আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘‘প্রতি রাতে আমি যদি একটি ছোটখাট মিটিং না করি, সে রাত্রে আমার ভালো ঘুমই হয় না। নিরাপত্তাকর্মীদের কাছ থেকে এটি আদায় করেছি। প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মানুষের সঙ্গে আড্ডার ব্যবস্থা করেছি বঙ্গভবনে’’।

৫ই মে এর গনহত্যা ইতিহাসের নৃশংস গনহত্যা জনসান্নিধ্যের কাঙাল ছিলেন সদ্য প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। এই তুখোড় রাজনীতিখ জীবনের ৬২টি বছর একটানা কাটিয়েছেন জনগণের সঙ্গে, তাদের নিবিড় সান্নিধ্যে। জীবনের শেষ সময়ে এসে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর নিরাপত্তা প্রটোকলের কারণে জনগণ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন জনগণমননন্দিত এই নেতা। তাঁর শারীরিক অসুস্থতার জন্য এই জনবিচ্ছিন্নতাও কম দায়ী নয়। গত বছরের ডিসেম্বরে চিকিৎসার জন্য লন্ডন এসেছিলেন রাষ্ট্রপতি।

শারীরিক চেকআপ শেষে ডাক্তাররা তাঁর জনসান্নিধ্য বাড়ানোর পরামর্শও দিয়েছিলেন। ২০১০ সালের মধ্যভাগে রাষ্ট্রপতি লন্ডন সফরে এসেছিলেন। এসময় তিনি একান্তভাবে মিলিত হয়েছিলেন ব্রিটেনের বাংলা মিডিয়ার কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের সঙ্গে। লন্ডনের সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় ঐসময় বেরিয়ে এসেছিলো জনসান্নিধ্য লাভের জন্য একজন রাষ্ট্রপতির আকুতির কথা। রাষ্ট্রপতির জনসান্নিধ্যের আকুতি নিয়ে এই প্রতিবেদক ব্রিটেনের জনপ্রিয় বাংলা ম্যাগাজিন ‘মিলেনিয়াম’-এর কাভার স্টোরি করেছিলেন ওই সময়।

লন্ডনে ওই সফরকালে রাষ্ট্রপতি প্রবাসীদের দেওয়া নাগরিক সংবর্ধনায়ও যোগ দেন। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ছিলেন দেশের একজন প্রবীণ রাজনীতিক। উপমহাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের তিনটি সময়ের সরব সাক্ষী কালদর্র্শী এই রাজনীতিক তাঁর ৮৪ বছরের জীবনের ৬২ বছরই কাটিয়েছেন রাজনীতিতে, জনগণের সান্নিধ্যে। বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় সংসদ সর্বসম্মতিক্রমে তাকে রাষ্ট্রপতি মনোনীত করে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার পর বঙ্গভবনে ঢুকে এক সময়ের জনমানুষের নেতা জিল্লুর রহমান নিরাপত্তার জালে অনেকটাই আবদ্ধ, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

যদিও মানুষের কাছাকাছি থাকতে বঙ্গভবনের অনেক নিয়মও তিনি বদলেছিলেন, তারপরও রাষ্ট্রপতির জনসান্নিধ্যের তৃষ্ণা মেটেনি। রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত এসএসএফ সদস্যরাও তাঁকে নিয়ে শান্তিতে ছিলেন না। ২০১০ সালের ২৭ জুন, রোববার রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান লন্ডনের সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন জনসান্নিধ্যের জন্য তার আকুতির কথা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পর মূলত জিল্লুর রহমানই প্রথম রাষ্ট্রপতি যিনি একজন সার্বক্ষণিক রাজনীতিক হিসেবে দীর্ঘ ৬২ বছর কাটিয়েছেন জনগণের সান্নিধ্যে। সেই তরুণ বয়সে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে জনকল্যাণের ব্রত নিয়ে যে যাত্রা তাঁর শুরু হয়েছিল, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের আগ পর্যন্ত সেই একই ব্রত নিয়ে তিনি কাজ করে গেছেন।

ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিচারণ করতে করতে রাষ্ট্রপতি লন্ডনের সিনিয়র সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এসএসএফ সদস্যদের নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি তাঁর মোটেও ভালো লাগে না। এসএসএফ সদস্যরা নিরাপত্তার খাতিরে অনেক সময় অনেক অনুষ্ঠানে যখন কাউকে ধাক্কা দেয়, এটি তাঁর কাছে খুবই পীড়াদায়ক হয়ে ধরা দেয়। রাষ্ট্রপতি জানালেন, আগে দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে কাউকে সাক্ষাৎ করতে হলে আবেদন করার পর প্রায় একমাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো, এটি তিনি বন্ধ করেছেন। তিনি তাঁর কর্মকর্তাদের সাফ বলে দিয়েছেন, একদিনের মধ্যেই আগ্রহী ব্যক্তিকে সাক্ষাতের অনুমতি দিতে হবে। জিল্লুর রহমান হৃদয়ের আকুতি দিয়ে জনসান্নিধ্যের লোভ এভাবেই প্রকাশ করেছিলেন সাংবাদিকদের কাছে, ‘‘প্রতি রাতে আমি যদি একটি ছোটখাট মিটিং না করি, সে রাত্রে আমার ভালো ঘুমই হয় না।

নিরাপত্তাকর্মীদের কাছ থেকে এটি আদায় করেছি। প্রতিদিন বিকেল ৫টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত মানুষের সঙ্গে আড্ডার ব্যবস্থা করেছি বঙ্গভবনে’’। সাংবাদিকদের রাষ্টপতি আরও বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি যত বেশি মানুষের কাছাকাছি থাকবো, ততই শারীরিকভাবে ভালো থাকবো। আর আমার নিরাপত্তাকর্মীরা মনে করে মানুষের কাছ থেকে যত দূরে থাকবো ততই মঙ্গল। ’ রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, ‘আমি জানি এই লন্ডনেও অনেকের ইচ্ছা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে একটু দেখা করবে, কথা বলবে।

কিন্তু এটিও সম্ভব হয় না প্রোটোকলের কারণে। লন্ডন এসে আমি আমার নিরাপত্তাকর্মীদের বলেছি যারাই দেখা করতে আসবে তাদেরই সুযোগ দিতে হবে। এরপরও তা হয়ে ওঠে না। রাষ্ট্রপতি অবশ্য নিরাপত্তাকর্মীদের এ জন্যে কোন দোষ দেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রের নিয়ম কানুন তো তাদের মানতে হয়, রাষ্ট্রপ্রধানের জীবনের নিরাপত্তাই তাদের কাছে বড়।

’ ওই সময় তিনি অনেকটা কৌতুক করে লন্ডনের সাংবাদিকদের বলেন, ‘আপনারা বলেন রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অভিভাবক, কিন্তু আমি বলি রাষ্ট্রপতিরও অভিভাবক আছে, তারা হলো নিরাপত্তাকর্মী’’। নিরাপত্তার বেড়াজাল নিয়ে রাষ্ট্রপতি যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখনও তাঁর পাশেই ছিলেন এসএসএফ কর্মকর্তাসহ তাঁর ব্যক্তিগত কর্মকর্তারা। জিল্লুর রহমান বলেছিলেন, ‘জীবনের ৬২ বছরই কাটিয়েছি রাজপথে, জনগণের সঙ্গে। আজ কিভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে একটি ভবনে বন্দি হয়ে থাকি বলুন। ’ মাঝে মাঝে কোন অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার আগ মূহূর্তে যখন নিরাপত্তাকর্মীরা জানান নিরাপত্তার কারণে ঐ অনুষ্ঠানে যাওয়া যাবে না, তখন ভীষণ রকম কষ্ট পেতেন জিল্লুর রহমান।

লন্ডনের সাংবাদিকদের কাছে তিনি প্রশ্ন রেখেছিলেন, ‘দীর্ঘ একমাস অথবা তাঁর চেয়ে বেশি সময়ের চেষ্টার ফলে হয়তো কোন সংগঠন রাষ্ট্রপতিকে প্রধান অতিথি করে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করলো, অনুষ্ঠানের আগ মূহূর্তে যখন বলা হয় ঐ অনুষ্ঠানে যাওয়া যাবে না, তখন উদ্যোক্তা বা রাষ্ট্রপতির নিজের মনের অবস্থা কি হয়, আপনারা বিবেচনা করুন। ’ তিনি বলেছিলেন, ‘দুয়েক বার এ ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হলে আমি সাফ বলে দিয়েছি আমি অনুষ্ঠানে যাবোই, জীবনের শেষ প্রান্তে আমি, এমনিই হয়তো আর বেশি দিন বাঁচবো না। আয়ু ফুরালে কেউ আমাকে রক্ষা করতে পারবে না। ’ দেশ, জাতি ও জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের ত্যাগ আপন গৌরবে উদ্ভাসিত। জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষ, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আজীবন লড়াকু সৈনিক সহধর্মিনী আইভি রহমানকে তিনি হারিয়েছেন ধর্মান্ধ মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তির নিষ্ঠুর গ্রেনেডের আঘাতে।

এর চেয়ে বড় ত্যাগ একজন রাজনীতিকের জীবনে আর কি হতে পারে? স্ত্রী আইভি রহমানের মৃত্যু জিল্লুর রহমানের ব্যক্তিগত জীবনে ঝড় বইয়ে দিলেও দেশ ও জনগণের কাছ থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন করতে পারে নি। সেই বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন সময়ে স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তাঁর সর্বোচ্চ ত্যাগ আজ অনেকটা ইতিহাসের অংশ, যা নতুন প্রজন্মের রাজনীতিকদের অনুপ্রাণিত করবে নিঃসন্দেহে। আদর্শিক অঙ্গীকারের প্রতি রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের দৃঢ়তা তাঁকে এক কিংবদন্তিতে পরিণত করেছে। স্ত্রী আইভি রহমানের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও সব ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে যে দৃঢ়তা নিয়ে তিনি আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তা আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনীতিকদের আরো সাহসী হওয়ার প্রেরণা হয়েই থাকবে। রাজনীতিতে জিল্লুর রহমান একজন সফল ব্যক্তিত্ব।

তরুণ বয়সে মাঠ পর্যায় থেকে রাজনীতি শুরু করে জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি হয়েছিলেন জাতির অভিভাবক, দেশের রাষ্ট্রপতি। ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ স্থান কয়জন রাজনীতিকের ভাগ্যে জোটে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে জিল্লুর রহমান ছিলেন একজন সক্রিয়কর্মী, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের মূল ভিত্তি বায়ান্ন’র ভাষা আন্দোলনে ছিলেন একজন তরুণ নেতা এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন একজন শীর্ষ সংগঠক। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সহযোদ্ধা হয়ে তিনি একসাথে রাজপথ কাঁপিয়েছেন বাঙালির অধিকার আদায়ের আন্দোলনে। ইতিহাসের সরব সাক্ষী হয়ে জিল্লুর রহমান হয়েছিলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা।

দলমত নির্বিশেষে সকলের অভিভাবক। জাতির অভিভাবক হয়ে বঙ্গভবনে প্রবেশের পর আজীবন জনসঙ্গী রাজনীতিক জিল্লুর রহমান হয়ে পড়েছিলেন অনেকটা একা। এই একাকিত্ব তাঁকে খুব পীড়া দিত। সেই বেদনা ও পীড়ার বার্তাই তিনি ২০১০ সালে পৌঁছে দিয়েছিলেন লন্ডনের সাংবাদিকদের কানে সূত্র বাংলা নিউজ ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.