আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিস্মরণ

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। একজন পুরুষ এবং একজন নারী। বাড়ি থেকে বেরিয়েছে মাত্রই।

হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যাচ্ছে ওদের গাড়ির দিকে। গাড়ির নম্বরপ্লেটে কী লেখা আছে আমার মুখস্ত। কে জে ২৪০৩। আমার চেনা গাড়ি। পুরুষটি গাড়ির দরজা খুলে ধরল।

আর মেয়েটি হাসিমুখে ঢুকে পড়লো। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি। দেখছি ওরা কোথায় যায়। রোজ এই সময়ে ওরা বেরিয়ে যায়। পুরুষটির নাম ভিনসেন্ট, মেয়েটির নাম মলি।

ভিনসেন্ট যাবে অফিসে, আর মলি যাবে লাইব্রেরীতে কাজ করতে। আমি চিনি ওদেরকে। না চিনলে ওদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকবো কেন? মলি হল আমার স্ত্রী। সত্যি বলতে, একসময় স্ত্রী ছিল, এখন নেই। আর ভিনসেন্ট? ওর বর্তমান স্বামী, আমার প্রাক্তন বন্ধু।

কি সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে নিজেদেরকে। আমার বুক ভেঙে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। আমার ছেলেটার কথা মনে পড়ে। থাকে কাছাকাছিই, ওর “গ্র্যানির” কাছে। স্কুলে চলে গেছে, সকালে ওর বাস আসে।

একগাদা বন্ধুবান্ধব জুটিয়েছে। স্কুলের সকার টিমে ওর নাম আছে। ভাল অংক করে। সবাই কত ভালোবাসে। আমাকে নিশ্চয়ই ভুলে গেছে, কখনো তো ওকে বাবার কথা ভেবে একটু মন খারাপ করতে দেখি না! বন্ধুরা ছিল সবসময় আমার প্রাণ।

কথা বলতে ভালবাসতাম, সবাইকে নিয়ে মজা করতাম, হৈচৈ করতাম, মাতিয়ে রাখতাম চারপাশ। সবাই আমাকে জানতো প্রাণখোলা একজন মানুষ হিসেবে। সেই আমি একে একে সব বন্ধুর বাড়িতে ঘুরে এসেছি; কই, কেউ তো ভুলেও আমার নাম উচ্চারণ করে না। পিটার অ্যালেনসন নামে কেউ যে কখনো ছিল, সেটা কারো আচরণে মনে হয় না। এমনকি বাচাল মারফি পর্যন্ত নয়, যার বাসায় উইকএন্ডের রাত্রিগুলো কত আনন্দ আর গল্পগুজব করে কাটিয়েছি।

বললে কেউ বিশ্বাস করবে কীনা জানি না, অফিসে আমার কামরাটাও একবার ঘুরে এসেছি। কি আশ্চর্য, এত বছর যে চেয়ারটা আমার একার দখলে ছিল, সেখানে কোথাকার কে বসে কাজ করছে, নির্বিকার চিত্তে। অফিসের কেউ, এমনকি আমার প্রিয় কলিগরাও সেদিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে না। কাউকে দেখে মনে হচ্ছে না এখানে কেউ অনুপস্থিত, এখানে অন্য কারো থাকার কথা ছিল, সে নেই। সারাটা দিন এখানে-সেখানে ঘুরে বেড়াই।

বাসা, অফিস, আমার পরিচিত জায়গাগুলো। বড় চেনা জায়গাগুলো কি আশ্চর্য দ্রুততায় অচেনা হয়ে গেছে, এবং যাচ্ছে। একটা সময় হয়তো এখানে চলাফেরা করতেই ভয় লাগবে। এই পুরো শহরটা আমার মন খারাপ করে দেয়। জুন মাসের রৌদ্রকরোজ্জ্বল এই দিনটি, ঘোর নীল আকাশটি, ডালপালা মেলে দেয়া বিশাল রেইনট্রি গাছটি আমার মনকে প্রফুল্ল করতে পারে না।

চারিদিক কেমন একটা বিষণ্ণতায় ঢাকা। একাকীত্ব আমাকে সবসময় পোড়াচ্ছে। আরও যেটা বুকের ভেতর বাজে, সেটা হল, কেউ আমাকে জিজ্ঞেসও করছে না আমি কেমন আছি। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে বারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলি। তপ্ত দীর্ঘশ্বাস।

এটাই এখন একমাত্র সম্বল। বলি, হা ঈশ্বর, এজন্যই কি ... ... একসময় ক্লান্তিময় দিনটি ফুরোয়। রাত গভীর হয়। আমার মতো আরও যারা আছে, তারা কে জানে কী আশায় রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। কেউ বুক চাপড়ে কাঁদে।

কেউ হাহাকার করে, শহরের নির্জন রাস্তায় কিংবা কানাগলিতে সে চিৎকার প্রতিধ্বনিত হয়। আমি আর সবার মতো নই। হয়তো আমার শক্তি ফুরিয়ে গেছে। আমি আমার সংকীর্ণ আস্তানায় ফিরে আসি, গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ি। আরও একটা দিন আমার সামনে অপেক্ষা করছে, তারপর আরও একটা, তারপর আরও একটা।

ভেবে ভয় লাগে আমার। এর কি শেষ হবে না? এখানে আরও দু’চারজন থাকে। তাদের সাথে কথা হয় না, বড়জোর চোখাচোখি হয়। ওদেরকে পর্যবেক্ষণ করি আমি। সবার মধ্যে কি আশ্চর্য মিল।

সবার চোখেই তীব্র আকুতি, তীব্র ক্ষুধা। সবার দৃষ্টি বুভুক্ষু। সবাই এখানে একাকী, নিঃসঙ্গ। সেদিন এখানকার এক বাসিন্দা গভীর রাতে কাঁদতে কাঁদতে ফিরে এসেছিল। মুখ ঢেকে অনেকক্ষণ কেঁদেছিল।

বিলাপ করে বলছিল, ওকে নাকি কেউ চিনতে পারে নি। না ওর স্ত্রী, না ওর সন্তান, না ওর বন্ধুরা। ঠিক আমার মতোই সমস্যা। আমাদের এখানে সাধারণত কান্নাকাটি করার নিয়ম নেই। নিয়ম নেই সান্ত্বনা দেয়ারও।

যদি থাকতো, তাহলে অবশ্যই ওকে সান্ত্বনা দিতাম। বলতাম, এখানে আটকা পড়ে গেছ, কেঁদে আর কী হবে? হ্যাঁ, আমরা যারা বায়ুচর আত্মা, তারা সবাই নিঃসঙ্গ। আমাদের এই আস্তানায়, এই গহ্বরে সবসময় জমাট বেঁধে থাকে অন্ধকার, বেদনা আর চোখের জল। এখানে আলো নেই। এখানে আছে নীরবতা।

এখানে পাহারা দেয় মৃত্যু। একটা সময় ভাবতাম, আমি ছাড়া আমার চারপাশের মানুষগুলো, আমার প্রিয়জনেরা কীভাবে থাকবে? আমার ধারণা ভুল ছিল। কত সহজেই না আমাকে সবাই ভুলে গেছে। কত সহজেই না আমাকে ওদের জীবন থেকে ঠেলে বের করে দিয়েছে। মৃত্যু নামের দু’অক্ষরের শব্দটি আমার সেই প্রিয়জনদেরকে কত সহজেই না পর করে দিয়েছে।

মলি আমার স্মৃতিজড়ানো সবকিছু ফেলে দিয়েছে। কিন্তু ওর অজান্তে স্টোররুমে একটা ছবি রয়ে গেছে। পিটার অ্যালেনসনের সেই ছবিটার দিকে কোনদিন আর কেউ মায়াভরে তাকাবে না, যত্ন করে ছবিটা মুছবে না। ভিনসেন্ট আর মলি সুখে সংসার করবে। করুক।

আমার ছেলেটা বড় হবে, বাবার সব স্মৃতি ভুলে যাবে, ভিনসেন্টকেই মনে করবে ওর বাবা। করুক। আমার চেয়ারটা দখল করে কোথাকার কে কাজ করছে, করুক। আমার জন্মদিনে আর অফিসের কলিগেরা সারপ্রাইজ দেবে না, না দিক। আমাকে ছাড়াই বন্ধুদের আড্ডা খুব জমে উঠবে, উঠুক।

সবাই আমাকে ছাড়াই ভাল থাকুক, সুখে থাকুক। আজ কারো সাথে আমার আর স্থান নেই। আমি পাশ ফিরে শুলাম, যাতে চোখ ফেটে আসা পানি কেউ দেখতে না পায়। হাজার হোক, আমি তো আর রক্তমাংসের মানুষ নই যে হাপুস নয়নে কাঁদতে পারবো, কেঁদে হালকা হতে পারবো। (২৮ জুন, ২০১৩) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।