আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘুমাও বাউণ্ডুলে, ঘুমাও এবার...

আমার খুব কষ্ট হয়, যখন RAJAKAR বানানটা বাংলা বর্ণমালায় লিখা হয়। এটা বর্ণমালার জন্য অপমান। "কে বেশি পাগল, কবি, না কবিতা দরকার নেই সেই হিসেব দেবার। ঘুমাও বাউণ্ডুলে-ঘুমাও এবার। " আব্বার নিষ্প্রান দেহটা যতক্ষণ না বাঁশের ডাই এর আড়ালে একেবারে ঢাকা পড়ে গেলো, ততক্ষণ গিট্টুমিয়া উঁকি দিয়ে দিয়ে দেখছিলো।

শেষ ডাই’টা দেয়া হয়ে গেলো। তার উপরে চাটাই। গিট্টুমিয়া (পূর্ণ ওর আসল নাম) এক দৌড়ে একে আমাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো। তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা চিরতরে মাটির গর্ভে হারিয়ে গেলো। সাড়ে সাত বছরের একজন মানুষ কিইবা বলতে পারে? তার আছে কেবল কান্না।

কবরের পাশ থেকে সবাই চলে গেছে, দাঁড়িয়ে আছি কেবল আমি আর পূর্ণ। পূর্ণ কাঁদছে। আর আমি শেষ বারের মতো কবরের গা ছুঁয়ে দেখলাম। মাথায় ঘুরছিলো লাইন ক’টি-‘ঘুমাও বাউণ্ডুলে, ঘুমাও এবার’। বিড়বিড় করে তাই বললাম।

তারপর হিরন্ময় নিরবতা! লোকটা বাউণ্ডুলে ছিলোতো বটেই। নইলে কি আর সদ্য প্রেমিকাকে ছেড়ে যুদ্ধে যায়? তার অসমাপ্ত ডায়েরি হাতে নিয়ে বসেছিলাম স্থাণুর মতো। একদিন সে বলেছিলো, ‘বাজান, যুদ্ধের ঘটনা। লেখা শেষ হইলে ছাপাইয়া দিও। আমার তো ছাপানোর মতো টাকা নাই’।

সম্মতিতে ঘাড় নেড়েছিলাম। আচ্ছা। ডায়েরিতে হিসেব লিখা। ২৩৫০০ টাকা ধার। ৫৮০০০ টাকা ব্যাংক লোনের ৩৬৪০০ শোধ করেছেন।

বাকীটাকা গুলো শোধ করার আপ্রান চেষ্টা করেছেন বলে বোঝা গেলো। ধার করে ধার শোধ করার বেশ কিছু ইতিহাস পাওয়া গেলো। আর তিনটা ডায়েরি ভর্তি কবিতা। মুক্তাক্ষরে লিখা। যেখানে কাটাকুটি হয়েছে, পরম যত্নে ফ্লুইড দিয়ে নিজের ভুল ঢেকেছেন।

হায়! মৃত্যুর মতো বড় ভুলকে তিনি ঢাকতে শিখেননি। পকেটে টাকা নিয়ে বের হলাম ধার শোধ করার জন্য। ঘুরে ঘুরে শোধ করলাম একজন মুক্তিযোদ্ধার সারা জীবনের সঞ্চয়। সঞ্চয় মানে এখানে দেনা। সারাজীবন খরচ করে গেছেন এমনকি শেষ পর্যন্ত জীবনটাও।

সঞ্চয় করবেন কি করে! সন্ধ্যে বেলায় ঘরে ফিরলাম। নির্ভার। রাত ৮টা গ্রামের জন্য নিশুতিই বলা চলে। তার উপর মৃতশোকাহত বাড়ি। ঢোকার সময় দেখলাম গিট্টুমিয়া গেটের কাছে দাঁড়িয়ে।

জিগ্যেস করলাম, ‘কি করো’? সে বললো, ‘আমার ভালো লাগেনা’। প্রতি সন্ধ্যায় আব্বা বাইরে থেকে ফেরার সময় ফোন দিতো গিট্টুমিয়াকে। গিট্টুমিয়া গেটে দাঁড়িয়ে থাকতো। তার দাদাজি’র পায়ের শব্দও তার চেনা। অন্ধকারে সে দৌড়ে যেতো আব্বার হাতে ঝুলতে থাকা বাজার কিংবা তার ফরমায়েশ হাতে নেবার জন্য।

তারপর দুজন সরবে গল্প করতে করতে উঠোন পেরিয়ে ঘরে ঢুকতো। সেদিন সন্ধ্যেবেলায় দেখি পূর্ণ তার বন্ধুদেরকে বলছে-আকাশের ঐযে সবচেয়ে বড় তারাটা, ঐটা আমার দাদাজি। চুপচাপ সে বারান্দায় রাখা সোফাটাতে শুয়ে থাকে-ঠিক যেভাবে আব্বা শুয়ে থাকতেন। কিছু জিগ্যেস করলে সে বলে ‘আমার ভালো লাগেনা’। পড়তে বসে বইয়ের প্রতিটা পৃষ্ঠায় সে তার দাদাজি’র চিহ্ন খুঁজে পায়।

সে পড়া ভুলে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। লিখতে গিয়ে বকুল ফুল বানান ভুল করে। আমি ভুল করে ডায়াল করে ফেলি আব্বার নাম্বারে। বন্ধ ফোনের ওপার থেকে দুঃখ প্রকাশ করা যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরটাকেও আমার খুব বিষণ্ণ মনে হয়। আমি ফুঁপিয়ে উঠি।

ছবিঃ ৮ই জুন, ২০১৩, আব্বা মারা যাবার দুইদিন আগে নিজের হাতের লিখায় আব্বার সর্বশেষ কবিতা। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।