আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চলতি পথে ভালবাসা

shamseerbd@yahoo.com
প্রেম বিষয়টা বিশাল এক ফ্যান্টাসীর জগৎ বলে মনে হয় মেহেদীর। মানুষের যে কত ভাবে প্রেম হতে পারে গল্প উপন্যাস আর বাস্তবে দেখে সে সম্বন্ধে তার একটা ব্যাপক ধারনা তৈরি হয়েছে । এর মাঝে চলতি পথে প্রেম এই বিষয়টা তার বেশ পছন্দ হয়েছে। এই নিয়ে তার ফ্যান্টাসীর জগৎ টাও ছোট নয়। মোটামুটি প্রতিটা যাত্রার আগে এই ফ্যান্টাসী কিছুটা করে হলেও তার মাঝে যে ভর করেনা তা নয়।

কিন্তু হায় মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক- এটাই জগতের নিয়ম, আর তাই মেহেদীর ও হয়না চলতি পথে ভালবাসার দেখা পাওয়া । এমনই চলমান অবস্হায় হঠাৎ করে একদিন হয়ে গেল ব্যতিক্রম। প্ল্যাটফর্ম এ দাঁড়িয়ে আছে মেহেদী ঢাকাগামী ট্রেনে উঠার অপেক্ষায় । হঠাৎ এক বন্ধুর ডাকে পিছন ফিরল, মেডিকেলে পড়ুয়া বন্ধু । সে ঢাকা যাবেনা, তার কিছু বান্ধবী ঢাকা যাচ্ছে সে জাস্ট সি অফ করতে এসেছে।

বান্ধবীদের সাথে মেহেদীর পরিচয় করিয়ে দিল বন্ধুটি। অন্য কামরায় তাদের আসন। নজরকাড়া কাউকে চোখে পড়লনা-তাই তার ভাবনায়ও তেমন গত্যন্তর হলনা। নিজের সিটে গিয়ে বসল সে। ট্রেন ছাড়ার আগে আগে তার বন্ধু এসে হাজির।

দোস্ত আমার ফ্রেন্ডরাত একা যাচ্ছে, তোর আপত্তি না থাকলে ওদের সাথে গিয়ে বসতে পারিস । অন্য লোকের সাথে সিট বদলিয়ে বন্ধুই সব ব্যবস্হা করে দিল। অমন আহামারী কেউ না, লুকোছাপা করে, আঁড়চোখে তাকানোর কোন দরকার পড়লনা । গল্প হল তিনজনের সাথেই- এই সেই আরও কত কিছু নিয়ে। রাত্রীকালীন ভ্রমন।

একসময় সবাই ঘুমিয়ে পড়ল। কন্যারা মনে দাগ কাটার মত তেমন কিছু ছিলনা, তাই তার ঘুমাইতে খুব একটা প্রবলেম হলনা। বিধাতার খেলা বোঝা বড় দায়, তার মনে যে কি আছে, তিনি যে কখন কি ঘটাবেন তা শুধু তিনিই জানেন। দিবসের প্রথম প্রহরটা আসলেই সুন্দর, অন্তত মেহেদীর তাই মনে হল। হালকা সূর্য্যের আলো যখন চোখে পড়ে ঘুম ভেঙ্গে গেল, ঘুম ঘুম চোখ খুলে অমন সুন্দর সে এর আগে কখনও চোখে দেখেনি।

রিয়া তখন জানালা দিয়ে মাথাটা সামান্য বের করে বাইরে তাকিয়ে আছে- সোনালী আলোকচ্ছটা তার ফর্সা মুখটাকে যেন আরও রঙ্গীন করে তুলেছে। মেহেদী চোখ ফেরাতে পারছেনা। চিত্রশিল্পী হলে কি ছবি আঁকত মনে মনে তাই ভাবছে। সে ছবিটাই তার মনের ভেতর গেঁথে গেল। বিমানবন্দর স্টেশনে নামার পরও সে বারবার পিছন ফিরে চেয়েছিল সে দৃশ্যটা যদি আরেকবার দেখা যায় এই ভাবনায় ।

তারপর তাই হল যেমনটা সবার ক্ষেত্রে হয়। বন্ধুর থেকে নাম্বার সংগ্রহ করে শুরু হল রিয়ার সাথে ফোনে কথা বলা। কথা বাড়তে থাকে-তার অনুভূতিও গাঢ় হতে থাকে। যেটা বাড়েনা সেটা হল মেয়েদেরকে তার বোঝার ক্ষমতা । এই জিনিসটা তাকে দিয়ে আর হলনা।

কথা বাড়ে, তার মাঝে একবার দেখা ও হয়, একই শহরে থাকলেও শুধু মোবাইলেই কথা হয়। ভাল লাগাটা বাড়তে থাকে, আর কোচিং করিয়ে পাওয়া টাকা গুলোও প্রতিদিন হাওয়ায় উড়ে যেতে থাকে । মানুষ কি অত কথা বলে এই ভাবনাটা এখন আর তার মাঝে কাজ করেনা। কি দিয়ে ভাত খাওয়া হল থেকে শুরু করে, রিয়া যে কত ভাল চা বানাতে পারে সেটাও জানা হল। কথায় কথায় রিয়াও জানায় একদিন তাকে চা বানিয়ে খাওয়াবে, সে কথা যেন ভাবনার পালে নতুন হাওয়া এনে দেয়।

এভাবেই চলছিল, মেহেদী যা বলতে চাইছিল সে কথাটা আর বলা হয়ে উঠেনা। একটা ব্যাপার সেও খেয়াল করেছিল রিয়া কখনো তাকে ফোন করেনা, মিস কল ও দেয়না, কিন্তু সে ফোন করলে যে বিরক্ত হয় অমন ওনা-গল্প করেই যেতে থাকে। সে ফোন করা কমিয়ে দেয়, রিয়াও তাকে নক করেনা...............থাক মেহেদীর এই গল্প আর বলে লাভ নেই, এক সময় থেমে যায় সে। কাহাতক আর একতরফা দাঁড় টেনে চলা । লেগে থাক পাগল, লাইগ্যা থাকলে পাবি- বন্ধুদের এই ধারনার সাথে সে তাল মিলাতে পারেনা, স্বতঃস্ফূর্ততার অভাব তাকে পীড়া দেয়- আই কুইট শব্দটাই তার পছন্দ হয়।

এরপর অনেক দিন ভ্রমনে আর কোন সহযাত্রীনির সাথে আর তার দেখা হয়নি। পরবর্তী ঘটনা তার বন্ধুদের আড্ডার ব্যাপক আনন্দের খোরাক। সাত বন্ধু যাচ্ছিল ট্রেনে। টিকেট কাটার পর থেকেই আড্ডায় আলোচনা সপ্তম সিটে কে বসবে। সবার ই ভাবনা ইস কোন ঐশ্বরিয়া যদি পড়ত ঐ সিটে ।

যাত্রার দিন একটু দেরী করে পৌঁছানোয় ঐ সিটে গিয়ে বসল সে। পাশের সিটটা তখনও খালি। সবাই যেন অপেক্ষায় কে আসে সেটা দেখার। তাদের ভাবনার বেলুনটা ফুটো করে দিয়ে সে সিটে এসে বসল অন্যসিটে বসা একপরিবারের গৃহপরিচারিকা । বাকীরাত মুখ টিপে হাসতেছেত হাসতেছেই ।

মেজাজ ব্যাপক চড়ে গেল মেহেদীর। ব্যাগ থেকে হেড ফোনটা বের করে কানে দিয়ে সে গান শোনা আরম্ভ করে দিল। ঐদিকে বন্ঢুরাত সব হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। মাঝে মাঝে তাকায় আর একটা ধরা খাওয়া হাসি দিয়ে সে আবার চোখ বন্ধ করে গান শুনতে থাকে। মজার ব্যাপর হল পুরা জার্নিতে তার বন্ধুরা কেউ আর নিজের সিট ছেড়ে উঠার সাহস পেলনা।

এমনিতে একসাথে গেলে নিজের সিট বলে কিছু থাকেনা, কিন্তু এইবার কেউ আর সিগারেট খেতেও যাচ্ছেনা। যদিও পরে সুযোগ পেলেও সে তার নিজের সিটে ছিল-ভাবখানা এমন এটা কোন ব্যাপার হল, পাশের সিটে কে তাতে আমার কি, আমার জার্নি আমি করতেছি। তবে এই যাত্রা বন্ধু মহলে তাকে ক্ষ্যাপানোর একটা ভাল সুযোগই তৈরি করে দিয়েছে, যদিও সে এটা গায়ে মাখেনা। তারপরও ব্যাপারটা এমন না যে চলতি পথের ভালবাসার প্রতি তার আগ্রহ কমে গেছে। তবুও সে অপেক্ষায় থাকে।

এ অপেক্ষায় সর্বশেষ ঘটনা হয়ে রইল এক ট্রাজেডী হয়ে । "চলতি পথে যাদুকর ভালবাসা, প্রেমিক ডাকাতের মত তোমায় ছিনিয়ে নেবে" জেমসের এই গানটার একটা চিত্রায়ন তার মনের আকাশে সব সময় ছিল, তবে ঐ ট্রাজেডীর পর এ ধরনের সব ভাবনায় সে পরিত্যাগ করেছে। চট্রগ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরছিল ভলভো বাসে করে মেহেদী। রাতের যাত্রা , তাও আবার বাসে, তাই কোন সহযাত্রীনির আশা সে করেনি। সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে সে বাসে উঠল।

তার পাশের সিটে একটা মেয়ে বসে আছে দেখে সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারলনা ঐটা তার সিট কিনা। আরেকবার কাউন্ট করে দেখল ঐটা তারই সিট। জানালার পাশে তার সিট। সে বসতে যাবে কিন্তু ঐ মেয়ে সে যাবার জন্য পাটা সরাচ্ছেনা। মেজাজটা শুরুতেই খিছড়ে গেল তার, এ কোন অভদ্রের পাশে সারা রাত জার্নি করতে হবে ভেবে, উপরন্তু তার সিটে মেয়েটার হাত ব্যাগ রাখা।

মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সে বলল ঐটা আমার সিট। মেয়েটার ঘাড় ত্যাড়া জবাব তো কি হইছে। সে যেন আকাশ থেকে পড়ল । ব্যাগটা হাতে নিন, আমি বসব , কথাটা বলতে না বলতেই মেয়ের জবাব আগে সিটের কাছে যান । একরকম মেয়ের পায়ের উপর দিয়েই সে নিজের সিটে বসল।

সমবয়সী একটা মেয়ের এমন অশোভন আচরনে তার মেজাজ প্রায় আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যাচ্ছিল। নিজেকে শান্ত করে সে হেডফোনটা কানে লাগিয়ে চোখ বুজল, সকালে বাস থেকে নেমে অফিসে যেতে হবে এই ভাবনা মাথায় নিয়ে। কিছুক্ষন পরে হঠাৎ করে বাম কানের হেড ফোনটা কে যেন ঝাটকা মেরে খুলে দিল। সে অবাক হয়ে চোখ খুলতেই ঐ মেয়ে বলল গাইড কে টিকেট দেখান । মেহেদীর চোখ প্রায় বিস্ফোরিত, এ কার পাল্লায় পড়ল সে, এ কোন ধরনের আচরন।

কি বলবে সে কিছু বুঝতে পারছেনা। পরের কাউন্টারে বাস থামায় সে নীচে নেমে এল, জোড়ে টেনে একটা সিগারেট শেষ করল । বাসে উঠে সে এদিক ওদিক তাকাল কোন সিট ফাঁকা আছে কিনা। না আজ কোন সিট ই খালি নেই। নিজের সিটের কাছে এসে সেত আরও অবাক, সেই মেয়ে এখন টার সিটে বসে আছে।

জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে টাকাতেই মেয়ে বলল আমি জানালার পাশে বসব । মেহেদীর রাগের মাত্রা ঠিক কত ছিল সে বুঝতে পারছেনা, মনে মনে গজগজ করছে একি, এ কোন ধরনের মেয়েরে বাবা !!!!! কিছু করার নেই, বাধ্য হয়েই তাকে এখন মেয়েটির সিটে বসতে হবে, বাসে সিনক্রিয়েটের কোন মানে নেই। ইচ্ছা করছে একটা কষে ঝাড়ি লাগাতে, সেটা সে পাড়লনা। ভদ্রভাবে বললে সে সিট এমনিতেই ছেড়ে দিত, এটা চান্স পেয়ে বসে যাবারত কোন ব্যাপারনা। সিটে বসতে বসতে সে দু সিটের মাঝখানের হাতলটা নামিয়ে দিল, হাতলে হাত রেখে আরামে একটা ঘুম দিবে এই ভাবনায়।

সে হাত রাখতে যাবে এমন সময় দেখে ঐ মেয়ে সে সিটে হাত রেখে দিয়েছে। সে কি করবে ঠিক করতে পারছেনা। চুপচাপ সিটে বসে চোখ বন্ধ করল। নরমালি রাতের যাত্রায় সে জুতা মোজা খুলে একটা আরামের ঘুম দেয়। আজ এই বিটকেলে সহযাত্রীনির পাল্লায় পড়ে সে এই কাজ করার সাহস পেলনা।

তার মোজায় নরমালী কোন গন্ধ নেই সে জানে। মনে মনে সে শিউর সে জুতা খুললেই এই মেয়ে একটা সিনক্রয়েট করে বসবে। তটস্হ এবং মেজাজ খারাপ করা একটা অনুভূতি নিয়ে সে শক্ত হয়ে বসে রইল। ঘুম আসছেনা, অপেক্ষায় কখন এই জার্নি শেষ হবে। মনে মনে ভাবছে চলতি পথে মানুষের কত প্রেম হয়ে যায়, আর আমার একি হল, শান্তির ঘুমটাও নস্ট হয়ে গেল।

একসময় শেষ হল নির্ঘুম এক প্যাথেটিক জার্নির। আজকের অফিসটা কেমন যাবে কে জানে । বাস থেকে নেমেই সে আকাশ পানে তাকিয়ে স্বগোতোক্তি করল , হে আল্লাহ আমার চলতি পথে হয়ে যাওয়া প্রেমের কোন দরকার নাই, আমি শান্তিময় ভ্রমন চাই । চলতি পথে যাদুকর ভালবাসা প্রেমিক ডাকাতের মত তোমায় ছিনিয়ে নেবে তুমি লুটপাঠ হয়ে যাবে...... লুট হয়ে যাওয়া ঘুমের জন্য তার মনটা খারাপ হয়ে গেল । ।


 


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।