আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইরানের দিনগুলো - ৬

ইরানের দিনগুলো - ১ ইরানের দিনগুলো - ২ ইরানের দিনগুলো - ৩ ইরানের দিনগুলো - ৪ ইরানের দিনগুলো - ৫ ইমাম খোমেনীর বাড়ি থেকে ফেরার সময় বেশ কিছু রাস্তা হেঁটে এসে বাসে উঠতে হয়েছিল। এই রাস্তাটা বেশ ঢালু ছিল। আসার সময় উঠতে গিয়ে তেমন একটা টের পাওয়া যায়নি, কিন্তু এখন নামার সময় দেখা গেল ঢালুর পরিমাণ একেবারে কম না। আমি ভয়ে ভয়ে ছিলাম কখন না পিছলে সটাং হয়ে যাই। অবশ্য তাতে একটা লাভ হত, সবার আগে তাড়াতাড়ি বাসের কাছে পৌঁছে যেতে পারতাম।

যা হোক কোন দুর্ঘটনা ছাড়াই জায়গামত পৌঁছে বাসে উঠতে পারলাম। পিছলে পড়ার এই ভয়ের কারণটা পরে বলব নে। আমার কাছে তো ক্যামেরা ছিল না। একদিন দুপুরে লাঞ্চের পর আমাদেরই এক প্রতিযোগী আমাকে তার ক্যামেরা দিয়ে বলল, আজকে সকালে আমাদেরকে সুন্দর একটা পার্কে নিয়ে গিয়েছিল, তোমাদেরকেও নিশ্চয়ই বিকালে নিবে, ছবি তুলে নিও। আফসোস, ঐদিন আমাদেরকে একটা মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে ছবি তোলা নিষেধ।

একদিন আমাদেরকে একটা মাদ্রাসায় নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে মাদ্রাসার ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা কুরআন তেলাওয়াত করে শোনাল, হামদ-নাতও হল। এরপর হঠাৎ করে আযান দিয়ে নামায পড়া শুরু হল। তখনও যোহরের ওয়াক্ত হয়নি। আমি বুঝতে পারছিলাম না।

পাকিস্তানী ক্বারীয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কিসের নামায। সে বলল, ওরা শিয়া যে, শিয়াদের নামাযের সময় তো আমাদের মত না। জানলাম ওরা নামায পড়ে তিন বার, সূর্যোদয়ের আগে ফজরের নামায, দুপুরের আগেই জোহর আর আসরের নামায একসাথে, রাতে মাগরিব আর ইশার নামায একসাথে। আমরা সুন্নীরা পাশে বসে রইলাম। তবে কিছু দেশের প্রতিযোগী বুঝতে না পেরে তাদের সাথে নামাযে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

একদিন আমাদেরকে শপিং-এ নিয়ে যাওয়া হল। একটা মাঝারি ধরণের মার্কেটে গেলাম। এতদিন বাস থেকে রাস্তার দুই পাশে কত সুন্দর সু্ন্দর দোকান দেখেছি। এই মার্কেট সেই তুলনায় তেমন সুবিধার না। যা হোক, আমরা তো আর চিনি না।

যেখানে নিয়ে এসেছে সেখান থেকেই শপিং করব। ঘুরে ঘুরে দেখছি, কিন্তু আমার শপিং-এর অভ্যাস নেই বলে বুঝতে পারছিলাম না কী কিনব। আব্বার জন্য কয়েকটা আংটি নিলাম। তার মধ্যে একটা খুবই সুন্দর, মাঝখানে একটা বড় রুবি, আর দুইপাশে ছয়টা করে ছোট ছোট ফিরোজা পাথর বসানো। আব্বার আঙ্গুলের মাপ তো ছিল না, আমার বুড়ো আঙ্গুলের মাপে কিনলাম।

একটা কালোর উপর সাদা বুটিওয়ালা হেয়ার ব্যান্ড কিনলাম ছোট বোনের জন্য। সে সময় তার খুব শখ ছিল এসবের। ছোট ভাইয়ের জন্য খেলনা খুঁজছিলাম। কিন্তু এই মার্কেটের খেলনার দোকানগুলো দেখে পুরোপুরি হতাশ হলাম। আমাদের দেশের কোন গ্রামের মেলাতেও এর চেয়ে ভালো মানের খেলনা পাওয়া যায়।

কাপড়ের দোকানে গিয়েও পছন্দমত কিছু পেলাম না। ইরানী মেয়েরা জিনস আর টি-শার্ট পরে। ঐ জিনিস তো আর আমি কিনব না। বোরকাগুলো সুন্দর ছিল। ওগুলোর দাম আরও সুন্দর ছিল।

আমাদের আরেকজন প্রতিযোগী আমাকে বলল এখানে নাকি মেয়েদের মোজা ভালো পাওয়া যায়, আমাকে বারবার কেনার জন্য তাগিদ দিচ্ছিল। বিরক্ত লাগছিল, আরে বাবা আমি মোজা কিনব কি কিনব না সেটা তো আমার ব্যাপার। আর কিছুই কেনা হল না আমার। খালাম্মা খুব শপিং করলেন। জায়নামায, ইরানী পারফিউম, তার মেয়েদের জন্য স্কার্ট-টপস।

আমি সামান্য যাও কিছু কিনেছি, আমার রুমমেট কিছুই নিল না। শপিং-এর ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতা আমার চেয়েও করুণ। আফসোস! আফসোস! সবার আগে মার্কেট থেকে বের হয়ে এলাম আমরা। বাসে উঠব, কিন্তু বাসের দরজাটা খুলতেই পারছিলাম না। ড্রাইভার পাশেই হাত-মুখ ধুচ্ছিল।

তাকে ডাকতে সে ইশারায় বোঝানোর চেষ্টা করল কিভাবে দরজা খুলতে হবে। আমি তাও পারলাম না। অগত্যা সে নিজেই এসে খুলে দিল। বেশ কিছুক্ষণ পর সবাই একে একে বের হয়ে বাসে উঠল, সবার হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ। প্রতিযোগিতা যখন শেষ, আমাদের আরও তিনদিন পর দেশে ফেরার ফ্লাইট।

আমাদের সবাইকে এবার নিয়ে যাওয়া হবে তেহরানের বাইরে, মাশহাদ শহরে, ইমাম রেজা-র মাজারে। রাতের বেলা ফ্লাইট। সকালে লদান এসে জানাল, আমরা যদি বিশ্রাম নিতে চাই তাহলে নিতে পারি। আর যদি বের হতে চাই তাহলে আমাদের নিয়ে একটা কারুশিল্প একাডেমীতে নিয়ে যাবে, সেখানে কাপড় কেটে ফুল বানানো শেখানো হবে। খালাম্মা সাথে সাথে বললেন, আমি তো বিশ্রাম নিব, তোমরা দু'জন গেলে যেতে পারো।

আমার রুমমেটও জানাল আমি গেলে সে সাথে যাওয়ার চিন্তা করতে পারে, নইলে সেও বিশ্রাম নিতেই আগ্রহী। আমারও ক্লান্তি এসে গিয়েছিল কিছুটা। লদানকে বললাম, আমরা সবাই আজকের দিনটা বিশ্রাম নিতে চাই। এখন আফসোস হয়, গেলেই পারতাম। রাতের বেলা অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে মোটামুটি নিম্নমানের একটা প্লেনে বিরক্তিকর খাবার খেতে খেতে গেলাম মাশহাদে।

বিরক্তি নিয়ে গেলেও এয়ারপোর্টে নেমে মন ভালো হয়ে গেল। আমাদেরকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিল ছোট ছোট মহা কিউট এত্তগুলো পুতুল। তারপর তারা লাইন ধরে দাঁড়িয়ে রইল দুইপাশে। আমরা এগিয়ে গেলাম। যেতে যেতে কয়েকটা পুতুলের গাল না টিপে পারছিলাম না।

পুতুলগুলোও জানে সবার আদর তাদের পাওনা। তাই গাল টিপতেই তারা গাল এগিয়ে দেয় আরেকটু আদরের আশায়। ঐ আশা ফিরিয়ে দেয়ার সাধ্য নেই কারুর। আদর করতে করতেই চললাম বাসের দিকে। আমাদেরকে নেয়া হল হোটেল রোজ-এ।

সুন্দর হোটেল, পছন্দ হল একবারেই। সবচেয়ে ভালো লাগল এজন্য যে আমাদের বাংলাদেশের মেয়েদের একটা স্যুট দেয়া হল, অন্যদেরও দিয়েছিল হয়ত। স্যুটে ছিল দুইটা বেডরুম, একটায় একটা ডাবল বেড, আরেকটায় দুইটা সিঙ্গেল বেড। দুই রুমেই বিশাল বিশাল দুইটা ক্লজেট আর লাইট লাগানো ড্রেসিং টেবিল। বাথরুমের সাথে লাগোয়া একটা ছোট স্পেস যেখানে ফ্রিজ ভর্তি ফলমূল আর সফট ড্রিংকস রাখা।

ফল কেটে খাওয়ার জন্য ছুরিও আছে। আমরা আপেল আর আঙুরগুলোর সদ্ব্যবহার করলাম। পরদিন সকালে নিয়ে যাওয়া হল ইমাম রেজার মাজারে। এখানে যাওয়ার আগে মেয়েদের সবাইকে বড় বড় চাদরের মত আলখেল্লা দেয়া হল গায়ে জড়িয়ে নেয়ার জন্য, নইলে মাজারে ঢুকতে দেয়া হবে না। সবাই আলখেল্লা জড়িয়ে গেলাম মাজারে।

বিশাল আর অনেক পুরনো মাজারের শৈল্পিক সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হচ্ছিলাম। অনেক মানুষ সেখানে এসে মানত করছে, দোয়া পড়ছে, নামায পড়ছে। আমরা শুধু কবর জিয়ারতের দোয়া পড়লাম। তারপর ভিড়ের মধ্যে একটু বসার জায়গা করে বসে রইলাম। আমাদের তো আর কিছু করার নেই।

একজন স্থানীয় মহিলা আমাকে বেকার বসে থাকতে দেখে একটা দোয়ার বই ধরিয়ে দিল। ভদ্রতার খাতিরে নিলাম সেটা। বের হবার সময় ওটা রেখে আসছিলাম, খালাম্মা বললেন, নিয়ে নাও তো, রুমে গিয়ে দেখব কী ধরণের দোয়া আছে ঐ বইয়ে। নিয়ে রাখলাম বইটা। পরে অবশ্য সেটা ভুলে হোটেলের খাবার টেবিলে রেখে এসেছিলাম।

মাজার থেকে বের হয়ে পাশের একটা মিউজিয়ামে নিয়ে যাওয়া হল। এখানে এসে আবারও মুগ্ধ হতে হল। এটা একটা কুরআন শরীফের মিউজিয়াম। কত রকম পুরনো কুরআন শরীফ যে আছে। কোনটা এত পুরনো যে কাগজগুলো অনেকখানিই নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

কোনটা এত ছোট যে একটা আঙুলের চেয়েও ছোট হবে। আবার কোন কোনটা এত বড় যে পুরো দেয়াল জুড়ে আছে। সবগুলো দেখলাম অনেক সময় নিয়ে। বেশ কিছু পুরনো লিপিও ছিল। একটা জায়গায় এসে একটু থমকে গেলাম।

লেখাগুলো যেন খুব পরিচিত লাগছে। এটা তো আরবী নয়, কেমন জানি বাংলার মতই, কিন্তু পড়ার চেষ্টা করে পারছি না। পাশে লেখা বর্ণনা পড়ে দেখলাম ওটা হল ব্রাহ্মী লিপি। এর থেকেই তো বাংলার উদ্ভব। মনে হচ্ছিল যেন দূরদেশে এসে নিজের দেশের একটা ছোঁয়া খুঁজে পেলাম।

এই মিউজিয়াম থেকে বের হয়ে পাশেই আরেকটা মিউজিয়ামে নেয়ার কথা হচ্ছিল। কিন্তু আমাদের গাইডরা সবাই প্রতিবাদ জানিয়ে সেটা বাতিল করল। সবাই খুব বেশি ক্লান্ত। আসলেই তাই ছিলাম। আমরা ফিরে এলাম হোটেলে।

রাতেই আবার তেহরানে ফিরতে হবে। বিশ্রাম নিয়ে নিলাম যতটুকু পারি। বের হবার সময় সবাইকে হোটেলের পক্ষ থেকে ছোট্ট উপহারের বক্স দেয়া হল। এখানে ছিল রোস্টেড পেস্তাবাদাম, মিছরি, সুগন্ধি এলাচ আর একটা আতর। আবারও সেই বিরক্তিকর ফ্লাইটে করে ফিরে এলাম তেহরান।

এরপর একদিন বিশ্রামের পর আমাদের দেশে ফেরার পালা। সেই কথায় না হয় আবার পরে আসি। চলবে........... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.