আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সন্তান এবং কুকুর

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। সন্তান এবং কুকুর মোহাম্মদ ইসহাক খান কুকুর প্রাণীটাকে আমার এমনিতেই একদম পছন্দ নয়। তার ওপরে এই বৃদ্ধার পোষা কুকুরটার চেহারা কেমন বদখৎ, বিটকেল, দেখলেই ভয় লাগে।

কাজেই আমি পারতপক্ষে কাছে ঘেঁষি না, চেষ্টা করি এড়িয়ে চলতে। তা আর হয় কোথায়? একসাথে থাকি, কাছের পড়শিমানুষ। দরজা খুললেই চোখে পড়ে মিসেস মিলারের বাসা, অর্থাৎ যে বৃদ্ধার কথা বলছি। বুড়ির সারাক্ষণের সঙ্গী এই কুকুর, নাম রেমি। ধুমসো শরীর, বড় বড় হলদেটে লোমে আপাদমস্তক ঢাকা, ঝুলে পড়া অদ্ভুত চামড়া, বিশালদেহী কুকুরটা সারাদিন মিসেস মিলারের পাশে বসে বসে জিভ বের করে হাঁপায়।

ভেবেছিলাম, বৃদ্ধা যখন আমাকে ঘাঁটান না, আমিও তাঁর ছায়া মাড়াবো না। তার দরকারও তো নেই। দেশটাই এমন, কেউ কারো দিকে প্রয়োজন ছাড়া ফিরেও তাকায় না, যে যার কাজে ব্যস্ত, সবাই ছুটছে ডলার কামানোর পেছনে, অন্ধের মতো। এমন একটা দেশ, যেখানে ডলার ছাড়া কেউ একটা কাশিও দেয় না। এ দেশের আকাশে-বাতাসে টাকা উড়ছে বলে গুঞ্জন সবসময়ই শোনা যায়।

কাজেই অনেক স্বপ্নদর্শী যুবকের মতো আমিও পাড়ি জমিয়েছিলাম এই দেশে, আর এসে জুটেছিলাম মিসেস মিলারের ঠিক উল্টোদিকের ছোট্ট বাসাটাতে। সপ্তাহের পাঁচ দিন কাজে কেটে যায়, ভূতের মতো খাটুনি। উইকএন্ডে দুদিন ছুটি, ঘুমিয়েই বেশিরভাগ পার করে দিই। চারপাশটা ছবির মতো সাজানো, হাঁটতে বেরুলে বুক ভরে নেয়া যায় পরিষ্কার বাতাস। সব মিলে আমি বেশ সুখেই ছিলাম।

দেশে বলার মতো কেউ নেই, তাই নাড়ির টান বলে যে ব্যাপারটা থাকে, সেটা আর তেমন অনুভব করতাম না। বলেছিলাম যে একা একা, নিরিবিলিতেই থাকার মনোবাঞ্ছা ছিল। কিন্তু শত হলেও আমি যে বাঙালি। না খেয়ে থাকতে পারি, কিন্তু কথা বলতে না পারলে তো দম বন্ধ হয়ে আসে। কাজেই আমি স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মিসেস মিলারের সাথে ভাব জমাতে গেলাম।

আশেপাশে এমন কেউও ছিল না যে একটু মনের কথা বলবো, "গপসপ" করবো, কাজেই এই বৃদ্ধাই ছিলেন ভরসা। প্রথমদিকে একটু-আধটু ভয় ছিল, রাশভারী বুড়ি মানুষ, ধমক না দিয়ে বসেন। কিন্তু দেখলাম, তিনি বেশ দিলখোলা মানুষ, কথায় কথায় হাসেন, ভাল রসিকতা করতে পারেন, আর খুব সজ্জন। আমার একদিনের আলাপেই বেশ পছন্দ হয়ে গিয়েছিলো তাঁকে। ঘনঘন আসাযাওয়া শুরু করতে লাগলাম তাঁর বাড়িতে।

ক্রমে তাঁর অনেক কথাই জানতে পারলাম। মিসেস মিলার বিধবা। স্বামী গত হয়েছেন বহু বছর হয়। আর বিয়ে করেন নি। এই বয়সে তা আর সম্ভবও নয়।

তাঁর দুই ছেলে, এক মেয়ে আছে। তারা সবাই যার যার জায়গায় আলাদা থাকে। দুই ছেলে থাকে বোস্টন আর ফিলাডেলফিয়াতে, মেয়ে থাকে তার এক "পার্টনারের" সাথে, ক্যালিফোর্নিয়াতে এক বিলাসবহুল বীচ হাউজে। স্বামী বড় ব্যবসায়ী ছিলেন, মৃত্যুর আগে লেখাপড়া করে দিয়ে গিয়েছিলেন বেশ কিছু টাকাপয়সা, তাই মিসেস মিলারের রক্ষা, ঐ টাকার সুদে তাঁর খরচ চলছে। একা মানুষ বলে ঝক্কি কম, বেশ চলে যায়।

কিন্তু বয়স হয়েছে, প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিউমোনিয়া, হাঁপানি, বাতের ব্যথা জাতীয় অসুখবিসুখ। কিন্তু নিজের কাজ নিজেই করতে ভালোবাসেন। তাছাড়া বাড়িটা তাঁর নিজের, এটা নিয়ে গর্বই করেন, আমাদের দেশের মহিলারা যেমন "স্বামীর ভিটে" নিয়ে গর্ব করে থাকেন। পুরো বাড়িতে মিসেস মিলার ছাড়া আর কেউ থাকে না।

ভুল বললাম, মানুষ কেউ না থাকলেও থাকে ঐ বিরাট আকারের কুকুরটা। সে একাধারে মিসেস মিলারের সঙ্গী, সহচর, ভৃত্য এবং পাহারাদার। কাজে সহযোগিতার জন্য মিসেস মিলার কোন নার্স বা এমন কাউকে রাখেন নি। ছেলেমেয়েদের সাথে যোগাযোগ বলতে ক্রিসমাসের কার্ড আর দু'লাইনের চিঠি। কালেভদ্রে দেখা দেয় দুই ছেলের কোন একজন, এসেই পালাই পালাই করে, মায়ের কাছে মন টেকে না।

ছেলেদের ঘরের নাতি আছে দুটো, তাদের দেখতে আগে মন আনচান করতো মিসেস মিলারের, এখন কেন যেন সেই অনুভূতিও ভোঁতা হয়ে গেছে। এখন তিনি বাতের ব্যথায় বেশি কাতর, নাতিদের জন্য ব্যাকুল হয়ে লাভ কী? আর ছেলেদেরই বা দোষ দেন কী করে; শতেক চিন্তা আর মাথাব্যথা তাদের, নিজেদের জীবন আর ক্যারিয়ার নিয়ে, নিজেদের ছেলেপুলে মানুষ করা নিয়ে, একজন বুড়ো অথর্ব মা'কে নিয়ে চিন্তা করতে গেলে তো পিছিয়ে যেতে হবে। মিসেস মিলারের জীবন সাধাসিধে, রুটিন আর ছকে বাঁধা। সকালে উঠে কুকুরটার চেন হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন, প্রাতঃকালীন দূষণমুক্ত বায়ু সেবনের কাজটা সেরে বাড়ি ফেরেন। তারপর ব্রেকফাস্ট; টোস্ট আর মাখন, সাথে কফি।

তারপর উলের বল আর কাঁটা নিয়ে মাফলার বুনতে বসেন কিংবা বই পড়েন। দুপুরে খাওয়ার পর ঘণ্টাখানিক গড়িয়ে নেন, বিকেলে আবার হাঁটতে বেরোন। রাতে আবার বই পড়া, টিভি দেখা। রাত দশটার মধ্যেই খেয়েদেয়ে ঘুম। বুড়ো মানুষ, রাত জাগার কোন মানে হয় না।

খুব গোছানো স্বভাবের তিনি, বাড়ির ভেতরটা আমাকে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন তিনি, একটাও অপ্রয়োজনীয় জিনিস কিংবা জঞ্জাল নেই। এই করেই তাঁর দিনগুলো কাটছিল, তাতে আমি এসে ঢুকে পড়াতে প্রাত্যহিক কর্মতালিকায় একটু ছেদ পড়েছে বৈকি। এখন সন্ধ্যে কিংবা ছুটির দিনের সকালগুলোতে ঢুঁ মারি উনার বাড়িতে। উনি ভারী খাতির করেন আমাকে, নিজের ছেলের মতোই দেখেন, আজকালকার লোকজন যেমন অচেনা মানুষ দেখলেই দূর দূর করে আর সন্দেহের চোখে দেখে, তিনি মোটেই তেমন নন। উনাকে দেখে মনে হয়, সেকেলে মানুষগুলোই ভাল ছিল, এখন সব ভাল জিনিস আস্তে আস্তে পৃথিবী থেকে উঠে যাচ্ছে।

পুরনো আচার আর সংস্কার কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে কে জানে। মিসেস মিলারের সাথে গল্পে গল্পে কীভাবে যে সময় কেটে যায় টেরই পাই না। হোক না আমার গায়ের রং কালো আর উনার সাদা, হোক আমি বাঙালি আর তিনি আমেরিকান, ভাষা আর গায়ের রং সহ হাজারটা পার্থক্য থাকলেও "খেজুরে আলাপ" করার সময় বুঝি সব মানুষই একরকম হয়ে যায়। মিসেস মিলারের কুকুর রেমিকে দেখেও আজকাল আর এতটা ভয় খাই না। উনি আমাকে উনার জীবনের গল্প বলে শোনান, আমি উনাকে শোনাই বাংলাদেশের গল্প।

নদী, নৌকা, ধানক্ষেত, জোয়াল-লাঙলের গল্প। ইলেকশন, রাজধানী ঢাকা, গ্রামাঞ্চল, দেশের মানুষের গল্প। রিকশা, লুঙ্গি, মাছবাজারের গল্প। তিনি অবাক হয়ে শোনেন। কারণ, সব বিষয়েই যে তাঁর গল্প আর আমার গল্পের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য! কত কথা মিসেস মিলারের সাথে বলেছিলাম তার ইয়ত্তা নেই।

কিন্তু একদিনের কথা আমার আজীবন মনে থাকবে। সেদিন কথাপ্রসঙ্গে মিসেস মিলারকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, আপনি যে এই এতবড় বাড়িতে একা একা, ছেলেপুলে থেকে দূরে, শুধু একটা কুকুর নিয়ে থাকেন, আপনার খারাপ লাগে না? এখানে বলে রাখি, পশ্চিমাদের রীতি হল, বিশেষ আন্তরিক সম্পর্ক না থাকলে কেউ এভাবে পারিবারিক কোন বিষয়ে প্রশ্ন করতে পারে না, এটা অভদ্রতা বলে বিবেচিত হয়। আমি মিসেস মিলারের কোন আত্মীয় নই, রক্তের সম্পর্ক নেই, নিতান্তই একজন পরিচিত পড়শি মানুষ মাত্র। কিন্তু আজকাল আমাদের অন্তরঙ্গতা এতটাই গড়িয়েছে যে আমি তাঁকে যেকোনো বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করতে পারি, আবার উনিও আমাকে যেকোনো বিষয় নিয়ে নিঃসঙ্কোচে প্রশ্ন করে বসেন, কেউ কিছু মনে করি না। আমার প্রশ্ন শুনে মিসেস মিলার একটুক্ষণ থামলেন।

আমি কুণ্ঠিত হয়ে পড়লাম, ভাবলাম বুঝি একাকী বৃদ্ধা এই কথায় কষ্ট পেয়ে গেলেন কীনা। তবুও জিভ কেটে তাঁর জবাবের অপেক্ষায় বসে রইলাম। ভাবলাম, উটকো প্রশ্নটা করে ফেলার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেবো। কিন্তু না, তিনি বলে উঠলেন, আমার সন্তানেরা আমাকে দেখে না, বাবলু। তারা সবাই জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।

কিন্তু এই যে কুকুরটা, আমার পোষা রেমিকে দেখছ, সে ছোট্টটি থেকে আমার সাথেই আছে, সুখে-দুঃখে সবসময়। কখনো সে আমাকে ছেড়ে যায় নি। মৃত্যুর আগে যাবেও না। তাই আমার জন্য সন্তানের চেয়ে কুকুরই ভাল। মিসেস মিলার এই পর্যন্ত বলে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।

তাঁর অনেক বয়স হয়েছে, কথা বলবার সময় গলার স্বর কাঁপে, কিন্তু এই ভয়াবহ কথাগুলো (আমার কাছে ভয়াবহ বলেই মনে হয়েছে) বলার সময় তাঁর গলা একটুও কাঁপে নি। পশ্চিমা অনেক পরিবারেই পোষা প্রাণী প্রায় একজন ফ্যামিলি মেম্বারেরই মর্যাদা পায়। কিন্তু মিসেস মিলারের কাছে রেমি যে সন্তানের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছে, তা আমি জানতাম না। মিসেস মিলার নড়ে উঠলেন। পাশে বসে থাকা রেমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।

রেমি এখনো জিভ বের করে হাঁপাচ্ছে। বড়সড় লনটাতে মিষ্টি রোদ এসে পড়েছে, খুব আরাম লাগছে। কে জানে কেন, আমিও রেমি নামের কুকুরটির সূর্যালোকিত পিঠের দিকে তাকিয়ে রইলাম। কুকুরটি তখন চোখ বুজে মনিবের আদর উপভোগ করছে। ***** মিসেস মিলারের সাথে আমার বেশিদিন আর গল্প করা হয় নি।

এক শীতে তিনি মারা গেলেন, কাউকে কিছু না বলে। ঘুমের মধ্যে, বলা যায় যন্ত্রণাহীন মৃত্যু। আমি তাঁর কবরে গিয়ে ফুল দিয়ে এলাম। অনেকেই এসেছিলো, মায়ের মৃত্যুর খবর শুনে সুদূর স্টেটগুলো থেকে ছুটে এসেছিলো মিসেস মিলারের পুত্র, কন্যা, পুত্রবধূ, নাতি দু'জন - সবাই। শেষ বিদায় জানানোর আনুষ্ঠানিকতায় কোন ত্রুটি হল না।

সবাই মিস্টার জর্জ মিলারের স্ত্রী মিসেস কার্লা মিলারকে কবরস্থ করেই আবার যার যার ঘরে ফিরে যাবেন। স্বামীর পাশেই সমাহিত করা হল তাঁকে। ফুলে ফুলে ছেয়ে গেল কবরটি। মিসেস মিলারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় আমিও উপস্থিত ছিলাম। এমন হঠাৎ করে তিনি চলে যাবেন, আমি ভাবতেও পারি নি।

আমার দেখা দশজন ভাল মানুষের নাম করতে বললে আমি অবশ্যই মিসেস মিলারের নাম বলবো। কালো কোট পরে যখন এসে দাঁড়িয়েছিলাম, তখন গির্জার প্রাঙ্গন যেন শোকের ছায়ায় ঢাকা ছিল। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় আমার পাশে গুম হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে ছিল রেমি। কাঁদে নি সে, গোঙায় নি, শুধু ওর হলদেটে দুই চোখে গভীর বেদনা দেখেছি। মনিবের জন্য নয়, পুরনো বন্ধুর বিয়োগের বেদনা।

আমি রেমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। আমার মতোই বেচারা একা হয়ে পড়েছে। আজকাল সে বড় একটা খেতে চায় না, আমাকে বেশ সাধ্যসাধনা করে খাওয়াতে হয়। রেমি আমার বেশ বাধ্য হয়ে গেছে। মিসেস মিলারের সম্পত্তি দ্রুতই লেখাপড়া করে ভাগাভাগি হয়ে গেল, আইনসম্মতভাবে।

কোন ঝামেলা হল না। সবাই "জাস্ট ডিস্ট্রিবিউশনে" খুব সন্তুষ্ট হয়েছেন বলে মনে হল। আমাকে সবাই ব্যক্তিগতভাবে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছেন, এই বৃদ্ধার শুভানুধ্যায়ী ছিলাম বলে। আমার মন প্রায়ই খারাপ থাকে, গল্প করার সঙ্গীকে হারিয়েছি, তাই। আবার আমার একা জীবনে ফিরে গেছি।

বিকেলে সেই বেঞ্চটাতে গিয়ে বসে থাকি, যেটাতে রেমির চেন ধরে মিসেস মিলার বসে থাকতেন। মিসেস মিলারের বাড়িটা বিক্রি করে দেয়া হবে, তারপর নাকি সেটা ভেঙে ফেলা হবে শোনা যেতে লাগলো। জিনিসপত্রগুলো নিলামে তোলা হবে, সেগুলো বিক্রয়ের টাকাও ভাগাভাগি হবে। নতুন একটা জিনিস আবিষ্কার করেছি। প্রায়ই দেখি, রেমি একা একা মিসেস মিলারের কবরের কাছে গিয়ে বসে আছে।

চারদিকের নীরবতাকে আরও প্রকট করে তুলছে সে। আমি তখন বুকের ভেতর একটা ভার অনুভব করি। (২৭-২৮ জানুয়ারী, ২০১৩) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.