আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাহাড় চূড়ার পথে...৩

When it comes my time I'll leave this old world with a satisfied mind.' অনেকক্ষণ পর ঝিরিপথ থেকে বের হয়ে আসলাম। সামনে তাকিয়ে চক্ষু চড়কগাছ! এ যে রেমাক্রি খাল! শীত কালেও এত পানি!এটা পাড়ি দিয়ে আগাতে তো খবর আছে! কিন্তু আমাদের সাথে ছিল আমাদের ''সুপারম্যান'' ফয়সাল ভাই। উনি থাকতে আমাদের কিসের ভয়!কোন না কোন উপায় তো সুপারম্যান বের করবেই। দরকার পড়লে না হয় পিঠে করে উড়ায় নিয়ে যাবে! অনেক আশা নিয়ে সুপারম্যান এর দিকে তাকালাম। ফয়সাল ভাই বললেন, ''খাল ক্রস করতে হবে,আর কোন উপায় নাই!'' কিন্তু কিভাবে? সহজ উত্তরঃ ''হেঁটে!!!'' বুঝলাম বাংলাদেশের সুপারমানেও ভেজাল।

উড়তে পারে না! তো এটাও ছিল কপালে। কাপড় চোপড় সব সিপলামপি রেখে আসচি!এখানে সব ভিজে গেলে পরে পড়ব কি?খালের মাঝখানে কি পরিমান পানি হতে পারে?ডুবে গেলে? এসব আজাইরা কথা যতই যুক্তিসঙ্গত হোক না কেন,ঐ মুহূর্তে এ নিয়ে মাথা ঘামানো মানেই সময় নষ্ট। খাল ক্রসিং এ কাপড় ভিজবে দেখে দীপ আমার দিকে রক্তচক্ষু মেলে বলল আমি না থাকলে নাকি বাকি সব ছেলেরা সব কাপড় খুলেই খাল পাড় হত,আমি থাকায় এখন আর তা সম্ভব হল না! দীপের মন খারাপ দেখে আমার মন খারাপ হতে লাগল,কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর হল না। ফয়সাল ভাই এগিয়ে গেলেন। আর সাথে নূর ভাই আর বাঁধন।

আমি অবাক হয়ে দেখলাম ৬ ফুটিয়া বাঁধনের কোমরের অনেক উপরে পানি উঠে গেছে! তো ৪ ফুটিয়া নিবিড়ের অবস্থা ভেবে বেচারির জন্যে মায়া হতে লাগল। অবশেষে যখন ঐ পাড়ে পৌঁছলাম,আমার মাথা বাদে সব ভেজা! তারপরেও অনেক মজা হয়েছিল কারণ আমাদের মনোরঞ্জনের জন্যে ছিল আরেফিন আর দীপ । এরা ২ জন টি শার্ট বাদে গায়ের নিচের অংশের একান্তই লজ্জা নিবারণ মুলক এক টুকরা কাপড় রেখে প্যান্ট মোজা সব খুলে খাল পাড়ি দিল। ঐপাড়ে পৌঁছে যখন দীপ প্যান্ট পরছে,কিছু পাহাড়ি মেয়ে ওকে দেখে হেসে কুটি কুটি! এটা শুনেই যারা হাসা শুরু করেছেন তারা একটু ধৈর্হ্য ধরুন। যতই আমাদের হাসির খোরাক হোক না কেন,এত কষ্টে প্যান্ট, জুতো-মোজা বাঁচাল, এটাই তো বড় কথা।

পরে দেখা গেল পুরো খালের উপর দিয়েই আমরা এগিয়েছি। কমপক্ষে ১৩/১৪ বার (আরও বেশি হয়ার সম্ভাবনাই বেশি) খাল ক্রস করতে হয়েছে আমাদের। মাঝে মাঝে খালের একপাস দিয়ে কোমর পানিতেও টানা হেঁটেছি। বার বার তো ঐ দুজন কাপড় খুলতে আর পরতে পারেন নাই,অত সময় ছিল না,নইলে ঐ রেমাক্রি খালেই রাত হয়ে যেত । তো তাদেরও দিন শেষে আমাদের মতই পরনের কাপড় শুদ্ধ আপাদমস্তক ঠিকই ভিজল।

লাভের মধ্যে এইটুক লাভ হল যে তারা আমাদের আর ঐ কতিপয় পাহাড়ি মেয়েদের নির্মল আনন্দ দান করেছিল। রেমাক্রি খাল কিন্তু দারুন সুন্দর। শীতকালেও চরম স্রোত। কিছু কিছু জাগায় হাত ধরে শিকল করে পাড় হতে হয়েছিল। এত তাড়াতাড়ি পা চালাতে হচ্ছিল, তারপরেও মাঝে মাঝে থেমে অবাক হয়ে রেমাক্রির রূপ দেখছিলাম।

স্বচ্ছ পানি। একেবারে স্বচ্ছ! নিচের পাথর গুলো পর্যন্ত দেখা যায়!মনে হয় যেন কেউ এঁকে রেখেছে! আশপাশের সবুজে মোড়া পাহাড়,সাদা মেঘ আর নীল আকাশের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি রেমাক্রির পানিতে। টলটলে পানি। আর সেই পানি অসম্ভব ঠাণ্ডা!! এই সেই রেমাক্রি =) আবারও রেমাক্রি ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে,ভেজা কাপড়ে আগাতে থাকলাম। পকেটে যা ছিল সব ভিজে একাকার।

কিন্তু তখন আর এসব ভেবে লাভ কি! এমন সময় অবিরাম হেঁটে চলছি, হঠাৎ সামনে তাকিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম!! এ যে দারুন এক দৃশ্য! সামনে একটা ছোট জলপ্রপাত!কিন্তু বেশ স্রোত! অনেক ছোট কিন্তু ভারী সুন্দর!বিশাল পাথরের চাঙের মাঝ দিয়ে মুক্তোর মত সাদা ফেনায় মেশা পানির ঢল! উজ্জ্বল পানি,আর পাথরগুলো রোদের আলোয় ঝক ঝক করছে! অবাক হয়ে গেলাম এর রূপ দেখে!হুট করে সবাই বেশ খুশি হয়ে গেল যেন। এই প্রপাত টার নাম চমবকই ফলস। এটা চমবকই ফলস চমবকই ফলস,দীপের তোলা ছবি এটা। চমবকই ক্রস করছি আমরা। মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার অবস্থা হয়েছিল আমার!এত সুন্দর জায়গা অথচ আমাদের থামার অবকাশ নেই।

পাঁচ দশ মিনিট থামলেও তাতে কি আর মন ভরে? কিন্তু জানি যে নেফিউ এর আগের জঙ্গল বেশ ঘন। বিকাল হতে না হতেই সেখানে অন্ধকার হয়ে যায় প্রায়। তাই আলো থাকতে থাকতে ঐ জঙ্গল পাড়ি দেয়ার তাড়া ছিল। এভাবে রেমাক্রি পাড়ি দিলাম। রেমাক্রির বাম পাশ দিয়ে খাড়া উঠে যাওয়া একটা ট্রেইল দিয়ে নেফিউ এর বনে ঢুকলাম।

অনেক ঘন বন। আর ঘন গাছপালার মাঝ দিয়ে উঠে চলা। এই জঙ্গল কিন্তু মোটেই সমতল ছিল না। পাহাড় বেয়ে ওঠা জঙ্গল। ঝরনাও ছিল এর মাঝে।

জঙ্গলের একাংশ কত রকমের ,কত জাতের ,কত প্রকৃতির বিশাল বিশাল গাছ এই বনে তার ইয়াত্তা নেই। একেকটার গুড়ি এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে! কিছু গাছের বেধ এত বড় যে আট দশ জন মানুষ ও পাশাপাশি দাঁড়ালেও হার মানবে। আর উচ্চতায় একেকটা আকাশ ছুই ছুই! আর ছিল অনেকরকমের লতান গাছ!বিশাল বিশাল লতা,বনের এক মাথা থেকে শুরু হয়ে যতদূর চোখ যায় ততদূর গিয়ে মিশে গেছে। এই সবুজের মাঝে হঠাৎ হঠাৎ চারপাশ আলো করে ফুটে থাকা উজ্জ্বল রঙিন জংলা ফুল দেখে প্রায়ই থমকে দাঁড়াতাম। কেউ যদি জানতে চায় সবুজের কয়টা শেড আছে,পাতার কত রকম আছে,লতার কত প্রকার আছে, তাকে বলব এখানে এসে হিসেব করে যেতে!প্রকৃতির এত বৈচিত্র্য আমি আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না! হাঁটছি তো হাঁটছিই! আসলে রীতিমত দৌড়াচ্ছি! পথ আর ফুরায় না!রেমাক্রি এর প্রথম কিছুটা পথের পর থেকে এখন পর্যন্ত রাস্তায় কোন জনমানুষ পাই নি! অন্য রাস্তাগুলোতে তাও মাঝে মধ্যে কিছু পাহাড়ির দেখা মিলে।

বোঝাই যাচ্ছে আমরা বেশ গভীরে চলে এসেছি। অবশেষে জঙ্গল সরু এবং আরও খাড়া হওয়া শুরু করল। এগিয়ে চলছি,পাশে গভীর খাদ। বুঝতে পারছি যে পাড়ার কাছাকাছি এসে গেছি। GPS মিলালেও দেখছি পাড়া অনেক কাছেই।

এভাবে আগাচ্ছি,হঠাৎ শুনি দীপ বলে উঠলঃ "শিট!এটা কি" তাকিয়ে দেখি সামনে একশ ফিটের মত একেবারে খাড়া ঢাল!তাও আবার নূড়ী পাথরের !! আমরা এমনিতেই যথেষ্ট খাড়া ঢাল বেয়ে উঠছিলাম! আর এখন চিকন ,নূড়ী পাথরের একেবারে খাড়া ট্রেইল !আশেপাশে গাছ টাইপ কিছু নেই যে ধরে উঠা যাবে! আবারও ভাবলাম, 'শালা আসল সুপারম্যান থাকলে মন্দ হত না!' ঐ যে দীপের "শিট। " বলা টা! পুরো টিমের মনবল আরও নাড়ায় দিল। নিজে তো কোনমতে উঠে গেল,কিন্তু ঐ ঢালে আমি আর নূর ভাই লক খেলাম! সবার আগে ছিল বাঁধন,তারপর দীপ। ওরা দুজন কষ্ট করে উঠে পড়ল। এর পর আমার পালা,আমার পিছে ছিল আরেফিন,তারপর নূর ভাই আর সবার শেষে ফয়সাল ভাই।

রাস্তায় এত বেশি নুড়ি যে এক পা আগালে ছেঁচড়ে দু পা পিছিয়ে যাই। মোটামুটি অর্ধেক ঢাল উঠে গেছি,তখন হঠাৎ আমি স্লিপ খাওয়া শুরু করলাম! একে তো অনেক খাড়া,আর আশেপাশে ধরার কিছু নেই! ভুল টা আমি করেছিলাম পড়ে যাচ্ছি দেখে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ছিলাম! তাতে শরীরের ভার সামনের দিকে এসে ভারসাম্য হারায় ফেলছিলাম। আরেফিন ওর হাত দিয়ে আমার পায়ের পিছে ধরার চেষ্টা করছিল। কিন্তু তাতে লাভ হচ্ছিল না। আমি প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম! আর এমন জাগায় আমি আটকে ছিলাম,যে আমার পেছনের সবাই অনেক নড়বড়ে অবস্থায় কোনমতে দাঁড়ায় ছিল! তখন আরেফিন অনেক কষ্ট করে আমার পাশ দিয়ে ঐ চিকন রাস্তার মাঝেই আমায় ডিঙিয়ে সামনে চলে আসলো যেন আমায় সামনে থেকে টেনে তুলতে পারে।

ঠিক এই সময় নূর ভাই স্লিপ কাটল! আমরা দুজনই প্রায় পড়ে যাই এমন অবস্হা!আমি তখন ভাগ্যক্রমে একটু সামনে একটা ছোট্ট গাছের গুড়ি দেখে কোনমতে দৌড়ে ওইটা ধরে সামনে এগিয়ে একটু সাইডে দাঁড়িয়ে পরলাম। তখন নূর ভাই কোনরকমে হাচরে পাঁচরে উঠে গেলেন। আমরা তিন জন তখন মাঝপথে। আমি তো ঐ গাছ ধরে শক্ত হয়ে দাঁড়ায় গেসি!না সামনে আগাই,না পেছনে যাই! ভয় পাইসিলাম ভালই! ফয়সাল ভাই আর আরেফিন তখন বুঝাচ্ছে যেন আমি উঠা শুরু করি। কিন্তু আমার তো অবস্থা ডাইল।

বেশ ভালই ভয় পাইসিলাম। রাস্তা তেমন বাকি ছিল না,আর কঠিন অংশটুকুও পেরিয়ে এসেছিলাম,কিন্তু হটাৎ এত উপর থেকে স্লিপ করসি দেখে লক খেয়ে গেসিলাম। একটু পরে অবশ্য ঠিকই উপরে উঠে গেসি। আমার ঐ মুহূর্তের অবস্থা দেখে দীপ ফাজিলটার হাসির যেন মেলা পড়ে গেল! ঢাল টা পার করেই নেফিউ পাড়া দেখা যায়। মাথা পুরাই নষ্ট!! একেবারে পাহাড়ের উপরে,এত উঁচুতে এত সুন্দর একটা পাড়া!মনে হল এত কষ্ট করে এখানে আসাটা একেবারে সার্থক।

দূর দুরান্ত পর্যন্ত বিভিন্ন পাহাড়ের চূড়া দেখা যায়। নীল আকাশ আর বন্য সবুজের ছড়াছড়ি চারিদিকে! মাঝে মাঝে মেঘের আঁচলে মুখ লুকায় বিভিন্ন পাহার,আর একটু পর লজ্জা কাটলেই আড়াল থেকে বের হয়ে আসে! আর তো পারি না। সকাল থেকে দৌড়ের উপর আছি সবাই,তেমন কোন বিশ্রাম ছাড়াই অবিরাম পথ চলা!আর স্রোতের বিরুদ্ধে রেমাক্রি ক্রস,ঘন জংগলে উঠে যাওয়া! সবাই বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। অনেকটা বিদ্ধস্ত অবস্থায় নেফিউ পাড়ায় ঢুকলাম। যতই কষ্ট হোক না কেন,সারা দিনের ট্রেইল টা অনেক অনেক বৈচিত্র্যময় ছিল।

পাহাড়,ঝিরি ,খাল ,বন !কিছুই বাদ যায়নি! নেফিউ তে পৌঁছেছি, তখন সূর্য প্রায় ডুবি ডুবি। এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম সবাই,তাই ঠিক করলাম সাকা সামিট পরদিন অনেক ভোরে উঠে করব। আজকের মত নেফিউ তেই ক্ষান্ত দেই নেফিউ পাড়া যে একেবারে বান্দরবানের গভীরে, তা এ পাড়ায় পা ফেলতেই বোঝা যায়। একেবারে অন্যরকম। এই পাড়ার মানুষের ব্যাবহার, চাল চলন, সংস্কৃতি, সমাজ ব্যবস্থা সবকিছুর মাঝে একটা নিখাদ ভাব আছে।

মুরং পাড়া এটা। ছোট পাড়া, খুব বেশি হলে দশ থেকে পনের টা পরিবার থাকে। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ বাবস্থা। চাষ বাস থেকে শুরু করে প্রায় সব কাজ ই মেয়েরা করে। ছেলেরা অলস সময় পার করে, অথবা ঘুরে বেড়ায়।

এদের প্রায় সবাই বেশ শক্ত পোক্ত গড়নের হয়। তাদের চেহারা কিন্তু বেশ মায়া কাড়া। অনেক মজার মানুষ এরা। একজনের ছবি তুলতে গেল দীপ, আর ওমনি সে ঘরের দিকে দৌড়ে গেল! আমরা ভাবলাম কাপড় পরে আসার জন্যে ভেতরে গেছে কিন্তু পরে দেখি খালি গায়েই শুধু একটা টুপি পরে অমায়িক এক হাসি মুখে নিয়ে ফেরত আসল ছেলেটা! টুপি পরে ছবি তুলে কি আনন্দ তার! আর এই যে আমাদের ক্যামেরা ,এই যন্ত্রটার প্রতি অনেক আগ্রহ তাদের সবার। আমাদের বয়সী এক ছেলের সাথে দীপের অনেক খাতির হয়ে গিয়েছিল।

দীপ তাকে ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা শেখাচ্ছিল। নেফিউ পাড়া। নেফিউ তেও থেকেছিলাম কারবারির বাসাতেই। বেশ বন্ধুসুলভ ব্যবহার তাদের। আমাদের প্রথমেই পেঁপে খেতে দিল।

গপাগপ করে সবাই পেঁপে গিললাম! এত স্বাদের ছিল পেঁপে গুলো! তারপর পাড়া ঘুরে দেখলাম অনেকক্ষণ। আধুনিক সভ্যতার ধরা ছোঁয়ার একেবারে বাহিরে তবুও স্বাবলম্বি এক সভ্যতা। সূর্যাস্তের সময়টা ছিল সবচাইতে অন্যরকম! এত মায়াবি লাগছিল চারিদিক! উঁচু থেকে চারিদিকে তাকিয়ে দূর দুরান্ত পর্যন্ত বিস্তীর্ণ বন জঙ্গল কি যে অদ্ভুত দেখায় সূর্যাস্তের আলোয়!আকাশটা যেন জলরঙ করা। আর সেখানে আলো খেলায় মেতেছেন বিধাতা! অনেক উঁচুতে এই নেফিউ পারা। এখানে সেখানে বসে থেকে আর আড্ডা মেরে সময় পার করছিলাম।

যথারীতি রাতে মুরগির আয়োজন!রান্না করার সময় দেখি পাড়ার প্রায় সব ছেলে আর বাচ্চাদের দল কারবারির ঘরে এসে আমাদের দেখছে। নিজেদের চিড়িয়া চিড়িয়া লাগছিল! আমরা তাদের ঝাল টোস্ট আর মিষ্টি টোস্ট খেতে দিলাম। তারা অনেক মজা করে খেল। সেই সাথে তাদের সাথে অনেক গল্প করলাম। সাকা যাচ্ছি শুনে তারা জানতে চেয়েছিল তাদের কাউকে পথ চেনার জন্যে সঙ্গে নেব কিনা।

সবিনয়ে জানালাম যে আমরা একা যেতেই আগ্রহী। বাসাগুলো বেশ গোছান। ছিমছাম। একটা ঘরে স্তুপ করে চাল রাখা। আরেকঘরে এক কোনায় চুলা।

এখানকার চুলা হল লাকড়ির চুলা। আর উপরে লোহার জালি দেয়া থাকে। অনেক ভাল আর গোছানো ব্যাবস্থা। কিছু কিছু বাসায় আরও একটা ঘর থাকে থাকার জন্যে। দীপের তোলা, নেফিউ পাড়ার ঘরের ভেতর রান্না ও খাওয়ার পাট চুকিয়ে বসলাম পরদিনের প্ল্যানিং এ।

ঠিক হল পরদিন অনেক ভোরে,প্রায় পাঁচটার দিকেই সাকার পথে রউনা দিতে হবে। নইলে পরদিন সিপলামপি পৌঁছানো কষ্ট হয়ে যাবে। সেই রাতেও জম্পেশ আড্ডা হয়। আর আড্ডায় দীপের আর নূর ভাইয়ের হাসাহাসি তো আছেই। মজা হল যখন আমরা ঘুমানোর জন্যে স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে ঢুকছি তখন।

আমাদের দেখে তখনো ঘরে থাকা পাহাড়িরা হাসতে হাসতে গড়াগড়ি শুরু করল!কি জানি কেন আমাদের স্লিপিং ব্যাগে ঢোকা দেখে ওদের এত হাসি পেয়েছিল!একেক জন স্লিপিং ব্যাগ খুলে তাতে পা ঢুকানের সাথে সাথে তাদের হাসির রোল পড়ে যাচ্ছিল! নেফিউ তেও বেশ ভালই শীত পড়ে! ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে ঘুমিয়ে পরলাম। পরদিন ভোর পাঁচটার আগেই উঠে পড়তে হল! কি য কষ্ট এত ঠাণ্ডায় ভোরে উঠা! আর প্রতিদিনের খাটুনির জন্যে অত সকালে শরীর এক ইঞ্চি নাড়তেও ইচ্ছা করে না। ইচ্ছা মুড়ি খাক, আমাদের তো আজ সাকা সামিট করে সিপলামপি ফিরে যেতে হবে। আমার কি যে ইচ্ছা করছিল এই পাড়ায় বেশ কয়েকদিন থাকার!! এখনও আড্ডায় আমি প্রায় বলি যে একটা ট্রিপ দিব যেখানে বেশ কিছু পাড়ায় ২/৪ দিন করে থাকব। এর মধ্যে নেফিউ পাড়া আমার টপ লিস্টে।

যাইহোক,ভোর সাড়ে পাঁচটা/ ছটার দিকে সাকার পথে রওয়ানা দিলাম। নেফিউ ছাড়ার সাথে সাথেই বেশ ঘন বন উঠে গেছে। বনের মাঝ দিয়ে এগিয়ে উঠতে থাকলাম। প্রথমে বেশ শীত করছিল, কিন্তু অল্প কিছুক্ষণ টানা হাঁটার পরিশ্রমে ঠাণ্ডা কমে গেল। বরং রোদ না থাকায় আমরা বেশ দ্রুতই পা চালালাম।

এই প্রথম ভোরবেলা এমন একটা জঙ্গলে প্রবেশ করলাম। ভোরের আলোতে তো আমাদের ঢাকা শহরও কেমন রহস্যময় লাগে। আর এ তো সাকার জঙ্গল! মনে হচ্ছিল যেন রুপকথার গল্পের কোন দৃশ্যের মাঝ দিয়ে হেঁটে চলছি। এ জঙ্গলে লতা কিংবা ছোট কোন গাছ নেই। প্রায় সব গাছ আকাশ ছুই ছুই! সারি সারি লম্বা গাছ! যত গভীরে যাচ্ছি, ঘন হচ্ছে বন।

মাঝে মাঝে ঘোরের মত লাগছিল! যেদিকে তাকাই বিশাল বিশাল গাছের মেলা!চারিদিকে সবুজের উৎসব ! আগাতে থাকলে হঠাৎ এক ঝিরি ! বেশ সুন্দর! কল কল করে পানি পড়ছে!পাখির ডাক আর পানির শব্দ! আর ছিল আমাদের পায়ের শব্দ!কোনভাবেই বোঝাতে পারবনা যে কেমন অদ্ভুত ভাললাগায় হারিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা! ঝিরি ধরে আগাতে আগাতে হঠাৎ বেশ খাড়া রাস্তায় এসে পড়লাম..........। উঠতে গিয়ে মাঝপথে এসে দেখি আর রাস্তা নেই,বরং যেখানে রাস্তার মত থাকার কথা,সেইদিকে পাহাড় ধস ! এ দেখে তো আমাদের মাথা আর কাজ করে না! কিভাবে সামনে যাব,রাস্তা কোনটা কিছুই বুঝতেসিনা! পাহাড় ধসের উপর দিয়ে যাওয়া অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কথা। আমাদের রেখে ফয়সাল ভাই GPS নিয়ে এগিয়ে গেলেন। একটু পরে অন্যপাশ থেকে ফয়সাল ভাই চিৎকার দিয়ে জানালেন যে এটাই রাস্তা। এই ধসের উপর দিয়েই যেতে হবে।

পা রাখার শক্ত জাগাও পাচ্ছিলাম না। তার উপর আমার পা ছোট! অনেক দূরে দূরে পা ফেলতে পারি না অন্য সবার মত! কিভাবে ক্রস করব ভেবেই পেরা খাচ্ছিলাম! কিন্তু পেরা খেয়ে তো কোনই লাভ নেই। শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে সামনে পা বাড়ালাম। খুব দ্রুত কোথাও খুব বেশি ভর না দিয়ে হাল্কাভাবে পাড় হতে হয়েছিল জাগাটা। নতুবা ঐ নরম মাটিতে বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকলে মাটি শুদ্ধ মানুষ পড়ে যেতে পারে !! ছবিতে পাহাড় ধ্বসের অংশ পার হচ্ছি আমরা।

এরপরে আবারও বন। ...তার একটু পরে দেখি GPSএ যেদিকে দেখাচ্ছে,সেদিকে একটা পাথরের দেয়াল! আর অন্যদিকে বাঁশবন!এখানে এসে আবারও আমরা বিভ্রান্ত! ঐ দেয়াল বেয়ে হাচরে পাঁচরে দীপ ওঠা শুরু করে আর বার বার পড়ে যাচ্ছিল। এত মজা লাগছিল দেখতে যে আমরা রাস্তার কথা ভুলে ওর পড়ে যাওয়ার দৃশ্য উপভোগ করছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। হঠাৎ নূর ভাই ডান দিকে ঝিরি দিয়ে আপস্টৃমে উঠে যাওয়া একটা রাস্তা দেখালেন। পরে গিয়ে দেখি ঐটাই ট্রেইল আমাদের।

বেচারা দীপ শুধু শুধুই কতবার যে আছাড় খেয়েছিল!! এখানে না বললেই নয় যে এ জাগাটা বেশ অপার্থিব ছিল। একদিকে বাঁশবন,একপাশে ঝিরি,ঝিরি ঘেরা সবুজ জঙ্গল,আর পেছনে পাহাড় ধ্বস!! ভীষণ অপরূপ! সেই ঝিরি বেয়ে উঠে দেখি চিকন রাস্তা যার দুপাশে পা ফেলা যায় না এমন ঘন ছনের বন!! রাস্তা বেশ উঁচু , অনেকদূর খাড়া বেয়ে ওঠা আর মাঝে মাঝে কিছুদূর নেমে যাওয়া... উপরে বেয়ে ওঠার সময় অল্প কিছু রাস্তা দেখা যেত আর তার পরপরেই চোখে পড়ত দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ! কি যে অবাক করা এক দৃশ্য! তবে আরও বেশি অবাক করার মত অবস্থা হল যখন দেখলাম এই চিকন দুরারোহ রাস্তা যেখানে পাশাপাশি দু পা রাখাও দায়, সেখানে এক দেড় ফিটের মত জায়গা দখল করে পড়ে আছে ইয়া বিশাল বিশাল গোবরের দলা! পাহাড়ি গয়ালদের কাজ! যত্তসব! ফয়সাল ভাই তা দেখে বলতে লাগলেন "দেখ দেখ, গয়াল গুলা তো গু এর মুকুট বানায় রাখসে রাস্তা জুড়ে! " কি যে মেজাজ বিগড়াইসিল ঐ তথাকথিত ''মুকুট'' দেখে! আর দীপ যতবার মুকুটের সামনে পড়ত,ওকে দেখলে মনে হতো, ''এই পড়ল!এই পড়ল!!''আর নূর ভাই তো ছিলেনি,দীপ কে দেখে হাসতে হাসতে কাহিল। ! সেই হাসি একবার শুরু হলে থামাথামির নাম নেই। এই সময় সূর্য উঠে গেছে,রোদ্দুর ভালই,আর ছনের গাছগুলো তো অত লম্বা নয়,তাই ছায়া ছিল না খুব একটা। যেহেতু ক্রমাগত উঠে যাওয়া,একটু কষ্ট হচ্ছিল আমাদের।

রাস্তাটাও ছিল বেশ দীর্ঘ। অনেক অনেকক্ষণ পর এই রাস্তা শেষ হল। বেশ খুশি হয়ে সামনে আগালাম। ঘন বাঁশবনের মাঝ দিতে আগানো শুরু করলাম আমরা এবার। হালকা ছায়া থাকলেও ছিল কাঁটা আর বাঁশের মাঝ দিয়ে ইঞ্চি খানিক ম্যানেজ করে সেখান দিয়ে ঘুরিয়ে পেচিয়ে শরীরটাকে নিয়ে চলা! আর কয়েকটা জায়গা আমার জন্যে অনেক মজার ছিল! বেশ কিছুদূর এমন কিছু জায়গা থাকত যেখানে ঘন বাঁশ আর কিছু লতা পেচিয়ে সুড়ঙ্গের মত করা রাস্তার মাঝে।

ঐ সুড়ঙ্গ গুলো ছিল ৫/ সাড়ে ৫ ফিট উচ্চতার। আমি অতি আরামে সেসবের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলতে পারলেও বাকিদের বেশ কষ্ট হয়েছিল, বিশেষ করে বাঁধনের। পুরো রাস্তার মাঝে বাঁধনের জন্যে এই জায়গাটা ছিল সবচাইতে পেড়াদায়ক! বুঝলাম খাটো হওয়ারও অনেক সুবিধা আছে ! এই পথে মাঝে মাঝে রাস্তা দুই/তিন ভাগ হয়ে বিভিন্ন শাখায় বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। এর মাঝে কোনটা আমাদের ট্রেইল তা বুঝে বুঝে উঠে যেতে হচ্ছিল। এত ঘন বাঁশবনের ভেতর দিয়ে যাওয়া!এর আগে কখনও আমার অভিজ্ঞতায় ছিল না।

আগাতে গিয়ে বার বার আটকে যাচ্ছিলাম। পরে অবশ্য ''কিরসেতং'' অভিযানে এ এর চাইতেও বেশ ঘন বনের মাঝ দিয়ে আগাতে হয়েছে। সে এক ভিন্ন কাহিনী। উঠেই চলছি ,কিন্তু বুঝতে পারছিলামনা কত উপরে আমরা কারণ বাঁশবনের ঠিক মাঝে ছিলাম, চারিদিকে বাঁশঝাড়! আস্তে আস্তে বন হালকা হতে লাগল, তখন বুঝতে পারলাম যে বেশ উপরে উঠে এসেছি ! কি যে সুন্দর দৃশ্য ছিল! দূর দুরান্তের উঁচু পাহাড়ের চূড়া দেখা যাচ্ছিল!নিচে তাকালেই বিস্তীর্ণ জুড়ে সবুজের খেলা! সাকার চূড়ার খুব কাছাকাছি এসে পরেছি ! কেমন যেন এক অদ্ভুত শিহরণ আমাদের হাতে পায়ে! [চলবে] পাহাড় চূড়ার পথে...১ পাহাড় চূড়ার পথে...২ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।