আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাতাসের এই শহরে...

সাংবাদিকতার ছাত্র,আপাতত প্রবাসে আছি। উত্তরবঙ্গের যে ছোট্ট জেলা শহরে আমার বাড়ি, সেখানে অনেক বাতাস। ঠিক সন্ধ্যা বেলা আমরা রেললাইন ধরে হাঁটতে যেতাম। পাশে থাকত বাবলা গাছের সারি,আর একটু আগে ভাগেই বেরিয়ে পড়া দলছুট কিছু জোনাকি। অনেকটা পথ হেঁটে তুলসীগঙ্গার ওপর যে রেলসেতুটা আছে,তার গার্ডারে পা ঝুলিয়ে বসতাম।

অস্পষ্টভাবে কানে আসত প্রায় মরে আসা তুলসীগঙ্গার বয়ে চলার শব্দ। আমরা অবশ্য অপেক্ষায় থাকতাম বাতাসের। প্রায় মাতাল করে দেয় এমন একটা বাতাস। তুলসীগঙ্গার পাশের ধানক্ষেত গুলো কাঁপিয়ে এ বাতাস আমাদের চুল ছুঁয়ে যেতো। আমরা চোখ বন্ধ করে,বাতাসে গন্ধ খুঁজতাম।

একটু আগে শেষ হয়ে যাওয়া বিকেলের পড়ে আসা রোদের গন্ধ কিংবা অনেকদূরের কোনও বুনোঝোঁপ থেকে ভেসে আসা কামিনীর গন্ধ। মাঝে মাঝে আমরা বাতাসের ভাষা বুঝতে চাইতাম। বাতাসটাকে বুকের ভেতর ভরে রাখতাম অনেকটা সময় নিয়ে। কিন্তু বুঝে উঠতে পারতাম না,এ বাতাসের ভাষ্য। তবে এটুকু বুঝতাম, এ বাতাসের অনেক কথা।

অনেকের অনেক কথা জমিয়ে রেখেছে এ বাতাস। রাত বাড়ে। দূরের সাঁওতাল পল্লীর টিমটিমে কুপি বাতিগুলোকে পেছনে ফেলে আমরা ফিরে আসতাম,আমাদের শান্ত শহরটায়। সীমান্ত থেকে প্রায় ১৭ মাইল ভেতরে আমাদের এই জয়পুরহাট জেলা শহর। জয়পুরহাটকে জেলা শহর বলাটা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না।

মফঃস্বল বললেই ভাল শোনায়। দোকানপাট বিশেষ কিছু নেই। যা আছে তা দেখে শেষ করার জন্য মোটামুটি ভাবে ১০ মিনিট হাঁটাই যথেষ্ট । রাত আটটার পর বাতি নিভিয়ে যে যার বাড়ি চলে যায়। শনি বার আর বুধ বারে শহরের মাঝখানে একটা হাট বসে।

সে হাটে আপনি হয়ত,একটু আগে ক্ষেত থেকে তুলে আনা লাউটা পাবেন মাত্র ১০ টাকায়। কিংবা আলুর সময় আলু পাবেন ৬ টাকা কেজি দরে। শীতের সময় বাঁধাকপি আর ফুলকপি হয়তো পাবেন আরও কম দামে। বাংলাদেশের আর দশটা জেলার মত এ জেলার মানুষগুলোও খুব বেশি সরল। এবং কোন কোন ক্ষেত্রে একটু বেশিই সুখি।

৮৭ আর ৯৮ ছাড়া এই এলাকায় কখনও বড় কোন বন্যা হয় নাই। অধিকাংশ আবাদি জমিতে বছরে তিন বার ধান হয়। ধানের পর সবচেয়ে যে ফসলটা বেশি হয়-সেটা হল আখ। সব সুখের মাঝে ছোট করে একটা দুঃখ থাকে। আমার এলাকার দুঃখ হল আমাদের জয়পুরহাট চিনিকল।

একসময়কার লাভজনক এই চিনিকলটি,শেষ কবে লাভের মুখ দেখেছে এলাকার লোকজন জানেনা। আর এই সব ব্যাপার জানার সময়ই বা কই? আমরা সবাই ভারতীয় চিনি খাই। এই জনপদে কোন শিশু জন্ম নিলে, প্রথমে আমরা যে কাজটা করি- তা হল,তার মুখে এক চামচ ভারতীয় চিনি তুলে দিয়ে বলি “আমীন” । এমন না যে বাজারে বাংলাদেশি চিনি নেই। আছে,কিন্তু প্রতিযোগিতার বাজারে এই চিনি কিনবে কে? আমরা যারা একটু মধ্যবিত্ত তারা হয়তো মাঝে মাঝে চায়ে এই চিনি খাওয়ার বিলাসিতা করতে পারি।

কিন্তু খেটে খাওয়া যে লোকগুলো, তারা এই বিলাসিতা কেন করবে? প্রতি কেজিতে যেখানে ১৫ থেকে ২০ টাকা তফাৎ, সেখানে বিলাসিতা করাটা নেহাতই বোকামি। তাই বলে আমাদের চিনিকলটা কিন্তু বন্ধ হয়ে যায়নি। প্রতি বছর শীতের শুরুতে সেটি চালু হয়। গোটা মৌসুম জুড়ে জেলার বিভিন্ন আখ ক্রয় কেন্দ্রে এই মিলের জন্য আখ কেনা হয়। সেই আখ থেকে চিনি হয়।

তারপর মৌসুমের শেষে আমাদের সুগারমিলটা পরিণত হয় একটা “চিনি জাদুঘরে”। বছরজুড়ে এই চিনি সুগারমিলের মেঝেতেই বস্তাবন্দী হয়ে পড়ে থাকে। বাজার পর্যন্ত আর আসা হয়ে ওঠেনা। যত দূর জানি, দর্শনার “কেরু অ্যান্ড কোং” সুগারমিলটি ছাড়া বাকি ১৬টিরও একই অবস্থা। ডিস্টিলারিজের সাইড ইনকাম থাকায় এই সুগারমিলটি কোনভাবে টিকে আছে।

চিনি প্রসঙ্গ বাদ দিই। সত্যি কথা বলতে কি লবন,ডাল, তেল,শাড়ি-চুড়ি থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুই আমার এলাকায় ওপারের(ভারতীয়)। কে জানে?হয়তো সারা বাংলাদেশ জুড়েই ভারতীয় পণ্য। মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে আসলে এই সব নিয়ে দুঃখ পেয়ে লাভ নেই। মুক্তবাজারে না হোক,অন্ততও কালোবাজারের কল্যাণে হলেওতো আমরা কম দামে খেতে পড়তে পাড়ছি।

আমরা এতেই খুশি। চিনিশিল্পের মত বাংলাদেশের বাকি সব শিল্প পাঁজর ভেঙ্গে পড়ে যাক। আমরা সংকল্প করেছি,আমরা কিছু দেখবনা। অতঃপর একটি অপ্রাসঙ্গিক গল্পঃ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আজকে ক্ষেতে যেতে হবে আরমান মিয়াকে। সকাল থেকে এই টিপটিপানি বৃষ্টিকে অন্তত শখানেক বার গালি দিয়েছেন।

রাগ তবুও পড়ছেনা। ধান কাটার এই মৌসুমে চাই কড়া একটা রোদ। তা তো নাই ই। বাড়তি জ্বালা হিসেবে এখন এসেছে-এই ছিচকাঁদুনে বৃষ্টি। দেরি করেও লাভ নেই।

ক্ষেতের পথে পা বাড়ান আরামান মিয়া। সীমানা পিলার নং ১৪৫৫ ঘেঁষা ছোট এই জমিটুকু আরমান মিয়ার। জমির দিকে তাকিয়ে মন খারাপ ভাব কোথায় যেন হারিয়ে যায় তাঁর। সোনা রঙা ধানের আলোয় আকাশের মেঘলা ভাব যেন অনেকটাই কেটে গেছে। গুন গুনিয়ে গান গান ধরেন আরমান মিয়া।

ব্যস্ত হয়ে ওঠে তাঁর হাতের কাস্তে। আরমান মিয়া আজ অকারনেই খুশি। আনমনা হয়ে হারিয়ে যান হেমবরণী কিছু স্বপ্নে। হঠাৎ করে পিঠের দিকটায়, অনেক জোড়ালো ধাক্কার মত কিছু একটা এসে লাগে। আরমান মিয়া নাকে বারুদ পোড়া একটা গন্ধ পান।

ঠিক কি হয়েছে বুঝে উঠতে গিয়ে,দাঁড়াতে চান তিনি। দাঁড়াতে পারেন না। আলতো করে শুয়ে পড়েন মাটিতে। চোখ বন্ধ হয়ে আসে। আরমান মিয়া বোধহয় মারা যাচ্ছেন।

আরে মৃত্যু কি এতো সহজ নাকি? মৃত্যু আসলে সহজ। আমি বা আরমান মিয়ার মত যারা সীমান্তের কাছাকাছি বাস করি, তাদের জন্য খুব সহজ। আমরা কোনও কারনে বা ভুল করে সীমানার কাছাকাছি গেলে,ওপারের সীমান্তরক্ষীরা আমাদেরকে আমাদের সীমানাটুকু মনে করিয়ে দেয় চরমতম কোনও মূল্যে। এক নিমিষে বিএসএফের খেলার ছলে ছোঁড়া বিষাক্ত বুলেট স্তব্ধ করে দেয় সব কিছু । মাঝে মাঝে আমাদের লাশটাকেও ওরা টেনে হিঁচড়ে ওপারে নিয়ে যায়।

দুই তিন দিন পরে আমাদের ক্ষত বিক্ষত গলিত লাশ ওরা ফেরত দেয়। আমাদের স্বজনদের দেখাবার জন্য। সারা বাংলাদেশকে দেখাবার জন্য। আরমান মিয়া মারা যাচ্ছেন। চার পাশ ঘোলাটে হয়ে আসছে তাঁর।

ঠিক এই সময়টায় চোখের সামনে আরও অনেক মানুষকে আসতে দেখেন। দলে দলে অগণিত মানুষ। দলটায় সবার আগে ১৬ বছরের এক কিশোরী। আরে এতো সেই ফেলানি!! সেই কাঁটাতাঁরে ঝুলে থাকা ফেলানি। ওরা আরমান মিয়াকে ওদের দলে নিয়ে নেয়।

তারপর বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দলগতভাবে একটা স্যালুট দিয়ে,সবাই একসাথে হো হো করে হেসে ওঠে। ওদের হাসি অনেক ক্ষণ ধরে শোনা যায়। অনেকটা প্রতিধ্বনির মত। তারপর একটা সময় ধীরে ধীরে বাতাসে মিলিয়ে যায়। ।

পুনশ্চঃ কয়দিন আগে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন,“ফেলানি নাকি ভারতীয় নাগরিক। তারপরও উনি ফেলানিদের বাড়িতে গিয়েছেন। এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে যথাসাধ্য সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন”। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই কথায় অনেকেই রাগ করেছেন। কেউ কেউ হয়তো রাগে চিৎকার করে কেঁদেছেন।

আমার অবশ্য এই সব ব্যাপারে এখন আর রাগ-টাগ হয়না। আমি শুধু ফেলানিকে একটা প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম। আচ্ছা ফেলানি, “যখন দুই দেশের সীমানা টেনে দেওয়া ওই কাঁটাতারের ওপর তুমি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ঝুলে ছিলে। আর শেষবারের মত ঘাড় উঁচিয়ে দেখার চেষ্টা করছিলে এপারে থাকা তোমার প্রিয় স্বদেশকে!! তখন যদি তুমি জানতে-তুমি মরবার পর,তোমার দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তোমার নাগরিকত্বকে বিতর্কিত করবেন। তখন তুমি কি করতে”? ফেলানির উত্তরটা আমি বাতাসে পাই।

ও হয়তো ছোট্ট করে একটু হাসতো। তারপর বলতো-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলতাম, “উনি যাতে দয়া করে এপার থেকে আমাকে আরেকটা গুলি করেন। তারপর আমি মরে গেলে-আমার লাশটা যেন উনি ধাক্কা দিয়ে ভারতীয় সীমান্তের ওপারে ফেলে দেন”। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী প্রতিটা এলাকার বাতাস প্রতিদিনই অল্প অল্প করে ভারী হচ্ছে। বাতাসে মিশে যাচ্ছে ফেলানি,আরমান মিয়া সহ অগনিত নিরপরাধ মানুষের দীর্ঘশ্বাস।

আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একদিন অবশ্যই খোলা হাওয়ায় আসবেন। আমাদের বিশ্বাস-সেদিন আমাদের মত উনিও বাতাসের কথা বুঝতে পারবেন। বাতাস তার কানে কানে এসে বলে যাবে,“ফেলানি বাংলাদেশি, ফেলানিরা বাংলাদেশি!” লেখাটা ক্যাডেট কলেজ ব্লগে অনেক দিন আগে লেখা। এখানে রিপোস্ট করলাম। ভারতীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে আসছেন।

সময় এসেছে আমাদের সমস্যাগুলো খুব জোরালোভাবে তুলে ধরবার। শুধু সীমান্তে হত্যা নয়, ভারতীয় অগ্রাসনে আমার এলাকার মত আরও অনেক এলাকাতেই মড়ক লেগেছে । এখনই এ মড়ক না থামাতে পারলে, এ মড়ক যে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়বে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।