আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধর্মচিন্তা : বহুরৈখিক ব্যবহার ও বিকাশ

আমাদের দেশ আমাদের সম্পদ জন্ম-মৃত্যু এখন আর ঈশ্বর নামক অদৃশ্য শক্তির হাতে নেই। ক্রমে তা প্রতিটি স্রষ্টার কব্জাতলে নত হচ্ছে। ফলে আজ যে শিশুটি জন্মগ্রহণ করলো, আসলে সে জন্মেনি, পৃথিবীতে নতুন রূপে তার আবির্ভাব ঘটেছে। এর অর্থ এমন, প্রকৃতি বাবা-মায়ের শরীরেই অথবা পৃথিবী সৃষ্টির বহু আগে এই বীজ রোপিত হয়েছে সৌরমণ্ডলের লক্ষ-কোটি বস্তু-অবস্তু ও প্রাণের সম্মিলনে। এই তত্ত্বটিই যেমন একটা জটিল ও কুটিল বিষয়ের অবতারণা করে, তেমনি ধর্মের রূপকথাও মানুষকে বিভ্রান্ত কর--তার অলৌকিকতায় বা স্বপ্নাদিষ্টতার ভালোমন্দ দুই অর্থেই।

যদিও অলৌকিকতার কনসেপ্টই এসেছে মানসিক দুর্বলতা বা অসহায়ত্বের কবলে পতিত কল্পনা থেকে। সেখানে শয়তানের অস্তিত্ব কল্পনাই তার দাসত্বকে স্বীকার করে নেয়া। এটা অনেকটা ধর্মাধর্মের লড়াইয়ের মতো করে নয়, বিশ্বাস ও মূল্যবোধের বিষয়। জ্ঞান ও বিজ্ঞানের উৎকর্ষে বিষয়ভিত্তিক বিবেচনার নানাদিক। পরীক্ষাযন্ত্রে যাচাই করে বিজ্ঞান নিশ্চিত হলেও, জ্ঞান দর্শনের সর্বোচ্চমার্গীয় অবস্থানকে মেনে নেয় এবং আত্মার সন্ধান করে।

প্রতিটি আত্মার ওপর একজন স্রষ্টা অবতীর্ণ হন এবং এর দৃশ্যরূপ মানুষকল্পকে স্বীকার করে। এখানেই জ্ঞানের বিকাশ ও সীমাবদ্ধতা। কেউ স্বীকার করে, কেউ-বা করে না। কেউ-বা আরো চর্চায় নিমগ্ন হয়--ধ্যান-সাধনায়, অথবা গুহাগামী হয় এবং ক্রমে নির্জনতাপ্রিয় হয়ে ওঠে। বর্তমান পৃথিবীতে গুহাগামী হওয়াটা যতটা কঠিন, সেরূপ হাজার হাজার মানুষের মাঝে থেকে চিত্তকে ছুটি দেওয়াটাও ততটাই সহজ।

এখানেও তাত্ত্বিকতার সঙ্গে বিজ্ঞানের সংযোগ আছে। আধ্যাত্মিকতা বা দর্শন বা মেডিটেশন সায়েন্সের ভাষায় এ-বিষয়গুলো আরো পরিষ্কার হয়ে ওঠে; যখন মানুষ ধ্যান-সাধনায় আসনাবিষ্ট হয় ও নিজেকে চিনতে পারে বা আত্মদর্শনের মধ্য দিয়ে জগৎকে চিনে ওঠে, সময় ও বস্তুকে নিজের অধীনস্থ করে ফেলে, তখন এক নতুন স্বপ্ন ও স্বপ্ন-সম্ভব সম্ভাবনা ধরা দেয় সাধক বা ধ্যানীর কাছে; যেখানে এসে জগৎজ্ঞান একাকার হয়ে যায়--একই চিন্তা ও দর্শনে--অমূল্য প্রলোভনের মুখোশে। ঠিক তখনই মগজের আড়ালে বেড়ে ওঠে জগৎজীবন ও দেখা-অদেখার সামগ্রিক সম্মিলন, এখানেই সাধকের সিদ্ধি লাভ ঘটে। আর মানুষ মায়া থেকে মুক্ত হয়, মোহ থেকে--রূপারূপতায় কৌলীন্যতা ভেঙে পরিত্রাণ পায়। ধীরে ধীরে স্বার্থ থেকে ঊর্ধ্বগামী বা নির্বাণপ্রাপ্তির দিকে নিবিষ্ট হয়।

এসবও শরিয়ত-মারেফতের দ্বন্দ্ব-সংঘাতে কখনো ন্যুব্জ হয়ে পড়ে, কখনো-বা হকিকত-তরিকতের মতো বিষয়াদিকেও ধারণ করে এক সর্বজনীন তত্ত্বীয় ব্যাখ্যায় গিয়ে দাঁড়িয়ে যায়--যেখানে মানুষের মুক্তি অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। মানুষ মুক্তার্থে জগৎমুক্ত হয়; মূর্খরা দলে দলে যুগে যুগে ছিল এবং থাকবেও। জগৎসৃষ্টির আদি কথা ও জগৎজ্ঞান তাদের জন্য নয়, জগৎ তার নিয়মেই চলছে, চলবে এবং জ্ঞানও বিকশিত হবে তার নিজস্ব ধারায়। এখানেই সত্য এসে একটি জায়গায় স্থিত হয়ে যায়, ওই জায়গাটিই সত্যদর্শন বা ধর্মদর্শন। ধর্মদর্শন এখানে কোনো ভিন্ন ধারণা নয়, আবার প্রচলিত গড্ডলিকা প্রবাহের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধর্মীয় ফতোয়াও নয়।

পানির একটি ধর্ম আছে, আবার ভাঙা-গড়ার প্রকৃতিনির্ভর নানা নিয়ম-অনিয়মের মধ্য দিয়েও বহু ধর্মজ্ঞান দাঁড়িয়ে গেছে--যা জগৎজীবনকে স্বীকৃতি দিয়ে আধ্যাত্মিকতার চরম অধ্যায়কে আত্মস্থ করার শিক্ষা দেয়। এখন গ্রহণের বিষয়, কে--কীভাবে গ্রহণ করবে? এখানেও প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির নানা বিষয় থাকবে, থাকবে রুচি-অরুচির ভিন্ন ভিন্ন তারতম্য। মানুষ এর মধ্য দিয়েই বেরিয়ে যাবে এবং পৌঁছে যাবে আরেকটি নতুন গণ্ডিতে। গণ্ডিকে ভাঙা যাবে, তবে ত্যাগ করা যাবে না। পৃথিবীতে যে যত বেশি গণ্ডি ভাঙতে পেরেছে বা প্রসারিত করতে সক্ষম হয়েছে, জগতে সে তত বেশি চিরস্মরণীয় ও সাফল্যের শীর্ষবিন্দুতে আরোহণ করেছে।

দুই যখন কেউ নিজের ওপর বিশ্বাস বা আস্থা হারিয়ে ফেলে, তখন সে ধর্মের শরণাপন্ন হয়। কেননা ধর্মই একমাত্র জড় ও অসাড়, যার স্পর্শে বা অস্পর্শে কিছুই যায় আসে না। ধর্ম এমনি অকর্মা বানিয়ে দেয় মানুষকে। দেখা যায়, ধর্ম যুবক-বয়স নিয়ে নানারকম লোভাতুর সব অসম্ভব-অসাধারণ গল্প ফেঁদেছে, কারণ যুবক বয়সেই একজন নারী-পুরুষের যদি শিরদাঁড়া ভেঙে দেয়া যায় এবং পঙ্গু মানসিকতায় বেড়ে ওঠে, তবে ধর্মগুরুর খাদ্যার্তি বাধাহীন হয়ে যাবে; আর বয়সী ঈশ্বরের দলে মিশে যারা চিৎকার করে--তাদের চিৎকার বীর্যপতনের মতোই স্বস্তিস্বত্ব রূপ পাবে; এ ক্ষেত্রে ধর্ম ভয়ঙ্কররকমভাবে গুণাগুণ মিলেমিশে গোলালু জাতীয় একটি খাদ্যে পরিণত হয়। যাকে নিয়ে ব্যবসা চলে, আবার দু’বেলা দু’মুঠো পেটের ভাতও যোগাড় হয়ে যায়।

এর কারণ ব্যাখ্যায় বলা যায়--দুই চোখে দেখে, বুঝে, মেনে; তার পরও প্রশ্ন তোলে প্রাণিকুলে মানুষ একমাত্র। অথচ সেই মানুষই যখন অন্ধের মতো, ভীরু ও দুর্বলচিত্তে ঝুঁকে পড়ে অলৌকিক অথবা রূপকথার রাজ্যে, তখন একটি বাক্যাংশ বারবার মনে পড়ে যায়--‘যাহা দেখি নাই চক্ষু মেলিয়া, তাহা মানিবো কেমন করিয়া। ’ ধর্ম মানুষের সেই অন্তর্চক্ষু বন্ধ করে দিয়ে বদ্ধ জলে শুদ্ধতা শেখায়। ঘোলাজলে পবিত্র করে তুলতে চায়। আর বিজ্ঞান মানুষের সর্বজনীন জ্ঞানকে বিকশিত করার পথ বাতলিয়ে দেয়, কুসংস্কারাচ্ছন্ন থেকে মুক্ত করে, অন্ধবিশ্বাস বা মনের বেড়া বা বাঁধন ভেঙে দিয়ে মানুষকে প্রশান্তি যাত্রার পক্ষে নিয়ে চলে--যা বাস্তব এবং স্বপ্নবিলাসী নয়।

রূপকথার সত্তরহুরি পুরুষের জন্য নির্ধারিত থাকলেও, নারীর জন্য--প্রিয়তম প্রেমিকা কিংবা মা-বোনের ক্ষেত্রে এক চরম উদাসীনতার পথে অপমান ও নির্যাতনের ইতিহাস বয়ে আনে--যা দারুণভাবে ব্যথিত ও পীড়িত করে। ঐসব রূপকথাবুলি মা জাতির প্রতি পপাতদুষ্ট অবস্থানকে দেখিয়ে দিয়ে চরম অবমূল্যায়নকে সমর্থন করে। এমতাবস্থায় পঞ্চেন্দ্রিয় বন্ধ রেখে যে-যাত্রা--তার নাম নিশ্চয়ই অন্ধযাত্রা বা মূর্খামিপূর্ণ পথচলা। মূর্খতা মানুষকে সীমিত শক্তির অধিকারকে উৎসাহিত ও শৃঙ্খলিত করে। মানুষ পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত ধর্মের অহংকারে মেতে ওঠে, বড়াই করে অদৃষ্টবাদের এবং প্রকৃত ধর্মচর্চায় অগ্রগামী না-হয়ে বসে থাকে অলস মস্তিষ্কে, আর সময়ের কাজ সময়ে না-করে--অবসরজীবনে অভ্যস্ত হয়ে আলাদিনের চেরাগ কামনায় অপো করে সত্তরহুরির প্রত্যাশায়--যা শুধু কাল্পনিক ও রূপকথাই নয়--কাবুলিওয়ালাদের মন্ত্রবাণে আর ইন্স্যুরেন্সের মাঠকর্মীর গালগল্পে পর্যুদস্ত।

কখনো কখনো এরা আবার ভয়ঙ্কর সাহসীও হয়ে ওঠে, দলবেঁধে মসজিদ-মন্দির দখল ও ভাঙা থেকে--তা আঁচ করা যায়। সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিবাদের নামে বাংলাদেশে উস্কানিমূলক কথাবার্তা ও মানুষ হত্যা এবং ধর্মীয় শাসন প্রবর্তনের গর্জন-হুংকার--সে কথা পুন-পুনশ্চ আমাদের জানিয়ে দেয়, ধর্ম কীরকম বীভৎস ও ভণ্ডদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। এরা অশিতি ও মূর্খতাদুষ্ট গোষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত হলেও, এদের মধ্যেই কেউ কেউ প্রচলিত শিক্ষায় শিক্ষিত, যাদের আবার আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে তিল পরিমাণ সম্পর্কও নেই। একাডেমিক নির্বুদ্ধিতা ও অ-একাডেমিক অন্ধত্বজ্ঞান বা অলৌকিকতার বিশ্বাস এবং পরকালে আপাত নির্দিষ্ট পুরস্কারের তীব্র নেশা--এদেরকে মানুষচরিত্র থেকে পশু-প্রকৃতিতে পরিণত করেছে। পশু-প্রকৃতি অর্থে এখানে অবিবেকী-মূঢ়কে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ধর্মের নামে এ দেশে বা বিশ্বজুড়ে আদর্শের যে উড়নচণ্ডীভাব তা নিজেদেরকে ছোট করতে করতে একটা বদ্ধ কৌটায় নিয়ে গিয়ে আবদ্ধ করে এবং আরব্যরজনীর কৌটাবন্দি সেইসব মানুষ আমরা পৈতৃক সম্পত্তি, বাবা-মা, ভাই-বোনের সঙ্গে ধর্মকেও পেয়েছি। প্রশ্ন করি নিজেকেই--হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান অথবা প্রচলিত পৃথিবীর আরো প্রায় দুইশ ধর্মের যে-কোনোটিতে জন্ম নিলে কোন ধর্মাবলম্বী হতাম? সহজ উত্তর : পৈতৃক সে যে-ধর্মই হোক। কেউ কেউ বের হয়ে আসবার গল্প বললেও, আমার কাছে তা ব্যতিক্রমের মতোই, ব্যতিক্রম যেহেতু নতুন নয় এবং নতুন পরিবর্তন বা ব্যতিক্রম নয়--আবিষ্কার; সেহেতু এরা কোনো গণনার মধ্যে পড়ে না। সে-কারণে আমরা এখনো তথাকথিত ধর্মাড়ালে পড়ে আছি--কূপব্যাঙসদৃশ্যতায় মাথা হেঁট করে। ফলে বিনয় হয়েছে বোঝা আর সময় হয়েছে ঋজু; মিথ্যা পথচারীদের কে দেখাবে আলো, কে দেবে প্রাণস্পন্দন, কে জাগাবে এই অধঃপতিতদের? সীমা বা গণ্ডি থেকে বের হয়ে আসবার এই নিরন্তর ভাবনাই একদিন আমাদের মুক্তি দেবে, স্বপ্ন দেবে বাস্তব জ্ঞান আর শক্তি পরিণত হবে ভক্তিরসের আনন্দ-আরাধনায়।

এ-যাত্রা শুভ হোক--কল্পনাশ্রয়ী কিংবা রূপকথাসক্ত নয়। তিন আমার কিছু লেখা ধর্মের পক্ষে গিয়ে দাঁড়িয়েছে--যা অন্ধ ধর্মভীরুর পক্ষেও যায়নি, আবার যারা জ্ঞানের প্রচলিত ধারায় পড়ে বেশি উদারনৈতিক ও প্রগতিভিত্তিক চিন্তা-চেতনা ধারণ করতে চান--তাদের পক্ষে গিয়েও দাঁড়ায়নি, আর মধ্যবর্তী গ্রুপের কাছে তা জ্ঞাতার্থ হয়ে ওঠেনি বা সাধারণীকরণের প্রক্রিয়ায় অজ্ঞাত রয়ে গেছে--যারা একূল-ওকূল দু’কূলহারা যাযাবর গোত্রীয়। যদিও ধর্ম কোনো যাযাবর শ্রেণির জন্ম দেয় না এবং ভিন্নমতাবলম্বীদেরও স্বীকার করে না। সে ক্ষেত্রে ধর্ম মানুষকে একটি গণ্ডির মধ্যে বাঁধতে চেয়েছে বা সীমা এঁকে দিয়েছে; আমার লেখাগুলো সেইসব গণ্ডি ও সীমার বাঁধন কেটে দিয়েছে, পান্তরে সংযোগ ছাড়েনি। একটি অদৃশ্য সংযোগকে স্বীকার করে নিয়েই আলোচনায় অগ্রসর হয়েছে।

তার কারণ হলো, আমি প্রায়শই বলি বা লেখি--ধর্ম মানুষকে বিভক্ত করেনি, বিভক্ত করেছে যাজক ও মোল্লাকুল। যারা নিজেদের অস্তিত্ব ও ভাত-কাপড় নিশ্চিত করতে গোত্রে গোত্রে, বর্ণে বর্ণে, ভাষায় ভাষায় মানুষকে পৃথক করে দিয়েছে আর ধর্মের নীতিবুলি বা ফতোয়া ছড়িয়ে/বিলিয়ে সম্পর্কচ্যুত করেছে। এখানে ধর্মকে একার্থে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অন্ধজনেরা এর কৌশলগত ফাঁক বের করার চেষ্টা করেছে একাডেমিক মূর্খতা জ্ঞানে। আর লেবাসধারী প্রগতিবাদীরা--তারাও তাদের নীতি-আদর্শ বিক্রি করে একশ্রেণির মানুষের কাছে প্রিয়পাত্র বা আদর্শ হওয়ার জন্য এর বিরোধিতা করেছে।

কিন্তু প্রকৃতার্থে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা হলো, প্রত্যেক মানুষ তার বাক-স্বাধীনতা রা করতেই অন্যের কল্যাণ নিশ্চিত করে--নিজের কল্যাণও নিশ্চিত করবে অর্থাৎ অন্যের নিরাপত্তা প্রদান করেই নিজের নিরাপত্তা রা করবে। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে--বলতে হবে, অন্যের বাক-স্বাধীনতা রাকল্পে নিজের বাক-স্বাধীনতা সংযত করা। অর্থাৎ প্রত্যেকে নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, অন্যেরটি হস্তক্ষেপ না-করেই। এতে সহমর্মিতা বাড়বে, রক্ষিত হবে বিবিক্ত চিন্তা ও বাক-স্বাধীনতা এবং বিকশিত হবে চিন্তার বহুরৈখিকতা। অন্ধকে পথ দেখানো যাবে, তবে তা যেন জোরপূর্বক বা লোভ-লালসাভিত্তিক না হয়।

আমাদের দেশে ধর্মগুলো হয়ে পড়েছে, পেশাভিত্তিক প্রচারণা ও প্রোপাগান্ডা-নির্ভর। অনেকাংশে ধর্মের ধ্বজাধারীদের অর্থলিপ্সা ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করছে। ধর্মগুলোর যে-কোনো একটির মূল আদর্শও যদি এইসব অন্ধরা মানতো, তবে কিছুটা হলেও সমাজে কল্যাণ নিশ্চিত হতো, অন্যের ধন-সম্পদ ও ইজ্জত ভূলুণ্ঠিত হতো না। আর অন্যেরটি রতি হলে নিজেরটি আপনাতেই রা পেতো। আমার কাছে অন্য যেমন, অন্যের কাছে আমিও তেমন।

এই মোদ্দাকথাটি সমাজে আজ প্রয়োগ অতীব জরুরি। ধর্মে ধর্মে, ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ নয়, মতাদর্শগত পার্থক্য থাকতেই পারে, তবে তা অবশ্যই সংঘাতপূর্ণ নয়--সাম্যতাভিত্তিক হওয়া একান্ত জরুরি। আমরা যেন বাক-স্বাধীনতা রা করতে গিয়ে স্বৈরাচারী না-হয়ে উঠি, বাক-স্বাধীনতা ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যকে স্বীকার করে, স্বৈরাচারী মনোভাব বা কর্মপন্থাকে নয়। এ জন্য দরকার কল্যাণভিত্তিক ও সেবামুখী একটি আধুনিক মতাদর্শ--যা প্রত্যেকে তার নিজের মধ্যেই লালন করেন, পরিচর্চার অভাবে শেষ পর্যন্ত ঘুণে ধরা বা মরচে পড়া, কখনো কখনো অন্ধ ও কূপমণ্ডূকতাপূর্ণ। আমরা বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক ও মানসিক উৎকর্ষপূর্ণ বিকাশ চাই--যা অন্যের কল্যাণ, নিরাপত্তা ও বাক-স্বাধীনতাকে রা করবে।

তার ফলে নিজেরটিও রতি হয়ে যাবে। এই যৌক্তিক অবস্থানই আমার প্রচলিত ধর্মত্যাগ, চিন্তার বহুরৈখিকতা ও বিকাশ। পরবর্তী পর্যায়ে চিন্তার ধাপে ধাপে স্বপ্ন ও কেস স্টাডি দিয়ে আলোচনার ধারাবাহিকতা রা করা হয়েছে--যা বিশ্লেষণ ও দর্শনগত অবস্থানকে স্বীকার করে নিয়ে ধর্মভিত্তিক চিন্তাকে প্রসারিত করবে এবং বিকাশপর্বের যাত্রাকে করবে ত্বরান্বিত। চার কোনো ধর্মের পক্ষে স্তুতিবাক্য রচনা অথবা বিপে বিষোদ্গার করা আমার ল্য বা উদ্দেশ্য নয়। বরং পৈতৃক ধর্মের বাইরে গ্রহণ করার অধিকার থাকলে, ত্যাগ করার অধিকারও আমার আছে।

আর যদি বলা হয়, পৈতৃকসূত্রে প্রাপ্ত ধর্ম অলঙ্ঘনীয়, তবে প্রশ্ন ওঠে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচারেরও। তখনই ভাবনাগুলো ডালপালা মেলে বেড়ে ওঠে এবং দেখা দেয় নতুন আরেকটি প্রশ্নের। কেন এই ধর্মপালন? ধর্মপালনের যৌক্তিকতা এবং অযৌক্তিকতা কি? ফলে উঠে আসে আমার গ্রহণ করার এবং ত্যাগ করার পাশাপাশি প্রচলিত নিয়মনীতি এবং সামাজিক ও প্রাকৃতিক বেড়ে ওঠা জীবনাচরণ নিয়ে আমার বিশ্বাস, উপলব্ধি ও প্রকাশাধিকারের নানা মত। মত প্রকাশ ও বাক-স্বাধীনতা রার অধিকারের কথা। আমি কারো দাস নই এবং কোনো দাসত্ব-সংসিদ্ধ নীতিকেও মেনে নিতে পারি না।

আমার স্বজন এবং প্রজন্মের জন্য আমার সেই সংশয় আরো প্রকটভাবে বেড়ে ওঠে। সত্য এবং সুন্দরের জন্য আরো কী কী প্রয়োজন এবং কী কী অপ্রয়োজনীয়? বলয় আমাকে মুক্তি দেয়, নাকি মুক্তি নামের চিন্তার হাজতে বন্দি করে রাখে? সে ক্ষেত্রে আমার প্রশ্ন হলো : সবাইকে কোনো-না-কোনো ধর্মের অনুসারী হতে হবে কেন? জীবনবৃত্তান্তে কেন ধর্ম নামক একটি ঘর থাকতেই হবে? কেন আমাকে একটি ধর্ম বেছে নিতেই হবে, না-হলে পীড়িত হতে হয়? কেউ কি কখনো শুনেছেন বা দেখেছেন, ধর্মত্যাগী মানুষ কখনো কাউকে, বিশেষত ধর্মাবলম্বীদের আক্রমণ করেছে। অথচ বহু উদাহরণ আছে, ধর্মের নামে যুগে যুগে কীভাবে মানুষের উপর অত্যাচার করা হয়েছে--জুলুম-নির্যাতন, ত-বিত করা হয়েছে মানব হৃদয়কে। নত করার আর কত আয়োজন হতে পারে? ধর্ম তার মধ্যে এক নম্বর; দমিয়ে রাখার, চাপিয়ে দেবার এবং পদদলিত করার। আমার অবস্থান প্রকৃতার্থে এর (ধর্মের) সপে নয়।

কারণ সত্য ও সুন্দরের উপাসক, যিনি স্রষ্টা--তিনি কখনো কারো দ্বারা বা কোনো গ্রন্থপাঠে চিরস্থায়ীভাবে আদর্শায়িত হন না অথবা মেধাবন্দি হয়ে পড়েন না। তবে ভালো লাগা থাকতে পারে। শিক্ষার জন্য, জ্ঞানের জন্য--অনেক কিছুই পাঠ্য এবং চেনা-জানার পরিধি বাড়ানোও উচিত। কিন্তু মেনে চলতে হবে, মেনে নিতেই হয় অথবা চিন্তার হাজতখানায় বাস করতে হবে; একটি বা বিশেষ বিশ্বাসের দ্বারা সীমায়িত হয়ে নুইয়ে পড়তে হবে, এটা কোনো গ্রহণযোগ্য কথা নয়। সত্য ও সুন্দরের কোনো নির্দিষ্ট বিশ্বাস বা সীমাঙ্ক থাকে না।

কারণ স্থান, কাল ও অঞ্চলভেদে তা পরিবর্তিত এবং গ্রহণযোগ্য পর্যায়ের পালনীও। সে-কারণে বীরের ধর্ম যেমন অসি পরিচালনা; তেমন সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের ধর্ম তার সৎচিন্তা ও সৎকর্মের সংঘটনা। জ্ঞান ও বিজ্ঞানের যৌথসঙ্ঘবদ্ধতায় গড়ে ওঠে সত্যধর্ম বা মানবধর্ম। এটা কোনো গ্রন্থ বা একক বিশ্বাসের কাছে দুমড়ে-মুচড়ে যেতে পারে না। সে জন্য প্রতিজন সত্যসন্ধানী মানুষ নিজেই নিজের উপাসক ও স্রষ্টা।

এর মধ্যে যে সত্য লুক্কায়িত, সেখানে জগতের সমস্ত কল্যাণ নিপতিত ও গচ্ছিত। নিবেদিত হওয়া এবং নিবেদিত করা দুই-ই যেমন সত্য, তেমনি পরমত্ব লাভ এবং পরমত্ব প্রকাশ সেও সত্য। সত্য কখনো প্রতারণা করে না বা ধোঁয়াজাল বিছিয়ে দেয় না। সত্য জানে আলোর নিচেই অন্ধকার, কিন্তু অন্ধকার মানেই ভয় বা পরাজয় নয়; বরং অনেক আলো, আর কোনো আলো জ্বালাতে পারে না, সে শুধু জ্বলে আর নেভে, তার কোনো অস্তিত্ব বা সার থাকে না। বীরের তলোয়ারের নিচেই সাম্রাজ্যবাদীদের তলোয়ার যেমন চিকচিক করে জ্বলে উঠে ঠিকরে পড়ে--যা আলোর মুখোশে শোষণের অহঙ্কারী কৃপাণ মাত্র।

এও একরকম সত্য, কিন্তু ভুল সত্য। কারণ এখানেও শিতি জ্ঞানপাপীদের সমাবেশ ঘটে। যেমন হিরোশিমা-নাগাসাকিতে যে বিমান থেকে পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছিল, তা মেঘমুক্ত আকাশে খুব কাছে থেকে স্পষ্ট ছবি তুলতে ও পরীক্ষাকর্ম সম্পাদন করতে ছয়জন নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানীও ঐ বিমানে সওয়ার ছিলেন। সে-জন্য উন্নয়নটা হতে হয় আত্মায় বা কলবে। যেখানে চিরসত্যের ঘণ্টা বেজে ওঠে প্রতিনিয়ত।

আমরা সে চরম ও পরম সত্যকে অস্বীকার করি বলেই প্রতি পদে পদে বিপদগ্রস্ত ও ধ্বংসের দিকে ধাবমান হই। এ জন্য প্রয়োজন নির্বাণপ্রাপ্তি বা শূন্যযাত্রায় নিরন্তর অবগাহন, ত্যাগের মহিমা যেখানে আলোর কণা ছড়ায়; আর এমন এক কণা যেখান থেকে হাজারো প্রদীপ জ্বালানো যায়। সেখানে যাত্রারম্ভ হয় বেসিক ফাউন্ডেশন বা ভিত্তিমূল সাজিয়ে। সেই সাজানোটাই সাজাতে হবে, আর নিবেদিতচিত্তে বিকশিত হতে হবে; তবেই মুক্তি--পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়বে শান্তির অনাবিল ধারা। আমরা সত্য, সুন্দর, কল্যাণ ও শান্তি এবং পরমানন্দের পক্ষে।

পাঁচ ধর্ম আমার কাছে ভালো কিংবা মন্দ অর্থে নয়, বরং এর ব্যবহার আমাকে তৃপ্ত করেনি বা আনন্দ দেয়নি, আবার খুব মন খারাপও করেনি। এটা অনেকটা গোলালুর মতো--ভত্তা, ভাজি বা ঝোলরান্না সবই করা সম্ভব; ধর্মকে নিয়েও। ধর্ম নিয়ে ব্যবসাও করা যায়, আবার ফতুর হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘোরাও যায়। পোপাসনে অধিষ্ঠিত হওয়া এবং সন্ন্যাস বা বাউল যাপনের উভয় সুযোগই থাকে। যে যেভাবে গ্রহণ করে বা করে থাকে।

এর ভালো দিক রয়েছে, আবার মন্দ দিকও রয়েছে। প্রচুর ভালোর মধ্যে প্রচুর মন্দ, এই নিয়ে ধর্মপদ্ধতি প্রচলিত--যা ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে আসার উদাসীনতাও দেখায়। অনেকটা চলচ্চিত্র বা সিনেমার মতো নায়ক আছে, খলনায়কও আছে। ধর্মকে (প্রচলকে) স্বীকার করলে শয়তানকেও মেনে নেয়া হয়, পরম-মহান ঐশ্বরিক শক্তি ও তার স্রষ্টা অবয়বের পাশাপাশি। এ যেন সাধু-শয়তানে সমানে সমান।

সকল ধর্মই যেখানে সত্য কথা, সৎচিন্তা ও সৎকর্মকে সমর্থন করছে এবং অন্যের অকল্যাণকে ঘৃণা করছে, সেখানে প্রকৃতার্থে যা হচ্ছে, তাতে উচ্চবাচ্যধারী কাতারে কাতার ধর্মপালনকারীগণ মূলত ধর্মাদর্শ পালন না-করে ধর্মের লেবাসে ব্যবসা পেতে বসেছে অথবা ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থকে কাজে লাগিয়ে উপরি-স্বার্থ হাসিল করছে। তা না-হলে প্রতিদিন যে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন চলছে, তাতে ভীষণরকমভাবেই শঙ্কিত হতে হয় যে, এরাই আবার কোনো-না-কোনো ধর্মের অনুসারী বা পরিচয় দিয়ে তৃপ্ত হন। সে ক্ষেত্রে এইসব ধর্মাচারী জঘন্য এবং ভয়াবহ শিষ্ঠাচার লঙ্ঘনকারী। এদের ধর্মপালন আর পোঁদচালন একই কায়দায় চলে বা ঘটে। কোনোভাবেই তারা সমর্থনযোগ্য নয় এবং মানুষ হিসেবে হীনশ্রেণিভুক্ত জানোয়ার পর্যায়েও।

এ ক্ষেত্রে ব্যবসা, যেমন ইমামগিরি, ফতোয়া বয়ান। ফতুর, যেমন সন্ন্যাসধারণ, পাগলগোত্রযাত্রা প্রভৃতি। আরেকটি শ্রেণি আছে, যারা এদিকও নয়--ওদিকও নয়। প্যান্ট-শার্ট পরে ধূপদুরস্ত আধুনিক মানুষ, কিন্তু ভেতর ভেতর সবটাই মাকাল। এরা প্রেমের জন্য বলি দেয়, যেমন ঈশ্বর প্রথম নারী-পুরুষকে বর্ণিত রূপকথার স্বর্গ থেকে বিতাড়ন করেছিলেন, শুধু মানবিক প্রেমের কারণেই এবং সেই শাস্তি এতোটাই ভয়াবহ ও ভয়ঙ্কর ছিল যে, দেশান্তর বা বিতাড়ন করেই ক্ষান্ত হননি, ন্যাঙটোও করে ছেড়েছেন।

কারণ হিসেবে সেখানে বসবাস সময়কালীন বসনাদির ঐ-অর্থে কোনো উল্লেখ না-থাকলেও, বিতাড়িত পর্যায়ে যে আবরণছিন্ন করা হয়েছিল, তার পরিষ্কার উল্লেখ আছে। উনি আর ওনার ধ্বজাধারী ফেরাস্তাকুল তা চেয়ে চেয়ে দেখেছেন, যেমন এখনো দেখেন, দেখতেই হয়; তা না-হলে যে গাছের একটি পাতাও ঝরে পড়বে না। সে অর্থে ভালো এবং মন্দের সঙ্গেই তার বসবাস এবং সাধু-শয়তানে উপরত। সে-কারণে দেখা যাচ্ছে যে, প্রকৃতির মতোই মানুষের মাঝেও একটি কনসেপ্ট বা বিশ্বাস দাঁড়িয়ে গেছে, একজন সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বরও আছেন উপগত--গড অথবা ভগবান অথবা আল্লাহ। এটা জন্ম-পরম্পরায় বা উত্তরাধিকারসূত্রে আমাদের মস্তিষ্কে ঢুকে গেছে--ভূতের অসারতার মতোই।

কারণ যে বাবা-মা ভূত বিশ্বাস করেন না, সেই বাবা-মা-ই সামান্য বা তুচ্ছ কিছু কারণে ছোটবেলাতেই সুকৌশলে সন্তানের মাথার ভেতরে ভূত-ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে--অনেক ভালোবাসায়, অনেক উত্তেজনায়। একক সে শক্তিকে আমরা সৎগুণাবলির আবরণে ঢেকে দিয়েছি পরিত্রাতা হিসেবে, কারণ আমাদের তো কেউ একজন এসে মুক্ত করতে হবে। তা না-হলে আমাদের উদ্ধার করবে কে? বাঙালির জন্য তা আরো বিপর্যয় পর্যায়েও। অন্যের সাহায্য বা করুণা ছাড়া আমরা যেন একা কিছুই করে উঠতে পারি না। আলোকলতার মতো বেঁচে থাকতে থাকতে আমরা এ-অঞ্চলের মানুষ অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

সে-কারণেই আমাদের একজন ঈশ্বর অবশ্যই লাগবে এবং তিনি থাকবেনও। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও একজন মাহাথির, ফিদেল, গাদ্দাফি কবে কখন এসে হাল ধরবেন; তবেই আমরা উঠে দাঁড়াবো নিজের পায়ে (দণ্ডায়মান থেকেও) এবং তিনি এসেই বয়ে নিয়ে যাবেন আমাদের দুঃখ-জরা-কান্তি-মেদসমূহ। দারিদ্র্য যেমন আমাদের ভূতের ভয়ের মতো পেয়ে বসেছে, আর মানসিক দীনতা আমাদের দিনে দিনে ছোট করতে করতে, নীচ করতে করতে--ভীরু-দুর্বল-অসহায় করে ফেলছে, আমরা তার কোনো খোঁজখবরই যেন রাখি না, এমনকি রাখতেও চাই না। কারণ দেশ চালান সরকার, তারই সব দায়-দায়িত্ব; আর পৃথিবী বা সৌরমণ্ডলীয় সমস্তকর্ম চালান ঈশ্বর, তিনিই সব শুভ বয়ে নিয়ে আসবেন--পাপমুক্ত করবেন। এই তৃতীয় শ্রেণিটি আরো ভয়াবহ, অসম্ভবরকম কট্টর ও খুনি-প্রকৃতির।

চোখে দেখতে অনেকটাই শাদামাটা, মুখে ভালো ভালো কথাও বলেন, কিন্তু নিজের বউ-বোন-সন্তানের কাছে গেলে বোঝা যায়--এরা কতটাই হারামি ও পিশাচ হতে পারে। প্রেমের জন্য বলি দিয়েই তারা ক্ষান্ত থাকে না শুধু, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় মর্যাদাহানি করা থেকে শুরু করে--ভিটেমাটি ছাড়া করতেও দ্বিধা করেন না। যাদের খললোলুপ দৃষ্টি হাসি হাসি, কিন্তু সোনা খাড়া হলে মাথায় আর কিছু থাকে না, তখন মাল উঠে যায় চাঙে। সে-কারণে মানুষ এবং জীবজন্তুকে এক-করে হিংস্র-শিকারি হয়ে ওঠে, কখনো গুপ্তঘাতক ও পতিত পুরুষ। আমার অবস্থান এর বিপরীতেই শুধু নয়, প্রচলিত যে-কোনো ধর্মের বিপে এবং এক ও একাধিক ঈশ্বরেও নয়; নিজের মাঝেই ঈশ্বরকে খুঁজে ফেরা ও তার অস্তিত্ব সন্ধান--এই-ই আমার ধ্যান ও সাধনা এবং নতুন ধর্মানুসন্ধান বা ধ্যানপ্রাপ্তি পথ।

পূর্ণাংশে মানুষের সঙ্গে থাকায়--অনেকাংশে তাদের পে হলেও, সৎ এবং কমিটেড মানুষের সঙ্গে--সৎচিন্তা এবং সৎকর্মে। সৎমানুষ আর যাই হোক, অমানুষ কিংবা বেইমান নয়। বিশ্বাস এদের স্বতন্ত্র জ্ঞানবৈশিষ্ট্যে--যা অন্যের কল্যাণের পাশাপাশি নিজের কল্যাণও নিশ্চিত করে। ধর্মের জন্য দুটো কথাই যথেষ্ট; সৎকর্ম ও সৎচিন্তা, অন্যার্থে কথায় সত্যবাদী হয়ে ওঠা ও মিথ্যাচার পরিহার করা এবং অন্যের কল্যাণ না-হোক অকল্যাণ না-করা বা বিরত থাকা। এটুকু রক্ষিত হলে, পৃথিবীতে ধর্মের প্রয়োজনীয়তাও কমে যাবে এবং যাজকের মূর্খতাদুষ্ট ফতোয়া থেকে মানুষ মুক্তি পাবে।

মানুষের সেই অপার-সম্ভাবনার মুক্তিই পৃথিবীতে চিরশান্তি বয়ে আনতে পারে। চিরকালীন প্রত্যাশার সেই শান্তির পরে মানুষদের এক হওয়া জরুরি এবং ধর্মব্যবসায়ীদের প্রতিহত করা আরো জরুরি। উনিশ ও বিশ শতকের বিজ্ঞাননির্ভর পৃথিবী এবং একুশ শতকের উন্নয়নযাত্রা--যার পুরোটাতেই ছিল ধর্ম ও ধর্মবেত্তাদের নির্লজ্জতা এবং অসারতার জয়গান। খোদ যুদ্ধাস্ত্রপন্থি রাষ্ট্রগুলো ও তাদের নানামুখী শোষণ ও তাঁবেদারি কৌশল সাজিয়েছে ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে এবং সেখানে মানুষকে (রাষ্ট্রকে) পৃথক করা হয়েছে ধর্মগত অবস্থান থেকে--যা কোনোভাবেই বিশ্বব্যবস্থার কোরামকে সমর্থন করে না। ফলে ধর্মব্যবসা ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে মসজিদ থেকে মন্দিরে, ধর্মালয় থেকে স্নানালয়ে।

যে-অর্থে মসজিদ, মন্দির গড়ে উঠেছে; সে-অর্থে মানুষের মধ্যে ধর্মের মৌলশক্তি বা সত্যশক্তির বিকাশ না-ঘটে উল্টো ধর্মকে বা এ সকল জায়গাকে ব্যবসা বা রাজনীতির ফাঁদকৌশল হিসেবে তৈরি করে ব্যবহার করছে বা উৎসর্গ করেছে পুরুষ যাজকেরা মহা-ধুমধামে। মানুষে মানুষে দ্বিধাবিভক্ত করে দিয়েছে, আর আন্তঃসম্পর্ক ভেঙে দিয়ে সংঘাতকে করেছে ত্বরান্বিত। হতভাগা বিশ্বদেশে যাজকের যাজকিগিরি দিন দিন বেড়েই চলেছে, গুটিকয় ব্যতিক্রম ছাড়া। যারা এ-বিশ্বমাঝারে যাজক না-হয়ে মানুষ হয়ে উঠেছেন কল্যাণে, সেবায়, মহত্ততায়; এমন মানুষের দেখাও আমরা পাবো। অথচ এর ব্যাক-প্র্যাকটিস হচ্ছে সর্বত্র, দায়ী হয়ে পড়ছে ধর্ম।

যদিও ধর্ম একটি দায়ী অবস্থানকেই চিহ্নিত করে। মানুষকে তার সীমা এঁকে দেয়--গণ্ডি; এর বাইরে যাওয়া যাবে না, গেলেই পাপ, স্বর্গনাশ বা সর্বনাশ, আর মহা ভয়ঙ্কর সব শাস্তি, আর... আর...। অন্ধরা সীমার বাইরে যেতে পারে না, কিছু শিতি-মূর্খ বেহুদাই আস্ফালন করে, আর আমার মতো অনেক ধর্মত্যাগীরা তা দেখে হাসে; কিন্তু হাসার কোনো কারণ নেই। এই মূর্খ, অর্ধশিতি ও শিতি-মূর্খদের জন্য মাঝে মাঝে করুণা হয় এই ভেবে যে, এরা কি কখনোই পুণ্যালোর সন্ধান পাবে না। এরা কি নিজেকে চিনতে পারবে না? নিজেকে জানবার মধ্য দিয়েই একজন মানুষের প্রকৃত ধর্মপালন সম্পন্ন হয়।

আর এই প্রত্যয়কে যত দ্রুত সম্ভব অব্যয় না-করে সব্যয় করার মধ্য দিয়েই অন্যকে, অনেককে জানা যায় ততই মঙ্গল। এই জ্ঞান বা চেনা-জানাই ধর্মের মূলকথা। যদিও প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসীরা এসব তত্ত্বীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে অতটা আগ্রহী নয়, যতটা আগ্রহী মাজার-মাদ্রাসা--ধর্মশালার দিকে। কিন্তু এও সত্য যে, মানুষ তার মনুষ্যত্ব জ্ঞানে ও গুণে এবং বিকাশেই পূর্ণ ও সম্পন্ন মানুষ। এই পরিপ্রেতি-বিবেচনায় শুধু ধর্মব্যবসায়ীদেরই নয়, তদ্রুপাচরণ পালনকারী ধর্মালয়ও ত্যাগ করা আবশ্যক এবং প্রকৃত জ্ঞানীদের সান্নিধ্যে এসে নিজের জ্ঞানকে পরিচর্চার মাধ্যমে সাবলীল ও সতেজ করে তোলা উচিত।

প্রচলধারার পীর বা ধর্মগুরু নয়, একজন ওস্তাদ বা সাধনগুরুর সন্ধান লাগবে; জ্ঞান প্রকাশের বা বিকাশের অন্যার্থে জ্ঞানদর্শনের ও অর্জনের বা মাধ্যমের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যেতে, এর শাখাসমূহ বা পদ্ধতি-পথ ক্রমেই অতিক্রম করে। যে পথে দেহের শান্তি এবং আত্মার প্রশান্তি রতি হবে। ধর্মব্যবসায়ীদের কু-লালসা এখন ধর্মালয় ছেড়ে ব্যবহারিক জীবনের সাধারণ কাতারে এসে পৌঁছে গেছে বা দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে গেছে--যা আরো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে দিনে দিনে। কিছু টুপি ও পৈতা পরা মূর্খ মোল্লা ও ঠাকুরেরা ফতোয়া দিচ্ছে, আর কিছু শিতি-অশিতি মূর্খ পালন করছে বা মেনে নিচ্ছে নিজের মেরুদণ্ডহীনতার কারণেই। মেরুদণ্ডবান মানুষ কখনোই কোনো অধীনতাকে মেনে নিতে পারে না বা গ্রহণ করে না এবং কোনোভাবেই এর বশ্যতা স্বীকার করে না।

সে ক্ষেত্রে যুগে যুগে ভীরু, দুর্বল অসহায় মানুষই ধর্মের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। কারণ বিজ্ঞান মানুষকে রূপকথার স্বপ্ন দেখাতে পারেনি, বাস্তবভিত্তিক স্বপ্ন-সম্ভবকে নিশ্চিত করেছে বা স্বীকৃতি দিয়েছে, আর ধর্ম সত্তর হুরের মতো, বেহেস্তের মতো, পুনর্জন্মের মতো রূপকথারূপ হাজারো স্বপ্ন দেখিয়েছে। মৃত্যুর পর একটা নিশ্চয়তা দিয়েছে, আপনি ভালো কাজ করলে বেহেস্তে যাবেন আর মন্দ কাজ করলে দোজখে যাবেন। কিন্তু আমার বলা হলো, ভালো কাজ করলে ভালো মানুষগুলো তো এ পৃথিবীতেই সম্মানিত হবেন এবং তার কর্মফল পুরস্কারও পাবেন। আমাদের সমাজে এর উদাহরণ বিরল নয়।

তা ছাড়া মূর্খ মানুষ যদি লোভে (বেহেস্ত-মোহে) পড়েও ভালো কাজ করতো, তবুও তো একটা কিছু হতো--আপাত শান্তির পক্ষে, তাও হচ্ছে না। সর্বত্র চলছে ভাঁওতাবাজি আর ফতোয়াবাজি, অর্থাৎ লুটেপুটে খাবার একটা প্রক্রিয়া--এটি চলছে, ছড়িয়ে পড়েছে ধর্মযাজক থেকে শুরু করে সাধারণ শ্রেণি-পর্যায় থেকে খেটেখাওয়া-অভুক্ত মানুষ পর্যন্ত। যেহেতু ধর্মযাজকদের কাছে অন্ধ মানুষেরা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিকভাবে নানা দুর্বলতায় ও অসহায়ত্বের কারণেই তাদের কাছে নত থাকে এবং আদেশ-নিষেধ পালন করে অথবা দু-একজন করে না। কিন্তু তাকে অর্থাৎ ধর্মযাজক বা অনুসারীদের অনুসরণ করে। ফলে যাজককুলের ভণ্ডামি, ফতোয়া আজ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে, করানো হচ্ছে--শিক্ষিত (মূর্খ) মানুষদের দিয়েই, যারা অর্থের কাছে কেজির দরে বিক্রি হতে পারে, হবে, হয়েছে।

এমন বিক্রির উদাহরণ বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রেও নানাভাবে ঘটেছে। সবাই আহমদ শরীফ, আব্দুর রাজ্জাক কিংবা আহমদ ছফা হন না। অন্যদিকে হুমায়ুন আজাদ-এর দ্রোহ কিংবা তসলিমা নাসরিন-এর বিদ্রোহ নিয়েও কেউ মাথা উঁচু করে দাঁড়ায় না। গড়পড়তা মানুষ গড়ায়ু আর গড় Nature বা Culture নিয়ে বেড়ে উঠছে--যা কোনো অবস্থাতেই শুভলক্ষণ নয়। এর বিপে লাঠিচার্জ নয় বরং মানসিক বিকাশ দরকার--সত্যের জন্য, সম্ভাবনার জন্য, কল্যাণের জন্য; প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা ও বাক-স্বাধীনতার জন্য।

সুন্দর ও আলোকিত ভবিষ্যতের জন্য। সৎমানুষ অবশ্যই কমিটমেন্টচারী এবং কোনো কমিটেড মানুষ কখনোই অসৎ হতে পারেন না। অর্থাৎ সৎ হওয়ার জন্য কমিটমেন্ট একটি বড় গুণ, আর কমিটেড মানুষ অসৎ হন না। যদিও ধর্মগুরু বা যাজক, রাষ্ট্র অথবা সমাজ দ্বারা নির্ধারিত সৎ-অসৎ আমার আলোচ্য নয়। তথাকথিত সবকিছুতেই আমার আপত্তি আছে, আপত্তির জন্য নয়--আরোপিত অন্ধত্বের জন্য।

আমার কাছে সৎমানুষ তিনিই--যিনি অন্যের কল্যাণই শুধু করেন না, নিজের কল্যাণও নিশ্চিত করেন এবং সময়জ্ঞান, সম্পর্কজ্ঞান ও ধর্মজ্ঞানকে (মানুষধর্ম, পুঁথিগত আচারি ধর্ম নয়) সমন্বয় করেন। অর্থাৎ কল্যাণভিত্তিক সেবাচিন্তা নিজে বহন করেন এবং অন্যের মাঝে প্রবাহিত করেন, এটি তার নিজস্ব ধর্মজ্ঞান হতে পারে, তবে তা অবশ্যই প্রচলিত ধর্মের বাইরে এসে--এ-ও এক ধরনের ধর্ম; কেননা নীতি, আদর্শ এবং কল্যাণ ও সেবাচিন্তা যেখানে জড়িত সেখানে পানির একটি ধর্ম নিচ দিকে প্রবাহিত হওয়ার মতো--এটিও একটি ধর্মজ্ঞানকে সমুচিত মনে করতে পারে বা স্বীকৃতি দিতে পারে। এ-ধর্ম মানুষধর্ম, মানুষের ধর্ম, কল্যাণ ও শান্তির ধর্ম; মানবতা বা মানববাদ--যার একমাত্র ও অদ্বিতীয় শক্তি। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.