আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইরানের দিনগুলো - ৩

ইরানের দিনগুলো - ১ ইরানের দিনগুলো - ২ টিচার্স ক্লাবে ঢুকতেই আমাদের অভ্যর্থনা জানাল সুন্দরী ইরানী মেয়েরা। এরপর প্রতি দেশের মেয়েদের আর ছেলেদের জন্য আলাদা আলাদা গাইড পরিচিত হয়ে নিল। আমাদের গাইড যে মেয়েটি হল, লম্বা ছিপছিপে শরীরের তীক্ষ্ম চেহারা আর মিষ্টি হাসির একজন, তার নামটা প্রথমে আমরা ধরতে পারলাম না। খালাম্মা বারবার জিজ্ঞেস করে বললেন, কী নাম বললে? নাদিয়া? সে কয়েকবার বলার পরেও আমরা না বোঝায় সে হেসে বলল, আপনারা যেটা ইচ্ছা ডাকতে পারেন, নাদিয়া মনে হলে নাদিয়াই ডাকুন। যা হোক, পরে তার নামের ব্যাজ দেখে বুঝতে পেরেছিলাম, তার নাম লদান।

আমাদেরকেও যার যার নামের ব্যাজ দেয়া হল, আর বলা হল যেন সব সময় ব্যাজ পরে থাকি, এমন কি খাওয়ার সময়ও। ওখানে আমাদের নাম আর দেশের নাম লেখা ছিল। লদান আমাদের রুমে পৌঁছে দিয়ে বলল, আপনার ফ্রেশ হোন, আমি একটু পর এসে লাঞ্চ করতে নিয়ে যাব। লদানের এত শক্তি, আমার বিশাল স্যুটকেসটা এক হাতে তুলে নিয়ে মেইন গেট থেকে রুম পর্যন্ত নিয়ে এসেছিল। আমি তো ওটা দুই হাতে টানি, তাও আবার চাকার উপর ভর করে।

আমার স্যুটকেসটাই সবচেয়ে বড় ছিল। ডিজি স্যার দেখে বলেছিলেন, তুমিই ভালো করেছ, বেশি করে কাপড়-চোপড় নিয়ে এসেছ, তোমার আর সমস্যা হবে না। আসলে অন্যরা এক সপ্তাহের প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল, আর আমাকে দুই সপ্তাহের কাপড় গুছিয়ে দেয়া হয়েছিল। আমাদের এই রুমটা আমার খুব পছন্দ হল। বিশাল রুম।

দরজার পাশে একটা সিঙ্গেল বেড, এরপর অনেকখানি জায়গা, সেখানে সোফা, টেবিল সাজানো। ছোটখাট একটা ড্রয়িংরুমই বলা যায়। আরেক কোণায় একটা ডাবল বেড। সেটা এমনভাবে বসানো যে হঠাৎ কেউ রুমে আসলে ঐ বেডটা দেখা যাবে না। রুমের একপাশে পুরোটা দেয়াল জুড়ে উপর থেকে নীচ পর্যন্ত কাঁচের জানালা।

সেখান থেকে পিছনের বাগানের অর্ধেকটাই দেখা যায়। বাগানের ঐ পাশে দেখলাম আরেকটা একতলা দালান। আমরা গোসল করে তৈরী হয়ে নিলাম সবাই। লাঞ্চের সময় হতেই লদান চলে এল। আমাদের নিয়ে গেল বাগানের পিছনের সেই একতলা দালানে।

দেখলাম সেটার পুরোটাই বিশাল ডাইনিং হল। বেসমেন্টে কিচেন। যেতে যেতে খালাম্মা সময় জেনে নিলেন। হিসাব করে দেখলাম বাংলাদেশের সময় থেকে আড়াই ঘন্টা পিছনে। সবাই যার যার ঘড়ির সময় পাল্টে নিল।

আমি বাংলাদেশের সময়টাই রাখলাম। মনে মনে আড়াই ঘন্টা মাইনাস করে নিলেই তো হল। ডাইনিং হলে অন্য দেশের প্রতিযোগীদের সাথে পরিচিত হলাম। নাম মনে রাখতে পারছিলাম না কারুরই। সেটা অবশ্য সবারই সমস্যা হচ্ছিল।

সবাই তাই দেশের নামটাই জানতে চাইছিলাম। নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করার অনুভূতিটা এই প্রথম বুঝতে পারলাম। দেশের নামের সাথে সাথে সবাই আরেকটা তথ্য জানতে চায়, বয়স। কেন জানি বয়স বলতে লজ্জা লাগছিল। প্রতিযোগিতাটা ছিল ১২ থেকে ১৮ বছর পর্যন্ত।

বেশির ভাগ প্রতিযোগীই ছিল ১৬-১৭ বছরের। কয়েকজনকে আরেকটু বড়ও মনে হচ্ছিল। শুধুমাত্র পাকিস্তানের হাফিজা মেয়েটা ছিল ১২ বছরের, সর্বকনিষ্ঠ প্রতিযোগী। আর তারপরই আমরা বাংলাদেশের দুই মেয়ে, দুজনেই সাড়ে তের বছরের। মনে হল পিচ্চি বলে সবাই একটু আদর আদর ভাব দেখাচ্ছিল।

বিশেষ করে অন্য দেশের সুপারভাইজাররা। তবে ব্যাপারটা একেবারে খারাপও লাগেনি। সবচেয়ে ভালো লেগেছিল শ্রীলংকার সুপারভাইজারকে। তিনি খুব আন্তরিকভাবে কথা বলতেন। মালয়েশিয়ার ক্বারীয়ার সাথে সুপারভাইজার হিসেবে তার মা এসেছিলেন।

উনি অবশ্য চুপচাপ থাকতেন, তার মেয়েটা মিশুক ছিল। দেখা হলেই টুকটাক কথা বলত, বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চাইত। তবে অনেকেই ছিল যারা ইংরেজী জানত না বলে কথাবার্তা হত না, কিন্তু দেখা হলে মিষ্টি একটা হাসি দিত। ইরানী প্রতিযোগীদের তিন মাসের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল স্পোকেন ইংলিশের উপর, শুধুমাত্র এই প্রতিযোগিতায় সবার সাথে কথাবার্তা বলার জন্য। এছাড়া আমাদের গাইড তো ছিলই, যে কোন সময় অনুবাদকের কাজ করার জন্য।

ইরানের প্রতিযোগীর সংখ্যা বেশি ছিল। প্রতি বিষয়ে একজন করে প্রতিযোগী ছাড়াও দুইজন করে ব্যাক-আপ প্রতিযোগী ছিল, কোন কারণে একজন অংশ নিতে না পারলে ব্যাক-আপ চলে আসবে মাঠে। আর প্রত্যেকের সাথে তাদের গার্জিয়ানও ছিল। তাই আমরা যখন একসাথে কোথাও যেতাম, আমাদের বাহিনীতে প্রায় অর্ধেকটাই থাকত ইরানীরা। বিকালে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল একটা পার্কে।

পার্কটার নাম মনে নেই। শুধু মনে আছে খুব সুন্দর ছিল। ছোট ছোট লেকের মত ছিল, তার মাঝে কৃত্রিম ফোয়ারা। আর জানা-অজানা নানান ফুলের গাছ তো ছিলই। তবে এই পার্কের দর্শনীয় জিনিসটা ছিল আন্ডারগ্রাউন্ডে।

সেখানে একটা অ্যাকুইরিয়ামের মিউজিয়াম ছিল। একেকটা ঘরে বিশাল বিশাল সব অ্যাকুইরিয়াম, আর সেখানে নাম না জানা সব মাছ। মাছের নামগুলো যদিও লেখা ছিল, কিন্তু অত কঠিন কঠিন নাম কেই বা মনে রাখে। আমরা ঘুরে ঘুরে সব মাছ দেখলাম। এখানে আবার ছবি তোলা নিষেধ।

আমার কাছে অবশ্য ক্যামেরা ছিলও না। একটা মাছ দেখে সবাই খুব ভড়কে গিয়েছিল, সাপের মত দেখতে, সবার দিকে রাগী রাগী চোখে তাকিয়ে গজ গজ করছিল। আসলে গজ গজ তো করছিল না, গোল্ডফিশের মত করে মুখ খুলছিল আর বন্ধ করছিল (শুধু তার মুখটা ছিল লম্বাটে), কিন্তু তার রাগী চোখ দেখে মনে হচ্ছিল যে আমাদের বকা দিচ্ছে। মাছের রাজ্য দেখা শেষ হলে আমরা পার্কে সবাই মিলে ফটোসেশন করলাম। আজকে অবশ্য প্রফেশনার ফটোগ্রাফার ছিল না, তাদেরকে পেয়েছিলাম পরদিন থেকে।

যারা শেষ সময় পর্যন্ত আমাদের বিভিন্ন সময়ের ছবি তুলে গিয়েছে। তারপর সেগুলো দিয়ে কী করেছে পরে বলব। আমাদের ডিজি স্যার তখন ফারসি শিখতে ব্যস্ত। শাহরম খুব আগ্রহ নিয়ে স্যারকে ফারসি শব্দ শেখাতে থাকল। একসাথে এত শব্দ শুনে কিছুই মনে রাখতে পারছিলাম না।

তাই চেষ্টাও করলাম না। কথায় কথায় স্যার লদান নামের অর্থ জানতে চাইলেন, কেউ ঠিকমত বলতে পারল না। একজন এর কাছাকাছি একটা শব্দ বের করে তার অর্থ জানাল, সে করেনি। এটা নিশ্চয়ই কারুর নামের অর্থ হতে পারে না। সন্ধ্যা পর্যন্ত পার্কে ঘুরাঘুরি করে আমরা ফিরে এলাম আমাদের বাসস্থানে।

একটু পরেই রাতের খাবারের ডাক পড়ল। ইরানের খাবার নিয়ে একটা আলাদা পর্বই দিতে হবে মনে হচ্ছে। যা হোক, এখন প্রথম রাতের খাবারের মেনুটা শুধু বলে রাখি। একটা আস্ত চিকেন রোস্ট প্রত্যেকের জন্য, যেটা আমরা কেউই শেষ করতে পারিনি। আর পানি মানেই হল বরফ গলা ঠান্ডা পানি।

এখানে নরমাল পানি কেউ খায় না। ভারী সমস্যা। পাকিস্তানের ক্বারীয়া দেখলাম কিছুক্ষণ নরমাল পানির জন্য এদিক ওদিক ডাকাডাকি করল, কিন্তু সুবিধা করতে না পেরে শেষে বলল, ঠিক আছে, এই পানিই রেখে দিই, একটু নরমাল হলে খাব। আমি দেখলাম এই পানি খেলে আমার গলা দিয়ে আর কোন আওয়াজই বের হবে না। তাই ড্রিংকস খাওয়াই ভালো, সেটা একটু কম ঠান্ডা।

ড্রিংকস বলতে এখানে কোক, সেভেন আপ, পেপসি এগুলোর কিছুই দেখিনি। ইরানের ড্রিংকস হল জামজাম। (আমাদের দেশে মনে হয় এসেছিল কিছুদিন আগে। ) এটাই খেতাম বাধ্য হয়ে। খালাম্মা মাঝে মাঝে ঠাট্টা করে বলতেন, নাও শুরু কর আবে জমজম খাওয়া।

রোজ দুইবেলা এই ড্রিংকস খাওয়ার একটা কুফলও ভোগ করেছিলাম পরে, সেই কাহিনী পরেই বলি। ডিনারের পর আমরা যার যার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। অনেক ধকল গিয়েছে, এবার একটা শান্তির ঘুম দিতে হবে। পরের দিনটা কেমন যাবে সেটা চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। চলবে............. ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.