আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মধ্যরাতের ' চোরা ফারুক' , আমি এবং কিছু প্রশ্ন

আমার থাকার রুমটি তিনতলার কোনায়। যার জানালার পাশ ঘেঁষে একটি সুউচ্চ কাঁঠাল বৃক্ষ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে । যার কিছু ডালপালা নুয়ে পড়েছে ঠিক জানালার ঘেঁষে। কিছুক্ষণ আগে আমার জানালার পাশের কাঁঠাল বৃক্ষটির ডাল নাড়াচাড়া শব্দ পেলাম। ডালের একটি অংশ জানালার কাঁচে 'টুক' করে শব্দ করলো।

শব্দ শুনে জানালা খুলে বাহিরে তাকিয়ে আমি তো হতবাক!!!!!! একী দেখছি আমি?? জলজ্যান্ত একটি মানুষ এই রাতের বেলায় কাঁঠাল বৃক্ষটির ডালে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে বসে আছে। প্রথমেই একটু ভাবলাম যে মনে হয় ভুল দেখছি তাই ভালো টেবিলল্যাম্প জ্বলে থাকা সত্ত্বেও রুমের টিউব লাইট টি জ্বালিয়ে কাঁঠাল বৃক্ষটির ডালে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম। নাহ, এইবার সেই একই দৃশ্য ... সেই আধো আলো ছায়ার মাঝে একটি মলিন মুখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি 'চোর' বলে চিৎকার করার আগেই আমাকে ঐ লোকটি প্রশ্ন করলো- "ভাই কি ডরাইছেন"? প্রশ্নটা শুনে আমি আরও হতবাক। এই লোক দেখি পালিয়ে না গিয়ে উলটো আমাকে প্রশ্ন করছে!!!! আমি নিজেকে সামলে উত্তর দিলাম - '' নাহ।

কে তুমি? এতো রাতে এখানে কি করো"? লোকটি আমার কথা শুনে বললো- ''আস্তে বলেন মিয়া ভাই। অন্য বাড়ীর মানুষ শুনলে সমস্যা হবে। আমি ফারুক। চুরি কইরা খাই। " তাঁর নির্ভয় স্বীকারোক্তি শুনে এবার নিজেকে এবার সামলে নিলাম।

ভাবলাম, দেখি ঘটনা কি? তাঁকে এবার রাগের ভঙ্গিতে বললাম ''তোমার সাহস তো কম না। তুমি এতো রাতে আমার জানালার পাশে বৃক্ষে উঠেছো চুরি করতে !!! জলদি নামো , নাহলে দারোয়ান কে ডাক দিয়ে তোমার ধোলাই দেয়া হবে''। আমার কথা শুনে সে তো ভয় পেলোই না বরং আমাকে উলটো প্রশ্ন করলো " আপনার বাসার দারোয়ান কে পাইবেন কই? সে তো ঘুমায়। আমার কথা বিশ্বাস নাহলে গিয়ে দেখে আসেন''। তাঁর কথা শুনে মেজাজটা পুরো গরম হয়ে গেলো।

এই বেটা দেখি আমাকে উলটো ভয় দেখায়!!!!!!! এবার সে নিজেই আমাকে বললো '' বড় ভাই, আপনি চিন্তা কইরেন না, আমি আপনার সাথে একটু বইলাই চইলা যামু। কোন কিছু চুরি করমু না। আপনি শুধু অন্য কাউরে ডাইকেন না ,দোহাই লাগে"! আমি ওর কথা শুনে এবার কিছুটা স্বাভাবিক বোধ করতে লাগলাম । তাকে জিজ্ঞেস করলাম " তোমার বাড়ি কই"? সে উত্তর দিলো " দেশের বাড়ি নেত্রকোনা। থাকি আপনাদের পাড়ার 'পুরানবস্তি' এর রাজু মিয়ার কলোনিতে।

" এই কথা বলেই সে আমার দিকে তাঁর একটা হাত লম্বা করে বাড়িয়ে দিয়ে বললো '' বড় ভাই বেয়াদবি নিবেন না, আপনি তো অনেক সিগারেট খান রাত জাইগা, আমারে একটা সিগারেট দিবেন? আমার সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ ধইরা এই ডালে বইসা বইসা আপনার ঘুমানোর অপেক্ষায় ছিলাম। " আমি ওর কথা শুনে হাসবো না কাঁদবো চিন্তা করছি, এই লোক সেই শুরু থেকেই আমাকে বারবার অবাক করে দিচ্ছে। চরম তো মানুষটা। নিজের বিরক্তি ঢেকে ওরে আমার সিগারেট এর প্যাকেট থেকে ২ টা সিগারেট দিলাম।

সিগারেট পেয়ে তাঁর মুখে বেশ সুখের একটি হাসি দেখলাম। সিগারেট ধরাতে ধরাতে আমাকে সে বলতে লাগলো- " বড় ভাই আপনি তো দেখি এক আজব মানুষ!!!!!!! গত ৩দিন ধইরা আমি আপনার রুমে চুরি করতে আসছি কিন্তু সারারাত এই ডালেই বইসা কাটাইছি। আপনিও ঘুমাননা আমারও চুরি করা হয়না। সারারাত দেখি আপনি কম্পুটারে কি করেন আর কত সময় পরপর শুধু সিগারেট ধরান। আপনি ঘুমান না ক্যান?" আমি ওর কথা শুনে এবার নিজেকে আর সামলাতে পারিনি।

হেসে দিলাম। আমি হাসি দেখে সে জিহ্বা কেটে লজ্জিত ভঙ্গিতে ইশারায় বুঝালো আস্তে হাসতে। হাসির শব্দ শুনে কেউ জেগে গেলে ওর সমস্যা হবে। আমি হাসি থামিয়ে তাকে বললাম " তুমি ৩ রাত আমার জানালার পাশে বসা আর আমি টের পেলাম না !!!!!!!! বলো কি এসব? '' সে আমার বিস্ময় দেখে তাঁর কথা প্রমান দেয়ার জন্য আমি গতরাতে আমি কোন রঙের টি শার্ট পরা ছিলাম, মোবাইল কোথায় চার্জে দিয়েছি সব বলতে লাগলো। তাঁর কথায় বুঝলাম যে ঘটনা আসলেই সত্যি।

আমার 'থাই' এর জানালা হওয়াতে বাতি জ্বালালে রুমের ভেতর পরিষ্কার দেখা যায় এবং ভেতর থেকে বাহিরের কিছু দেখা যায় না। এবার সে হতাশ ভঙ্গিতে বলতে লাগলো - '' ভাই ৩ টা রাত পুরাই বেকার গেলো। কোন কাম হয় নাই। আপনার এখানে আর চুরি করতে আসুম না। আপনি না থাকলেও আর আসুম না।

কারন আপনি আমারে আজকে চেনার পরেও কোন ঝামেলা করেন নাই। অন্য কেউ হইলে এতক্ষণে আমারে মাইরা তক্তা বানিয়ে ফেলতো। আপনি খুব সহজ সরল ভাই। '' তাঁর কথা শুনে এবার ভাবলাম ওরে এবার ভয় দেখানো যায়, দেখি বেটার সাহস কত? তাই তাকে বললাম-' তোমাকে আমি মাইর দিবো না সেইটা কেমনে বুঝলা? আমি তো একটু পরে সবাইকে ডেকে তুলবো চিৎকার দিয়ে। তোমার শাস্তি হওয়া উচিৎ।

তুমি অন্য কোন কাজ করো না কেন? চুরি না করে তো রিক্সা চালাইতে পারো। " আমার কথা শুনে তাঁর মাঝে কোন পরিবর্তন দেখলাম না। বরং সে আমাকে উলটো নির্ভয়ে বলতে লাগলো- '' আপনি যে আমারে মাইর দিবেন না সেইটা এতক্ষণে আমি বুঝে গেছি। আপনি ঝামেলা করার মানুষ না। মারামারি করার ইচ্ছা থাকলে আপনি এতক্ষণ আমার সাথে কথা কইতেন না।

প্রথমেই তা করতে পারতেন। আর আমি তো চুরি করি নাই যে আপনি আমাকে শাস্তি দিবেন। আমি রিক্সা চালাই ঠিকই। মাঝে মাঝে বাড়তি ইনকামের জন্য সুযোগে চুরি করি। কি করুম, রিক্সার রোজ মালিকরে দিয়ে যা থাকে সেইটা দিয়া পোষায় না।

তাই মাঝে মধ্য চুরি করি। আমর তো চুরি করি অভাবে, পেটের দায়ে। অল্প জিনিস চুরি করি কিন্তু যারা অনেক ভালো অবস্থায় আছে তাঁরাও তো চুরি করে। হেরা চুরি করে ক্যান? হ্যাগো তো কোন অভাব নাই। দেখলেন না ঐদিন বস্তা ভর্তি টাকা নিয়া ধরা পড়লো কিন্তু কিছু হয় নাই ।

হেরা তো চুরি কইরা দেশের ক্ষতি করে হ্যাঁগো কেউ কিছু কয় না। সব দোষ আমাদের। আমরা ১০ টাকা চুরি করলেও গণধোলাই খাই, হাজার টাকা চুরি করলেও গণধোলাই খাই। কিন্তু হেরা লাখ- কোটি টাকা চুরি করলেও কোন বিচার হয় না। গরীব বইলা কেউ আমাগোরে মানুষ মনে করেনা।

" চোর বেটার মুখ থেইকা এতো কঠিন কথা শুনতে পাবো ধারনা করি নাই! ওর কথার পেছনে আমি যুক্তি দিলাম '' ঐটা তো চুরি করা টাকা না। ঘুষের টাকা ছিল''। আমার যুক্তি শুনে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারলো না সেটা তাঁর মাথা নাড়ানোর ভঙ্গিতে বুঝলাম। সে পাল্টা আমাকে বুঝাতে লাগলো- '' ঘুষ খেয়ে যাগো চাকরি দিতে চাইছিল সেইটা তো এক ধরনের চুরি। হূনছি যারা পরীক্ষা দিয়া পাশ করে নাই হ্যাঁগো টাকা দিয়া চাকরি দিবো।

এইটাও তো এক ধরনের চুরি। আসল মানুষদের চাকরি না দিয়া নকল লোকদের চাকরি দিয়া ট্রেইন চালাইলে পাবলিকের লস হইবো হেইডা তো সবার ক্ষতি। " এই কথা বলেই সে গাছ থেকে নেমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে আমাকে বিদায় জানালো - " থাউক ভাই। এইসব আপনি আমার চেয়ে ভালো কইতে পারেন। আমি বাড়িত যাই।

ফজরের আজান পড়ার টাইম হইয়া গেছে। এখন তাড়াতাড়ি রাইত শেষ হইয়া যায়। রাইত এখন ছোড। আসসালামুলাইকুম''। লোকটি আর আমার কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ধীরে ধীরে কাঁঠাল গাছের নিচে নামতে লাগলো।

নেমেই পাশের দেয়াল টপকে বাড়ীর পেছনের রাস্তায় চলে গেলো। আমি আবছা আলো অন্ধকারে যতটুকু দেখা যায় অবাক দৃষ্টিতে লোকটার চলে যাওয়া দেখলাম দৃষ্টির বাহিরে যাওয়া পর্যন্ত । লোকটা চলে যাওয়ার পর নিজের মনে ২টি প্রশ্ন জাগলো - ১) লোকটা চোর জেনেও কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়েই আমি তাকে নির্বিঘ্নে চলে যেতে সাহায্য করলাম যা হয়তো উচিৎ হয়নি। নিজেকে কেন জানি হুট করে 'বিজিবি'র মহাপরিচালক মনে হলো !!!!!!!!! আচ্ছা আমি কি বিজিবি'র মহাপরিচালকের মতো একটি অন্যায় কাজ কে সমর্থন করলাম? ২) এক অশিক্ষিত হতদরিদ্র লোকের মনের ভেতরেও দেশের লাভ-ক্ষতির চিন্তা আসে, কিন্তু আমাদের ভোটে নির্বাচিত উচ্চশিক্ষিত ঐ সব দেশপ্রেমিক জনপ্রতিনিধিদের মনে কেন এই চিন্তা আসেনা? তাঁরা কেন অনবরত আমাদের ক্ষতি করে যাচ্ছে? তবে কি ওদের চেয়ে ঐ অশিক্ষিত দরিদ্র ব্যক্তিটিই জনগণের প্রতিনিধি হবার যোগ্যতা বেশী রাখে? ............জানিনা , শুধুই অন্ধকার দেখতে পাই। * এই গল্পের ঘটনা ও প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক।

বাস্তবের সাথে ইহার কোন মিল নেই। কেহ ইহাকে বাস্তবের সাথে মেলাতে গিয়ে ভুল করলে এর জন্য লেখক দায়ী থাকবে না। * আসুন বাংলাদেশের দালালী করি ......... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।