আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডাস্টবিন

যা লিখি, হয়ত কিছুই লিখি না। যা লিখব হয়ত অনেককিছুই লিখব। আসল কথা হলো, গল্প ছাড়া কিছুই লিখতে পারি না আমাদের বাসার পাশে থাকা উৎকট গন্ধ ছড়ানো ডাস্টবিনটি একদিন চুরি হয়ে গেলে কিংবা বলা যায় গায়েব হয়ে যাওয়াতে আমরা সবাই খুব অবাক হই এবং কিছুক্ষণের মাঝে বুঝতে পারি এই অবাক হয়ে যাওয়াটা আনন্দে পরিণত হচ্ছে। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারে ডাস্টবিনের আশেপাশে থাকা সকল বাড়িতে এক-ই ধরনের আনন্দের হিল্লোল বয়ে যাচ্ছে। প্রাথমিক উচ্ছ্বাস থেমে গেলে আমি গিয়ে জানালাটা খুলে দেই।

দীর্ঘদিনের পঙ্গুত্তে জানালাটি নবজাতক শিশুর মতো কেঁদে ওঠে, মেঠোপথে ধুলোর ঝড় ওঠার মতো করে ধুলো উড়ে, আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। সূর্যের আলো এসে ঘরে ঢোকে। কৃত্রিম আলোয় আচ্ছাদিত হয়ে থাকা ঘরটি প্রাকৃতিক স্পর্শে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, জোছনা বলে ভ্রম হয় আমার। আমি দু হাত ছড়িয়ে দেই, যেন নদীতে গোসল করব, শুদ্ধ হবো। খাটে শুয়ে থাকা নাঈমাকে দেখি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আর সঙ্গে সঙ্গে আমার ভ্রম ভেঙ্গে যায়।

কাল্পনিক পরিবেশ বাস্তবের সাথে সাংঘর্ষিক। বাস্তবের সন্দেহাতীত সত্য নাঈমার বিস্মিত চোখ আমাকে বলে দেয় ভ্রম থেকে বের হয়ে আসতে এবং তাকে হেসে বলতে, ডাস্টবিন চুরি হয়ে গেছে, তাই জানালাটা খুলে দিলাম। আমি ভেবেছিলাম সে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠে দাঁড়াবে, আমার পাশে এসে জানালার গ্রিল ধরে বলবে, আরে তোমাদের বাসার এ পাশে পুকুর আছে জানতাম না তো। হতাশ হই যখন দেখি নাঈমা বিরক্ত হয়ে বলছে, আজ ছুটির দিন, ঘুমোতে দাও, জানালা বন্ধ করো। এটা অবশ্য নতুন না।

আমি যা বলি, যা ভাবি নাঈমা ঠিক তার উল্টোটা করবে। অবশ্য ওর দিক দিয়ে চিন্তা করলে আমি উল্টোটাই ভাবি ও বরং সোজাভাবে চিন্তা করে। যাই হোক, আমি বিষণ্ণমনে ঘর থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দেখি বাবা পেপার হাতে নিয়ে উদাস দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। ঠিক রাস্তার দিকে না, কারেন্টের তারে বসা কাকের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে। অনেকদিন পর সকালবেলা বাবার সাথে দেখা হলো।

বুঝতে পারলাম না, এটা কী তার রোজকার রুটিন কি’না। একবার ভাবলাম বাবাকে জিজ্ঞেস করি, কী দেখ? কিন্তু প্রশ্নটা অবান্তর হয়ে যায় যেখানে আমি নিজেই দেখছি বাবা কাক দেখছে। সুতরাং বাবাকে একা থাকতে দেওয়াটা বুদ্ধিমানের কাজ ভেবে চুপচাপ বের হয়ে মা’র রুমে যাই। মা আমাকে দেখে উঠে বসলেন। সাতসকালে আমাকে দেখে বুঝি কিছুটা অবাক আর সংশয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,কিছু হয়েছে বাবা? আমি হেসে বললাম, ডাস্টবিন চুরি হয়ে গেছে, বাড়ির পাশে এখন কেউ ময়লা ফেলবে না।

জানালা খুলে রাখতে পারবে। মা অবাক হয়ে তাকালেন। বললেন, ডাস্টবিন চুরি হবে কেন? হয়ত সিটি করপোরেশনের লোক এসে নিয়ে গেছে। না, তা হয় নি। সিটি করপোশনের লোক এসেই ডাস্টবিন খুঁজে না পেয়ে সকালে এসে চেঁচামেচি শুরু করল, আমি বের হয়ে দেখি এই অবস্থা।

এখন আর নাক চেপে বের হতে হবে না। আমি তো বের হই না। মা’র অবাক হওয়া কন্ঠ আরো অবাক শোনায়। তাই তো তুমি বের হবে কেন? আচ্ছা বাবা কী প্রতিদিন সকালে এভাবে বারান্দায় বসে থাকে? মা কি যেন ভাবতে থাকেন। ভাবতে ভাবতে বললেন, ডাস্টবিন চুরি হয়ে গেল? আজকাল ডাস্টবিন চোর এসে গেছে? মা কে অনেক আনমনা লাগছে।

কী প্রশ্ন করলাম আর কী উত্তর দিল? মা’কে ভাবতে দিয়ে আমি উঠে চলে আসি। কাজের লোক মাত্র নাস্তা বানাচ্ছে। বাইরে থেকে নতুন এলাকাটা হেঁটে আসা যায়। মানুষের প্রতিক্রিয়াও জানা যাবে। আমাদের বাড়িতে এখনো সেই পুরোনো কেঁচি গেট।

ডেভেলাপাররা ঘুরছে পেছন পেছন কিন্তু দাম দিচ্ছে না ঠিকমতো। বাবাও রাজি না। এখন হয়ত পরিস্থিত বদলাবে। গেট খোলার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ হয়। বাবা ডাক দিয়ে বললেন, কে এলো? কেউ না, বাবা আমি বাইরে যাচ্ছি।

ডাস্টবিন চুরি হয়েছে, দেখে আসতে যাই। কিছুক্ষণ দাঁড়াই আমি। কিন্তু বাবার কোনো উত্তর আসে না। আবার কী কাক দেখায় ব্যস্ত হয়ে গেছেন? এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল অথচ বাড়ির কারো কোনো মাথাব্যথা নেই কেন? কাক দেখতে হবে? ঘুমোতে হবে? কে চুরি করেছে এটা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে? সবাই কেমন রসহীন হয়ে গেছে, যাচ্ছে। আমার বের হতেই সানিয়ার কথা মনে পড়ে যায়।

বেশ ক’দিন যাওয়া হয় না ওর বাড়িতে। ওর জন্য সেদিন ধানমন্ডির সুইট ড্রিম থেকে অনেক সুন্দর একটা নাইট ড্রেস কিনে পাঠিয়ে দিয়েছি। আজ যেতে হবে। কেমন মানিয়েছে দেখতে । ফোন করে বলেছিল, পছন্দ হয়েছে।

আমার সামনে পড়ে আসার জন্য অপেক্ষা করছে। আজ যেতেই হবে, ভাবতে ভাবতে আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ি। এখন-ই চলে যাব নাকি? আমি দ্রুত আবার ঘরে এসে ঢুকি। নাঈমা এখনো ঘুমোচ্ছে। ওর কাপড় বিশ্রীভাবে উপরে উঠে আছে।

দেখতে খুব বাজে লাগছে। জেগে থাকলেও আজকাল ওকে ভালো লাগে না। এক-ই শরীর আর কতদিন ভালো লাগে? শরীর ঝুলে গেছে এই অল্প কদিনেই, বিছানাতে বড় বেশী শীতল। আই লাভ ওয়াইল্ডনেস। অন্যদিকে, সানিয়া কী অসাধারণ! ও না থাকলে যে আমার কী হতো।

হঠাৎ করেই টের পেলাম নাকে হালকা গন্ধ লাগছে। আশ্চর্য ডাস্টবিন ফিরে এলো নাকি? আমি দৌড় দিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে দেখি, না ফিরে আসে নি। হাঁফ ছেড়ে বাঁচি কিন্তু সানিয়ার বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছেটা মরে যায়। লাভলু ভাই, কী অবস্থা? অনেকদিন পরে দেখলাম। কেউ একজন ডাকে আমাকে।

চিনতে পারি না। চিনবই বা কীভাবে? এলাকায় বের হলাম কতদিন পর তার হিসেব নেই। কোনোমতে দু একটা কথা বলে হাঁটতে থাকি। যেখানে ডাস্টবিন ছিল সেখানে এসে দাঁড়াই। ক’জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।

তাদের মুখে কোনো বিস্ময় নেই, যেন এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করতে থাকি সকাল থেকে ঘটে আসা ঘটনাগুলো। নিরুত্তাপ রাত্রি শেষে ঘুমোচ্ছিলাম। নাঈমাকে ডেকেছিলাম, এলো না, সরে গিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে থাকল। কিছুটা রাগারাগির পর ঘুমটাকে অনেক প্রার্থিত মনে হচ্ছিল।

ছুটির দিন তাই সারা সকাল ঘুমাবার প্ল্যান ছিল। সকালে হঠাৎ হৈ-চৈ শুনে বাইরে বের হয়ে দেখি ডাস্টবিন নেই, দুগর্ন্ধ নেই, আর সিটি করপোশনের লোকেরা এলাকাবাসীকে দোষারোপ করছে। নিরাপদ দূরত্বে থেকে সব শুনে বাড়ি ফিরে জানালা খুলে দিলাম। কিছু অর্থহীন সময় পার করে এখন আবার ভবঘুরে। ফুরফুরে মনে এখন মাঝ সকালের রোদ্দুর বিষণ্ণতার ছায়া দিতে শুরু করে।

আমি কী এমন জীবন চেয়েছিলাম? # রোদ আমাকে বলেছিল উষ্ণতার কথা, বলেছিল লাভলু চোখের জলের স্যাঁতস্যাঁতে ভাব তোমার দেখতে হবে না। মাঝ বিকেলের পড়ন্ত সূর্য বার্তা পাঠিয়েছিল, তোমার ক্লান্তিগুলো নিয়ে ডুবে যাচ্ছি, তুমি নতুন করে সতেজ হয়ে নাও। রাত আমাকে শিখিয়েছিল কিভাবে অন্ধকারকে ভালোবাসতে হয়। আমি এখন রোদ এলে দৌড়ে পালাই। অফিসের এসিতে বসে বলি, বাইরে বড্ড গরম পড়েছে।

মাঝ বিকেলে রাস্তায় জ্যামে আটকে থাকি আর খিস্তখেউড় করতে থাকি, রাত এলে ঘুমিয়ে পড়ি। নাঈমার সাথে প্রথম পরিচয়টা একদম-ই অপ্রত্যাশিত ছিল। বইমেলার গেট দিয়ে বের হচ্ছি। নবীন লেখক, প্রথম বই বের হয়েছে। স্টলের এককোণায় বইটি পড়ে আছে অবহেলায়।

এই যে শুনছেন, আপনার বইটি আমার কাছে চমৎকার লেগেছে। তাই? হুম। আরো ভালো লেগেছে প্রেম বিষয়ক উপন্যাস না। একটু ডিফারেন্ট। এইভাবে শুরু হলো।

চলতে শুরু করল নতুন চাকায় পুরোনো জীবন। আমার লেখালেখি যেখানে ছিল তার প্রধান আগ্রহ। আজ কোনো গল্প লিখলে না? নাহ,খুব টায়ার্ড ছিলাম। আর আমার কথা শুনে নাঈমা খুব রাগ করত। আমি হাসতে হাসতে পকেট থেকে বের করে দিতাম ওকে নিয়ে লেখা কয়েক ছত্র পক্তিমালা।

ওর হাসিতে আমার সমস্ত জগত শূণ্য হয়ে যেত। আর এখন হাসে না বলে চারপাশে শূন্যতা খেলা করে। এখন আমি গল্প লিখতে বসি না দেখে নাঈমা আর রাগ করে না। এখন আর তাকে নিয়ে কোনো কবিতা লেখা হয় না, গল্প বানানো হয় না। ক’দিন আগে এক সাহিত্য সম্পাদকের ফোন পেয়ে গল্প লিখতে বসেই শুনলাম,আবার শুরু করেছে।

লিখে আমার মাথা উদ্ধার করে ফেলবে। আমি সম্পাদক কে ফোন করে জানাই, শরীরটা খুব খারাপ। আমাদের বিছানায়, ঘরের দেয়ালে, জানালার পাশে ইউক্যালিপটাসের ধারে খেলা করত আদর। তখন সময়টা ছিল মাতাল করা। এখন বুঝি তাই সব লেথার্জিক,মিয়ম্রান।

ভালোবাসা শক্তির নিত্যতা সূত্র মেনে চলে। ডাস্টবিন কেন চুরি হলো? এখন আমাকে জানালা খুলতে হবে, চাঁদ দেখতে হবে; সেই চাঁদ,বিগতযৌবনা চাঁদ। আবার কী আমার অন্ধকারকে ভালবাসতে হবে? আমাকে রোদের করা প্রতিজ্ঞার কথা, মাঝ বিকেলের আহবানের কথা, রাতের সৌন্দর্যের কথা মনে করিয়ে দিল? হঠাৎ খেয়াল করি এই ডাস্টবিন ঘিরে আমার মতো ক’জন বিষণ্ণ মানুষ। তাদের ও কী আমার মতো লেখক হবার কথা ছিল? মানুষ হবার কথা ছিল? মনে হলো, ডাস্টবিন থেকে বের হওয়া দুর্গন্ধে আমাদের মৃত আত্মার লাশের গন্ধ এতদিন চাপা পড়ে ছিল। এখন সেটা তীব্র হয়ে অন্তরের নাকে গিয়ে লাগে।

রাস্তা ভাসিয়ে দেই বমি করে। দেখতে পাই স্বপ্নগুলোর ফসিল বের হয়ে যাচ্ছে, রাস্তা বেয়ে ড্রেন এ পড়ে হারাতে থাকে তারা। আমি এখন স্বপ্নহীন মানুষ, জীবনের ভারবাহী পশু। # বাড়ি ফিরতেই সানিয়ার ফোন পাই। আর নাকে এসে লাগে তীব্র দুগন্ধ।

ফোন কেটে দিয়ে ঘরজুড়ে চেঁচাতে শুরু করি। জানালা বন্ধ করো,জানালা বন্ধ করো। বাবা এসে বলে,জানালা বন্ধ। কতদিন পর বাবা নিজ থেকে এসে কথা বললেন আমার সাথে? টের পাই, আমার শরীর কাঁপছে শীতে। সম্পর্কের শীতলতা? ঠান্ডা আর গন্ধে আমি অচেতন হতে থাকি।

আমার কাউকে ভালো লাগে না, বাবাকে না, মা’কে না, নাঈমাকে না, সানিয়াকে না। আমি বহু আগে মরে গেছি, পচে গেছি। অজ্ঞান হয়ে যাবার ঠিক আগমুহূর্তে টের পাই, কেউ একজন বলছে, এজন্যই বলেছিলাম ডাস্টবিন চুরি হওয়াতে খুশি হবার কিছু নেই,কিছু থাকে না, বেঁচে থাকার জন্য আমাদের কেবল একটু আড়াল দরকার হয়। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।