আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাংস চোর কাউলা।

কিছু মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে। কিছু মানুষ স্বপ্নটা সত্যি করার জন্য ঘুম থেকে জেগে উঠে। জীবন আপনার কাছে সেভাবেই ধরা দিবে আপনি যেরকম থাকবেন। তার নাম কাউলা। রেসজিম ব্যাপারটা তার বোঝার কথা না।

যেহেতু ইতিমধ্যে তার নাম কাউলা তাই তাকে কাউলা ডাকাটাও হয়ত রেসিজম হবেনা (!!)। রেসিজম তখনি হবে যখন তাকে ডাকা হবে কালা কাউলা। যাকে নিয়ে এই গল্প ফাঁদতে চাই সেই কাউলা আমাদের জাতীয় জীবনে এমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ না। এই কাউলা হল টোকাই কাউলা। যে তার বাবা মাকে কখনো দেখেনি।

তাই তার নাম যে কাউলা , এটা কোথেকে আসল সে জানেনা। সে খালি জানে তার নাম কাউলা। সে থাকে মামার সাথে। মামাকে পথে ঘাটে কাগজ টোকাই করে এনে দেয়। মামা রাতে মরিচ ভত্তা দিয়ে ১ বেলা খাওয়ায়।

দুপুরে ১ টা পাউরুটি কলা যা জোটে। কাউলা এখন কাগজ টোকানিতে ব্যস্ত। ঘটনার প্রয়োজনে এমন সময় সে রাস্তায় তাকিয়ে দেখে থামানো গাড়িতে অনেকে ভিক্ষা করছে। এক গাড়ি থেকে এক লোক নামল আর লোকের পকেট থেকে মানিব্যাগ পড়ে গেল। কাউলা দৌড়ে গেল।

মানিব্যাগ ভর্তি টাকা। মানিব্যাগ নিয়ে দৌড়ায় লোকটির কাছে গেল। লোকটি মানিব্যাগ হাতে নিল। এ যেন খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। তার মানিব্যাগ পড়ে গেল কাউলা সেটা দৌড়ায় তুলে দিবে।

কাউলা ধরনের প্রাণীদের জন্য ধন্যবাদটাও মিটে না। তারা যাই করবে সেটা থ্যাঙ্কলেস জব। মানিব্যাগ ফিরিয়ে দিয়ে কাউলা কি জানি চিন্তা করল। কাগজ টোকানোর বদলে ভিক্ষা করলে কেমন হয়? সে রাস্তায় থামা গাড়ি গুলাতে চাওয়া শুরু করল। কেউ দিল, কেউ দিলনা, কেউ গালি দিল, কেউ তিরস্কার করল।

তার সমান এক ছেলে গাড়িতে বসে বিরাট বার্গার খাচ্ছিল। পাশে বসা তার মাকে বলল, সি, পোর পিপল , হাংরী পিপল। মা বলল, ডোন্ট সে লাইক দ্যাট। হি ইজ অফ ইউর এইজ। এই ছেলে এদিকে আস।

রিচ বয়, বার্গার বয় -এর মা কাউলাকে দশটাকা দিল। কাউলা হতভম্ব। এতটা আশা করা কঠিন। কাউলার ছেড়া পকেটে টাকাটা ভরল। আরও ২,৩,৪ টাকা উঠল।

সব মিলিয়ে ২১ টাকা। কিছু আছে ছেড়া নোট। ২ টাকার নোটে হয়ত দশ টাকার টেপ মারা। কাউলা আবার কাগজ টোকানোর কাজে ফিরে গেল। এই কাগজ, সেই কাগজ।

দুপুরের সময় প্রায়। রাস্তায় রাস্তায় গরু নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গরুদের কথা গল্পে আগে বলা হয়নি কারন সে দিকে কাউলার কোন মনযোগ নেই। কোরবানীর ঈদ, গরু , ছাগল এইসবের প্রতি মনযোগ রেখেই বা লাভ কি? কাউলা খাবার হইল ভাত আর মরিচ ভত্তা। মাঝে মাঝে তার থেকেও খারাপ।

দুপুরের পর মামার বাসায় যেতে হয়। টোকানো কাগজ সেখানে দিতে হয়। মামার বাসায় যাওয়ার পরেই প্রথমে মামীর গালি। বান্দীর পুত কই আছিলি? তোরে যে সকালে কইলাম পানি যোগাড় কইরা রাখতে সেই খেয়াল আছিল? কাউলা জিহবায় কামড় দিল। এক্কেবারে ভুইলা গেছে।

ভাগ্য ভাল এটা মামার সামনের ভুল না। মামী যাই হোক গালি দেয়। মাইর দেয় মামা। তবে কপালে আজকে মামার মাইরও ছিল। সেটাই হল।

মামা আর মামী মিলে সম্পূরক কোন। এক কোন গালি দেয় আরেক কোন মাইর দুই কোন মিলে ১৮০ ডিগ্রী হয়। মামা বলল, আইজ কাগজ এত কম ক্যান? কাউলা কোন জবাব দেয়নায়। কখনো দেয়ও না। মামার মাইর শুরু।

থাপ্পড় দিল দুইটা। এটা অবশ্য খুব কম। আরও বেশি খাওয়ার কথা। আইজ তোর খাওন বন্ধ। যা আরও কাগজ টোকায় আন।

(ছবিটি ইন্টারনেট থেকে পাওয়া) কাউলা বের হয়ে অন্তত আজকের জন্য খুব চিন্তা করল না। পকেটে কিছু টাকা তো আছে। কাগজ টোকানোর বস্তা নিয়া সে আবার বের হল। পকেটে ২১ টাকা। রুটি খাইতে লাগল ৬ টাকা।

এখনও আছে ১৫ টাকা। মামা রাইতে খাওণ না দিলেও সমস্যা নাই। তয় মামা রাইতে খাওন দেয়। মাইর দিলেও দেয়। মামা, মামী খাওনের পর যা থাকে সে খায়।

পথে পথে লোকজন গরু নিয়ে যাচ্ছে। ঈদের গরু। উৎসাহ উদ্দীপনার অভাব নেই। কাউলে গরু দেখতে লাগল। হাটতে হাটতে এক হাটেই চলে গেল।

কি অবাক করা পশু রে বাবা। এটারে বলে উট!! মক্কার উট। এটাকে শোয়ায় কেমনে? কত বড় বড় গরু। এক লোক গরু কিনল ১ লাখ টাকা দিয়া। কাউলাও গরুটার সাথে হাটা শুরু করল।

এই গরুর দাম ১ লাখ টাকা!! গরুটা নিয়ে যাচ্ছে ২ জন। হটাৎ গরু দৌড় দিল। ধর ধর ধর। কাউলা তার ছোট শরীর নিয়ে গরুটা ধরতে গেল। লাভের লাভ কিছুই হলনা কাউলার হাটু ছিড়ে গেল।

কনুইয়ে ব্যাথা পেল। গরু ধরা পড়ল অন্যদের হাতে। কিন্তু গরুর মালিক জানলনা কাউলার মত কেউ সেই চেষ্টায় হাত পা ছিড়ে ফেলল। হাতে পায়ে ব্যাথা নিয়ে কাউলা মামার বাসায় ফিরল। মামার চোখ তখন রক্তবর্ণ।

বলল হারামজাদা টাকা পাইছিলি কই? কাউলা চুপ করে থাকল। চোরের পুত তোরে আর ঘরে রাখমুনা। তুই টাকা চুরি কইরা বনরুটি খাইছস। গল্পের অগোচরে এরকম কিছু গালিগালাজ শেষে কাউলাকে অর্ধচন্দ্র দেওয়া হল। তবে তারপরেও শান্তি নাই।

কাউলা গিয়া ধরা পড়ল আরেক গ্রুপের কাছে। এদের কাজ কে কোথায় ভিক্ষা করবে তা নির্ধারণ করে দেওয়া। কাউলাকে দেখেই একজন বলল ধর শালারে। ঐ ফুটপাথে আমাগো পোলাপাইন ভিক্ষা করে। অর্ধেক আমাগো।

তোর জন্য আজকে কম আসছে। আর জানি না দেখি। কাউলার আঘাতপ্রাপ্ত শরীরে আরও আঘাত পড়ল। প্রচন্ড ব্যাথা আর ক্ষিদা নিয়ে কাউলা যখন আবার বনরুটি কিনতে গেল তখন আবিষ্কার করা হল বাকি ১৫ টাকা আর নাই। পকেট আগেই ছিড়া ছিল।

গরু পিছনে ছুটতে বা অন্য কোন সময়ে তা নাই হয়ে গেছে। পরের দিন সকালে রাস্তায় শুয়ে ছিল তখন আবার মামা আসল। মামা ঘুম থেইকা উঠায় বলে, কিছু খাইছস? কাউলা এবারো চুপ। মামা কাউলারে বাসায় নিয়ে গেল। কাউলা অবাক হল আজ সকালেই ভাত! মামী বলল, তোরে খালি গাইল দেই এমন মনে করস ক্যান? তোরে খাওনও দেই।

এখন মরিচ ডলা দিয়া খাইয়া রেডি হ। আইজ কুরবানীর ঈদ। মাংস টোকাইতে যাবি। মামা বলল, সকালে খাওয়াইয়া দিলাম। রাইত পর্যন্ত মাংস টোকাইবি।

তারপর আবার খাওন পাবি। এখন যা ছালা নিয়া বাইর হ। কাউলা মাংস টোকাতে গেল। কোথাও ঢুকতেই পারলনা কারন আগেই অনেকে এসে হাজির। কোথাও বড়দের শাসানি।

তারপরেও আধাঘন্টা প্রতি মাংস হারে কিছুটা যোগার হল। ঠ্যালা গুতার অভাব নাই। কালকেই হাতে পায়ে ব্যাথা পেয়েছে সে। এরমধ্যে এক বাসা থেকে দাড়োয়ানের গলাধাক্কায় রাস্তাতেই পড়ে গেল। তার কলিক শ্রেণী মানে যারা মাঙ্গস টোকাইতে আসছে তারা সহানুভুতি তো দেখালোই না তারা হাসতে শুরু করল সেই গলা ধাক্কা দেখে।

কাউলা তারপরেও তার অধ্যবসায় চালু রাখল। যেভাবেই হোক মামাকে আজ মাংস যোগার করেই দিবে। তারপর আসল গল্পের ক্লাইমেক্স। সমস্যা যেটা হল এক জায়গায় রাস্তার মোড়ে সে মাংস কাটা দেখছিল তখন তার ছালা হাত থেকে পড়ে গেল। তার নিজের মাংস ঐখানের গরু বানানোর সাথে মিশে গেল।

সে যখন টোকাতে গেল তখন কে জানি বলল, চোর। মাংস চোর। মাংস চোর। মাংস চোর নামে আলাদা খেলা আছে কিন্তু এ সত্যিকারের মাংস চোর। দমাদম লাথি, ঘুষি , চর, থাপ্পড়।

অন্যদিকে হাসাহাসি। ভিতর থেকে এক মহিলা তখন দৌড়িয়ে আসল। এই দাঁড়াও দাঁড়াও কি হচ্ছে এখানে? সবাই বলল, নিলুফার ম্যাডাম এ মাংস চোর। মহিলা বলল, আরে এটা সেই ছেলেটা না যাকে দশ টাকা দিলাম!! ইনফ্যাক্ট এই ছেলেটা আরেকজনের মানিব্যাগ তুলে দিয়েছিল। উহু এ চোর না।

তারপরেও নানা মনে সন্দেহ থাকল এ চোর কিন্তু ম্যাডাম তাকে বাঁচানোর জন্য এভাবে বলল। ম্যাডাম তাকে ভিতরে নিয়ে গেল। তুমি দাঁড়াও। তুমি তো ভাল ইঞ্জুরড। ম্যাডাম কাউলার জায়গায় জায়গায় ব্যান্ডেজ বেধে দিল।

কাউলাকে অনেক গুলা মাংস দিল। তারপর বলল, যাও আর কোথাও মাংস টোকাতে যেওনা। রেস্ট নাও। আমার ধারনা তোমার গায়েও জ্বর। কাউলা আবারো অভিভূত হল।

সে কখনই জানতনা তার জন্যও কেউ ভাল ব্যবহার রেখে দিয়েছে। ২ বছর পরের কথা। কাউলা ঐ মাংস মামাকে দেয়নি। সে সেটা হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়ে পরে ঝালমুড়ির ব্যবসা শুরু করে আর এখন ফুচকা, চটপটি। মামা আর মামী মাইর দিবে কি মামা-মামী এখন পুরাপুরি কাউলার উপর নির্ভরশীল।

কাউলা নিজের মত টোকাইদের যোগার করে তার চটপটির দোকান কাজ দিয়েছে। চাকার দোকানের উপর লেখা নিলুফার ম্যাডাম চটপটি। একবার রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক ডাক্তার মহিলা দেখলেন, আরে কি আজব!! আমার নামে চটপটির দোকান!! সেই মহিলার ছেলে মজা করে বলল, মাম, ইয়রস চটপটি। সৎ ব্যক্তির একটা ব্যবস্থা আল্লাহই করে দেন। কাউলার মত জায়গায় থেকেও কেউ কেউ সৎ থাকতে পারে।

কোরবানির মাংসের ৩ ভাগের ১ ভাগ নিজের জন্য, ১ ভাগ আত্মীয়দের জন্য, আর ১ ভাগ কাউলাদের জন্য। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।