আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের দেশ

প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের দেশ বাংলাদেশ । হাজার হাজার বছরের প্রামান্য ইতিহাসের বিখ্যাত মহানায়কদের প্রায় সকলেই প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের স্বীকার হয়ে বিয়োগান্তিক পরিণতি লাভ করেছেন। সিরাজউদ্দৌলা থেকে বঙ্গবন্ধু ,শামস্উদ্দিন ইলিয়াস শাহ থেকে জিয়াউর রহমান কেউ এই বিষাক্ত যড়যন্ত্র থেকে রক্ষা পাননি। যিনি ষড়যন্ত্র করেছেন তিনিই আবার ষড়যন্ত্রের স্বীকারও হয়েছেন। বাংলার মসনদকে ঘিরে এই নির্মম খেলা চলেছে হাজার বছর ধরে কিন্ত এর শুরুটা হয়েছিলো কিভাবে? বাংলাদেশ সহ এতদঅঞ্চলের প্রথম প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের ইতিহাস খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেলো যে এর সূচনা হয়েছিলো মূলতৎ বরেন্দ্র অঞ্চলে।

অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক সে ইতিহাস। কৃষিভিত্তিক পশ্চাৎভূমি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপাদানের সহজলভ্যতার কারনে পুন্ড্র -বরেন্দ্র অঞ্চলে খৃষ্টের জন্মের হাজার বছর আগেই এক বিশাল নগর সভ্যতা তথা রাষ্ট্রীয় সত্তার জন্ম হয়েছিল একথা আজ নিঃসন্দেহে প্রমানিত হয়েছে। এই সভ্যতা ছিল সমসাময়িক কালের বহুল আলোচিত আর্য সভ্যতার চেয়েও অনেক প্রাচীন এবং ক্ষেত্রবিশেষে উৎকৃষ্টতর। প্রাথমিক পর্যায়ে কৌম সমাজ হতে বিবর্তিত হয়ে নগরসভ্যতা এবং পরে আরো সুসংবদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রীয় সত্তার জন্ম সর্ম্পকে স্বচ্ছ ধারণা পেতে হলে আমাদেরকে প্রথমতঃ দূর অতীতের মহাকাব্য গুলোর দ্বারস্থ হতে হবে। ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ (খ্রীঃ পূর্বঃ ১৪০০-১০০০) ‘মনুসংহিতা’ (খ্রীঃ পূর্বঃ-৯০০) ‘বৌধায়নের ধর্মসূত্র’ (খ্রীঃ পূর্বঃ-৬০০) পানিনির রচনা(খ্রীঃ পূর্বঃ-৭০০) এবং ‘মহাভারত’ সহ অন্যান্য প্রাচীন রচনাতে পুন্ড্র-বরেন্দ্র অঞ্চলের রাষ্ট্রীয় সত্তার প্রমান ভূরি ভূরি যা আমরা দূর অতীতের মহাকাব্যিক নিদর্শন গুলির মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি ।

এর আরো প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় হেলেনিক ইতিহাসবিদদের রচনায় যারা আলেকজান্ডারের ভারত বিজয়ের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এদের মধ্যে ভার্জিল,টলেমী,ডিওডোরাস ইত্যাদি গ্রীক ইতিহাসবিদদের রচনায় আমরা জানতে পারি যে খৃষ্টের জন্মের তিনশত ছাব্বিশ (৩২৬) বছর আগে আলেকজান্ডার যখন ভারতবর্ষের পূর্ব প্রান্তের কিছু এলাকা জয় করে বিতস্তা বা বিপাশা নদীর তীরে এসে পৌঁছান তখন পুন্ড্র -বরেন্দ্র সহ এতদঞ্চলের দুটি শক্তিশালী রাষ্ট্রের কথা জানতে পেরে এতদঅঞ্চলে তার দিগবিজয়ের বাসনা ত্যাগ করেন। এই রাষ্ট্রদুটির একটিকে গ্রীক ঐতিহাসিকেরা গঙ্গারিডাই ( Gangaridai) বা গঙ্গারিডি ও অন্যটিকে প্রাসিঐ (prasioi) বা প্রাচ্য রাষ্ট্র নামে অভিহিত করেছেন। এ প্রসঙ্গে ডিওডোরাস বলেছেন“ভারতবর্ষে বহু জাতির বাস,তন্মধ্যে গঙ্গারিডাই জাতিই সর্বশ্রেষ্ঠ অথবা সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী। ইহাদের চারি সহস্র বৃহৎকায় সুসজ্জিত রণহস্তী আছে, এইজন্যই কোন রাজা এই দেশ জয় করিতে পারেন নাই।

স্বয়ং আলেকজান্ডারও এই সমুদয় হস্তীর বিবরন শুনিয়া এই জাতিকে পরাস্ত করিবার দুরাশা ত্যাগ করেন। ”-১ এ প্রসঙ্গে নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন -'' Gangaridai যে গাঙ্গেয় প্রদেশের লোক এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। কারন গ্রীক ও লাতিন লেখকরা এ সম্বন্ধে একমত। দিয়োদোরাস-কার্টিয়াস-পু­তার্ক-সলিনাস-প্লিনি-টলেমী -স্ট্রাবো প্রভৃতি লেখকদের প্রাসঙ্গিক মতামতের তুলনামূলক বিস্তৃত আলোচনা করিয়া হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী মহাশয় দেখাইয়াছেন যে“ Gangaridai ” বা গঙ্গারাষ্ট্র গঙ্গা ভাগিরথীর পূর্বতীরে অবস্থিত ও বিস্তৃত ছিল এবং প্রাচ্যরাষ্ট্র গঙ্গা-ভাগিরথী হইতে আরম্ভ করিয়া পশ্চিমদিকে সমস্ত গাঙ্গেয় উপত্যকায় বিস্তৃত ছিল। তাম্রলিপ্তি যে প্রাচ্য রাষ্ট্রের অর্ন্তগত ছিল ইহাও তাহারই অনুমান।

রায়চৌধুরী মহাশয়ের এই অনুমান যুক্তিসম্মত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত বলিয়া মনে করা যাইতে পারে। ”-২ গঙ্গারিডাই বা প্রাচ্য রাষ্ট্রের অবস্থান প্রসঙ্গে নবীন প্রবীন সকল ইতিহাসবিদ তাহলে অন্তত একটি বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছেছেন যে আজকের বাংলাদেশ ও পশ্চিমবাংলা, বিহার ও উড়িষ্যা সহ সন্নিহিত অঞ্চলগুলির সমন্বিত তৎকালীন রাষ্ট্রশক্তিই ছিল গঙ্গারিডি এবং প্রাচ্যরাষ্ট্র। এবং এই দুই রাষ্ট্রের সমন্বিত ভৌগলিক রূপ যাই হোকনা কেন তৎকালীন সময়ের সবচেয়ে প্রধান এবং প্রভাবশালী জনপদ পুন্ড্র-বরেন্দ্র যে এই দুটি রাষ্ট্রশক্তির প্রধান শক্তিস্থল হিসেবে বিবেচিত হতো একথা নিঃসন্দেহে ধরে নেওয়া যায়। কারণ আলেকজান্ডারের আক্রমণের বহু পূর্ব থেকে (অন্তত এক থেকে দেড় হাজার বছর)এতদঞ্চলের শক্তিশালী কৌম সমাজ এবং জনপদ হিসেবে পুন্ড্রের নাম আমরা পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম সাহিত্যিক নির্দশন ‘ঋগে¦দে’র ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ ‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণে’ দেখতে পাই (রচনাকাল খ্রীঃ পূর্বঃ-১৪০০-১০০০)। আগেই বলা হয়েছে যে প্রাথমিক পর্যায়ে কৌমসমাজ হতে বিবর্তিত হয়ে পুন্ড্র নামক জনগোষ্ঠির নগর সভ্যতায় প্রবেশ এবং পরে আরো সুসংবদ্ধ হয়ে তার রাষ্ট্রীয় সত্তার জন্ম আমরা দূর অতীতের মহাকাব্যিক নিদর্শনগুলির মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি।

‘ঐতরেয় ব্রাহ্মণ’, ‘মনুসংহিতা’, ‘বৌধায়নের ধর্মসূত্র’, বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ‘আচারঙ্গসূত্র’, পানিনির রচনায় এবং মহাভারত সহ অন্যান্য প্রাচীন রচনা যা খ্রীষ্ট জন্মের অন্ততঃ দেড় হাজার বছর আগে থেকে খ্রীষ্ট জন্মের অন্ততঃ পাঁচশত বছর আগে পর্যন্ত সময়ে রচিত হয়েছে তার সর্বত্রই পুন্ড্র-বরেন্দ্র অঞ্চলে রাষ্ট্রীয় সত্তার নিশ্চিত প্রমাণ সহ শক্তিশালী অবকাঠামোর পরিচয় পাওয়া যায়। তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ হিসেবে বলা যায় যে পুন্ড্র-বরেন্দ্র সমন্বিত সেই গঙ্গারিডি এবং প্রাসিঐ বা প্রাচ্যরাষ্ট্র এতো শক্তিশালী ছিল যে বিশ্বজয়ী আলেকজান্ডার স্বয়ং এ স্থানে তার দিগি¦জয়ের বাসনা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন। উৎকৃষ্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার ক্ষমতার মোহ তথা ধনে জনে পরিপূর্ণ রাজ্যসম্পদ যেখানে অত্যন্ত লোভনীয়,সুযোগ সন্ধানী রাজপুরুষদের ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র তথা প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অপতৎপরতাও সেখানে অহরহ লক্ষ্য করা যায়। ধনসম্পদ আর অঢেল বিত্ত-বৈভবে পরিপূর্ণ পুন্ড্র-বরেন্দ্র অঞ্চলের ক্ষমতার মসনদের লোভে বিভিন্নমুখী প্রাসাদ ষড়যন্ত্র তাই ইতিহাসের সেই উষাকাল থেকেই আমরা লক্ষ্য করি। এর প্রথম প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় সেই আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমনের সময় যখন এই পুন্ড্র-বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে সুদূর পাঞ্জাবে গিয়ে এই মাটিরই এক সন্তান আলেকজান্ডারকে এই মাটি আক্রমণ করতে প্ররোচিত করেছিলেন।

যে বিশাল রাষ্ট্রদ্বয়ের শক্তি মোকাবেলার ভয়ে আলেকজান্ডার এতদঞ্চল আক্রমণের আশা পরিত্যাগ করেছিলেন সেই বিশাল রাষ্ট্রশক্তিকে সুকৌশলে এবং ছলে বলে হস্তগত করার কূট বাসনা নিয়ে প্রথম এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। আর তিনিই হলেন মৌর্য সাম্রাজের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে খ্যাত শ্রী চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। তাই শুধু মৌর্য সাম্রাজের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবেই নয় বরং জানা মতে এতদঞ্চলের প্রথম প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের হোতা হিসেবেও ইতিহাসে তিনি নিজের স্থান তৈরী করে নিয়েছেন। চন্দ্রগুপ্ত পৌন্ড্র জনপদের অর্ন্তভুক্ত মানুষ ছিলেন বলে অনেক ইতিহাসবিদ মত প্রকাশ করেছেন। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে হিমালয়ের পাদদেশে “মোরিয়” নামের একটি বংশে চন্দ্রগুপ্তের জন্ম।

এই মোরিয় বংশই পরে ইতিহাসে মৌর্য রাজবংশ নামে বিখ্যাত হয়েছিল। হিমালয়ের পাদদেশের এই এলাকাটি পুন্ড্রবর্ধনের সাথে যুক্ত ছিল। তাই নিঃসন্দেহে মৌর্যদের মূলতঃ পুন্ড্রজনপদবাসী বা পুন্ড্রজন হিসেবে অভিহিত করতে হবে। এ প্রসঙ্গে নীহাররঞ্জন রায় মন্তব্য করেছেন যে “বাংলার পৌন্ড্র জনপদ একসময় হিমালয়ের শিখর দেশ থেকে শুরু করে সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ”-৩ চন্দ্রগুপ্তের এহেন কার্যকলাপে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী বা মন্ত্রণাদাতা সংগী হয়েছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত বা কুখ্যাত কূটনীতিবিদ পন্ডিত চাণক্য বা কৌটিল্য।

তাদের যৌথ কার্যকলাপ সম্বন্ধে জনৈক ইতিহাসবিদ বলেছেন “আলেকজান্ডারের ব্যবিলন প্রত্যাবর্তনের পর কোনো এক সময়ে চন্দ্রগুপ্ত,কৌটিল্যের কূটনৈতিক প্রজ্ঞার সাহায্যে মহাপদ্মানন্দের প্রাচ্যরাষ্ট্র অধিকার করে মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মৌর্য সাম্রাজের স্থায়ীত্ব খ্রীঃ পূর্বঃ ৩২২ অব্দ থেকে খ্রীঃ পূর্বঃ ১৮৭অব্দ। ”-৪ এই কূটনৈতিক প্রজ্ঞা যে আসলে কৌটিল্য প্রদত্ত বিভিন্ন ষড়যন্ত্রমূলক এবং অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা তা সহজেই অনুমান করা যায়। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় যে সে সময় ঐ দুই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন নন্দবংশীয় মহাপদ্মানন্দের পূত্র উগ্রসেন। মহাপদ্মানন্দ শিশুনাগ বংশীয় রাজাদের উৎখাত করে খ্রীষ্টপূর্ব আনুমানিক চারশত(৪০০)বছর আগে ঐ দুই রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে সমাসীন হন।

সাধারনভাবে তার বংশ নন্দবংশ নামে পরিচিত ছিল। মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের সাথে নন্দরাজাদের কি সম্পর্ক ছিল তা নিশ্চিতভাবে জানা না গেলেও কোন কোন ঐতিহাসিক বিষয়টিকে নিম্নলিখিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন “চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন অতিশয় চতুর ও উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি। নন্দরাজ সম্ভবত তার ভয়ে ভীত হইয়া বা অন্য কোন কারনে বিরুপ হইয়া তাহাকে তাহার রাজ্য হইতে তাড়াইয়া দেন। ......স্বীয় দেশ হইতে বিতাড়িত হইয়া চন্দ্রগুপ্ত গ্রীক শিবিরে উপস্থিত হন এবং আলেকজান্ডারের সহিত সাক্ষাৎ করেন। নন্দবংশের উচ্ছেদ সাধনের জন্য তিনি আলেকজান্ডারের সাহায্য প্রার্থনা করেন।

কিন্তু আলেক- জান্ডার তাহার ধৃষ্টতায় রুষ্ট হইয়া তাহার প্রানদন্ডের আদেশ দেন। .....তিনি সেখান হইতে পলায়ন করিয়া আত্মরক্ষা করিলেন। নন্দবংশের উচ্ছেদ সাধনে চানক্য নামের একজন ব্রাহ্মন ছিলেন তাহার প্রধান সহায়ক মন্ত্রণাদাতা। চাণক্য ছিলেন একজন বিচক্ষন কূটনীতিবিশারদ। তাহার সাহায্যে চন্দ্রগুপ্ত নন্দবংশ ধ্বংস করিয়া মগধের সিংহাসনে আরোহন করেন।

”-৫ ঠিক বাংলা বলতে কোন জনপদ তখন অস্তিত্ববান ছিলনা। কিন্তু গঙ্গারিডাই বা প্রাচ্য রাষ্ট্রের সীমা পরিসীমা যাই হোকনা কেন এতদঅঞ্চলে পুন্ড্রবর্ধনই যে তার প্রধান এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল তার প্রমাণ পরবর্তীতেও পাওয়া যাচ্ছে। চন্দ্রগুপ্তের মৌর্য সাম্রাজের প্রধান কেন্দ্র পুন্ড্রনগরে দুর্ভিক্ষের সময় ধান,গন্ডক এবং কাকনিক মুদ্রা দিয়ে সাহায্য করবার জন্য সম্রাট কতৃক মহামাত্রের প্রতি নির্দেশে পুন্ড্রজনপদের গুরুত্ব প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৩১ সনে মহাস্তানগড় বা পুন্ড্রনগরে প্রাপ্ত এতদঅঞ্চলের সবচেয়ে প্রাচীন শিলালিপিতে তৎকালীন সম্রাটের ঐ আদেশনামা পাওয়া যায়। উল্লেথ্য যে আজ থেকে একান্ন বছর আগে ১৯৬১ সনে মহাস্থানের গোবিন্দ ভিটায় মাটির উপরিভাগ থেকে গভীরে মাত্র ২২/২৩ ফিট খনন করার ফলে একের পর এক অন্তত: সতেরটি সভ্যতা স্তরের চিহ্ন বেরিয়ে আসে এবং খননের ফলে প্রাপ্ত তথ্য থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় যে, খ্রীষ্টপূর্ব ৪র্থ শতকের পূর্বেই অর্থাৎ আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগেও সেখানে জনবসতি বিদ্যমান ছিল।

গঙ্গারিডাই এবং প্রাচ্য রাষ্ট্রের অধিপতি নন্দরাজাদের পুন্ড্র তথা বঙ্গের অধিবাসী বলে প্রায় সকল ঐতিহাসিকেরাই মত প্রকাশ করেছেন। এ প্রসংগে রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেছেন -“অধিকাংশ গ্রীক লেখকদের উপর নির্ভর করিয়া মোটের উপর এই সিদ্ধান্ত করা অসমীচিন হইবেনা যে, যে সময়ে আলেকজান্ডার ভারতবর্ষ আক্রমন করেন,সেই সময় বাংলার রাজা মগধাদি দেশ জয় করিয়া পাঞ্জাব পর্যন্ত স্বীয় রাজ্য বিস্তার করিয়াছিলেন। গ্রীক ও লাতিন লেখকগণ এই রাজার যে নাম ও বিবরণ দিয়াছেন তাহাতে অনেকেই অনুমান করেন যে, ইনি পাটলীপুত্রের নন্দবংশীয় কোন রাজা। ইহা সত্য হইলেও পূর্বোক্ত সিদ্ধান্তের বিরোধী নহে। কারণ নন্দরাজা বাংলা হইতে গিয়া পাটলীপুত্রে রাজধানী স্থাপন করিবেন ইহা অসম্ভব নহে।

পরবর্তী কালে বাঙালী পাল রাজাগণও তাহাই করিয়াছিলেন। ”-৬ এ প্রসঙ্গে নীহাররঞ্জন রায়ও একই মতামত প্রকাশ করেছেন যা পূর্বে আলোচনা করা হয়েছে। তার উদ্ধৃতি দিয়ে আকরম হোসেন বলেছেন -“দিয়েদোরস,কার্টিয়াস,সলিনাস,প্লুতার্ক,প্লিনি,টলেমী,স্ট্রাবো প্রমুখ লেখকদের বিবরণ পরীক্ষা করে প্রফেসর হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী গঙ্গারাষ্ট্রের পশ্চিম সীমা ভাগীরথীর পূর্বতীর বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সুতরাং গঙ্গারাষ্ট্রের ইতিহাস যে বঙ্গজনের ইতিবৃত্ত তাতে কোন সন্দেহ নেই। ”-৭ ঐতিহাসিকদের মতানুসারে গঙ্গারিডিরা তাহলে যদি আমাদের পুন্ড্র-বঙ্গ সমন্বিত এতদঞ্চলের পূর্বঅধিবাসী বা পূর্বপুরুষ হন তাহলে বাংলাদেশের মসনদের লোভে প্রথম ষড়যন্ত্র করেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

এবং শুধু তাই নয়,চাণক্যের কূটকৌশলের সাহায্য নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত তার ষড়যন্ত্রকে কামিয়াব করার জন্য নন্দরাজ্যে যে প্রচন্ড অর্ন্তঘাতমূলক তৎপরতা পরিচালনা করেন তাতে তিনি পরিপূর্ন সফলতাও লাভ করেছিলেন । চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্যের এই মিলিত ষড়যন্ত্র এতো বেশী শক্তিশালী এবং ভয়াবহ ছিল যে তার ফলশ্র“তিতে অতি অল্প সময়ের মধ্য যে সাম্রাজের শক্তি মদমত্ততায় ভীত হয়ে স্বয়ং আলেকজান্ডার তাকে করতলগত করার বাসনা ত্যাগ করেছিলেন সেই সাম্রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে পড়ে। এ প্রসঙ্গে বিস্মিত জনৈক ঐতিহাসিক মন্তব্য করেছেন “আলেকজান্ডার ভারত ত্যাগের মাত্র দুই বৎসর পর মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত নন্দবংশ ধ্বংস করিয়া সুবিস্তৃত নন্দসাম্রাজের উত্তরাধিকারী হইয়াছিলেন। ”- বিশাল নন্দ সাম্রাজ্য ধ্বংস করার মত রাজশক্তি চন্দ্রগুপ্তের ছিলনা। কাজেই আলেকজান্ডারকে এদেশ আক্রমণে প্ররোচিত করে ব্যর্থ হবার পর কৌটিল্য প্রদত্ত অর্ন্তঘাতমূলক তৎপরতাই ছিল তার প্রধান সম্বল।

এবং শেষ পর্যন্ত এই ভয়াবহ ষড়যন্ত্রে তিনি যে সম্পূর্ন সফল হয়েছিলেন ইতিহাসই তার সাক্ষী রয়েছে। --“চন্দ্রগুপ্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার জন্য মগধের রাজা নন্দকে হটিয়ে সিংহাসন দখল করেন। বাংলা ও বিহার এই দুই মিলেই তখন ছিল মগধরাজ্য। বর্তমানে পাকিস্থানের রাওয়ালপিন্ডির অর্ন্তভুক্ত একটি স্থান তক্ষশিলার অধিবাসী বিখ্যাত বুদ্ধিজীবি কৌটিল্য বা চানক্যের সহায়তায় চন্দ্রগুপ্ত মগধের ক্ষমতায় আসেন। ”-৯ পরিশেষে বলা যায় পুন্ড্রজনপদবাসী চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন আজন্ম ক্ষমতালোভী।

এতদঞ্চলের ক্ষমতা দখলের লোভে চন্দ্রগুপ্ত সুদূর পাঞ্জাবে গিয়ে আলেকজান্ডারের সাথে অনেক সাধ্য সাধনা করে দেখা করেছিলেন এবং এদেশ আক্রমণের জন্য প্ররোচিত করেছিলেন। আলেকজান্ডার এদেশ আক্রমণ করে অধিকার করলে যাবার সময় হয়তো তাকেই এতদঞ্চলের শাসনভার দিয়ে যাবেন এই আশাতেই হয়তো চন্দ্রগুপ্ত এদেশের মাটি ও মানুষের সাথে এহেন বেঈমানী ও ষড়যন্ত্র করেছিলেন। কিন্তু মহৎহৃদয় আলেকজান্ডার চন্দ্রগুপ্তের এহেন ষড়যন্ত্রমূলক প্রস্তাবে ক্ষিপ্ত হয়ে উল্টো তাকেই বন্দী করেন এবং প্রানদন্ডের আদেশ দেন। বহুকষ্টে পালিয়ে চন্দ্রগুপ্ত নিজের প্রানরক্ষা করেন। কিন্তু মসনদের মোহ তিনি কখনোই ত্যাগ করতে পারেননি।

এরপর তিনি সাহায্য লাভ করেন তৎকালীন বিখ্যাত বা কুখ্যাত বুদ্ধি জীবী চাণক্য বা কৌটিল্যের। এবং তারই পরামর্শে এতদঞ্চল এবং সমগ্র নন্দসাম্রাজ্যকে কেন্দ্র করে যে প্রচন্ড অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা পরিচালনা করেন সেই সমস্ত কূটকৌশলের পরিপ্রেক্ষিতে নন্দসাম্রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় এবং চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসন দখল করেন। বলা বাহুল্য তার এই অপতৎপরতায় সমধিক অবদান ছিল কৌটিল্যের। সেই জন্যই বোধহয় বাংলা প্রচলিত ভাষায় মন্দ কূটকারী লোককে আজো কূটিল হিসেবে অভিহিত করা হয়। এভাবে দেখা যায় পুন্ড্র- বরেন্দ্র অঞ্চলের অধিবাসী সীমাহীন ক্ষমতালোভী চন্দ্রগুপ্ত প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এবং মৌর্য সাম্রাজ্যের পত্তন ঘটান।

Click This Link http://www.amarblog.com/rajkomol/posts/144574 ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.