আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বৃষ্টিভেজা পথ

দিতে পারো একশ ফানুস এনে...আজন্ম সালজ্জ সাধ একদিন আকাশে কিছু ফানুস উড়াই... ব্যাগে বই ঢুকাতে ঢুকাতে ক্লাসরুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো ঝিনুক। আকাশ কালো হয়ে এসেছে, যে কোন সময়ে বৃষ্টি নামবে। পয়লা আষাঢ়ে প্রতিবছর বৃষ্টি হয়, এবারেও নিশ্চই হবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ তরুনীর মত তারও বৃষ্টি নিয়ে পাগলামী আছে। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা তার জন্য খুবই স্বাভাবিক একটা ঘটনা।

মোটামোটি প্রতি বছরই সে পয়লা আষাঢ়ে নীল রঙের শাড়ী পড়ে। এবারই প্রথম ব্যতিক্রম, বেরসিক স্যারেরা ঠিক পয়লা আষাঢ়েই সেমিস্টার ফাইনাল ফেলেছেন। মনে যতই রোমান্টিসিজম থাকুক, পরীক্ষার মাঝে শাড়ী পরে লাফালাফির মানসিকতা মোটেই নেই ঝিনুকের মাঝে। তবে আশার কথা, আজই শেষ পরীক্ষা। আর বৃষ্টি তো সবে শুরু! ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে রাগে তার গা চিড়বিড় করে ওঠে।

জুনিয়র গুলি সব নীল শাড়ী আর পাঞ্জাবী পরে কলা ভবনের ঠিক সামনে বর্ষাবরণ উৎসব শুরু করেছে। পরীক্ষা হওয়ার আর সময় পেলো না। করিডোরে এসে তার প্রাণের বান্ধবী সুমির সাথে দেখা হয়ে গেলো। সুমির এক হাতে এক গাদা কদম ফুল, আরেক হাতে সবুজ রঙের ললি। এই মেয়ে সারাক্ষন কিছু না কিছু খেয়েই যাচ্ছে।

“অ্যাই, কদম ফুল নিয়ে কই যাস?” “কোথাও যাই না তো। কদম ফুল সব গুলি মাত্র ১০ টাকায় কিনলাম। সামনে যে পিচ্চিটা চকলেট বিক্রি করে না, সে বর্ষা আসা উপলক্ষে এখন কদম ফুল বিক্রি শুরু করেছে। তুই নিবি?” সুমি আইসক্রিম খেতে খেতে বললো। “আরে নাহ, গন্ধ নাই কিছু নাই, কদম নিয়ে কি করবো? কেউ ভালোবেসে দিলে অন্য কথা ছিলো” - ভেংচি কাটে ঝিনুক।

খিক খিক জাতীয় শব্দ করে সুমি হাসলো। “ভালোবেসে কদম দিলে আমি নিবো না, আমাকে ভালোবেসে ডায়মন্ড দিতে হবে”। ঝিনুক সুমির দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার এই বান্ধবী মহা সুন্দরী, মাঝে মাঝে এতই সুন্দর লাগে যে তারই তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। হীরা বা কদম – যা চাবে তাই তার পাওয়ার কথা।

“তুই তো চাইলে ব্রাড পিটকেও পাবি, তোর এত চিন্তা কি?” “হয়েছে! হয়েছে! চল, ঝালমুড়ি খাই”- সুমি টানতে টানতে ঝিনুককে নিয়ে গেলো। ঢাকা ভার্সিটির মত চমৎকার ভার্সিটি পৃথিবীতে আর দুইটা আছে কিনা তা নিয়ে ঝিনুকের সন্দেহ আছে। বিচিত্র সব কান্ড কারখানার আড্ডা খানা। এই যে বটতলায় মামুন এখন তার শিষ্যদের উদ্দেশ্যে রাজনীতির অমোঘ বাণী বর্ষন করছে, আবার ঠিক তার বিপরীত পাশেই আহসান কাগজ কলম নিয়ে এক মনে কবিতা লিখছে। অল্প কিছু দূরেই কয়েকজন ফর্সা ফর্সা আপু রূপচর্চার জন্য মুলতানি মাটি বেশী প্রয়োজন না বেলে মাটি- এই নিয়ে তুমুল তর্ক জুড়েছে।

ঝিনুক ঝালমুড়ি কিনে আহসানের কাছে উপস্থিত হলো। সুমি ততক্ষনে আবিরের সাথে রিক্সাভ্রমণে বেড়িয়ে গেছে। আহসানকে শুধু আহসান ডাকা যায় না, তাকে ডাকতে হয় কবি আহসান। এ পর্যন্ত প্রায় দেড় হাজার কবিতা সে লিখে ফেলেছে। কিন্তু ভার্সিটির ম্যাগাজিন ছাড়া অন্য কোথাও ছাপা হয় না।

সবার মাথার ৩০ হাত উপর দিয়ে যায় কবির কবিতা। ঝিনুক যেতেই কবি গম্ভীর মুখে বললো, “ভালো সময়ে এসেছিস! এই মাত্র একটা কবিতা প্রসব করেছি। শোন”। “ধূর! তোর কবিতা ভালো লাগে না। ছাইপাঁশ কি সব লিখিস, গল্প লিখতে পারিস না?” আহসান আহত চোখে খানিকক্ষন তাকিয়ে রইলো।

তারপরে ধুম ধাম করে খাতা নিয়ে উঠে পড়লো। “আরে থাম না, আমি তো দুষ্টামি করলাম। ওই!” আহসান রাগ করে চলেই গেলো। ঝিনুকের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। এভাবে সে না বললেও পারতো।

একটা মাত্র কবিতাই তো, শুনলে কি এমন ক্ষতি হতো? মোবাইলে চেষ্টা করলো কবিকে ধরতে, বন্ধ। মন খারাপ করে ঝিনুক হাঁটতে লাগলো। রিক্সা পেলে বাসায় গিয়ে ছাদে বসে থাকবে। শাড়ী পরে নিজের বাসার ছাদে সে বরণ করবে বর্ষাকে, একা একাই। ভাষা ইন্সটিটিউটের সামনে এসে ঝিনুক অবাক হয়ে গেলো।

সাব্বির বিরক্ত মুখে সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করছে গেটের সামনে। সেটা বড় কথা না, বড় কথা হলো সাব্বির এই সময়ে এখানে কি করছে? ঝিনুক সাব্বির কে একেবারেই পছন্দ করে না, সোজা বাংলায় অসহ্য রকমের নাক উঁচা একটা ছেলে। ছেলের আরো অনেক সমস্যা আছে, যার মাঝে অমিশুক, ঠোঁটকাটা আর সব কিছু তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা অন্যতম। এই জাতীয় ছেলের সাথে ঝিনুকের পরিচয় থাকার কথা না, কিন্তু ইন্টারনেট আর মোবাইলের যুগে সবই সম্ভব। প্রায় দিনই ঝিনুক অসহ্য হয়ে ফোন রেখে দেয়, কিন্তু কেন যে আবার কথা বলে সে নিজেই জানে না।

লুকিয়ে পড়বে নাকি ভাবতে ভাবতেই সাব্বির তাকে দেখে ফেললো। দেখেও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। সামনে দিয়ে গট গট করে হেঁটে গেলে মনে হয় উচিত শিক্ষা দেয়া যেতো, কিন্তু ঝিনুক অতিমাত্রায় ভদ্র। তাই সেই এগিয়ে গেলো। “কি ব্যাপার? এই সময় এইখানে? অফিস নাই?” “আছে, ফাঁকি মারছি”।

“কেন? আর ফাঁকি দিয়ে এইখানে দাঁড়ায় আছো কেন?” ঝিনুক এবার সত্যি অবাক। সাব্বির কিছু বলার আগেই হুড়মুড় করে বৃষ্টি চলে এলো। দৌড়ে পাশের ছাউনিতে যেতে যেতেই কাক ভেজা হয়ে গেলো দুইজনেই। অপূর্ব বৃষ্টি, ক্যাটস এন্ড ডগস বললে ভুল হবে; কুকুর আর বেড়াল পুরো মারামারি শুরু করেছে। বৃষ্টির শব্দে কথা শোনা দায়।

রাস্তার সবাই দৌড়াচ্ছে, কিন্তু বৃষ্টি তাদের চেয়ে দুই ধাপ এগিয়ে সবাইকেই ভিজিয়ে একশা করে দিলো। কিছুক্ষনের মাঝেই জারুল আর বাঁদর লাঠি ফুল ঝরে পড়ে রাস্তা রঙিন করে তুললো। ঝিনুক তাকিয়ে দেখলো সাব্বির খুবই কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। বেচারা বৃষ্টি সহ্যই করতে পারে না, ভীষন রকমের ঠান্ডার সমস্যা তার। একটু পরেই নিশ্চই হাঁচি দেয়া শুরু করবে।

ঝিনুক হেসে ফেললো। “হাসছো কেন?” সাব্বির ভুরু কুঁচকালো। “খুব মজা, না?” “মজাই তো। পয়লা আষাঢ়ে এত সুন্দর বৃষ্টি সব সময় হয় নাকি?” “একটু পরেই যখন সব তিন হাত পানির নিচে যাবে, তখন হাসিটা দিও”- সাব্বির আসলেই বিরক্ত। “তা তোমাকে কে আসতে বলছে? অফিসে বসে থাকলেই তো পারতা।

এইখানে কি?” সাব্বির উত্তর দেয়ার প্রয়োজন অনুভব করলো না। সে এখন তার মোবাইল চেক করতে ব্যস্ত। পানি ঢুকলেই তার মোবাইল যে ইন্তেকাল করবে, ঝিনুক সে ব্যাপারে একরকম নিশ্চিত। মোবাইলের যা অবস্থা, তাতে এখন তাকে আইসিইউ সাপোর্টে রাখলে ঠিক হয়। “শোনো, তুমি এইখানে দাঁড়ায় থাকো।

আমি এখন রিক্সা করে বুয়েট যাবো”। “বুয়েট যাবা কেন?” সাব্বির অবাক হয়ে প্রশ্ন করে। “কারন আমার বুয়েটের রাস্তাটা ভীষন পছন্দ, আমি ওখানে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে হাঁটবো”। ঝিনুক মুখ টিপে হাসছে, সে মোটেই এখন বুয়েট যাবে না। সাব্বিরকে রাগানোর জন্য বলেছে।

সাব্বির যে এখনই খ্যাক করে উঠবে এবং তিন দশে তিরিশটা বকা শুনায় দিবে সে বিষয়ে সে নিশ্চিত। “ঠিক আছে, চলো”। বজ্রাহত হলেও ঝিনুক এত অবাক হতো না। “মানে? তুমি যাবা?” “কি আর করবো। চলো”।

ঝিনুক প্রমাদ গুনলো, সে মোটেই এই পাজি ছেলের সাথে বৃষ্টিতে ভিজবে না। বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন আছে। “না না, বাদ দেই। কোন মামা এখন রিক্সা চালাতে রাজি হবে না”। সাব্বির ডাকতেই এক রিক্সা রাজি হয়ে গেলো।

সাব্বির উঠে ডাকলো, “কই? আসো”। নিম পাতা খাওয়া মুখে ঝিনুক রিক্সায় উঠলো। মেঘের দল ভীষন দুঃখে অশ্রু বর্ষন আরো বাড়িয়ে দিলো। এখনো বাংলাদেশের মানুষ পাগলামী দেখে অভ্যস্ত না। সুতরাং যেই গুটি কতক মানুষ রাস্তায় আছে, সবাই ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইলো।

তাকানোর কারনও অবশ্য আছে। দুইজন তরুন-তরুনী রিক্সা করে ভিজতে ভিজতে যাচ্ছে, কেউ কারো সাথে কথা তো দূর, কারো দিকে তাকাচ্ছে না পর্যন্ত। বুয়েটের কাছাকাছি এসে ঝিনুক আড়চোখে সাব্বিরের দিকে তাকালো। বৃষ্টির ঝাপটা সামলানোর জন্য সে একটু মাথা নিচু করে আছে। বড় বড় চোখের পাপড়ি দিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টির পানি গালের ওপর পড়ছে।

ঝিনুক হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো, ছেলেটাকে এত মায়া মায়া লাগছে কেন? এত অদ্ভুত লাগছে চারপাশের সবকিছু। সাব্বির রিক্সা থেকে নেমে যখন তাকে ডাকলো তখনো সে ঘোরের মধ্যে। বুয়েটের রাস্তাটা কৃষ্ণচূড়ার ডাল আর ফুল দিয়ে রক্তিম হয়ে আছে। অসম্ভব শান্ত চুপ চাপ একটা রাস্তা, অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করছে কারো আসার। বৃষ্টির তোড় তখন কিছুটা কমে এসেছে, ঝিনুক স্যান্ডেল খুলে ফেললো।

পানি আর কৃষ্ণচূড়া মাড়িয়েই সে হাঁটতে শুরু করলো। সাব্বির অবশ্য একটু দূরে ফুটপাত দিয়ে হাঁটছে। ঝিনুক ঘোরলাগা ভাবে হেঁটে চললো, কৃষ্ণচূড়া তার প্রিয় ফুল। কলি পেলেই সে তুলে ওরনার একপ্রান্তে জমাতে শুরু করলো। হাঁটতে হাঁটতে একটা বিল্ডিং এর কাছে আসতেই আবার জোরে বৃষ্টি শুরু হলো।

সাব্বির লাফ দিয়ে বারান্দায় উঠে গেলো। ঝিনুক সিঁড়িতে কৃষ্ণচূড়া হাতে দাঁড়িয়ে রইলো। কানের মাঝে অর্থহীনের গান বাজছে, আমার কাঁধে হালকা ঝোলা তোমার চুলে কৃষ্ণচূড়া… ঝিনুক দেখলো সাব্বির চুপ চাপ পিলারে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভিজলে মানুষের চুল বসে যায়, সাব্বিরের চুলে পানি পড়লেই সব চুল খাড়া খাড়া হয়ে যায়। আগে সে কেন কখনো খেয়াল করেনি যে সাব্বিরের চোখগুলো এতো মায়া কাড়া? ঠান্ডায় কেঁপে কেঁপে ওঠা শান্ত মুখের ছেলেটাকে দেখতে দেখতে ঝিনুকের দুই চোখ পানিতে পূর্ন হয়ে গেলো।

গলার কাছে শক্ত কিছু একটা জমাট বেঁধে আছে, বুকের মাঝে তীব্র অস্বস্তি। এটা কি ধরনের অনুভূতি? ভালোবাসা? এই ছেলেকে? অসম্ভব! বৃষ্টিতে ভিজে তার মাথা খারাপ হয়েছে নিশ্চই। আচ্ছা সাব্বির কি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তার দিকে? ঝাপসা চোখে তো কিছুই পরিস্কার দেখা যাচ্ছে না। যদি না দেয়? চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা সাবধানে বের করে দিয়ে ঝিনুক অনিশ্চিত ভাবে হাত বাড়ালো। ভালোবাসার প্রথম স্পর্শ।

************************ আমি নাকি গল্প, আবজাব রম্য, প্রলাপ লিখে লিখে সামুর সার্ভার ডাউন করে ফেলছি। পৃথিবীর সব বন্ধু বান্ধবের নামে কিছু না কিছু লিখে ফেলেছি, কিন্তু তাকে কোন কিছু উৎসর্গ করিনা। উৎসর্গ আর কি করবো, তার নামেই একটা খাপছাড়া গল্প লিখে ফেললাম। সুতরাং অবশ্যই উৎসর্গঃ সাব্বির হায়দার। ************************  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।