আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চলতি পথে গুঞ্জন

যে জানেনা এবং জানে যে সে জানেনা সে সরল, তাকে শেখাও। যে জানেনা এবং জানেনা যে সে জানে না, সে বোকা-তাকে পরিত্যাগ কর। লোকটি দরজা দিয়ে বাসে উঠলেন হেলপারকে সরিয়ে অনেকটা জোর করে। চিটাগাং রোড টু টঙ্গী রুটের ট্রান্স সিলভা। শাহাবাগ, মৎস্য ভবন পার হয়ে বাসটি থেমেছিল প্রেসক্লাব মোড়ে।

টিকেটধারী কিছু যাত্রী নামবে এবং কিছু উঠবে। আজ বড় দিনের ছুটি বিধায় যাত্রীর ভিড় কম। লোকটির হাতে পুরাতন এবং নোংরা একটি ফাইল। ফাইলের ভিতর একগাদা কাগজপত্র বুঝা যায়। ফাইলের উপরে প্রেসক্রিপশনের দুটি পাতা উঁকি দিচ্ছে।

বাস চলতে শুরু করেছে। দরজা লাগোয়া পাইপটা শক্ত করে ধরে ঝাঁকুনি সামলে একটু গুছিয়ে নিলেন বোধহয়। তারপর বিনীত কন্ঠে সালাম দিলেন সবাইকে। ঔষধ বিক্রেতা লেকচারারদের মতো নয়। অনেকটা আহাজারি ভঙ্গীতে- আস সালামু আলাইকুম, সম্মানিত স্যাররা, স্যার, স্যার, আমি ওমুক প্রাইমারী স্কুলের একজন সহকারী শিক্ষক ছিলাম।

আমি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে আজ প্রায় দুই বছর পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। আমার আরও সত্তুর হাজার টাকা লাগবো। উনচল্লিশ হাজার টাকা যোগার করছি। আপনারা দশজন যদি দুই চাইর টাকা করে দেন তাইলে আমি বাচমু…স্যারগো, স্যার, দুই চাইরডা টাকা দ্যান। মাঝখানে আবার কিছুটা ইংরেজিতে বললেন- স্যার, আই এম নট এ বেগার।

আই ওয়াজ এ প্রাইমারি স্কুল টিচার। আই এম ভেরি হেল্পলেস নাউ…ইত্যাদি ইত্যাদি। নিত্যকার বাস যাত্রীরা এই ধরনের সাহায্যপ্রার্থী দেখে দেখে অভ্যস্ত বিধায় কেউ তেমন একটা গা করে না লোকটির করুণ আকুতিতে। এই বাস থেকে একটি টাকাও পায়নি। বাসের এ প্রান্ত ও প্রান্ত হেঁটে এই বাসের কারও করুণার উদ্রেক করতে পারেন নি।

বিষণ্ন বদনে নেমে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। লোকটি নেমে গেলেন। বাসের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হলো- ‘এই ধান্ধাওয়ালা লোকটারে আমি ছয় মাস আগে মিরপুরের এক গাড়িতে দেখছি। রুট চেঞ্জ করছে। ‘ ‘কত ধান্ধাবাজ যে বাইর হইব।

ঐ কন্ডাক্টর, বাসে তোমরা এইসব লোক উঠতে দিবা না। নাকি তোমাগো লগে কানেকশন আছে?’ ‘ভাই এই ধান্ধাবাজগো বাসের লগে কানেকশন থাকে না। প্রতি রুটে নির্দিষ্ট লোক থাকে। হেরাই জোর কইরা বাসে নেওনের লাইগ্যা লাইনম্যানগো চাপে রাখে। ‘ভাই দেশটাই এখন জোর যার মুল্লুক তার।

যে যেমনে পারতাছে জোর জবরদস্তি কইরা লুইটা পুইটা খাইতাছে। ‘ ‘একজন প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক যদি হইয়াও থাকে ভিক্ষা করতে হইব ক্যান? সরকার দিতে পারে না?’ ‘ভাই প্রাইমারী স্কুলের বেতনের কথা বইলেন না। যেই বেতন পায় তারচেয়ে রিকশাওয়ালারাও অনেক বেশি ইনকাম করে। ‘ ‘হেগো আর দোষ কি! সরকারই যেখানে ভিক্ষা কইরা চলতাছে সেখানে হেরা তো করবই। দেশে ধনী একটা বাড়লে ভিক্ষুক বাড়ে এক লাখ।

‘ ‘হ ভাই, ঠিক কইছেন। এই এক লাখ গরীবরে চুইষা ভিক্ষুক বানাইয়া এহরপর একজন ধনী হয়। কথাডা বড় পছন্দ হইছে। ’ এর মধ্যেই আরেক স্টপেজে এসে বাস থেমেছে। বাসে এক মহিলা উঠেছে।

হাতে নামাজ শিক্ষার বই। মহিলার বেশভূষায় মনে হয় নগরের সাথে অনেকটা পরিচিত। ভদ্র ভাষায় তিনিও শুরু করলেন- আস সালামুআলাইকুম, সম্মানিত যাত্রীবৃন্দ। আমি আপনাদের কাছে কোনো ভিক্ষা চাইতে আসিনি। আমি এসেছি এই নামাজ শিক্ষা বইটি বিক্রি করতে।

আমি একসময় গার্মেন্টসে চাকরি করতাম। এক এক্সিডেন্টে আমার পিঠে ব্যাথা পাই। তারপর থেকে ভারী কোনো কাজ করতে পারি না। তাই এই সম্মানজনক পেশাটা বেছে নিছি। আমার একমাত্র ছেলেটার ক্যান্সার।

আইজ দুই বছর চিকিৎসা চলছে। আরও সত্তুর হাজার টাকা লাগবে ঔষধ খরচ বাবদ। আপনারা দশজন দশটাকা করে বইটি কিনলে আমার ছেলের চিকিৎসা করাইতে পারবো। দশ টাকা দিয়া বাড়ি গাড়ি করা যায় না। আপনারা বইটি না কিনলেও বোনরে দশটি টাকা দিয়া সাহায্য করুন।

দশটাকা নিয়া বড়লোক হওয়া যায় না। আপনারা আমার এই অসুস্থ ছেলেটির চিকিৎসার জন্য দয়া করে সাহায্য করুন…। কাকুতি মিনতি করে জনে জনে প্রতি বাসযাত্রীর কাছে তিনি নামাজ শিক্ষা বইটি নিয়ে গেলেন। একজন দয়াপরবশত কিনলেন। মহিলাটি বাস থেকে নেমে যাওয়ার পর গুঞ্জন উঠলো- ‘আগেরজন কি এই মহিলার ছেলে নাকি! ক্যান্সার চিকিৎসার টাকার অংকটা যে এক হইল।

সত্তুর হাজার টাকা। ‘  ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।