আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধর্মচিন্তা : বহুরৈখিক ব্যবহার ও বিকাশ ২

আমাদের দেশ আমাদের সম্পদ দ্বিতীয় পাঠ মফস্বল শহর অথবা গ্রামে যারা শৈশব-কৈশোর পার করেছেন--তাঁরা নিশ্চয়ই দেখেছেন, এলাকায় ষাঁড় ছাড়া হয় অর্থাৎ কোনো এক অলৌকিক কল্যাণ ও সেবাদানের উদ্দেশ্যে বা কোনো কারণে মানসা বা মানত করলে ছোট বাছুর জাতীয় গরুর বাচ্চা ছাড়া হয়; একেই বলে ষাঁড় ছাড়া। এই ষাঁড় কিন্তু কোনো জমির ধান-পাট অর্থাৎ কোনো ফসলাদি খায় না, এমনকি ফলদ ও প্রয়োজনীয় গাছেও মুখ দেয় না--সে বেছে বেছে ঘাসই খায়, তার জন্য বাঁধন বা গোছর দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না অথবা গলায় দড়ি দিয়ে খুঁটি গেড়ে বেঁধে রাখতে হয় না। সে প্রথম দিন থেকেই স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জীবনযাপনে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং মানুষের ব্যবহার্য কোনো প্রয়োজনীয় খাবারেই মুখ দেয় না বা নষ্ট করে না। এই অবুঝ, মূর্খ ও বোবা প্রাণীটিও তার স্বাধীনতার মতা জানে, স্বাতন্ত্র্যের মহার্ঘ সম্পর্কে অবগত এবং অন্য প্রাণিকুলের প্রতি সশ্রদ্ধশীল; অথচ মানুষ বুঝবান, শিক্ষিত ও ভাবের আদান-প্রদান করতে পেরেও কতক প্রকারের জন্তু-জানোয়ারে পরিণত হয়। এদের দেখলে মানুষাকৃতি মনে হলেও, ভেতরে তারা মূলত ঐ গরুরও অধম।

অবাধ্য ছাগল-গরুকে যেমন গলায় দড়ি লাগিয়ে, বাঁধন দিয়ে আটকিয়েও ঠিকমতো পারা যায় না, ছুটতে পারলেই অন্যের জমিতে মুখ দেয় অথবা প্রয়োজনীয় গাছের চারা খেয়ে ফেলে, যার ফলে তাদের সামাজিক শাস্তির জন্যও তৈরি করা হয়েছে খোঁয়াড়, যেখানে পশু ও পশুটির মালিকের আর্থিক ও মানসিক শাস্তির সাময়িক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। তদ্রুপ মানুষও সুযোগ পেলেই, দুর্বলতা দেখলেই আক্রমণ করে বসে--সবকিছু হরণ করে তবেই তার স্বস্তি। এদের জন্যই ধর্মগ্রন্থ প্রণীত হয়েছে--দড়ি, খুঁটি, খোঁয়াড়েরও ব্যবস্থা আছে : নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত, কালেমা পাঠের মতো প্রভৃতি বিষয় বা রীতিনীতি বা কর্মপন্থার মাধ্যমে--যা বিশ্বাসীদের জন্য আইনের মতোই অবশ্যপালনীয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত। অবাধ্য জাতির শৃঙ্খলার নমুনাও পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে--যা আসমানি গ্রন্থ বা কেতাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। অথচ এসব করা হয়েছে মূলত ঐ অবাধ্য ও দুশ্চরিত্রদের জন্য--যারা মানবিক রীতিনীতি মানেন না অথবা অন্যের কল্যাণ ও শান্তি বিঘ্নিত করেন।

ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থ তাদের জন্যই নাজিল হয়েছে। অতএব জ্ঞানচক্ষুর দরজা-জানালা খুললে স্পষ্টভাবেই বোঝা যায়, ধর্মটা আসলে কী? ধর্ম মূলত কিছু বিচক্ষণ, সুচতুর, জ্ঞানী ও সাহসী মানুষ দ্বারা রচিত ও প্রণীত মত বা ধারা--যা তাদের মাধ্যমে গ্রন্থাকারে এসেছে অথবা লোকমুখে বা বিশ্বাসীদের (উল্লিখিত আদলেই) দ্বারা স্মরণ প্রক্রিয়ায় নাজিল হয়েছে; ঐসব অবাধ্য জাতির জন্য, যারা ব্যক্তি ও মনুষ্যপ্রজাতির স্বাধীন বেড়ে ওঠাকে হুমকির সম্মুখীন করে, গণতন্ত্রকে করে বিপর্যস্ত আর মানবাত্মাকে করে কলঙ্কিত। তাদের জন্য এইসব খোঁয়াড় বা খোঁয়াড়-আকৃতির ঘর--যার নাম দেয়া হয়েছে ধর্মশালা বা ধর্মঘর; বৃহৎ-অর্থে এই-ই ধর্মজাল। এই খোঁয়াড়খানা অবাধ্যদের জন্য অতীব প্রয়োজন যেমন; তেমন যারা মানবকল্যাণ ও বিশ্বশান্তি প্রত্যাশা করেন, কামনা করেন পরমানন্দের--তাদেরকে আবার সেই খোঁয়াড় ভেঙে বেরিয়ে আসতেই হয়--নইলে মানবাত্মা ডুকরে কেঁদে মরবে--খোঁয়াড়ের মধ্যে আটকা পড়ে কিংবা চিন্তার হাজতখানায় বন্দি থেকে। আবার যারা খোঁয়াড়ের পক্ষে--তাদের জন্য বলা, খোঁয়াড়বন্দি হয়েও তো আপনাদের বা সমাজের মুক্তি হচ্ছে না।

কারণ হাজার হাজার, ল ল, কোটি কোটি মানুষ খোঁয়াড়বন্দি হচ্ছে--খোঁয়াড়ের পে মনভোলানে-ছেলেভোলানো হরেকরকম প্রচার-প্রচারণাও চালানো হচ্ছে, তার পরও সমাজে কেন কল্যাণ ও শান্তি আনা সম্ভব হলো না। এই পরিপ্রেক্ষিতে একটা গল্প বলা দরকার মনে করছি : গত শতকের মাঝামাঝি সুদূর সুইজারল্যান্ড থেকে ভারতের কলকাতা শহরে একজন পাদ্রি এলেন মানবসেবার লক্ষ্যে; এসেই তিনি দেখলেন, কলকাতার রাস্তায় শত শত মানুষ অনাহারে-অর্ধাহারে, রোগে-শোকে কিষ্ট হয়ে পড়ে আছে--তাদের সেবার কেউ নেই, তিনি তাদের সেবা ও শুশ্রুষার উদ্যোগ নিলেন। এ জন্য তিনি কলকাতার মুখ্যমন্ত্রীর নিকট একখানা জায়গা চাইলেন আশ্রম প্রতিষ্ঠার জন্য--জায়গা পেলেন, আশ্রম তৈরি হলো কালীঘাট অঞ্চলে এবং আশ্রমখানার নাম দেয়া হলো ‘নির্মল হৃদয়’। রোগে-শোকে কিষ্ট মানুষগুলোকে ধরে নিয়ে আসা হলো, কিছুদিনের মধ্যেই তারা সেবা-শুশ্রুষা এবং ভালো খাবারদাবার খেয়ে সুস্থ হয়ে উঠলো এবং একসময় সেখানে তাদের প্রয়োজনও ফুরিয়ে গেল। এভাবে একদিক দিয়ে ঢুকে সুস্থ হয়ে, মোটা-তাজা হয়ে--আরেক দিক দিয়ে মানুষগুলো বেরিয়ে গেল বা বের করে দেয়া হলো।

বাইরের প্রতিকূল আবহাওয়ায়--অভাবের তাড়না ও রোগ-জরায় পড়ে আবারও তারা অসুস্থ হয়ে পড়লো এবং ঘুরে এসে নির্মল হৃদয়ে আশ্রয় নিলো--এভাবে চক্রাকারে চলতে থাকলো সেবা কার্যক্রম (Charity Program)। এ-কর্ম করে ঐ মহীয়সী নারী নোবেল পুরস্কারও পেলেন। ধর্ম এভাবে চক্রাকারে মানুষকে আদর্শায়িত বা খোঁয়াড়বন্দি করছে, কিন্তু ধর্মালয় ছেড়ে মাটির পৃথিবীর প্রকৃতি-মাঝারে এসে কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মানুষ ভুলে যাচ্ছে রূপকল্পাশ্রিত খোঁয়াড়বাণী। ফলে ধর্মের Charity দান সফল হচ্ছে না। এ জন্য একটা কাজ করলে হয়তো ভালো ফল পাওয়া যেত--তা হলো সবার জন্য ধর্মালয়ে জীবনযাপন বাধ্যতামূলক।

* তাতেও খুব বেশি দিন যেত বলে মনে হয় না, কারণ মানুষ তার জন্মগত স্বভাব দোষেই বিপথগামী হয়ে পড়তো এবং পতিত হলে কাছাকাছি সকল আশ্রয় খেয়ে-পরে পুনরায় খুঁটি উপড়িয়ে ধর্মের আশ্রয়তলে উপনীত হতো। কেননা এ এমন এক রূপকথার রাজ্য--যেখানে রাতারাতি পবিত্রতার ধারক-বাহক ও যাজক হয়ে ওঠা যায়। ধর্মের এ-প্রক্রিয়া আলাদিনের চেরাগকেও হার মানিয়ে দেয়। মা-অযোগ্য পাপ ও অন্যায় করে এসেও একনিমেষে তওবা করে শুদ্ধি অভিযানে অংশগ্রহণ করা যায়--হাজারটা খুন-ধর্ষণ, এমনকি সম্পদ লুণ্ঠন করেও। একেই বলে রূপকথার মায়াজাল--যার কাছে যুগে যুগে মানুষ তার জ্ঞানার্জন বিসর্জন দিয়েছে।

ধর্ম এমনই শক্তিশালী আলো-আঁধারির এক খোয়াব, যেখানে অসহায়, ভীরু ও দুর্বলের দল অনন্তকাল ধরে ভিড় করে আছে; আর যেহেতু পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ জন্মগতভাবেই অসুখী এবং তার প্রভাবে ও তাপে পুড়ে ক্রমে হয়ে পড়েছে অসহায়, ভীরু ও দুর্বল; ধর্ম মানুষের ঐ জায়গাটিই দখল করেছে। ধর্মের সাফল্য এখানেই। ধর্মগুরুরা আজকের যুগে জন্মগ্রহণ করলে তাঁরাও নোবেল পুরস্কার পেতেন নিশ্চয়ই। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেখা যাবে একদিন হয়তো তিনিও দেবতাদের সঙ্গে ঠাকুরঘরে আশ্রয় পেয়েছেন। * আমার কাছে মনে হয়েছে, ধর্মপালন করতে পীররা যেমন সংসারাদি ছেড়েছুড়ে ধর্মোদ্দেশ্যে একরকম জীবনোৎসর্গ করেন (যদিও অধিকাংশ পীরাস্তানা শয়তানাস্তানায় পরিণত), সেভাবেও হয়তো ধর্মপালন সুষ্ঠু হতো এবং ধর্মও হয়তো হাজারো টানাহেঁচড়া থেকে রা পেতো।

কিন্তু ধর্মযাজকেরা এতে করে পুরোদমে আশকারা পেয়ে যেতেন--ভাত-কাপড়ের জীবনে (যদিও তা ভিক্ষাবৃত্তিরই শামিল)। দুই সবকিছুর মধ্যেই দুটো ভিন্ন ভিন্ন রূপ ও অর্থ এবং দিক থাকে। যেমন আলোর বিপরীতে অন্ধকার, অন্ধকারের বিপরীতে আলো; এরূপ সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ ইত্যাদি। দুই-এর এই অবস্থান সৃষ্টির সকল অর্থ ও লক্ষ্যের মধ্যে লুক্কায়িত রয়েছে রূপ ও স্বরূপের খেলায়--যা কখনো কখনো অরূপের মায়ায় পড়ে আরো সুবিস্তৃত হয়। কখনো নির্দিষ্ট চালে, কখনো-বা অনির্দিষ্টতায়--স্পর্শের বাইরে।

কথা হলো, এর বাইরের ব্যতিক্রমটা কী? বিপরীতে বিপরীতে মিল অথচ মাঝে ফাঁকা বা অন্ধকার বা আলোহীন। এটা নারী-পুরুষের উদাহরণেই স্পষ্ট হতে পারে। কীভাবে দুটি ভিন্নমুখী এক হয়ে যায় বা থাকে বা ঘোষণা করে। নারী ও পুরুষ জন্মগতভাবেই দু’রকম শক্তি-সামর্থ্য ও গুণাগুণে বিকশিত হয় বা বেড়ে ওঠে, তার পরও কী করে এই দুই মহাশক্তি এক হয়ে যায় অথবা শারীরিক ও মানসিক শক্তির যৌথরূপে; একে হাইব্রিড বলছে না, তবে তা যৌগিক সম্পর্কের দিকে এগিয়ে যায়--যা সত্যি সত্যি গবেষণার বিষয়। সিগমুন্ড ফ্রয়েড-এর শারীরতত্ত্ব বিশ্লেষণ এবং ধর্মের অলৌকিক বাঁধন পেরিয়ে এ-সম্পর্কের বিকাশ, আরো কিছুদূর পর্যন্ত গিয়ে পরম মিলনকে নিশ্চিত করে অথবা এগিয়ে দেয়।

সে ক্ষেত্রে দুই ভিন্নতর ও ভিন্নমুখী সত্তার কি করে একমুখী যাত্রা, নাকি পশ্চাতের মিলনান্বয়, নাকি এখানেও কোনো ঐশ্বরিকতার অলৌকিক শক্তির হাত রয়েছে--তা-ও বিবেচনা করতে হবে। এ ছাড়া একটি মৌলিক প্রশ্ন--সত্য ও মিথ্যা, ন্যায় ও অন্যায় অথবা ভালো ও মন্দের মধ্যবর্তী অবস্থাটি কী? এটি কি কোনো ব্যতিক্রম নাকি বায়বীয় আলোচনামাত্র। এর মাঝামাঝি অবস্থানে কি সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের বসবাস নাকি শয়তানের। প্রচলিত ধর্মে বিশ্বাস করলে তো ঈশ্বর এবং শয়তান উভয়কেই বিশ্বাস করতে হয়। কারণ ধর্ম ঈশ্বর এবং শয়তান দুই শক্তিকেই স্বীকৃতি দিয়েছে।

আবার এই পৃথিবীও (পুরো জগৎ বা সৌরমণ্ডলী) নাকি ঐ দুই শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কেননা ঈশ্বরপন্থিরা শয়তানকে ভয় পাচ্ছে বা শয়তান থেকে দূরে থাকছে। বলছে, ঈশ্বরের পথ থেকে একমাত্র শয়তানই দূরে সরিয়ে নেয় বা নিয়ে যাবার শক্তি রাখে। তাহলে শয়তানের শক্তি সম্পর্কেও আমাদের অবগত হতে হচ্ছে। শয়তানের শক্তি-ও কি ঈশ্বরের সমান? প্রচলিত ব্যাখ্যায় একটুখানি বেশিই মনে হয়।

তার অবস্থানই-বা কোথায়, প্রচলিত সমস্ত ঈশ্বরেরও? বলা হচ্ছে, প্রেমের প্রথম শর্ত ভয়--ভয় থেকেই শ্রদ্ধা--শ্রদ্ধা থেকেই প্রেম। প্রেম বা মহব্বতের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটে এখান থেকেই। তাহলে যে শয়তান মানুষের পক্ষ থেকে ভয় ও অনুগ্রহ পাচ্ছে, তার প্রতি প্রেম না-জন্মাক--বীতশ্রদ্ধ হয়ে যে-প্রকারের অপ্রেমের জন্ম নিচ্ছে, তা থেকে তো তাকে স্বীকার করে নিয়েই করা হচ্ছে। তাহলে কি দ্বিতীয়তম ঈশ্বরের নাম শয়তান। তার প্রণীত ধর্মগ্রন্থেরই-বা নাম কি? সোজা বাংলায় দেখা যাচ্ছে, যারা ঈশ্বর মানেন--তারা শয়তানও মানেন।

কিন্তু আমার মতো যাদের ঈশ্বরতান্ত্রিকতায় বিশ্বাস নেই, তাদের কোনো শয়তানও নেই। অর্থাৎ কারো প্রতি তাদের একক আস্থাও নেই। আস্থা আছে সৎচিন্তা ও সৎকর্মে এবং নিজের ওপর নিজেরই ঈশ্বরোপিত হয়ে ওঠায়। যিনি নিজেই স্রষ্টা এবং ঈশ্বরাসন আলোকিত করে আছেন। ‘মনে হয়’ বললে ভুল হবে, আমার বিশ্বাস : উল্লিখিত বিপরীতমুখী দুইয়ের মাঝে সেই পরম সত্য লুক্কায়িত, যেখানে ঈশ্বর-শয়তান কারো স্থান নেই; যেখানে সত্যবাদীদের পরমাসন অবস্থিত এবং মুক্তি বলি আর নির্বাণ বলি--সত্যায়ন ও পরমায়ন--এই দু'য়ের সহাবস্থানে যে ‘সহজ মানুষ’ তার অবস্থান সেখানে।

এর মধ্যে লুকিয়ে আছে সেই পরমসত্য--যা জগৎকে, তার জীবকুলকে মুক্তি দেবে--করবে পুণ্যালোকিত। আর এখানেই সেই অরূপ দর্শন--যেখানে সিরাজ সাঁইয়ের হাত ধরে লালন সাঁই সহজ মানুষ খুঁজে পেয়েছিলেন। তিন পাপ আমার কাছে পাপের মতোই নির্মম মিথ্যাচার বা অগ্রহণযোগ্য মনে হয়। কেননা পাপ বলি আর যাই বলি, এর উৎস--অন্যায়, নির্যাতন এবং মিথ্যা থেকে। তবে পাপ সম্পর্কে একটি সংজ্ঞার সঙ্গে আমার সংস্রব আছে, তা হলো : ‘যা কিছু প্রকাশ করতে কুণ্ঠাবোধ করি--তাই পাপ।

’ আবার এ সংজ্ঞাও পুরোপুরি সঠিক নয়--কারণ এমন অনেক কিছুই আছে--যা বলতে নেই বা বলা হয়ে ওঠে না। যেমন--বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে শারীরিক বৃদ্ধির কথা। তার পরও অনেক কিছুই বলা যায় ন--যা পাপ পর্যায়ীয়। যেমন, যৌবনকালে বাথরুমে গিয়ে অনেকেই কেন দেরি করে ফেরে--তা বলা না-গেলেও এবং সেখানকার গোপন কার্যাদি পাপ না-হলেও, তা খুব বেশি সুখকর নয়, তা তো বলা যায়। কিংবা তা কি প্রকাশ্য? তা ছাড়া খুনি যেমন বলে না তার খুনের কথা, ঘুষখোর যেমন বলে না তার ঘুষের কথা, চোর বলে না তার চুরির কথা--এমনকি স্বামী তার বৈধ (তথাকথিতার্থে) স্ত্রীর সঙ্গে রাতগভীরে যে কর্মটি সারে--তা কি কারো কাছে বলে? অতএব দেখা যায়, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল ঘৃণিত কাজই পাপ এবং অঘৃণিত বা গ্রহণযোগ্য কর্মসম্পাদনই পাপের বিপরীত।

সে প্রেক্ষিত জগতের কোনোকিছুই পাপ নয়, আবার সকল কিছুই পাপমুক্তও নয়। আঞ্চলিকতা, ভাষা এবং ধর্মগত অবস্থান থেকে পাপ বেড়েছে, পাপের বিস্তৃতিও ঘটেছে। আবার একই কারণে হ্রাসও হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বলা যায়, সব আঞ্চলিকতায় পরিণত হলে অর্থাৎ পৃথিবীটা যদি একটা দেশ বা একটা গ্রাম হতো এবং ভাষা ও ধর্মের কুৎসিত দাপট কমে গিয়ে যদি মানুষ কাছাকাছি সহাবস্থানে আসতো, তবে পৃথিবীবাসীর পাপমুক্তি ঘটতো নিঃসন্দেহে। যদিও তার পরও কিছু অজ্ঞাত-অদেখা ও অদ্ভুত প্রশ্নোত্তর এসে যেতে পারে, সেই পারাকে আমরা ইতিবাচকার্থেই দেখতে চাই, কেননা এই দেখতে চাওয়া থেকেই হয়তো একদিন মূল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

সেদিন হয়তো পৃথিবীজুড়ে মানুষ বাস করবে--কোনো উঁচু-নিচু, ধর্ম-বর্ণ, ভাষা-আঞ্চলিকতা ভেদাভেদ নিয়ে নয়। পাপ থাকে মনে, প্রকাশিত হয় কথায় ও কর্মে। সেহেতু ব্যক্তিগত আত্মশুদ্ধির মধ্য দিয়েই পাপমুক্ত হওয়া যায়। যদিও ধর্মীয় কায়দার প্রচলিত পাপাদি আমার আলোচ্য বিষয় নয়। বরং জগতের কল্যাণ ও শান্তির জন্য যা-কিছু তিকর এবং গ্রহণীয় নয়, তাই আমার কাছে পাপ।

চার বাঙালির জাতীয় জীবনে আজ এমন-এক চরম দুর্দিন উপনীত যে, দেবতা ও অসুর জ্ঞান কেন, তারা খাওয়া এবং ফেলার কাণ্ডজ্ঞানও দিনে দিনে হারিয়ে ফেলছে। এর নমুনা বাজার ঘুরে, রান্নাঘরে গিয়ে, ডাইনিং টেবিলে বসে এবং পয়ঃনিষ্কাশনের নিম্নতম ব্যবস্থা দেখেই বোঝা যায়। সেখানে দেবতা ও অসুর জ্ঞান তো প্রশ্নবিদ্ধ করবেই। প্রচল অর্থান্তেও দেবতা সবকিছুর ঊর্ধ্বেই দেবতা, মাটির (ধরার) পাপ-কাম তাঁকে স্পর্শ করে না। মায়া-মমতা, সংসার যাঁর কাছে তুচ্ছ হয়ে পড়ে।

আর এ জন্য দেবতাকে দেবতা হয়ে উঠতে হয়। মঙ্গলযাত্রায়--শূন্যকায়ায়। এখানেই রক্ত-মাংসের মানুষ দেবতা হয়ে ওঠেন। সেই দেবতামানুষের পে বেড়ে ওঠা--গল্প-কবিতায়, অনন্তযাত্রায়। দেবতা হলেন সর্বত্র দেবতা ও প্রমাণিত।

তার কর্মজীবন ও যৌনজীবন দুই-ই দেবত্ব দ্বারা সাধারণ চোখে ঈর্ষান্বিত। আর অসুর যার বেসুরো ও বেখাপ্পা কাণ্ডাদি অসুরের প্রকৃত বেদনা জাগিয়ে তোলে। আমাদের এই দেবতাকে সত্যিকারার্থে চিনতে হবে এবং সতর্ক হতে হবে অসুর থেকেও। তবেই পরমমুক্তি সম্ভব; সম্ভব--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-এর খণ্ড থেকে অখণ্ডে, সীমা থেকে অসীমে যাত্রা। তৃতীয় পাঠ ঈশ্বর বলতে যদিও আমি, মানে মানুষের যদি কেউ একজন অদৃশ্য সত্তা বা ঈশ্বর থাকেন, তবে সে নিজেরই প্রতিরূপ-প্রতিচ্ছায়া-প্রতিকায়া-প্রতিচ্ছবি, যার নিবাস নিজেরই অন্তরালে-বাইরে স্বকীয় ভাবপ্রকাশে, প্রেমে-অপ্রেমে।

তবে এর বাইরের বিশ্বাসীদেরও আমার বয়সীই মনে হয়! কারণ বুড়ো, মূর্খ, প্রবীণেরাই ঈশ্বর এবং ধর্ম মানেন, যারা মনে এবং ধ্যানে তরুণ নন, উন্নত নন, বিকশিত নন। তারা নতুনকে স্বীকার করতে ভয় পান। এই হলো তাদের গুণাগুণ। সাহসী, দিগ্বিজয়ী অথবা কোনো সৃষ্টিকর্তা (মানুষের ক্ষেত্রে--যিনি নিজের সৃষ্টির ক্ষেত্রে নিজেই একজন স্রষ্টা) কোনো অলীক-অন্ধ-অবাস্তব ভিত্তিহীন বিশ্বাসে বিশ্বাসী হতে পারেন না। যেমন--কবি-চিত্রকর থেকে শুরু করে অন্য সকল পদে ও ভেদে স্ব স্ব ক্ষেত্রের স্রষ্টা ও আবিষ্কারকর্তা।

বন্ধুমহলে-আড্ডায় একটি কথা প্রায়শই বলা হয়ে থাকে, তা হলো--কোনো কবির (কবি এখানে ফ্রান্সে যে অর্থে পোয়েট বলতে কবি-লেখক-সাংবাদিক-সাহিত্যিক-চিত্রকর-নাট্যকার-শিল্পীকে বোঝানো হয় সেই অর্থে) ধর্ম এবং রাজনীতি থাকতে পারে না। কেননা সে নিজেই স্বাবিষ্কৃত সৃষ্টির দ্বারা একটি ধর্ম ও রাজনীতি প্রকাশ করে থাকেন। প্রচলিত ধর্ম ও রাজনীতির কাদা ছোড়াছুড়িতে কবিকে মানায় না--যা অন্য মানুষের দ্বারাই সৃষ্ট ও পরিচালিত। খুনি, বদমাশ, স্বার্থান্বেষী গ্রুপ বা দল ও ব্যক্তিই পারে রাজনীতি ও ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ততা রাখতে। কল্যাণ ও সৎ গুণাবলি যাদের মধ্যে আছে, তারা অন্তত লোক-দেখানো ধর্ম এবং রাজনীতি করেন না; প্রকৃতান্বেষণ ব্যতিরেকে।

দুই মানুষকে যদি সত্যিকারার্থে মানুষ হতে হয়, সৎ হতে হয়, কমিটেড হতে হয়, তবে গ্রন্থচর্চার বিকল্প নেই। কেউ কেউ একে যদি ধর্মগ্রন্থ চর্চা বলতে চান, আমার তাতেও খুব বেশি আপত্তি নেই। তবে আমার মূল্যবোধ বা বিশ্বাস থেকে বলবো--পড়াতে কান্তি নেই, গ্রন্থচর্চা ব্যতীত মুক্তি নেই। আমরা মানুষ অন্য সব প্রাণী ও জীবকুল থেকে শ্রেষ্ঠ কিনা? সে ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ এতোটাই দুর্বল যে--যা অনেকাংশেই তুলনার পর্যায়ে পড়ে না, অন্যার্থে বলা যায় নেই। এই না-থাকার কারণে এর কোনো যুক্তিগ্রাহ্যতা না-খুঁজে বরং জ্ঞান-বিজ্ঞান, বুদ্ধি-বিবেচনা এবং চিন্তা ও ধ্যান-চেতনা দ্বারা আমরা অন্য প্রাণিকুল থেকে পৃথকই শুধু নই--স্বতন্ত্র এবং ধারাবাহিকভাবে কমবেশি সংজ্ঞাপ্রাপ্তও।

এই যে আমাদের এতো গুণ, এর উল্টোদিকেই লুকিয়ে আছে হাজারো অগুণ-আঁধার-হিংস্রতা। আমরা যেদিন আমাদের এই হাজারো অগুণ-আঁধার-হিংস্রতা ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে সমাজ-প্রকৃতির সত্যালোয় এসে দাঁড়াতে পারবো--সেদিনই হবে আমাদের জয়, মানবজন্মের বিজয় এবং রচিত হবে পরমাত্মার প্রশান্তি। মানুষকে তার নিজের ভেতরে লুকিয়ে থাকা সেই পরমাত্মাকে চিনতে হবে এবং ধর্মজ্ঞান, সমাজজ্ঞান ও প্রকৃতি জ্ঞানের ঊর্ধ্বে উঠে শূন্যজ্ঞান ধারণ করতে হবে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে ত্যাগের মহিমায় অদ্বিতীয় হতে পারাটাই হবে প্রতিটি জন্মের পরমত্ব লাভ। এখানেই প্রকৃত শান্তি এবং পরমানন্দ লাভ।

মানুষ এখানেই পূর্ণাঙ্গ মানুষ, অর্ধাঙ্গ বা বিকলাঙ্গ নয়। সহজ মানুষের দেখা নিশ্চয়ই এ-যাত্রায় মিলবে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.