আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রসঙ্গ: হুমায়ুন স্যার নির্মিত স্কুল ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’ একটি স্বপ্নের স্কুল ও নির্র্মম বা নির্বোধ গ্রামবাসী!

i am a simple man. তখন আমি খুব ছোট। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি। বাড়ির সামনে ক্ষেতে বৈদ্যুতিক খুটি গাড়া হচ্ছে। তার লাগানো হচ্ছে। কদিন পড়েই আমাদের গ্রাম সহ আশেপাশের সবকটি আধাঁর গ্রাম আলোকিত করে বিদ্যুৎ সংযোগ এলো।

গ্রামের সবার পা গর্বে যেন মাটির একটু উপরে উঠে গেল। আশেপাশের যে গ্রামে বিদ্যুতের সংযোগ নেই, সে সব গ্রাম থেকে কুটুম এ গ্রামে বেড়াতে আসতে লাগল। দুদিনের জায়গায় তারা চারদিন করে থাকতে লাগলো। আমার দাদী আবার এক কথা বার বার বলতে থাকেন। তিনি বলতে লাগলেন ‘কি যুগ আইলো।

কারেন্টের বাত্তিতো সব ফকফকা বানাইয়া ফালাইছে। গাঁওয়ে কারেন্ট আনছে হুমায়ুুন। তারে আল্লাহ বাচায়া রাখো। ’ এই প্রথম হুমায়ুুন স্যারের নাম শুনি। কিছুদিন পর গ্রামের পাশে ধূলিউড়া, কাদাঁমাঠা মেঠোপথে মাটিকাটা শুরু হল।

পথের ধারে ইট পড়ে থাকতে দেখা গেল। সেই ইট ভেঙ্গে সুড়কি বানানো হল। কালো পিচমাখা সুড়কি দিয়ে পথ মুড়িয়ে দেওয়া হল। গ্রামের সেই কাঁদামাঠা পথ পাকা হল। স্যারের বাবার নামে নামকরন হল ‘শহীদ ফয়জুর রহমান সড়ক।

’ আবারো আমার দাদীর মুখে স্যারের নাম। গ্রামের মানুষের মুখে মুখেও। এবার স্যার একটি স্কুল নির্মান করবেন। সড়কের শেষ প্রান্তে কুতুবপুর গ্রামে নির্মান করা হবে স্কুল। স্কুলের সামনে খেলাধূলার বড় মাঠ থাকবে।

বড় বড় ‘বিল্ডিং’ হবে। সেই বিল্ডিংয়ে বসে গ্রামের ছেলেমেয়েরা পড়ালেখা করবে। এটি হবে এমন একটি স্কুল, যা এই এলাকায় তো নেই-ই, দেশেও নেই! উন্নত দেশের মত এই স্কুলের শিক্ষার্থীরা সব সুযোগ সুবিধা পাবে। স্কুলের জমি কিনা হল। বড় মাঠ হল।

দেখতে দেখতে নয়নাভিরাম একটি ভবন নির্মাণ হল। মাঠের এক কোণে সুদৃশ্য শহীদ মিনার হল। খেলাধূলার জন্য সারি সারি খেলনা বানানো হল। বাঘ, সিংহ। বড় দোলনা।

সিড়ি দিয়ে অনেক উপরে উঠে নিচে পিছলিয়ে নামা। আরো কতো কী! আমাদের আনন্দ দেখে কে। টিনের স্কুলঘর, ভেঙ্গে পড়া বাঁশের বেড়া, টুল টেবিল হীন বিদ্যালয়ে তাহলে আর পড়তে হবে না। হয়ত নতুন চকচকা সব বই পাবো। বইয়ের গন্ধ শুকবো আর সব কবিতা দুদিনেই মুখস্থ করে ফেলবো।

এর বেশি তখন আর ভাবতে পারিনি। আনন্দে আটখানা আমরা সবাই। কবে হবে সেই স্কুল! কবে ভর্তি হবো সেই স্কুলে। আমাদের স্বপ্নের সেই স্কুল অবশেষে নির্মাণ হল। একদিন সেখানে বড় উৎসব হল।

বাদ্য বাজনা হল। উৎসবে স্যার, স্যারের পরিবার, চলচ্চিত্রের লোকজন ছাড়াও নামীদামী মানুষজন গেলেন। কবি শামসুর রাহমানও গিয়েছিলেন। স্কুলের নাম হল ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’। স্কুলটির অদূরেই আমার বাড়ি।

কিন্তু আমি সেই স্বপ্নের স্কুলে পড়তে পারিনি। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে স্কুলের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এখন আমার ছোটবোন সেখানে পড়ে। বড়ভাই পড়ায়। গত ২০.১১.১১ (রোববার) প্রথম আলোতে হুমায়ুন স্যারের লেখা ‘নিউইয়র্কের আকাশে ঝলমলে রোদ’ কলামের ‘কচ্ছপকাহিনি’ লেখাটা পড়লাম।

স্যারের হাতে গড়া ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’ নিয়ে লিখলেন। কিভাবে তিনি তিলে তিলে স্কুল গড়লেন সেই গল্প লিখলেন। গ্রামবাসীর প্রতিকূল ভূমিকাও লিখলেন। স্যারের মায়ের কথা ভেবে খুবই কষ্ট পেলাম। মা অতি কষ্টে ছেলেকে বললেন ‘দান গ্রহন করতেও যোগ্যতা লাগে।

তোর গ্রামের সেই যোগ্যতা নেই। ’ কথাটা কতটুকু বাস্তব তা গ্রামবাসীর কর্মকান্ড থেকে স্পষ্ট। স্যার গ্রামবাসীর ঘটন-অঘটন অনেক সংক্ষেপে লিখেছেন। আমার মামা তখন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান। তার কাছে শোনা।

স্কুলটা কুতুবপুর আর চাপুরী নামের দুই গ্রামের মাঝামাঝিতে পড়েছে। এক গ্রামবাসী বলছে স্কুলের নাম যদি ওই গ্রামের নামে হয় তাহলে আমাদের গ্রামের ছেলেমেয়েদের সেখানে পাঠাবো না। স্যারের গ্রামের বাড়িতে উৎসব হবে। সেখানে গান বাজনা হবে। উৎসবে এই গ্রামের কেউ যাবে না।

আলাদা তারাও গান বাজনার আয়োজন করবেন। সভা হল। গ্রামের মাতাব্বররা তাই রায় দিলেন। যেদিন উৎসব সেদিন তারাও মাইকে গান বাজাতে লাগলেন। অবশেষে চেয়ারম্যানের হস্তক্ষেপে ঘটনার নিষ্পত্তি হল।

পরে দেখা গেল স্কুলের নাম কোন গ্রামের নামে হল না। কারো নামেও হল না। স্কুলের নাম হল মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের নামে। ‘শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ’। গ্রামের আশেপাশে কোন বড় খেলার মাঠও নেই।

ওই স্কুলের বড় মাঠে আমরা খেলতে যেতাম। একবার একটি ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হল। ফাইনাল ম্যাচ দেখতে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। প্রতিযোগী দুই দলই বাইরে থেকে খেলোয়ার নিয়ে এসেছে। খেলায় তো হারজিত থাকবেই।

একদল হারার পথে। ইচ্ছা করে ওই গ্রামের মাতাব্বর টাইপ লোকজনের ইশারায় আম্পায়ার, বিপক্ষ দলের খেলোয়ার, সমর্থকদের বেধড়ক পিটানো শুরু হল। পায়ের জোরে ওইদিন মারের হাত থেকে বেচেছিলাম। তারপর থেকে ওই মাঠে খেলা বন্ধ। শিশুদের খেলাধূলার জন্য বানানো সারি সারি খেলনাগুলোও ধীরে ধীরে উধাও হয়ে যেতে লাগল।

বিশাল বাঘের মাথা ভেঙ্গে ফেলা হল। ক’দিন পরেই সিংহের পা, লেজ আর থাকলো না। দোলনা ছিড়ে পড়ল। উপর থেকে পিছলিয়ে পড়ার খেলনাসহ অন্যান্য খেলাধূলার যন্ত্রপাতি খুব অল্প দিনেই হাওয়া হয়ে গেল। সুদৃশ্য ভবন বানানোর জন্য ইট পাথর তো কিছু খোয়া গেলই।

একরাতে ১২০ মন রড গাথুনি থেকে খুলে কেটে টুকরা টুকরা করে কেজি হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হল। অজ পাড়াগাঁয়ে অপূর্ব নির্মাণশৈলীর স্কুলঘরকে গ্রামবাসী পরিত্যাক্ত গোয়ালঘরে পরিনত করল। সেখানে রেখে পালিত হল ঝাক ঝাক হাঁস। গরুরপাল। ছাগলছানা।

নির্মানের অল্পদিন পরেই দরজা জানালা ভেঙ্গে ফেলা হল। ভেতরে বসানো হল জুয়ার আসর। চলল নিয়মিত মাদক সেবন। এসব ঘটনার নায়ক সচেতন (!) গ্রামবাসী। কেউ জড়িত ছিল, কেউ এসব কর্মকান্ডকে উসকে দিয়েছে, কেউ দেখেও না দেখার ভান করেছে, নিজের স্বার্থ উদ্ধার করেছে।

এতকিছুর পরও স্যার পিছপা হননি। অনেক দেরিতে হলেও অবশেষে স্কুলের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সেই স্কুলেই পড়ছে গ্রামবাসীর ছেলেমেয়েরা। কিন্তু আমি যতদূর জানি, এখনো সেই গ্রামবাসীই প্রতিনিয়ত প্রতিষ্টানটির ছিদ্রান্বেশন করে যাচ্ছে। গ্রামের অশিক্ষিত বখাটে ছেলেদের লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

স্কুলের প্রধান শিক্ষককে শিক্ষার্থীদের সামনে অপমান করা হচ্ছে। স্থানীয় সালিশে আবার তা মীমাংসা হচ্ছে। স্কুলটি স্যারের হাতে তিল তিল করে গড়া। এখনও তিনিই স্কুলের সকল ব্যয় বহন করছেন। স্কুলটি নিয়ে গ্রামবাসী যে কতটা নির্মমতা দেখিয়েছে বা নিবুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছে তার বিশদ বর্ণনা স্যার বলেন নি।

আমি একটু বলতে চেয়েছি মাত্র। কারন, সকল ঘটনার দায়টা তো আমাদের গ্রামবাসীরই নিতে হবে? আর স্কুলের দায়দায়িত্ব? সেটা কি আমার, আপনার, আমাদের সকল গ্রামবাসীর না? যে স্কুলের শতভাগ পাশ করেছে, সেটা তো আমাদেরই স্কুল। যে পাঁচজন বৃত্তি পেয়েছে, তারা তো আমাদেরই সন্তান। তাহলে একবার ভাবুন তো, আমরা এই স্কুলটির সাথে কেন এমন করি? কারও দান আমরা গ্রামবাসীরা গ্রহনও করতে জানি না? এটি আমাদের জন্য কতবড়ো ধিক? কতটা লজ্জার? আমরা কতটা জঘন্য হলে আমাদের ছেলেমেয়ের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য, তাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য স্বপ্নের বিদ্যাপীঠটির এমন ক্ষতি করতে পারি। আমরা কি নিজেদের পায়ে কুঠারাঘাত করছি না? তাই আসুন না আমাদের বোধশক্তিগুলোকে একটু জাগ্রত করি।

নিজের ঔরসজাত সন্তানটির উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথাটা ভাবি। আমার লেখার দৃষ্টতা আমাদের গ্রামবাসীর জন্য। আমি দেখেছি স্থানীয় বাজারে দোকানে প্রথম আলো রাখা হয়। লোকজন দিনরাত সেই দোকানে পত্রিকা পড়তে ভিড় করে। ‘হুমায়ুন সাবের অসূখের শেষ খবরডা কিতা? এহন একডু ভালা নি?’ যারা পড়তে পরেন তারা সবাইকে পড়ে শোনান।

সবাই তার মঙ্গল কামনা করেন। যে মানুষটা ভয়াবহ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে সাত সমুদ্র তের নদীর ওপারে বসেও তার স্বপ্নের স্কুলটি নিয়ে ভাবছেন, আসুন আমরা সবাই তাকে আশ্বস্থ করি, ‘যা হবার হয়েছে, আপনি নিশ্চিস্ত থাকুন। আজ থেকে এই স্কুলের দায়দায়িত্ব আমাদের। ’ (লিখাটি একটি পত্রিকায় পাঠিয়েছিলাম। না ছাপানোয় সামুতে দিলাম) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।