আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইরানের দিনগুলো - ৪

ইরানের দিনগুলো - ১ ইরানের দিনগুলো - ২ ইরানের দিনগুলো - ৩ পরদিন সকালে উঠে তৈরী হয়ে নাস্তা করতে গেলাম। নাস্তার টেবিলে আমাদের জানিয়ে দেয়া হল আমাদেরকে নিয়ে এখন পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়া হবে। তাই আমরা যেন অবশ্যই বেশি করে গরম কাপড় পরে নিই, বা সাথে নিয়ে নিই। আমরা রুমে এসে প্রত্যেকে মোটা সোয়েটার পরে নিলাম। এদিকে আমাদের সাথের যে প্রতিযোগী শেষ মুহূর্তে এসেছিল ছেঁড়া স্যান্ডেল আর প্রায় একবস্ত্রে, তাকে ইরানে এসে প্রথম রাতেই এক জোড়া ভালো জুতা কিনে দেয়া হয়েছিল।

কিন্তু গরম কাপড় বলতে তেমন কিছু কেনা হয়নি। তার একটা পাতলা সোয়েটার ছিল, সেটাই পরে নিল। ঐ সময় ওতেই স্বচ্ছন্দ বোধ করছিল সে। উল্টো আমরাই মোটা সোয়েটার পরে ঘামছিলাম। বাসে করে আমরা সবাই রওনা দিলাম।

আস্তে আস্তে পাহাড়ী এলাকার দিকে যেতে থাকল বাস। পাহাড়ের ঢালে সারি সারি বাড়িঘর দেখছিলাম, আর ভাবছিলাম, এত হিসাব করে বাড়ি বানাল কিভাবে? দেয়াল একদিকে বড়, একদিকে ছোট, কিন্তু কোন হিসাবে কোন গড়মিল নাই। এদিকে রাস্তা যতই উঁচুতে উঠছে, ঠান্ডা ততই বাড়ছে। আমার মোটা সোয়েটারে তখন খুব আরাম বোধ হল। এক জায়গায় এসে বাস থামল।

সেটা একটা ছোট পাহাড়। নেমে দেখি চারপাশে শুধু বড় বড় পাহাড় আর পাহাড়। আরও অনেকেই ঘুরতে এসেছে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে। আমরা হেঁটে হেঁটে গেলাম একটা কাউন্টারে। ওখান থেকে টিকেট কেটে নিয়ে উঠলাম টেলিকেবিনে।

এইবার শুরু হল আসল যাত্রা। ছোট পাহাড়টা থেকে টেলিকেবিনে করে দুলতে দুলতে আরেকটা উঁচু পাহাড়ে রওনা দিলাম। চারপাশে আর নীচের দৃশ্য দেখে আর কুলাতে পারছিলাম না। আনন্দে দাঁত তো সবগুলোই বের হয়ে ছিল। লদান আমাকে জিজ্ঞেস করল, ভয় পাচ্ছ না কি? অবশ্য তুমি এতে ভয় পাওয়ার মানুষ না।

কিসের ভয়, আমি পারলে আনন্দে নাচি। আমার রুমমেট একটু ভয় পেয়েছে মনে হল। নিচের দিকে কয়েকটা পাহাড়ের গায়ে কিছু লেখা দেখলাম ফারসিতে। ঐখানে কে গেল আর কিভাবে গেল সেটাই বুঝলাম না। মেঘের মধ্যে দিয়ে মজার এই টেলিকেবিন ভ্রমণ করে আমরা পৌঁছে গেলাম দূরের একটা উঁচু পাহাড়ে।

সেখানে নেমে দেখি একটা সুন্দর মোটামুটি বড় রেস্টুরেন্ট। পুরোটা পাথরের দেয়ালে করা। আর কাঠের গুড়ির থাম। ওখানে সবাই চা-নাস্তা করতে বসলাম। খাব কি, আমি তো রেস্টুরেন্টের সৌন্দর্য্য দেখতেই ব্যস্ত।

হঠাৎ চোখে পড়ল আমাদের বেচারা সহপ্রতিযোগীর দিকে। সে ঠান্ডায় কুঁকড়ে এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর জন্য আসলেই খুব কষ্ট হয়ে গিয়েছে। শাহরম এগিয়ে এল ওকে রক্ষা করার জন্য। নিজের গায়ের সবুজ কোটটা তাকে পরিয়ে দিল।

বেচারা খুব লজ্জা পাচ্ছিল, কিন্তু আরামটাও অস্বীকার করতে পারছিল না। ওখান থেকে ফিরে আসার পর তার প্রথম কাজ ছিল গরম কাপড় কেনা। এরপর যতদিন ইরানে ছিলাম, বেচারাকে আর কখনই মোটা সোয়েটার ছাড়া দেখিনি। এখানে আসার সময় টেলিকেবিনে আমরা তিন রুমমেট আর লদান ছাড়াও শ্রীলংকার প্রতিযোগীরা ছিল। ফেরার সময় আমরা বাংলাদেশীরা সবাই এক টেলিকেবিনে উঠলাম, আমাদের গাইডসহ।

ডিজি স্যার বললেন, যাওয়ার সময় যে টেলিকেবিনে উঠেছিলাম, ঐটার সামনের কাঁচ ভাঙা ছিল, কনকনে ঠান্ডা বাতাসটা সরাসরি বুকে এসে লেগেছে, এখন মনে হচ্ছে ঠান্ডা লেগে যাবে। আসলেই ঐ দিন বিকাল থেকে ডিজি স্যারের গলা এমনভাবে বসে গেল যে দুই দিন ঠিকমত কথাই বলতে পারলেন না। যা হোক, সুন্দর একটা স্মৃতি নিয়ে ফিরলাম টিচার্স ক্লাবে। এখানে লাঞ্চ করে নিয়ে রুমে এসে গোসল করে একটু বিশ্রাম নিয়েই আবার তৈরী হয়ে নিলাম। আজকে আমাদের নিয়ে যাবে আমাদের প্রতিযোগিতার স্থানে।

আজকে হবে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। সব সময়ের মত সবার আগে বাসে গিয়ে উঠলাম। একটা বড় অডিটোরিয়ামে নিয়ে যাওয়া হল। জাঁকজমক করে সাজানো হয়েছে পুরো অডিটোরিয়াম আর স্টেজ। একে একে অতিথিরাও এলেন।

শুরু হল অনুষ্ঠান। একজন অনুবাদক প্রতিটি ঘোষণাই ইংরেজীতে অনুবাদ করে দিচ্ছিলেন। এক সময় পর্দা সরে গেল স্টেজের, দেখা গেল স্টেজের মাঝখানে একটা ছোট বেদীর মত করে স্টেজ বানানো হয়েছে, ওখানেই বসে প্রতিযোগীরা কুরআন তেলাওয়াত করবে। একটা কাঠের রেহেল রাখা আছে, কিন্তু কুরআন শরীফ নেই। হঠাৎ দেখা গেল উপর থেকে নেমে আসছে একটা কুরআন শরীফ, চিকন তার দিয়ে ঝোলানো।

ব্যাকগ্রাউন্ডে তেলাওয়াত চলছিল তখন। কুরআন শরীফটা আস্তে করে নেমে এসে রেহেলে বসে গেল। একজন ৮-৯ বছরের ছেলে গিয়ে সেই স্টেজে বসল। সুন্দর সুরে সবাইকে মুগ্ধ করে দিয়ে সে তেলাওয়াত করল। এরপর শুরু হল একে একে সব অতিথিদের ভাষণ।

কেউ ফারসি, কেউ আরবীতে দিলেন বক্তব্য। এই সময় আমাদের সবাইকে হেডফোনসহ রেডিও দিয়ে দেয়া হল যেখানে একেক চ্যানেলে একেক ভাষায় অনুবাদ করে দেয়া হচ্ছিল তাদের বক্তব্য। এই ব্যাপারটা অবশ্য আমি প্রথমে বুঝতেই পারিনি। এখন আমাকে রেডিও কেন শুনতে হবে সেটাই ভাবছিলাম। পরে লদানের মত আরেকজন গাইড আমাকে বলল, চ্যানেল ফোর দাও, ওখানে ইংরেজীতে অনুবাদ করছে।

তারপর বুঝলাম কাহিনী। কিন্তু আমার আবার বক্তৃতা শুনলে ঘুম আসে। কিছুক্ষণ শুনে রেডিও বন্ধ করে আমি এদিক ওদিক তাকিয়ে অডিটোরিয়ামটা দেখতে থাকলাম। একটু পর সব প্রতিযোগীকে ডাকা হল। লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে দিল।

আর সব দেশ থেকে একজনের হাতে যার যার দেশের নামের প্ল্যাকার্ড ধরিয়ে দেয়া হল। এরপর একে একে দেশের নাম ঘোষণা করা হল আর আমরা স্টেজে গিয়ে প্ল্যাকার্ডসহ দাঁড়ালাম। এই ব্যাপারটা খুব পছন্দ হল, একটা অলিম্পিক অলিম্পিক ভাব। তবে দেখলাম বেশ কিছু প্ল্যাকার্ড অব্যবহৃত পড়ে রইল, ওসব দেশ থেকে প্রতিযোগী আসার কথা থাকলেও তারা আসেনি বা আসতে পারেনি। যা হোক, গ্ল্যাডিওলাস ফুল দিয়ে বরণ করে নেয়া হল আমাদের।

ইরানে আসার সময় আম্মা আমাকে একটা সোনার ব্রেসলেট দিয়েছিলেন সব সময় পরে থাকার জন্য। ফুল নিয়ে সিটে এসে বসার সময় এক ইরানী ভদ্রমহিলা সেটা দেখে ধরে কি জানি বললেন ফারসিতে, আমি কিছু না বুঝে বোকার হাসি দিলাম শুধু। মূল অনুষ্ঠান শেষে শুরু হল ফটোসেশন। বিভিন্ন গ্রুপ ফটো তোলা হচ্ছিল। এক মহিলা সাংবাদিকের সাথে পরিচয় হল।

মহিলা না বলে মেয়েই বলি, একেবারেই কমবয়স। আর ওরা যে সবাই এত সুন্দর কেন? এই মেয়েটা আমাকে দেখেই এত বেশি উচ্ছলতা প্রকাশ করা শুরু করল, কেন জানি না। সে আবার ইংরেজী ভালো জানে না। আমাকে দেখলেই হাসি দিয়ে হড়বড় করে ফারসিতে কি কি জানি বলা শুরু করে, একবার হাত ধরে টানে, একবার গাল টিপে দেয়, একবার থুতনি নেড়ে দেয়, আজব যন্ত্রণা। আমি কি ছোট বাবু? একবার তো একটা গ্রুপ ফটো তোলা হচ্ছে, ঐ সাংবাদিক মেয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে এসে আমার হাত ধরে টেনে দাঁড় করিয়ে দিল।

পরে দেখি ফটোগ্রাফার ছবি তুলতে গিয়েও থেমে গিয়ে আমার দিকে ইশারা করে কী যেন বলল। আমি আশে পাশে তাকিয়ে দেখি ঐ গ্রুপে সবাই ছেলে। কী কান্ড, ছেলেদের গ্রুপে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। চুপচাপ সরে এলাম ওখান থেকে। যা হোক, ছবি তোলাতুলি শেষ হলে আমরা আবার ফিরে এলাম বাসস্থানে।

ডিনারের পর আবারও ডাক পড়ল আমাদের। ক্লাবের একটা ছোট রুমে সবাই একত্র হলাম। রুমের মেঝেতে পুরোটাই কার্পেটিং করা, সবাই কার্পেটে বসলাম। আগামীকাল থেকে প্রতিযোগিতা শুরু হবে। কয়েকদিন ধরে চলবে।

এখন প্রতি রাতে লটারী করে ঠিক করা হবে যে পরদিন কোন কোন দেশের প্রতিযোগী পারফর্ম করবে। সেই লটারী করতেই সবার এখন একত্র হওয়া। লটারীর নাম তোলার জন্য ছেলেদের থেকে একজন আর মেয়েদের থেকে একজনকে যেতে বলা হল। যে ভয়টা পাচ্ছিলাম। হাজারবার না করা সত্ত্বেও মেয়েদের মধ্যে থেকে ঠেলে ঠুলে আমাকে পাঠিয়ে দেয়া হল।

লদানই এর জন্য সবচেয়ে দায়ী, ঐটাকে যে কী করতে ইচ্ছা করছে এখন। যা হোক, লটারীতে চারটা দেশের নাম তুলে দিলাম। ভাগ্য ভালো বাংলাদেশের নাম উঠাইনি। নইলে প্রথম দিনই আমার পড়া লাগত, আর আমি ভয়ে টেনশনে সব গুবলেট করে ফেলতাম। আগে প্রতিযোগিতায় অন্যদের পারফর্মেন্স দেখে নিলে মনে একটু সাহস আসবে, নিয়মটাও বোঝা যাবে।

যে যে দেশের নাম উঠেছে, তাদেরকে আবার লটারীর মাধ্যমে কুরআনের আয়াত দেয়া হল যেগুলো তাদের প্রতিযোগিতায় তেলাওয়াত করতে হবে। আজকের রাতটাই তারা সময় পাবে প্র্যাকটিস করার। যাক, প্রথম দিনের মত ওরাই টেনশন নিয়ে প্র্যাকটিস করুক। আমি নিশ্চিন্তে ঘুমাই। চলবে............... এরপরের ঘটনাগুলো আর দিনের ক্রমানুসারে লিখতে পারব না, অত মনে নেই।

তাই এরপর শুধু একেকটা বিষয় নিয়ে লেখার চেষ্টা করব। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.