তমান জামায়াত ও বিএনপি বিরোধী ধর্ম ব্যবসা ও ভ-ামির বিরুদ্ধে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছে তা সফল হবে না। কারণ,্এরা পক্ষে থেকে যা ক্ষতি করছে, বিরুদ্ধবাদীরাও তা করতে পারছে না। জামায়াতবিরোধী আন্দোলনে হঠাৎ আবির্ভাব হেফাজতে ইসলামের। হাটহাজারী মাদ্রাসাকে কেন্দ্র করে গ্রুপটি গড়ে ওঠে।

এর প্রধান জনাব আহমদ শফী। হেফাজতে ইসলামের ভাষায়-“ বাংলাদেশের প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালক, বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড (বেফাকুল মাদারিস) এর চেয়ারম্যান, দেশের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শীর্ষ আলিম পীরে কামেল শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের বর্তমান আমির। প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ পর্যন্ত হেফাজতে ইসলাম মুসলমানদের ঈমান- আকীদা ও তাহযীব- তামাদ্দুন সংরক্ষণে সর্বাত্মক ও নিরাপদ ভূমিকা পালন করে আসছে। এই সংগঠন কখনও কোন রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি বা কারও সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধে জড়ায়নি; আগামীতে এর কোন রাজনৈতিক এজেন্ডা নেই। ” [সংগ্রাম ২০.১.২০১৩] অনেকে এতদিন এ কথা বিশ্বাস করতেন।

কিন্তু ফেব্রুয়ারি মাস থেকে এখন পর্যন্ত হেফাজত যা করছে তাতে জনমনে দারুণ সন্দেহ দেখা দিয়েছে। মনে হচ্ছে জামায়াতের টাকা সেখানেও পৌঁছেছে। পত্র-পত্রিকার মতে তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছে এখন জামায়াত, নেতাদের ব্যাংক এ্যাকাউন্ট হঠাৎ অর্থ স্ফীতির বিষয় আলোচিত হচ্ছে। অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, এর নাম হয়ে গেছে হেফাজতে ইসলামের বদলে হেফাজতে জামায়াতে ইসলাম। রহস্যে উপন্যাসে ‘সিøপার’ বলে একটি চরিত্র থাকে।

তারা বিরুদ্ধ দেশে সে দেশের নাগরিকদের মতো থাকে, কেউ তাদের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ করে না কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ে তাকে জাগিয়ে তোলা হয় এবং তখন সে নিজের দেশের পক্ষে কাজ শুরু করে। হেফাজত সেরকম সিøপার, জামায়াত এখন জাগিয়ে তুলেছে। শাহবাগের তরুণ জাগরণ যখন ব্যাপকতা পাচ্ছে তখন এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় খালেদার নীল চোখের ‘বালক’ মাহমুদুর রহমান, বিএনপির মুখপাত্র আমার দেশের সম্পাদক। জামায়াত-বিএনপির পক্ষে তিনি ব্লগারদের নাস্তিক মুরতাদ বলে ঘোষণা করেন ও মিথ্যা সংবাদ ছাপিয়ে দেশজুড়ে দাঙ্গা বাধিয়ে দেন। তাকে অনুসরণ করে নয়া দিগন্ত ও সংগ্রাম।

লক্ষণীয় হেফাজতও তার অনুসারী হয়ে দাঁড়ায়। হেফাজত এতদিন পরিচিত ছিল কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানে যারা জামায়াতের ইসলামবিরোধী কার্যকলাপ পছন্দ করত না এবং এটাও মিথ্যা নয়, জনাব শফী মওদুদীবাদের বিরুদ্ধে লিখেছেন। কিন্তু প্রশ্ন জাগে এই সঙ্কটে কেন তিনি জামায়াতের পক্ষে গেলেন এবং কওমি মাদ্রাসার একটি অংশকে জামায়াতের সঙ্গে যুক্ত করলেন? তা হলে ধরে নিতে হবে মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শিক্ষার্র্থীদের মনোজগতে খানিকটা ঝামেলা আছে। নাকি অর্থই সব অনর্থের মূল? নাকি ছিলেন তিনি সিøপার। এসব সন্দেহের কারণগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করব।

২০ ফেব্রুয়ারি হেফাজত তিনটি পত্রিকায় অর্ধপৃষ্ঠার বিজ্ঞাপন ছাপে এ শিরোনামেÑ “ সরকার ও দেশবাসীর প্রতি শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফীর খোলা চিঠি- ইসলাম বিদ্বেষের প্রতিবাদে গর্জে উঠুন। ” এ বিজ্ঞাপনটি বিএনপি জামায়াতের মুখপাত্র আমার দেশ, নয়া দিগন্ত ও সংগ্রামে শুধু ছাপা হয়েছে। অন্য পত্রিকায় নয় কেন? আচ্ছা, এবার দেখা যাক ঐ খোলা চিঠিতে যে দাবিগুলো তুলেছেন জনাব শফী- সেগুলো কী? কারণ, বিষয়গুলো বিস্তারিত না জানলে একজনের উদ্দেশ্য বিধেয় সম্পর্কে জানাটা কষ্টকর হয়ে ওঠে। সেজন্য দীর্ঘ হলেও তাদের দাবিগুলো আগে তুলে ধরছি- “শাহবাগে যেসব ইসলামবিরোধী কর্মকা- পরিচালিত হচ্ছে ১. অগ্নিপূজক ও পৌত্তলিকদের অনুকরণে মুসলমানদের সন্তান-সন্ততিদের দ্বারা মোমবাতি প্রজ্বলন। ২. নামাজের সময়সহ দিন রাত অনবরত মাইকে গান- বাজনা।

৩. কথিত জাগরণ মঞ্চের মূল উদ্যোক্তা আসিফ মহিউদ্দীনসহ স্বঘোষিত নাস্তিকদের ব্লগে আল্লাহ ও রাসূল (সা) তথা ইসলাম সম্পর্কে চরম অবমাননাকর ব্লগ লেখা ও জঘন্য মন্তব্য। ৪. নারী-পুরুষের উদ্দাম নৃত্য, অবাধ যৌনাচার, অশ্লীলতা, মদ, গাঁজা সেবন ইত্যাদি অসামাজিক ও অনৈতিক কর্মকা-। ৫. পবিত্র মক্কা-মদিনার ইমাম ও খতিবদের বিশেষ পোশাক কো’বা পরিয়ে ফাঁসির অভিনয়। ৬.শাহবাগ চত্বরের মঞ্চ থেকে বিভিন্ন পত্রিকার সম্পাদক ও দেশের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গকে হত্যার হুমকি ও অশালীন ভাষায় গালিগালাজ। ৭. দাড়ি-টুপি পরিহিত ব্যক্তির গলায় রশি বেঁধে রাসূলের সুন্নাত ও ইসলামের প্রতীকসমূহের অবমাননা।

৮. কোমলমতি, কচি-কাঁচা শিশুদের ‘...ধরে ধরে জবাই কর’ ইত্যাদি অপরাধ প্রবণতামূলক সেøাগান শিক্ষা দেয়া। ৯. বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশের আবহমান ইসলামী সংস্কৃতির বিপরীতে ভারতীয় অপসংস্কৃতির নেতিবাচক প্রদর্শনী। ১০. সব ধরনের ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধের উস্কানি দিয়ে দেশকে অনিবার্য সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়া। ১১. গভীর রাত পর্যন্ত শাহবাগে অবস্থানকারী তরুণ-তরুণীদের অবাধ মাখামাখী ও অসামাজিক কর্মকা-ের অভিযোগ উঠেছে ফেসবুক, ব্লগসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয়। ১২. সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য হুমকি দেয়া সত্ত্বেও শাহবাগ চত্বর নিয়ে এক শ্রেণীর গণমাধ্যমে দৃষ্টিকটূ ও সীমা ছাড়ানো মাতামাতি।

১৩. রাজধানীর বারডেম ও বঙ্গবন্ধু হাসপাতালের রোগীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ ও রাস্তা বন্ধ করা অমানবিক পদক্ষেপ। ১৪. স্বঘোষিত নাস্তিক ব্লগারদের ইসলাম অবমাননার প্রমাণ/ প্রতিবেদন তুলে ধরে দেয়া পোস্ট/ লেখা প্রকাশ করার কারণে সম্প্রতি নিরপেক্ষ অনেক ইসলামী ব্লগ সরকার কর্তৃক বন্ধ করে দেয়। কাদিয়ানী সম্পৃক্ততা। ” লক্ষ্য করে দেখুন এ দাবিগুলো জামায়াত ইসলাম প্রথম তোলে এবং তারপর আমার দেশ, নয়াদিগন্ত, সংগ্রাম এসব বিষয় নিয়ে প্রবল প্রচার শুরু করে। এখানে দুটি শব্দ ব্যতিক্রম সেটি হলো “কাদিয়ানী সম্পৃক্ততা।

” কাদিয়ানীদের বিষয়টা সব সময় জামায়াত নিয়ে আসে এবং এ দাবি তুলে কাদিয়ানীদের মসজিদ পুড়িয়ে দেয়, দাঙ্গা করে। আরও লক্ষ্য করুন, এসব দাবি বা অভিযোগের সবই মিথ্যা বা মনগড়া। কাদিয়ানীদের বিষয়টি আনা হয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও শাহরিয়ার কবিরকে অভিযুক্ত করার জন্য। সম্প্রতি তাকে ‘নাস্তিকদের পিতা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। লক্ষ্য করুন ব্লগারদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগগুলো তোলেন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় মাহমুদুর রহমান।

গতদিনের ‘দৈনিক জনকণ্ঠে’র প্রবন্ধেই দেখিয়েছে তিনি কীভাবে পাঠকদের সঙ্গে প্রতারণা করেন। ‘নাস্তিক ব্লগার’দের কিছু লেখার নমুনা বিজ্ঞাপনে দেয়া হয়েছে। এখন প্রমাণিত যে এগুলোও প্রতারণা। জামায়াতী ব্লগাররা এসব কাজ করেছে। জনাব শফী বা তার অনুসারীরা কি এসব ব্লগ পড়েছেন না জামায়াতীরা যা বলেছে তাই বিশ্বাস করেছেন? এরপর তারা উল্লেখ করেছেন- শাহবাগ চত্বরে নাস্তিক-পৃষ্ঠপোষকতা “শাহবাগের তথাকথিত জাগরণ মঞ্চে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছেন ইসলাম ও দেশবিরোধী অসংখ্য চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহরিয়ার কবির, বিশিষ্ট বাম বুদ্ধিজীবী মুনতাসীর মামুন, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মূর্তি স্থাপনের নেপথ্য নায়ক জাফর ইকবাল, ফতোয়া নিষিদ্ধের রায় প্রদানকারী সাবেক বিচারপতি গোলাম রাব্বানী, হিন্দু নাস্তিক অজয় রায়, বাম ঘরানার চিহ্নিত কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ, ইসলামবিরোধী নারী নীতি প্রণয়ন ও সংবিধান থেকে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ বাক্যটি বাদ দেয়ার নেপথ্যে সক্রিয় ব্যক্তিরাই শাহবাগ নাটকের পৃষ্ঠপোষক ও মূল কুশীলব।

” সারাদেশে এত রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী থাকার পর তারা আমাদের কয়েকজনকে খুঁজে পেলেন শাহবাগের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে। আমরা এর সমর্থক, আর পৃষ্ঠপোষক হলে তো গৌরবের কথা। কিন্তু আমরা ইসলাম ও দেশবিরোধী হলাম কিভাবে? শাহবাগে যারা গেছেন তাদের মধ্যে অসংখ্য ওলামা-মাশায়েখ, ধর্মপ্রাণ, হাজি ও বিভিন্ন পেশার মানুষজন গেছেন যারা নিজ নিজ ধর্ম পালন করে থাকেন। জনাব শফীর কী অধিকার আছে তাদের ইসলামবিরোধী বলার? মাদ্রাসা শিক্ষিত হলে আর মাদ্রাসার সঙ্গে যুক্ত থাকলে তিনি ইসলামের পক্ষে আর বাকি সব ইসলামের বিপক্ষেÑ এ ধরনের ধৃষ্টতাপূর্ণ কথাবার্তা থেকে একজন মুসলমানের বিরত থাকা উচিত যদি তিনি মোমিন মুসলমান হন। তারা মুসলমানদের ইসলামবিরোধী বলছেন, ইসলাম বিদ্বেষী বলছেন, দেশে অশান্তি সৃষ্টি করেছেন।

ধর্ম নিয়ে আমি হেফাজতের সঙ্গে তর্ক করব না কারণ হেফাজতের নেতারা আজীবন ধর্মচর্চা করছেন। তাদের পা-িত্যেরও সমালোচনা করব না কিন্তু তাদের বলতে হবে আমরা কিভাবে ইসলামবিরোধী হলাম। আমার মনে পড়ছে সূরা বাকারার কয়েকটা লাইন, আল্লাহ যেখানে মোনাফেকদের উদ্দেশ করে বলেছেন, “পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি কর না, তারা বলে, ‘আমরাই তো শান্তি প্রতিষ্ঠাকারী। ’ সাবধান! এরাই অশান্তি সৃষ্টি করে। কিন্তু এরা এ বুঝতে পারে না।

” (কোরানসূত্র) আমাদের জনাব শফি ‘নাস্তিক, মুরতাদ ও ইসলামবিরোধী অপশক্তির আন্দোলনের’ অংশ হিসেবে চিহ্নিত করছেন। কী কারণে? তিনি আমাদের কোন লেখা পড়েছেন? ইসলাম তো কওমী মাদ্রাসাকে ইজারা দেয়া হয় না। আর জনাব শফি ধর্ম বিষয়ে এত জ্ঞানী হয়ে কাঠমোল্লাদের মতো কথা বলবেন, মাহমুদুর রহমানের অনুসারী হবেন এটি তো ধর্মপ্রাণরা মেনে নিতে পারেন না? তিনিও কি বিশ্বাস করেন ১৯৭১ সালের ধর্ষক লুটেরা সাঈদীকে দেখা গেছে চাঁদে? যদি তা বিশ্বাস না করেন তা হলে যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাবার জন্য যে আন্দোলন তাতে তিনি কেন শরিক হবেন? তিনি বলছেন, শাহবাগের তরুণদের যে আন্দোলন তা ‘মোটেও স্বাধীনতার সপক্ষ-বিপক্ষের লড়াই নয়। ’ তাহলে সেটা কি? জামায়াত স্বাধীনতাবিরোধী হিসাবে পরিচিত আর অন্যদিকে তরুণদের স্লোগান জয় বাংলা অর্থাৎ স্বাধীনতার পক্ষের। বিএনপি জামায়াতের পক্ষে- এ নিয়ে কি কোন সন্দেহ আছে? বিএনপিও তা অস্বীকার করে না।

তিনি যদি জামায়াত-বিএনপির স্লোগান দেন তাহলে কি সেটা স্বাধীনতার পক্ষের হবে? হেফাজতে ইসলামের নামে একটি লিফলেট বিলি হচ্ছে। সেই লিফলেটের ভাষাও জামায়াতী প্রচারের মতো। এতে বায়তুল মোকাররমের খতিব মওলানা সালাহউদ্দিন আহমদ, শোলাকিয়ার ইমাম মাওলানা ফরিদউদ্দিন মাসউদ, চট্টগ্রামের শীর্ষ সুন্নি আলেম, জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য, শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা ও মঞ্চ সংশ্লিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের ‘মুরতাদ’ ও ‘মুশরিক’ ঘোষণা দিয়ে তাদের হত্যার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ” [আমাদের সময়, ১৮-০৩-২০১৩] মুসলমান মুসলমানকে হত্যার নির্দেশ দিচ্ছে। ১৯৭১ সালেও পাকিস্তানী মুসলমান ও জামায়াতী মুসলমানরা মুসলমানদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল।

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। তারা তরুণ। তাদেরও মুরতাদ বলা হয়েছে। বিএনপির তরুণরা কি এটি মেনে নিতে প্রস্তুত? ১২ মার্চ ২০১৩ তারিখে ইস্যুকৃত লিফলেটটিতে বলা হয়েছে, ‘কাফের, মুশরিক, মুনাফিকদের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং সমমনা বাম দলগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন বর্তমান সরকারকে প্রতিহত, নির্মূল ও উচ্ছেদ করার জন্য আমরা হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে ধর্মপ্রাণ বিশ্ব মুসলিম, আলেম-ওলামা, এবং সমমনা দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। ’ আরও বলা হয়েছে, ‘চিটাগাং ক্লাবের মতো দেশের অন্য ক্লাবগুলোতে যেখানে প্রকাশ্যে পতিতাবৃত্তি চলে, সিনেমা হলসমূহ, অভিজাত হোটেল, যাকাতের বিরোধিতাকারী স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসাসমূহ ধ্বংস করে দেয়া হেফাজতে ইসলাম অত্যন্ত জরুরী মনে করে।

’ লিফলেটটিতে বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমের নাম উল্লেখ করে সকল বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘অতএব তাদের হত্যা করা সকল ধর্মপ্রাণ মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব’। [ঐ] বিএনপি ধর্ম নিয়ে খেলছিল। এখন যে সব কথা বলা হয়েছে লিফলেটে তার মধ্যে বিএনপি সমর্থক এবং কওমী মাদরাসার বিরোধীদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ধর্ম নিয়ে খেললে কী হয় বিএনপির সমর্থক ব্যবসায়ী ও পেশাদারীদের ভেবে দেখতে বলব।

হেফাজতে ইসলাম থেকে বলা হচ্ছে, এটি তাদের নয়। এটি জামায়াতের। যে জামায়াত তাদের জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, মোমিনদের বিরুদ্ধে দাঁড় করাচ্ছে, ফেরেববাজী অনুসরণ করতে বলছে, তাদের মানইজ্জতে দাগ পড়ছে। তাহলে, তারা জামায়াতবিরোধী সমাবেশ না করে শাহবাগের তরুণদের বিরুদ্ধে সমাবেশ করছেন কেন? জামায়াত-বিএনপি গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে, তাহলে হেফাজতের তো মঞ্চের পক্ষে থাকার কথা। কিন্তু তা না করে, তারাও জামায়াতীদের মতো একই সেøাগান তুলে গণজাগরণ মঞ্চের বিরোধিতা করছেন এবং জামায়াতীদের মতো বলছেন, কোথাও গণজাগরণ মঞ্চ করতে দেয়া হবে না।

এবং চাটগাঁয় তারা লাঠিসোটা নিয়ে প্রস্তুত থেকেছেন তরুণরা যাতে চট্টগ্রামে সমাবেশ করতে না পারে। সংগ্রাম এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, শাহরিয়ার কবির বলেছেন, হাটহাজারী মাদরারা জঙ্গীদের আস্তানা। তিনি তার চলচ্চিত্রে তা দেখিয়েছেনও। হেফাজত অবশ্যই তার প্রতিবাদ করবে। কিন্তু লক্ষণীয় শাহরিয়ার কবিরের বিরুদ্ধে হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াত একই ধরনের বিবৃতি দিয়েছে।

এটি কিভাবে সম্ভব? বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি মওলানা জিয়াউল হাসান গত ১৬ মার্চ চট্টগ্রামে এক সমাবেশে বলেছেন- ১৯৭১ সালে জনাব শফি আহমদ মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানীদের সহযোগী হিসেবে যা যা করার তা তা করেছেন। আমি যেহেতু এ বিষয়টি সম্পর্কে জানি না, সে কারণে এ বিষয়ে কোন মন্তব্য করব না। লক্ষণীয়, হেফাজত বা জামায়াত এ বক্তব্যের বিরোধিতা করেনি বা ইসলামী জোটের বিরুদ্ধে মিছিলও করেনি। এ বিষয়ে আরো তথ্যের জন্য সাংবাদিকরা জিয়াউল হাসানের মতামত জানতে পারেন। হেফাজত কেন জামায়াতের ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করছে তার সূত্র হয়ত জিয়াউল হাসানের মন্তব্যের মধ্যে নিহিত।

আরও কয়েকটি বিষয় লক্ষণীয়। হেফাজত মাঠে নামার পর জামায়াত আর রাস্তায় বেরুচ্ছে না, কোন একক কর্মসূচীও দিচ্ছে না। শুধু তাই নয় গত শুক্রবার চট্টগ্রামে হেফাজতের সমাবেশ থেকে সাঈদীর মুক্তির দাবি তোলা হয়। [কালের কণ্ঠ, ১৭-০৩-১৩] হেফাজতে ইসলাম এতদিন ইসলাম রক্ষার আন্দোলন করেনি। জামায়াত-বিএনপি ইসলাম রক্ষার আন্দোলন শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু তারাও একই দাবি তুলে ‘ইসলাম রক্ষায়’ এগিয়েছে।

সময়টা বা টাইমিংটা কেন এরকম তা নিয়েও কিন্তু ভাবনার সময় এসেছে। বাংলাদেশ ফেতনা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাসুম বিল্লাহ বলেন, “বিভিন্ন কারণে হেফাজতে ইসলামের কার্যক্রম আর ইসলামের হেফাজতের কাজে নেই। তারা মূলত জামায়াত-শিবিরের হেফাজত করতে চায়। ” [ঐ] গণতান্ত্রিক ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মওলানা মাসউদুর রহমান বিক্রমপুরী জানান, “হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মুক্তির দাবি প্রমাণ করে, তারা এখন হেফাজতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। ” তিনি বলেন, “মহানবী (সা.) এর অবমাননাকারীদের শাস্তির দাবিতে যে আন্দোলন শুরু হলো, তাতে একজন যুদ্ধাপরাধীর মুক্তি দাবি করা পক্ষান্তরে মহানবী (সা.) কেই অবমাননা করার শামিল।

” [ঐ] বাংলাদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান। তাদের মুসলমানত্ব রক্ষার দায়িত্ব হেফাজতে ইসলামকে কেউ দেয়নি। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নিজেদের ধর্ম নিজেরাই এতদিন রক্ষা করেছেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী ও জামায়াতীদের সঙ্গে লড়াইয়ে ৩০ লাখ প্রাণ দেয়ার পরও তারা ধর্ম বিচ্যুত হননি। সুতরাং, পাকিস্তানীদের মতো ইসলাম রক্ষার দায়িত্ব নেয়া পাকিস্তানীদেরই অনুসরণ।

তারা যদি মতলববাজি রাজনীতি করতে চান, তাহলে অচিরেই জামায়াতীদের মতো ফন্দিবাজ ধর্ম ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত হবেন। আর যাই হোক মওদুদীর ইসলাম ও প্রকৃত ইসলামে তফাৎ অনেক। হেফাজতে ইসলামীরা লক্ষ্য করুন, তাদেরকে ইতোমধ্যে অনেকে হেফাজতে জামায়াতী ইসলামী বলে অভিহিত করছেন। হেফাজতে ইসলাম বলতে দ্বিধা করছেন। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.