আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ন্যায্য হিস্যা প্রতিবন্ধীর অধিকার

আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস ন্যায্য হিস্যা প্রতিবন্ধীর অধিকার নাদিমুল হক মণ্ডল | আজ ৩ ডিসেম্বর, জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস। প্রতিবন্ধিতা ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও মর্যাদা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, গ ৎবাঁধা নেতিবাচক ধ্যান-ধারণার পরিবর্তন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের ভবিষ্য ৎ কর্মপদ্ধতি ও পরিকল্পনা নির্ধারণের প্রত্যয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠন এবং সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে দিবসটি পালন করা হচ্ছে নানাবিধ কর্মসূচির মাধ্যমে। ৩০ বছর আগে ‘পূর্ণ অংশগ্রহণ এবং সবার জন্য সমতা’র আহ্বান নিয়ে জাতিসংঘের উদ্যোগে পালিত হয়েছিল প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী বর্ষ। এই ৩০ বছরে বিশ্বজুড়ে প্রতিবন্ধীদের অধিকার বিষয়ে সচেতনতা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে, তেমনি তৈরি হয়েছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারের মর্যাদা, সম্মান, সুরক্ষা ও সংবর্ধনের যুগান্তকারী এক দলিল ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ সনদ’। ইতিমধ্যেই বিশ্বের ১৫৩ দেশ এই সনদে স্বাক্ষর ও ১০৭ দেশ এই সনদে অনুস্বাক্ষর করেছে।

আরও নতুন নতুন দেশ স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষরের প্রক্রিয়ায় আছে। ইতিবাচক এক পরিবর্তনের যাত্রায় নিঃসন্দেহে অনেকদূর এগিয়েছি আমরা। এ বছরের আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসের প্রতিপাদ্যে সবার জন্য আরও বেশি মঙ্গলময় এক বিশ্ব তৈরিতে ‘উন্নয়ন’-এ সম্মিলিত উদ্যোগ এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি ও অংশগ্রহণের প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে দিবসটি সামাজিক কাঠামো ও অনুশীলনের পরতে পরতে প্রতিবন্ধিতা ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধ্যান-ধারণার আমূল উচ্ছেদ এবং অন্যায্যতা ও বৈষম্যের যে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ ঘটেছে রাষ্ট্রযন্ত্র ও ‘উন্নয়ন’ কাঠামো, ডিসকোর্স ও বিভিন্ন নীতিমালায় সেসবের ব্যবচ্ছেদ ও উ ৎপাটন—এ দুই ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলে আমি মনে করি। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর অধিকার লঙ্ঘনের বাস্তবতা খুব নিষ্ঠুর ও নির্মম।

প্রতিবন্ধীদের বড় অংশ সম্পত্তির অধিকারবঞ্চিত, দারিদ্র্যের হার তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, স্বাস্থ্যসেবা দুর্লভ আর শিক্ষা ও চাকরির পথে পথে রয়েছে পর্বতসংকুল প্রতিবন্ধকতা। সেই সঙ্গে রয়েছে নেতিবাচক ধ্যান-ধারণা ও শোষণ, নিপীড়ন ও বৈষম্যের আধিপত্যবাদী ও ঔপনিবেশিক মনোবৃত্তি। এ প্রসঙ্গে একটি নির্মম ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। অতিদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও মধুসূদন চক্রবর্তী নামের চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের এক প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী পড়াশোনায় ছিলেন অসামান্য সফল। বাবা-মা জায়গা-জমি বিক্রি করে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন নিয়ে পড়াচ্ছিলেন মধুসূদনকে।

উচ্চমাধ্যমিক পাস করে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তিও হয়েছিলেন মেধাবী এই শিক্ষার্থী। কিন্তু শুরু থেকেই সহপাঠী ও শিক্ষকদের নেতিবাচক মনোভাব ও অসহযোগিতার মুখোমুখি হয়ে পড়াশোনা না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে বাবার কাছে তিনি লম্বা এক চিঠি লেখেন। বাবা বিষয়টি নিয়ে শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেন। শিক্ষকেরা আশ্বস্ত করেন, আর কোনো সমস্যা যেন না হয় সেদিকে তাঁরা খেয়াল রাখবেন। কিন্তু তাঁরা কথা তো রাখেনইনি, উল্টো প্রতিবন্ধিতা নিয়েও মেডিকেল কলেজে পড়ার দুঃসাহস নিয়ে তিরস্কার করেন।

সেই সঙ্গে পরীক্ষায়ও বৈষম্যমূলকভাবে কম নম্বর দেওয়া হয়। ২০১০ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আবার যখন পুরো ক্লাসের সামনে তাঁকে হেনস্তা করা হয়, আর সইতে পারেননি মধুসূদন। হোস্টেল ছেড়ে তিনি একটি হোটেলে রুম ভাড়া নেন এবং সেখানেই বিষপানে আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার চিরকুটে এই নিপীড়নের বৃত্তান্ত তিনি ধরিত্রীকে জানিয়ে গিয়েছিলেন। অবজ্ঞা ও অবহেলা এখনো নিরন্তর সঙ্গী আরও অনেকের।

এখনো দেশের ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রে শতাধিক মানসিক অসুস্থ এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি এক নিকষ কালো আইনের জালে ‘ভবঘুরে’ আখ্যায়িত হয়ে বছরের পর বছর ধরে বন্দী জীবনে বাধ্য হচ্ছেন, বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদাগুলোর যেখানে নেই ন্যূনতম সংস্থান। ঢাকায় যখন গণতন্ত্র, মানবাধিকার কিংবা মুক্তিযুদ্ধের আবেগঘন উদ্যাপন চলে তখন রাজধানীর অদূরের এই ভবঘুরে আশ্রয়কেন্দ্রের চার দেয়ালে ‘মুক্তি’র আকুতি ডুকরে কাঁদে। বিগত চার দশকে বিশ্বজুড়ে তথাকথিত ‘পরজনপ্রীতি’ বা ‘চ্যারিটি’ থেকে ‘অধিকার’ ও ‘ক্ষমতায়ন’-এ ‘উন্নয়ন’-এর এক মৌলিক রূপান্তর ঘটেছে। তবে বাস্তবতা হলো প্রতিবন্ধিতা এবং প্রতিবন্ধীদের ক্ষেত্রে রাষ্ট্র, ‘উন্নয়ন’ সংস্থা ও ‘উন্নয়ন’ সহযোগীরা রূপান্তরের তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগ ঘটিয়েছেন খুব কমই। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ সনদের ৩ নম্বর ধারায় সমাজে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের পূর্ণ অংশগ্রহণ ও কার্যকর একীভূতকরণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে।

ধারাটি একই সঙ্গে ‘উন্নয়ন’ কৌশল ও কর্মসূচির প্রতিটি স্তরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিতের তাগিদ দেয়। দেশে দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের যোগ্য নেতৃত্ব ‘উন্নয়ন’ বয়ান ও অনুশীলনের এই এক্সক্লুশনারি প্রবণতাকে জোরালো চ্যালেঞ্জ করেছেন ও করছেন প্রতিনিয়ত। ‘পুনর্বাসন’ কর্মসূচির নিষ্ক্রিয় গ্রাহক হিসেবে প্রতিবন্ধীদের দেখার যে লেন্স ‘উন্নয়ন’-কর্তারা চোখে দিয়ে বসেছেন, তার বিপরীতে প্রতিবন্ধীরা দাবি তুলেছেন ‘উন্নয়ন’ কার্যক্রমে পূর্ণ, ন্যায্য ও সমান অংশীদারির। সিভিল সোসাইটি, ‘উন্নয়ন’ সংস্থা, ‘উন্নয়ন’ সহযোগী, গণমাধ্যম ও সরকারের কাছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনগুলো সুস্পষ্ট দাবি তুলছে উন্নয়নের প্রতিটি স্তরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করার। আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসে তাঁরা সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, সবার অংশগ্রহণ, প্রবেশগম্যতা ও ন্যায্য হিস্যা ব্যতিরেকে ‘টেকসই উন্নয়ন’ অসম্ভব।

‘উন্নয়ন’-এর মূল স্রোতধারায় প্রতিবন্ধিতার কার্যকর একীভূতকরণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংগঠনগুলোর একটি অন্যতম প্রধান দাবি। আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও তাদের সংগঠনগুলোকে অবশ্যই সুযোগ দিতে হবে অধিকার প্রতিষ্ঠা ও ‘উন্নয়ন’-এর সব কর্মসূচির নেতৃত্ব দেওয়ার। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের এই সমানাধিকারের দাবি শুধু প্রতিবন্ধীর নয়, একই সঙ্গে এটি অপরাপর অসাম্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে একটি বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণেরও ন্যায্য দাবি। নাদিমুল হক মণ্ডল: নৃবিজ্ঞানী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য। প্রথম আলো, তারিখ: ০৩-১২-২০১১, link: Click This Link ) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.