আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সন্তান

কিচ কিচ কুচ কুচ কাচ কাচ কোচ কোচ!!! তিন বছর আগের কথাঃ শরতের দুপুর। অন্যদিনকার মত আজকেও কিরণ ছড়াচ্ছে সূর্য। সে আলোয় আলোকিত হচ্ছে বিশ্ব চরাচর। অন্যদিনকার মত আজকেও বইছে মৃদুমন্দ উষ্ণ বাতাস। সে তাড়নায় মৃদু কাঁপছে গাছের সবুজ পাতা।

দিনটি সবদিক থেকেই অন্য যেকোনো দিনের মতই। দুঃখিত...ভুল বললাম। দিনটি অন্য অনেকের কাছেই সাধারণ একটি গুরুত্বহীন দিন হলেও একজন মানুষের কাছে এটি জীবনের কঠিনতম দিন। কারণ এই দিনে তাকে জীবনের কঠিনতম সিদ্ধান্তটি নিতে হবে। মানুষটি পায়চারি করছে হাসপাতালের করিডোরে।

তার মুখে অজস্র চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। হাঁটার মধ্যে প্রকাশ পাচ্ছে অস্থিরতা। কানে এখনও বাজছে ডাক্তারের সাথে কথোপকথন। -“আপনার স্ত্রীর অ্যাবনরমাল ব্লিডিঙ হচ্ছে। প্রেশার খুব কম...পালস আস্তে আস্তে ডিমিনিশ করছে...” -“আপনি শুধু বলুন ও বাঁচবে কি না...” -“আসলে মিস্টার, এরকম কেসে সেলফ রিকভারি না হলে আমাদের কিছু করার নেই...” -“অনর্থক বেশি কথা বলবেন না, ডাক্তার।

শুধু এইটুকু বলুন, বাচ্চা বা মা, কেউই কি বাঁচবে না?” -“আসলে...চেষ্টা একটা করা যায়, সেক্ষেত্রে বাচ্চাকে স্যাক্রিফাইস করতে হতে পারে...” -“আপনি বলছেন মাকে বাঁচাতে গেলে বাচ্চা বাঁচবে না?” -“আসলে...ব্যাপারটা সেরকমই...” আরও কিছু কথা বলেছিল যুবক ডাক্তার। কিন্তু ততক্ষণে মানুষটার ভাবনার জগতে শুরু হয়েছিল প্রবল আলোড়ন। আর কোন কথাই মাথায় ঢোকেনি তার। তারপর... প্রিয় পাঠক, ‘তিন বছর আগের কথা’র এখানেই শেষ। আমরা এখন মূল গল্পে চলে যাব।

মূল গল্পঃ সুন্দর একটি বাসা। সামনে ছোট একটি মাঠ। আর একটি ছোট বাগান। মাঠে খেলা করছিলো দুটি দেবোপম শিশু। আদৃতা আর রক্তিম।

ওরা জমজ ভাই-বোন। ওদের সামনেই ঘাসে পা ছড়িয়ে বসে ছিল লিলি। ওদের মা। আদৃতা আর রক্তিম একটা বল নিয়ে লোফালুফি করছিল। পৃথিবীর অন্য কোনও দিকে ওদের খেয়াল ছিল না।

আর ওদের প্রাণভরে দেখছিল লিলি। শুধু প্রাণভরে বললে পুরোটা বলা হবে না। সেই দৃষ্টিতে যে কি ছিল তা লেখকের পক্ষে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যদি বলা হয় লিলি তার সন্তানদের ‘ভালবাসে’, তবে কথাটা সম্পূর্ণ হবে না। সত্যি কথা বলতে গেলে, লিলি তার সন্তানদের প্রতি addicted. অনেকে বলেন, একজন মা তার সন্তানকে শুধু ‘সন্তান’ হিসেবেই ভালবাসেন।

সন্তান কালো কি সাদা, বধির কি অন্ধ, ছেলে কি মেয়ে, বাছবিচার করেন না। কিন্তু আমি মনে করি, ব্যাপারটা সত্যি নয়। লিলি তার সন্তানদের শুধু সন্তান হবার কারণে নয়, সুন্দর হবার কারণেও ভালবাসত। তার সারাদিন কেটে যেত সন্তানদের পিছনে। প্রথমে ব্যাপারটা এমন ছিল না।

এই ‘এক্সট্রা’ ভালবাসা জন্ম নিল তখন থেকে, যখন থেকে লিলি টের পেল জাহেদ তার সন্তানদের ঠিক পছন্দ করে না। অথবা সন্তানদের প্রতি লিলির ভালবাসা পছন্দ করে না। এবার জাহেদের কথা বলি। জাহেদ একজন ব্যস্ত মানুষ। সে অনেক বড় একটা কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে আছে।

তাকে বাসায় খুব কম সময়ই পাওয়া যায়। রক্তিমের বয়স যখন দু বছর, তখন ওর নিউমোনিয়া হল। সারাদিন সারারাত জেগে লিলি রক্তিমের দেখাশোনা করল। জাহেদ কতবার বলল, “যাও তুমি গিয়ে ঘুমাও”। অথবা, “এত কষ্ট করলে তোমারই তো অসুখ করবে”।

কিন্তু লিলি কোনও কথাই শুনল না। টানা তিন রাত জাগার পর জাহেদ এসে বলল, “ওকে আমার কোলে দাও”। কেন যেন লিলি জাহেদের কথা শুনল না। হঠাৎ জাহেদ রক্তিমকে লিলির কোল থেকে ছিনিয়ে নিল। তারপর বাচ্চাটাকে প্রায় ছুড়ে ফেলল বিছানায়।

লিলি চিৎকার করে উঠল। জাহেদ অগ্নিমূর্তি হয়ে বলল, “এই, চিৎকার করবা না, একদম চিৎকার করবা না”। লিলি আরও জোরে চেঁচিয়ে উঠল। জাহেদ হাত মুঠ করে বলল, “একদম খুন করে ফেলব”। লিলি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল।

জাহেদ এরকম পশুর মত আচরণ করছে কেন? তিন রাত না ঘুমানো ক্লান্ত লিলি আর কোন প্রতিবাদ করার শক্তি পেল না। জাহেদ রক্তিমকে কোলে নিয়ে চলে গেল। পাথরের মত কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকার পর লিলি চুপচাপ শুয়ে পড়ল। সাথে সাথে ঘুম। তখন থেকেই লিলির ধারণা হল জাহেদ তার সন্তানদের ঘৃণা করে।

আর তখন থেকেই লিলি তার সন্তানদের প্রতি ‘অতিরিক্ত’ ভালবাসা অনুভব করা শুরু করল। লিলি প্রতিদিন আরও বেশি সময় সন্তানদের সাথে কাটানো শুরু করল। তাদের যে কোনও ছোটখাটো সমস্যাতেও লিলির ঘুম হারাম হয়ে যেত। আর এসব দেখে জাহেদের আরও বেশি মেজাজ খারাপ হত। সকালে উঠে, বউ কোথায়? সারারাত সন্তানদের পিছে কাটিয়ে এখন লম্বা ঘুম দিচ্ছে।

দুপুরে বাসায় ফোন করে, বউ কোথায়? সন্তানদের গোসল করাচ্ছে। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে, বউ কোথায়? সন্তানদের গল্প বলছে। খাবার সময়, বউ কোথায়? সন্তানদের ঘুম পাড়াচ্ছে। শোবার সময়, বউ কোথায়? সন্তানদের পাশেই ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, লিলি কখনই তার সন্তানদের জাহেদের পাশে যেতে দিত না।

এমনকি চাইতো জাহেদ যেন ওদের মুখ ও না দেখে। কারণ তার ধারণা ছিল জাহেদ তার সন্তানদের ক্ষতি করবে। এই ধারণার পিছনে কোনও যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল না, তবুও। লিলির এরকম ব্যবহার জাহেদকে তাদের কাছ থেকে আরও দূরে ঠেলে দেয়। যতই দিন যায়, লিলি তত বেশি সন্তানদের প্রতি আকর্ষিত হয়।

ওদের হাঁটা চলা, কথা বার্তা, হাসি কান্না- সবকিছু লিলিকে প্রবল ভাবে আকর্ষণ করে। সারাদিনই তার ‘ছোট রাজকুমার’ ও ‘ছোট রাজকুমারী’র পিছে কেটে যায়। ওদের চেহারা দিন দিন সুন্দর হতে থাকে। মা বাবা - কারো মত নয়, ওরা নিজেদের রূপে ভাস্বর হতে থাকে। যে-ই দেখে, সে-ই বলে এমন সুন্দর বাচ্চা আর হয় না।

আর এসব শুনে লিলির হৃদয় গর্বে ফুলতে থাকে। সে আর বাচ্চাদের চোখের আড়াল করে না। আর দিন দিন জাহেদের সাথে তার ও বাচ্চাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। একদিন জাহেদ জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “তোমার কী হয়েছে বল তো”। লিলি অবাক হল।

“কী আর হবে”? “অন্যদেরও তো বাচ্চা আছে। তারা কিন্তু তোমার মত না”। “কী বলতে চাও তুমি?” “তেমন কিছুই বলতে চাই না। শুধু বলতে চাই, তুমি এক্সেস করছ”। “কী এক্সেস করছি?” “তুমি বাচ্চাদের পিছনে সারাদিন লেগে থাকো।

ওদেরও তো নিজের লাইফ বলে কিছু আছে, নাকি? সবসময় ওদের সাথে থাকার তো দরকার নেই। ওরা তো আর একদম পিচ্চি নেই যে সবসময় কোলে নিয়ে দুদু খাওয়াতে হবে...” “কী, কী বললে তুমি?” “বলেছি যে তুমি পাগলামি করছ। ওদেরও যে নিজের লাইফ বলে কিছু আছে এটা তুমি ওদের বুঝতে দিচ্ছ না। আর তোমার নিজেরও তো একটা লাইফ আছে, নাকি? তুমি কার মা এটা ঠিকই মনে আছে, কারও যে স্ত্রী সেটা বোধহয় ভুলে গেছ...” “ও...এই তাহলে ব্যাপার!!! তুমি তোমার সন্তানদের উপর জেলাস, তাই না? আমি সবসময় ওদের টাইম দিই, তাই তোমার ভাগে টাইম কম পড়ে যাচ্ছে, তাই না?” “ভদ্রভাবে কথা বল লিলি...” “হ্যাঁ, ভদ্র ভাবেই তো বলছি!! বাচ্চাদের সময় দিই এটা তোমার পছন্দ হয় না...তুমি চাও আমি সারাদিন তোমার পায়ের কাছে বসে থাকি...” “লিলি, তুমি পাগলামি করছ! আমি সেটা বলি নি”। “হ্যাঁ, বাচ্চাদের আর খাওয়ান যাবে না, গোসল করানো যাবে না, গল্প বলা যাবে না, তোমাকে খাওয়াতে হবে, সারাদিন তোমার ফোনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, তোমার জামাকাপড় কেঁচে দিতে হবে, তুমি কখন আসবে তার জন্য হা করে দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে...” “তুমি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ কিন্তু...” “আর রাতে তোমার সাথে ( অকথ্য )...” “লিলি!!!” ঠাস করে চড় মেরে বসল জাহেদ।

রাগে তার গা রি রি করছে। পরক্ষণেই অনুতাপে দগ্ধ হল সে। ভালবাসার সঙ্গিনীকে সে তো আগে কখনো মারে নি!!! লিলির রিআকশনটা হল একটু পরে। সে পাথরের মত মুখ করে এক দৃষ্টিতে জাহেদের দিকে তাকিয়ে রইল। সে দৃষ্টির তীব্রতায় জাহেদকে চোখ নামিয়ে নিতে হল।

“তুমি আর আমার সন্তানদের স্পর্শ করবে না”। “লিলি...” লিলি চলে গেল। থ মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকল জাহেদ। অফিসে অনেক কাজ। পারিবারিক ব্যাপার অফিসে টানলে হবে না।

তবুও পরদিন অফিসে গিয়ে তার মানসিক পরিবর্তনটা ধরে ফেলল তার জুনিয়র অফিসার। “স্যার, মন খারাপ?” “না”। “ভাবির সাথে কোনও...” “রহমান, তুমি যাও তো এখান থেকে...” প্রায় ধমকই দিল জাহেদ। রহমান নামের যুবকটি চলে গেল। আরও মেজাজ খারাপ হল জাহেদের।

কী করবে কিছুই বুঝতে পারলো না সে। ওদিকে লিলি আদৃতা আর রক্তিমের দিকে মনোযোগ আরও বাড়িয়ে দিল। তার কাছে মনে হতে লাগলো এই বাসা একটি কারাগার, সে আর তার সন্তানরা এর বন্দি। জাহেদ সেই কারাগারের প্রহরী। এই কারাগার থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় প্রহরীকে খুন করা।

লিলির ঘৃণা ও ভয় সঞ্চারিত হল তার সন্তানদের মাঝেও। আদৃতা আর রক্তিম জাহেদকে প্রচণ্ড ভয় পেত। জাহেদের কথা শুনলেই তাদের খাওয়া বন্ধ হয়ে যেত। জাহেদ আবার একদিন বলল, “তোমার সন্তানদের তুমি একদম কাছ ছাড়া করো না”। “তো?” “ধর কোনদিন যদি ওদের কেউ মারা যায়, তখন তুমি কিভাবে বাঁচবে?” “কেন? মারা যাবার প্রশ্ন আসছে কেন? তুমি...” “কেন, এরকম হতে পারে না?” “জাহেদ, তুমি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? তুমি কি ...” “হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ লিলি”।

হিস্টিরিয়াগ্রস্থ রোগীর মত পৈশাচিক হাসি দিয়ে জাহেদ বলল, “যাদের জন্য আমার প্রাণপ্রিয় স্ত্রী এখন আমার পাশে ঘেঁষে না, কথা বলে না, খবর নেয় না, আমাকে বন্য জন্তুজানোয়ার মনে করে, তাদের কি আমি মাথায় করে নাচবো?” এটুকু বলার সাথে সাথে লিলি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। দরজায় আদৃতা এসে দাঁড়িয়েছে। জাহেদ বলল, “কী দেখছিস তুই? কী দেখছিস?” আদৃতা ভয় পেয়ে কান্না শুরু করে দিল। রক্তিম কোথা থেকে এসে বোনের সাথে কিছু না বুঝেই কান্নায় যোগ দিল। বাড়ির কাজের বুয়া ময়নার মা কান্না শুনে ছুটে আসল।

এসে সবকিছু দেখে সে কী বুঝল কে জানে, সেও চেঁচামেচি শুরু করে দিল। সবকিছু দেখে জাহেদ তাড়াতাড়ি করে পাশের বাসার ভাবিকে একটা ফোন করল। তারপর সেই অবস্থাতেই বাইরে বেরিয়ে গেল। যেভাবেই হোক, একসময় সেদিনকার মত পরিবেশ ঠাণ্ডা হল। তারপর আরও দিন গেল।

রাত গেল। জাহেদকে নিয়ে লিলির ভয় বাড়তেই থাকল। কখন আমার সন্তানদের ও খুন করে বসে... কখন আমার সন্তানদের ও খুন করে বসে... কখন আমার সন্তানদের ও খুন করে বসে... Paranoia. পুরা paranoia. অবশেষে এল আজকের দিনটি। কাল রাতে একদম ঘুমায়নি জাহেদ। এই সপ্তাহে সে লিলির সাথে অসম্ভব ভাল ব্যবহার করেছে।

প্রতিদিন তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছে, লিলির খাওয়াদাওয়া, গোসল ঠিকমতো হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করেছে। বাচ্চাদের খবর নিয়েছে, আদরও করতে গিয়েছিল, লিলি তা সযত্নে প্রতিহত করেছে। ব্যাপারগুলো লিলিকে আরও সন্দেহের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আজকে কেন যেন জাহেদ অফিসেই যায় নি। সারাদিন ঘরে গোঁজ হয়ে বসে আছে।

লিলি তার সন্তানদের রেখে গোসল করতে যাবে কি না বুঝতে পারছিল না। হাজার হোক, মায়ের মন, তাও আবার paranoia-এ আক্রান্ত। শেষ পর্যন্ত লিলি ঠিকই গোসল করতে গেল। সেদিন কি এক অজ্ঞাত কারণে সে একটু বেশি সময় নিয়েই গোসল করল। আর মেয়েদের গোসল একটু বেশি সময় ধরে হওয়াই স্বাভাবিক।

বেরিয়ে আসার পরপরই সে ডাক দিল, “আদ্রি আম্মু...” সাড়াশব্দ নেই। হঠাৎ করে বুকের মধ্যে কেমন করা শুরু করল লিলির। ভেজা কাপড়গুলো ফেলে সে দৌড় দিল তার বাচ্চাদের রুমের দিকে। কেউ নেই। তারপর সে দৌড় দিল জাহেদের রুমের দিকে।

দেখে মাথা নিচু করে বসে আছে জাহেদ। “আমার বাচ্চা কোথায়?” ধীরে ধীরে মাথা তোলে জাহেদ। বলে, “লিলি, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে”। “আমার বাচ্চা কোথায়?” “লিলি, শান্ত হও। আমার কিছু কথা আছে, সেগুলো তোমাকে শুনতে হবে”।

“আমার বাচ্চাদের কি করেছ তুমি? কি করেছ?” “লিলি, আমি বলেছি আমার কিছু কথা আছে। আগে শান্ত হয়ে বস”। লিলি দৌড়ে টেলিফোনের কাছে গিয়ে পুলিশের নাম্বার ডায়াল করতে গেল। তখনি জাহেদ বলল, “লাইনটা আমি খুলে রেখেছি”। হাতের কাছে একটা ফুলদানি ছিল।

সেটা তুলে নিল লিলি। জাহেদের দিকে ছুটে আসল সে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ধস্তাধস্তি করতে হল জাহেদকে। ফলাফল, লিলির মাথায় আঘাত ও জ্ঞান হারানো। লিলির জ্ঞান ফিরল তিন ঘণ্টা পর।

উঠে সে প্রথমে কিছু মনেই করতে পারল না। অতঃপর আস্তে আস্তে তার সব কিছু মনে হতে লাগলো। সন্তানদের কথা মনে হতেই সে সারাবাড়ি জাহেদকে খুঁজল। পেলো না। বাসার বাইরে যেতে গিয়ে দেখল, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ।

চিৎকার শুরু করল লিলি। তার মনে অন্ধবিশ্বাস গেঁথে গেল, তার সন্তানদের খুন করেছে জাহেদ। এরপর তাকেও খুন করবে সে। পাগলের মত দরজা ধাক্কাতে লাগলো সে। কিন্তু, কেউ সাড়া দিল না।

আবার টেলিফোন সেটের কাছে আসল লিলি। খুঁজে খুঁজে বিচ্ছিন্ন হওয়া তারটা খুঁজে বের করল। তারপর সংযোগ দিয়েই কল করল পুলিশে। “আমি ... থেকে জাহেদ রহমানের মিসেস লিলি রহমান বলছি। আমার স্বামী আমার দুটো বাচ্চাকে খুন করেছে।

ও আমাকেও মারবে। আপনারা প্লিজ তাড়াতাড়ি আসুন...” জাহেদ যখন লিলির সাথে কী কী বলবে এই প্রস্তুতি নিয়ে বাসায় ফিরল, তখন দেখে পুলিশ তার জন্য বসে আছে। লিলি ওকে দেখেই চিৎকার করে বলল, “আমার বাচ্চারা কই?” জাহেদের চোখ ভিজে এল, কিন্তু পানি পড়ল না। “নেই”। জাহেদের কলার চেপে ধরে লিলি বলল, “নেই মানে? কোথায় আমার বাচ্চা?” জাহেদ ওদের বাগানের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাল।

লিলি বুঝল না। “কী বলছিস তুই? বাচ্চা কই?” জাহেদ কোনমতে ঠোঁট চেপে বলল, “কবরে”। পুরো রুমের সমস্ত মানুষ শিউরে উঠল। লিলি আবার জ্ঞান হারাতে শুরু করল। জ্ঞান হারাবার আগে কোনমতে সে বলে উঠল, “ক্যান খুন করলি আমার বাচ্চাদের? ক্যান করলি?????” চোখের সমস্ত পানি একসাথে বিসর্জন দিয়ে জাহেদ বলল, “আমাদের বাচ্চা মারা গেছে জন্মের আগেই।

সেটা আজ থেকে তিন বছর আগের কথা”। তিন বছর আগের আরেকটি কথাঃ হাসপাতালের করিডোরে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল জাহেদ। চোখের পানি বাঁধ মানছে না। এই মাত্র একটি মৃত সন্তান প্রসব করেছে তার ভালবাসার স্ত্রী লিলি। এমন সময় জুনিয়র অফিসার রহমান এসে তার কানে কানে বলল, স্যার, দশ নম্বর কেবিনে একটা মেয়ে জমজ বাচ্চা প্রসব করে মারা গেছে।

তার কোন আত্মীয়স্বজন নেই, সম্ভবত রেপড বা প্রতারণার শিকার। আমি বলি কি... অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে রইল জাহেদ। মনের মধ্যে কেমন একটা অস্বস্তি। কেমন একটা ভয়। রহমান আবার বলল, ভাবী যা সেনসিটিভ, হয়তো এই অবস্থা জানলে রিকভারই করতে পারবে না... অবশেষে ডিসিশনটা নিয়েই ফেলল জাহেদ।

পরম নির্ভরতায় আঁকড়ে ধরল জুনিয়র অফিসারের হাত। (গল্পটি আমার প্রিয় লেখক সিডনি শেলডনের 'Bloodline' উপন্যাস থেকে নেওয়া। অসম্ভব সুন্দর গল্পটি নিজের ভাষায় লিখে শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারলাম না। ) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.