আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রসঙ্গ মা, প্রসঙ্গ মাটি এবং দেশ

শূন্য ‘মা’ শব্দটির সীমা পরিসীমা নির্ধারণ কি সম্ভব! খুঁজে পাই না। শুধু দেখি বৃহত্তর কোন আবেগ বা অর্থ বোঝাতে মা’কে ব্যবহার করা হয় উপমা হিসেবে। তাই তো আমরা ব্যবহার করি মাতৃভূমি, মাতৃভাষা, নদীমাতৃক ইত্যাদি নানা শব্দ। পৃথিবীকে বলি মা, দেশকে বলি মা, জন্মভূমিকে বলি মা, স্কুল, কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়কে বলি মা। আমাদের বাঙ্গালী আবহে সকল মায়েরাই একই রকমের।

আমার মা আর তোমর মায়ের মাঝে তেমন কোন পার্থক্য চোখে পড়ে না। সেই একই রকম। একই তার মমতা, স্নেহ একই সেই চাহনী। কেমন যেন আদ্র, খুশিতেও আদ্র, কষ্টতেও আদ্র। মায়েরা আমাদের মানে সন্তানদের নিয়ে শুধুই চোখ ভেজান।

গর্বে-আনন্দে যেমন চোখ ভেজান, কষ্টেও চোখ ভেজান। জগতে আর কে আছে যে আমার কোন শারিরিক বা মানসিক কষ্টে নিজের সব ভুলে যান! বাঙ্গালী মায়েরা সব এক। হলুদের আঁশটে গন্ধে ভরা আঁচল, শরীরেও সেই একই গন্ধ। বাড়িতে ভাল কিছু রান্না হলে নিজের জন্য সবচেয়ে খারাপটা রাখার জন্য যেন জন্মগত সংকল্প তার। আর ভালটা সন্তানের জন্য রাখবেন এটাও যেন জন্মগত শপথ।

সবার খাওয়া শেষ হলে তিনি খাবেন। কখনো হয়ত উন্নত রান্নার দরুণ প্রতিদিনের চেয়ে একটু বেশী খেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বিছানায় পিঠ বিছিয়ে দেই। আর মা তখন পাতিলের তলে চামচের প্রতারণাকে অভিশাপ দেন। পড়ে থাকা কয়েকটি দানা সে বেলার উদরপূর্তির আইটেম হলেও, মনটা একটু বিষন্ন করেন সন্তান কেন শেষ দানাটাও গ্রহণ করতে পারলো না, সেটা ভেবে। আহারে, ও বোধহয় ঠিকমতো খায়নি।

মায়ের শরীরের সেই মা মা গন্ধ আর কোথাও কি মেলে! কৃত্রিমভাবে কত ফ্লেভারই তো আমরা গ্রহণ করছি রোজ। কিন্তু মায়ের শরীরে, শাড়ির আঁচলে, রান্নাঘরে, জলতলায় কলের পাড়ে যে মা মা গন্ধ সেটা কোথায় পাই! সমাজের একদম উঁচু থেকে একদম ছিন্নমূল মায়ের মাঝে মা মা আবহটার মাঝে কোন পার্থক্য নেই বলেই ধারণা করতে পারি। একই সেই আবেগ, একই সেই মহাত্ব। আমাদের উন্নত বিশ্ব এখন উন্নতির চরমে পৌঁছে, জীবনযাত্রাকে নিয়ে গেছেন দিবসের কেন্দ্রিকতার জালে। তারা এখন মা দিবস পালন করেন, বৃদ্ধাশ্রমে মা’কে ফুল বা টুকটাক গিফট পাঠিয়ে পাঠিয়ে মায়ের প্রতি দায়িত্ব আর ভালবাসার প্রকাশ ঘটান।

অপরদিকে আমাদের দেশ এতটা প্রকট আধুনিকতা এখনো পৌঁছেনি। তদুপরি কিছু কিছু উত্তরাধুনিক পরিবারের সদস্যরা তাদের পরিবারের বোঝা তূল্য বিবেচনায় পরিবারের এই মধুর সম্পর্কটিকে বিচ্ছিন্ন করে মা-বাবাকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন বৃদ্ধাশ্রমে। নিজেকে অনেক প্রশ্ন করে যে কথাটিতে নিজেকে আটকাতে পেরেছি তা হচ্ছে, স্বাধীনতার পর আমাদের সমাজ ব্যবস্থার সবচেয়ে লজ্জাজনক অধ্যায় হচ্ছে, এদেশে বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠা। গত প্রায় দেড় দশক ধরে আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রমের প্রচার এবং প্রসার যেভাবে বাড়ছে, তাতে আশঙ্কা করাই যেতে পারে যে, আমাদের দেশের একটা অংশ দিনদিন মূল্যবোধের জায়গা থেকে সরে যাচ্ছে। আর এটা অব্যশই সমাজের উঁচু স্তরেই বেশী হচ্ছে।

শুধু বেশী বললে হয়ত হালকা শোনা যায়, আসলে প্রায় পুরোটাই হচ্ছে সমাজের ধনী আর শিক্ষিত সমাজে। যে বাবা-মা নিজেরা খেয়ে না খেয়ে, কঠিনতর পরিশ্রম করে ২/৪ টি সন্তানকে বড় করেছেন, আর বয়সের ভারে একটা সময় যখন তাদের একটু আরাম, একটু বিশ্রাম নেবার ক্ষণ এলো, সে সময় তাদের ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রম। আবার অপ্রিয় একটা কথাও এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন। আর তা হচ্ছে, আমাদের ধনিক শ্রেণী এক সময় ক্ষমতা আর টাকার দাপটে ভুলে যান গ্রামে থাকা আত্মীয়স্বজনদের। কখনো কখনো তারা মনেও রাখেন না গ্রামে থাকা মা-বাবার কথা।

ফলে শহুরে দাপটের কাছে উনারা হারিয়ে ফেলেন নিজের শেকড়ের ঠিকানা। ফলে জীবনের এই দূর্যোগ মূহুর্ত্বে তারা শহরের এই অমানবিকতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে ফিরে যেতে পারেন না গ্রামের সেই শেকড়ের কাছে। কারণ তখন তাদের যাবার জায়গা নেই বলেই আবিস্কার করেন। বারবার মনে পড়ে, গ্রাম থেকে কাঁদামাটি মাখা সেই মানুষগুলো কখনই ড্রয়িংরুমের দামী সোফায় বসতে পারেনি, ময়লা হবার ভয়ে। দুদিন তার বাড়িতে অবস্থান করতে পারেনি।

ফলে আজ তার জন্য বৃদ্ধাশ্রমের বাইরে আর কোন ঠিকানা অবশিষ্ট নেই। অথচ এই মানুষটিই হয়ত এমন দু:ষহ সময়ে চাইলেই আবারো কাছে পেতেন গ্রামের সেই মাটির মানুষদের। কারণ মাটি কখনো বেইমানী করে না। গ্রামের সেই মানুষগুলো সব সময়ই সরল। কিন্তু তাদের সামনে দাঁড়াবার সেই সৎ সাহস তখন আর রাখেন না।

সবশেষ কথা: মা, মাতৃভুমি, মাতৃভাষা এই শব্দগুলো কখনো বস্তুগত বা অবস্তুগত যেভাবেই নেন না কেন, যদি আপনি এদের ভালবাসেন, যদি হৃদয়ের দূর্বিষহ অস্থিরতায় একটু আশ্রয়ের জন্য মায়ের কথা মনে পড়ে, যদি ভালবাসা, শ্রদ্ধা কিংবা অশ্রুসিক্ত চোখে মায়ের পবিত্র মুখটিকে বারবার হৃদয়ে ধারণ করতে পারেন, তবে অবশ্যই এবং অবশ্যই আপনার মন থেকে ঘৃণা আর ধিক্কার বেরিয়ে আসবে তাদের প্রতি যারা আপনার আমার এই বাংলার প্রতিটি মা’কে গণিমত বা লুটের মাল হিসেবে ঘোষণা করে সরবরাহ করতে চেয়েছিল এবং করেছিল পাকিস্তান বাহিনীর হাতে সেই ৭১-এ। পাক বাহিনী আর তাদের এ দেশীয় দোসরেরা যে অবর্ণনীয় নির্যাতন করেছিল আমাদের এই বাংলার মায়েদের, সেই মায়েদের প্রতি আপনার শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বর্হি:প্রকাশে আসুন ঘৃণা জানাই দেশ, জাতি ও স্বাধীনতার এই শত্রুদের প্রতি। তারা যেন কখনই আমাদের মায়েদের এবং ভবিষ্যত মা মানে আমাদের বোনেদের আর কখনই গণিমতের মাল বানানোর চেষ্টা করার সাহসও না পায়। পৃথিবীর সকল মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা। সকল মা ভাল থাকুক।

মা আমরা তোমার কোটি কোটি সন্তান জেগে আছি, তোমার সুরক্ষায় টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া। নতুন এই যুদ্ধ শেষে আবারো ফিরে আসবো তোমার কোলে। শান্তির সুবাতাস নিতে। ৭১ এ তোমাকে ফিরে আসবো বলে যে ভাই চলে গিয়েছিল, স্বাধীন পতাকা নিয়ে ফিরে আসবো বলে আর এলো না, জায়গা নিয়েছে অজানা কোন কবরে। আমরা সেই ভাই’র মতো প্রতারণা করবো না মা।

ফিরে আসবোই তোমার কাছে মা। ফিরে আসবোই। তোমাকে আর গাইতে হবে না: ‘খোকা ফিরবে, ঘরে ফিরবে, কবে ফিরবে, নাকি ফিরবে না’। ## (লেখাটি সাপ্তাহিক কাগজে প্রকাশিত) তির্থক আহসান রুবেল ।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।