আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশে দুর্নীতি: ধারণা, প্রেক্ষিত ও প্রাতিষ্ঠানিক মোকাবিলার হালচাল

( দ্বিতীয় কিস্তি) দুর্নীতি অনেক পুরনো রোগ : পর্যালোচনা খ্রীষ্টপূর্ব তিন শতাব্দী আগে প্রাচীন ভারতের কূটনীতি শাস্ত্রের পুরোধা চাণক্য লিখে যান, সাপের বিষ জিভের আগায় রেখে তার স্বাদ নেয়া যেমন অসম্ভব তেমনি ক্ষমতায় অধিষ্টিত ব্যক্তিদের রাজকোষের সম্পদে ভাগ না বসানো প্রায় অসম্ভব। চানক্যের অর্থশাস্ত্রের বয়স প্রায় দু হাজার বছর । চানক্য আরো লিখেছেন, সরকারী কর্মচারীরা দুভাবে বড়লোক হয়,তারা সরকারকে প্রতারনা করে অন্যথায় প্রজাদের অত্যাচার করে। চানক্যের অর্থশাস্ত্রে সরকারী কর্মচারীদের চল্লিশ ধরনের তছরুফের ও দুর্নীতির পন্থা চিহ্নিত করা হয়েছে । দুর্নীতির কুফল সম্পর্কে সজাগ থাকা সত্ত্বেও চানক্য রাজস্ব বিভাগে দুর্নীতি অনিবার্য মনে করতেন , তার মতে, ''জিহ্বার ডগায় বিষ বা মধু থাকলে তা না চেটে থাকা যেমন অবাস্তব তেমনি অসম্ভব হলো সরকারের তহবিল নিয়ে লেনদেন করে এতটুকুও সরকারের সম্পদ চেখে না দেখা ।

দুজন মার্কিন অধ্যাপক যথাক্রমে Dvendy Doniger এবং Brian Smith আমলাতন্ত্রের দুর্নীতির কথা বলতে গিয়ে মনুস্মৃতির ইংরেজী সংকলনে লেখেন যে , প্রজাদের রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে রাজা যাদের নিয়োগ করেন তারাই ভন্ডামি করে অন্যদের সম্পত্তি গ্রাস করে। দুর্নীতি একটি ক্রমবিস্তারকারী অনুসঙ্গ। এক ধরনের দুর্নীতি অন্য ধরনের দুর্নীতির জন্ম দেয় । একখাত হতে দুর্নীতি অন্য খাতে সংক্রমিত হয় । এই পরিস্থিতিতে আইন সমাজের পরাক্রমশালীদের নিয়ন্ত্রন করতে পারেনা ।

ঐতিহাসিক উইল ডুরান্টের মতে, Law is a spider's web that catches the little flies and lets the big bugs escape. দুর্নীতি থেকে মুক্তি অর্থনৈতিক মুক্তির পূর্বশর্ত দুর্নীতি সমাজের সুখ শান্তি নষ্ট করে অশান্তি ছড়ানোর ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা পালন করে । বা্স্তবের দিকে তাকালে দেখা যাবে, দুর্নীতির ফলে এক ধরনের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং উপকৃত হচ্ছে আরেক শ্রেনীর মানুষ, যারা মূলত অপরের অধিকার খর্ব করে থাকে । দুর্নীতির কারণে সমাজ তার গতি হারায়। পারস্পরিক দ্বন্ধ সংঘাত বাড়ে। সবকিছুকে গ্রাস করে অনাকাঙ্ক্ষিত এক স্থবিরতা।

জনজীবনকে পর্যদুস্ত করে। বিরাজমান চরম হতাশা ও নৈরাজ্যের পেছনে দুর্নীতি দায়ী। দুর্নীতির কারণেই আমাদের অর্থনৈতিক দুর্দশার সৃষ্টি। দুর্নীতি সব সফলতাকে ম্লান করে দেয়। সমাজের প্রতিটি স্তরেই দুর্নীতি যেন মানুষের আষ্টেপৃষ্টে মিশে আছে।

এটা দিনদিন আরো ব্যাপকতা লাভ করছে। দুর্নীতি সুন্দর ও শান্তিময় সমাজ বিনির্মানের প্রধান প্রতিবন্ধকতা দুর্নীতি আর্থসামাজিক উন্নতি রোধ করে স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করে এবং অগ্রগতির অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশে দুর্নীতির সূচনা ও বিকাশ বাংলাদেশে দুর্নীতি কবে কিভাবে শু্রু হয়েছিল তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা কমই হয়েছে। তবে বারবার শোষিত হওয়ায় উৎপন্ন থেকেই এরকম বিদ্রোহাত্নকভাবে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে দুর্নীতির মানসিকতা জন্ম লাভ করেছে বলে সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন। বিশিষ্ট লেখক কামরুদ্দীন আহমদ এই প্রসঙ্গে লিখেছেন,বাংলাদেশের গ্রামের অধিবাসীরা সব সময় তাদের বন্ধ সমাজে বাস করার দরুন দিল্লী বা কলকাতার শাসন ব্যাবস্থার পরিবর্তনে কদাচিৎ প্রভাবিত হয়েছে।

কিন্তু ১৯৪৩-এর মানুষের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে যখন গ্রাম্য সমাজের ভিত্তি নড়ে উঠেছিল, তখন ক্ষুধার জ্বালায় তারা শহর অভিমুখে দৌড়াতে বাধ্য হয়েছিল। এক মুষ্টি খাবারের জন্য স্ত্রী, পু্ত্র ও শিশুরা বাড়ি-ঘর ত্যাগ করে শহরের রাস্তায় ভিড় করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই প্রা্য় বিশ লক্ষ লোক অনাহারে মারা গেল। পল্লীর সরল প্রকৃতির লোকেরা প্রত্যেকের উপর আস্থা হারিয়ে ফেললো। এর ফলে সত্য ও সাধুতার প্রতি তাদের শ্রদ্ধাও বিসর্জন দিল।

সমাজের স্বার্থ অপেক্ষা নিজ স্বার্থের দ্বারাই তারা বেশির ভাগ পরিচালিত হতে থাকল। সাধু উপায়ে জীবন যাপন করার চেয়ে অর্থ সম্পদ আহরণই তাদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ হল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এদেশের মানুষ দেখেছে দু:শাসন, অত্যাচার , নির্যাতন আর অধিকার হারানোর চিত্র। পাকিস্তানীরাও বঞ্চিত করেছে বাংলার মানুষকে । ব্যবসায়ীদের খুশি করতে ঐ সময় সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে চাষি সমাজ বেকায়দায় পড়ে যায়।

পাকিস্তানীদের চরিত্রে উপনিবেশিক আচরণ দেখে ক্ষুদ্ধ মানুষ আবারও ঝাপিয়ে পড়েছে সংগ্রামে। প্রতিষ্ঠা করে আত্ননিয়ন্ত্রণাধিকার ৭১-এর স্বাধীনতা। কিন্তু তারপরও এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জিত হয়নি। ফলে এই ক্ষোভই তাদের নগদ যা পাও হাত পেতে নাও জাতীয় দর্শনের প্রতি অনুপ্রাণিত করেছে। এভাবেই দুর্নীতির বেড়াজালে আষ্টপৃষ্টে বাধা পড়ে গেছে বাংলাদেশের মানুষ।

এদেশে দুর্নীতি অনেক আগে থেকেই ছিল। চাণক্যের লেখায়ও আমরা তার প্রমাণ পাই। অন্যান্য ইতিহাস গ্রন্থে এই দুর্নীতির কথা বলা আছে। দুর্নীতির ধরণটা তখন ছিল মূলত উপহার হিসাবে ব্যবহার অথবা বখশিশ , যেটা ব্রিটিশ আমলে বিশেষভাবে চালু হয়। কখনও কখনও উপটৌকনের সঙ্গে মেয়েদেরকেও লিপ্ত করা হতো এই দুর্নীতিতে।

একটি গ্রন্থের নামই হলো গার্লস, গিফট গ্রাফট্স অ্যান্ড গুনস, যেখানে এ সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে। অর্থাৎ দুর্নীতির এই নানামুখিতা ঐতিহাসিকভাবেই বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে চলে আসছে। পলাশীর যুদ্ধের সময়ও দুর্নীতি দেখেছি। দুর্নীতি এদেশের ইতিহাসে নতুন নয়। দুর্নীতির সঙ্গে ক্ষমতার যে সম্পর্ক সেটাও নতুন কিছু নয়।

ব্রিটিশ আমলে সরকারি চাকরিতে কয়েকটি ক্ষেত্রে দুর্নীতি ছিল। যেমন-পুলিশের নিম্নপদে খাজনার সঙ্গে যুক্ত তহশিলদারদের, কোর্টে পেশকার ও নেজারতদের অর্থাত অল্প বেতনভোগী সরকারি কর্মচারী যারা সুবিধা দিতে পারতেন তাদের একটি অংশ কোনও না কোনও ভাবে দুর্নীতিতে যুক্ত ছিলেন। দুর্নীতি বেসরকারি খাতেও ছিল, মুনাফাখোরী, মজুদদারি কিংবা ভেজাল দেওয়া। ভেজালের মধ্যে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের দুর্নীতির পরিচয়টা আমরা পাই । তবে রাজনীতিবিদ মানেই সব দুর্নীতিবাজ।

রাজনীতিতে দুর্নীতি নিয়ে জনমনে এমন ধারণা সৃষ্টির জন্য বিশেষ মহলের প্রচারণা শুরু হয় ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মোসলেম লীগের পরাজয়ের পর। প্রথমে দুর্নীতির সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ সংযুক্ত করে যুক্তফ্রন্টকে তথা পূর্ববঙ্গবাসীকে দ্বিধাবিভক্ত করা হলো। অত:পর রাজনীতিবিদ প্রধানত মন্ত্রীদের জেলে পুরে তৎকালীন পূর্ব বাংলার গভর্নর জেনারেলের শাসন চাপিয়ে দেওয়া হলো। কয়েক বছরের মধ্যেই অবশ্য গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৫৮ সালে গণতান্ত্রিক শাসনকে স্থানচু্যত করে সামরিক শাসন কায়েম করলেন রাষ্ট্রপতি ইস্কান্দার মির্জা, নেপথ্যে জেনারেল আইয়ুব খান।

ক্ষমতায় এসেই জেনারেল আইয়ুব খান বুঝলেন, সেনাশাসন কায়েম করতে হলে জনগণের গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে উচ্ছেদ করতে হবে। এরই প্রথম পদক্ষেপ হবে, রাজনীতিবিদদের চরিত্র হনন, তাদের প্রতি জনগণের বিদ্বেষ সৃষ্টি। সেই ই্চ্ছার প্রতিফলনে তিনি রাজনীতিবিদদের ঢালাওভাবে দুর্নীতিবাজ অভিহিত করে রাজনীতির সামনের কাতারের ব্যক্তি-মন্ত্রীদের ও গড়পড়তা সব রাজনীতিবিদকে নির্বাসনে পাঠানোর জন্য একটি ফরমান জারি করলেন পাবলিক রিপ্রেজেনটেটিভ অফিসারস ডিসকোয়ালিফিকেশন অ্যাক্ট। জনপ্রতিনিধিত্ব করার অধিকার হরণ করার জন্য এ আইনে দুর্নীতির অভিযোগে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলো। অধিকাংশকে সামরিক আদালত জেলে পাঠালেন।

বিস্ময়কর হলেও সত্য, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিবিদদের অনেকেই সামরিক শাসকের দাবড়ানিতে তথাকথিত সব দুর্নীতির অভিযোগ স্বীকার করে নিয়ে অবসরে গেলেন। অল্প কয়েকজন আদালতে লড়াই করে অভিযোগ খন্ডনের সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল শহীদ সোহরাওয়াদী, হামিদুল হক চৌধুরী, মিয়া মমতাজ দোলতানা, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ। অবশ্য সামরিক কোর্ট তাদের বক্তব্য আমলে নেয়নি। আইয়ুবি স্বৈরশাসনের অবসানের পর স্বৈরশাসকের দেওয়া দুর্নীতির লেবাসটি জনগণই ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন।

প্রাথমিক সময়ের দুর্নীতি প্রশাসনিক দুর্নীতি হিসেবে চিহ্নিত করা হতো । প্রায় সকল আমলাতান্ত্রিক কাঠামোতেই দুর্নীতির কমবেশি উপস্থিতি খুজে পাওয়া যায় । ভারতে ব্রিটিশ আমলের প্রশাসন ছিল দুর্নীতিপূর্ণ। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের দুর্নীতির কথা সর্বজন বিদিত । ১৯৪৭ এর ভারত বিভক্তির পর ভারত বা পাকিস্তান কেউই দুর্নীতি সীমিত করার ব্যাপারে সফলতা পায়নি ।

বরং স্বজনপ্রীতি, ঘুষ , রাজনৈতিক প্রভাব উভয় দেশের প্রশাসনে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তানী আমলে শুধুমাত্র ১৯৫৯-৬০ সালে দুর্নীতিপরায়নতার জন্যে ৫ জন সরকারী কর্মচারীকে বরখাস্ত, ৬ জনকে বদলি এবং কয়েক জনকে বাধ্যতামূলকভাবে অবসর দেয়া হয়। পাকিস্তানে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতি দমন করার জন্য Constituent Assembly ১৯৪৯ সালে Public and Representative offices Disqualification Act পাশ করে । পাকিস্তান আমলে দুর্নীতির একটি অন্যরকম ব্যাপ্তি আসে। এখান থেকে অমুসলিমরা চলে যায় আর ওপার থেকে মুসলমানরা আসে।

তখন এপারের সঙ্গে ওপারের সম্পদের একটা বিনিময় হচ্ছিল। এই বিনিময়ের দলিল করতে গিয়ে একটা দুর্নীতি হলো। ভূমির দলিল নিয়ে দুর্নীতি তখন থেকে বিস্তৃতি লাভ করে । আমদানি লাইসেন্সের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ছিল; পাকিস্তান আমলে আয়কর, আমদানি কর, শুল্ক-এসব নিয়ে দুর্নীতি হতো। ব্যবসায়ীদের সাথে কর কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশ ছিল বলা হতো।

পাকিস্তান আমলের শেষ দিকে ১৯৬৫ সালে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের পর শত্রু সম্পত্তি নাম দিয়ে অনেক সম্পদ আটক করা হয় , তখন সেটাকে ঘিরেও একটা দুর্নীতি জাল বিস্তৃত হয়েছিল। তখন সরকারি প্রচেষ্টায় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের একটা চেষ্টা লক্ষ্য করা যায় , এই প্রকল্পে ঠিকাদার এবং সরবরাহকারীদের সঙ্গে সরকারি আমলাদের যোগসাজশে নতুন ধরনের দুর্নীতির সূচনা হয়। আইয়ুব খানের দিনপঞ্জিতে দেখা যায়, তিনি দুর্নীতির উল্লেখ করেছেন। সেই দুর্নীতি ব্যবসায়ের বিস্তৃতি এবং প্রতিরক্ষা ক্রয় বেড়ে যাওয়ার কারণে হয়েছে এবং দুর্নীতি সামরিক ও বেসামরিক খাতে বিস্তৃতি লাভ করে । পাকিস্তান আমলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরকার স্বল্প সুদে কৃষক কিংবা তাতীদের জন্য ঋণের ব্যবস্থা করত।

এই ঋণের ক্ষেত্রে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে দুর্নীতি ঢুকেছিল। সমবায়েও দুর্নীতি রাজনীতির মাধ্যমে বিস্তার লাভ করে । বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর এই দুর্নীতির একটা বিস্তৃতি ঘটল। প্রথমত, অবাঙালিদের সম্পদ লুণ্ঠন দিয়ে দুর্নীতি শু্রু হল। তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধারা দুর্নীতি শু্রু করলেন।

দ্বিতীয়ত, রাজাকার, আলবদর -এদের সঙ্গে সম্পৃক্তদের ধরে টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হয়। তৃতীয়ত, অবাঙালিরা প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে একটা কাগজ সংগ্রহ করত , যেটা করতে হতো পয়সা দিয়ে। সেটা দিয়ে তারা নেপাল হয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত চলে যেতে পারত। আর একটা দুর্নীতি হয় কোম্পানীগুলো রাষ্ট্রীয়করণ করার সময়। শ্রমিক নেতারা কলকারখানার কলকব্জা একবার খুলে বিক্রি করে, আবার সেগুলোই বিক্রি করেছিল সরকারি মিলের কাছে।

দুর্নীতির বিস্তার বাংলাদেশ আমলে এভাবেই শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশ হওয়ার পর রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যবসার বিকাশ ঘটে। পরিত্যক্ত ছোট ব্যবসা থেকে বড় ব্যবসা দেখভালের জন্য যে ব্যবস্থা করা হয় সেখানেও দুর্নীতি হয়েছে। সার বিতরণের জন্য ডিলারশীপ নিয়োগে রাজনীতিকরণের কারণেও দুর্নীতি হয়েছে। সিগারেট ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রী বিতরণের ব্যবস্থা সরকার নিয়ন্ত্রণ করত।

সেখানেও দুর্নীতি ঘটেছে। ফেলে যাওয়া পেট্রোল পাম্প নিয়ে দুর্নীতি হয়েছে। লোক নিয়োগেও দুর্নীতি হয়েছে। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। বঙ্গবন্ধু কোন দুর্নীতিবাজকে ক্ষমা করেননি।

তিনি দুর্নীতির অভিযোগে ২৩ জন এমসিএ-কে দল থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ..,২৩ জন এমসিএ-কে বহিষ্কার করেছে কোন পার্টি ? এমন বহিষ্কারের নজির পৃথিবীর আর কোন দেশের ইতিহাসে আছে ? কিন্তু আমি বহিষ্কার করেছি , আওয়ামী লীগ করেছে। ভবিষ্যতে যদি কোন এমসিএ বা পার্টি - সে যে পার্টিরই হোক না কেন, কিংবা কোন শ্রমিক নেতা বা ছাত্র নেতা চুরি করে তাহলে আমি মাফ করবোনা। ..এমসিএ'দের মধ্যে ভালো মানুষ আছে, খারাপ মানুষও আছে। সব দলেই ভালো মন্দ মানুষ আছে।

যারা খারাপ তারা সব সময়ই খারাপ । আমার দলের মধ্যে কেউ যদি চুরি করে, বিশ্বাস রাখতে পারেন, তাকে কেমন করে শায়াস্তা করতে হয় আমি তা জানি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে বেসামরিক ও সামরিক বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতির কথা শুনা গেছে। সামরিক সরকারগুলো বিভিন্ন কায়দায় দুর্নীতিকে ব্যাবহারও করেছেন। জিয়াউর রহমান শাসনক্ষমতায় এলে দুর্নীতির অন্য এক প্রকৃতির সাথে পরিচিত হই।

জিয়াউর রহমান রাজনৈতিক দল করতে গেলেন। রাজনৈতিক দল গঠন করতে গেলে অর্থের প্রয়োজন হয়। সেই অর্থ সংস্থানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন কিছু মন্ত্রীকে যারা বিরাষ্ট্রীয়করণ ও ব্যবসায়িক সুবিধার মাধ্যমে এই অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। সিবিএ নেতাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেও নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হন সাত্তার সাহেব। এইচ এম এরশাদ ব্যবসা করে বা ব্যবসায়ীদের সুবিধা দেওয়ার মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করেছেন এবং দুর্নীতির বিস্তার ঘটিয়েছেন।

সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে এরশাদের অর্থলিপ্সার বহি:প্রকাশ পাওয়া যায়। এই অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে । দুর্নীতির সঙ্গে অর্থ পাচার করার প্রবণতা সরাসরি যুক্ত করেন তিনি। এরশাদের পতনের পরের অবস্থায় দেখা যায় প্রশাসন, প্রকল্প , ব্যবসায়ী সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত। গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হলে আমলা , ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ-এই তিনের সম্পর্ক দৃঢ় হওয়ার কারণে দুর্নীতি আরো বাড়তে শু্রু করল।

জমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি, দলিল করায় দুর্নীতি, নির্মাণে রাজউকের দুর্নীতি, বিক্রয়ে দুর্নীতি-উন্নয়ন প্রকল্পের সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি। নির্বাচনেও দুর্নীতি ঘটে গণতন্ত্রই বিপন্ন আজ। রাজনীতিবিদ, বিশেষ করে মন্ত্রী নেতা-নেত্রীর পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের গায়ে দুর্নীতির কলঙ্ক লেপনের আইয়ুবি পন্থা অনুসরণ করলেন স্বাধীন বাংলাদেশে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমান। পরবতর্ী সময় জেনারেল এরশাদ সেই প্রয়াস অধিকতর সুসম্পন্ন করলেন। তবে পাকিস্তান আমলের চেয়েও দুর্নীতিবাজের ছাপটি পুরো গায়ে সেটে দেওয়ার ক্ষেত্রে জিয়া - এরশাদ কতিপয় রাজনীতিবিদ ও সাবেক মন্ত্রী-জননেতাকে শুধু একটি লেবাস পরালেন না, অনেককে দুর্নীতিবাজ বানানোর ব্যবস্থাটিও পাকাপোক্ত করলেন।

বাংলাদেশে দুর্নীতি মাঝে মাঝেই গরম ইসু্য হয়ে ওঠে। প্রথম সেরা দুর্নীতিবাজ দেশ হিসেবে চিহ্নিত হবার সময়ে টিআইবি রিপোর্টের দুর্বল দিকগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন কেউ কেউ, কিন্তু ওই রিপোর্ট নির্বাচনী হাতিয়ারে পরিণত হওয়ায় তাদের কথা তেমন গুরুত্ব পায়নি। বিএনপির দিক থেকে দেখলে টিআইবি রিপোর্ট ও দুর্নীতি ইস্যু সুযোগ নেয়াটা রাজনৈতিক দিক থেকে অন্যায় কিছু ছিলনা। কারণ তারা ১৯৯১-৯৬ মেয়াদে যখন ক্ষমতায় ছিল তখন আওয়ামীলীগ ১৯৯৩ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই বিএনপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনতে থাকে লাগাতরভাবে। শুধু তাই নয়, ১৯৯৬-এর গোড়ার দিকে যখন তৎকালিন বিরোধী দল গুলোর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার জন্য আন্দোলন যখন তুঙ্গে, সেসময় আওয়ামীলীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা এক বিবৃতিতে বলেন, বেগম জিয়া যদি তখনও দাবি মেনে নেন তাহলে বিরোধীরা নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করলেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করবেনা।

বিএনপি সেই সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দাবি মেনে নেয়নি। পরবতর্ী নির্বাচনে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা ঠিকই বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা শুরু করেন। এরপর ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা ঠিকই বেগম জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দায়ের করেন। তথ্যসূত্র: শেলী, ড. মীজানূর রহমান, দুর্নীতি দমন অভিযান কতটা সফল, 15/09/2008, Kautilya, The Arthasastra, Rangarajan, L, tr, (New Delhi, Penguin Books India, 1992; 296) Kangle, R.P, The Kautilya Arthasastra (Bombay: University of Bombay, 1972:9) pp.91-105) Doniger, Wendy and Smith Brain.K, tr, The Laws of Manu (New Delhi: Penguin Books India, 1991 p.14) আহমদ, কামরুদ্দীন ,পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি, প্রকাশক: ইনসাইড লাইব্রেরী , ধানমন্ডি, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ (সংশোধিত) ১৩৮৩ বঙ্গাব্দ, পৃষ্টা ১৫৫-১৫৬ শাইখ, আসকর ইবনে , মুসলিম আমলে বাংলার শাসনকর্তা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা মুসা ,এবিএম , দুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশিত হয় না, গুঞ্জরিত হয়, সুত্র: প্রথম আলো, ৩১/১২/২০০৯ Braibanti, Ralph: Research on the Bureaucracy of Pakistan, Duke University press: 1964 ১৯৭২ সালের ৭ জুন, সোহরাওয়াদর্ী উদ্যানের জনসভায় প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা লেলিন , নূহ-উল-আলম ,আসুন আমরা বদলে যাই, দৈনিক ইত্তেফাক, ৫ জুন ২০১০ Franda,Marcus, `Bangladesh Nationalism and Ziaur Rahman’s Presidency, Part 1, American Universities Field staff Report No-7, 1981 আহমদ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর ,দুর্নীতির বিস্তার: ৩৭ বছর ধরে, সাপ্তাহিক ২০০০, ২৮ মার্চ ২০০৮ (চলবে) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.