আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাহাড় চূড়ার পথে...১

When it comes my time I'll leave this old world with a satisfied mind.' পাহাড় হল আমার কাছে সবচাইতে শান্তির গন্তব্য। পাহাড়ে যেই প্রশান্তি ,তা আমি আর কোথাও খুঁজে পাই না। তাই পাহাড়ে ঘুরে আসার কোন সুযোগ আমি সহজে হাতছাড়া করি না। হাজার ব্যাস্ততার মাঝে একদিন শুনি টি ও বি ( ট্রাভেলার্স অফ বাংলাদেশ ) এর ১টা টীম যাচ্ছে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পিক সাকা হাফং জয় করতে। দীপ এসে আমায় যখন বলল, আমি তো সাথে সাথেই ঠিক করে ফেললাম এবার তো যেতে হবে।

সব ঠিক ঠাক করে কাঁধে ব্যাকপ্যাক ঝুলিয়ে নির্দিষ্ট রাতে বান্দরবানের বাসে উঠলাম। বলে রাখা ভাল যে এটাই ছিল আমার 'টিওবি' এর সাথে প্রথম ট্রিপ। পাহাড়ে এর আগে বহুবার গেলেও 'টিওবি' এর সাথে যাওয়া নিয়ে একটু টেনশনেই ছিলাম। কাউকেই তো চিনিনা! কিন্তু প্রথম দিনের পরিচয়ে সকলের আন্তরিকতা আর একেবারে সহজ ভাবে মেশাটা খুব ভাল লাগল। আর কয়েকটা টীম মিটিং এর পরে সেই টেনশন কিংবা হেসিটেসনও দূর হয়ে গেল।

টীম লিড করেছিলেন ফয়সাল ভাই। উরাধুরা পাবলিক!তাৎক্ষনিক সিদ্ধান্ত নিতে তার জুরি নেই। আর আজব stamina লোকটার। এক সেকেন্ড ও স্থির হয়ে বসে থাকেন না তিনি। আর ছিলেন নূর ভাই।

একটু ভাবুক। প্রকৃতির কাছে এসে বেশ রোম্যান্টিক হয়ে যান। আরেফিন হল অনেক গোছানো, আবার একিসাথে খুব চঞ্চল। নিমেষে একজাগা থেকে আরেকজাগায় দৌড়ে চলে যায়! বাঁধন বয়সে সবচে ছোট। তাতে কি, ৬ ফুট হাইট নিয়ে অনেক স্বাছ্ছন্দে ট্র্যাক করে ছেলেটা।

দীপ তো দীপ ই। তালপাতার সেপাই। পাহাড়ের সাথে যেন নাড়ির টান ওর। ওর আরেক সঙ্গী ওর ক্যামেরা! পাহাড় আর ক্যামেরা...বেচে থাকার জন্যে ওর আর কিছুর দরকার নেই। এই ৫ জন,আর আমি...মোট ৬ জন।

আর ছিলেন হাসান ভাই। সময়ের সল্পতার কারণে উনি পুরো ট্রিপে ছিলেন না। বোর্ডিং পাড়া পর্যন্ত আমাদের সঙ্গ দিয়েছিলেন। হাসান ভাই সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় উনি অসম্ভব ফিট। খুবি ফ্রেন্ডলি আর মজার মানুষ।

আমাদের রুট প্ল্যান ছিল থানচি হয়ে ঢুকে বগা দিয়ে বের হয়া। প্রথমদিন থানচি থেকে কমলাবাগান,তারপরদিন শেরকর ক্রস করে তাজিনডং সামিট করে আবার শেরকর এ থাকা। এরপর সিপ্লাম্পি হয়ে তান্দুই তে থাকা। তার পরদিন রেমাক্রি ক্রস করে নেফিউ পাড়া হয়ে সাকা সামিট করে আবার নেফিউ তে থাকা। এরপর আবার তান্দুই তে ব্যাক করা।

তারপরদিন থাইক্যান এ পৌঁছানো এবং তারপরদিন বগা লেক পাড়া এ আসা। বগা থেকে পরদিন রুমা হয়ে বান্দরবান। অতঃপর বান্দরবান থেকে ঢাকা। প্ল্যান এরকম হলেও চলার পথে অনেক পরিবর্তন আসে। সবগুলো পরিবর্তন ই অবশ্য পজিটিভ পরিবর্তন ছিল।

বান্দরবান পৌঁছলাম ভোরে। সেখানে সকালের নাস্তা করে সার্ভিস বাসে রউনা দিলাম থানচির উদ্দেশ্যে। পুরো ট্রিপে এই বাস জার্নিটা ছিল সবচে টায়ারিং। প্রচণ্ড চাপাচাপি,অসম্ভব ধীর গতি, আর অসহ্য গরম! দীর্ঘ সময় পর একজাগায় বাস থামায় আমি খুশি হয়ে ভাবলাম যাক শেষপর্যন্ত পৌঁছলাম বোধ হয়। কিন্তু তখন মাত্র মাঝপথ।

চাঁন্দের গাড়ী দিয়ে গেলে হয়ত একটু সুবিধা হত। ভেবে খারাপ লাগে যে ওখানকার মানুষেরা কিভাবে এত ধকল প্রতিদিন সহ্য করেন!যাইহোক, যাত্রাবিরতি তে দোকান থেকে ১টা সিঙ্গারা মুখে পুরে আবারো সেই টিনের বাসে উঠতে হল। অবশেষে যখন আমরা থানচি পৌঁছলাম, সূর্য তখন মাথার উপর। সময় নষ্ট না করে থানচি বাজার ক্রস করেই কমলাবাগানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। অসম্ভব রোদে শুরুতেই আমার অবস্থা কাহিল হয়ে যাচ্ছিল।

হাসান ভাই তখন কিছুপথ আমার ব্যাগ নিয়েছিলেন। রাস্তাটা ছিল প্রথমে কিছুদূর উঠে জাওয়া,আর তারপর প্রায় সমান পথে সবুজের মাঝ দিয়ে এগিয়ে চলা। মানুষের আনাগোনা ও খারাপ না। যেহেতু অনেক ক্লান্তিদায়ক বাস জার্নির পর তেতে ওঠা সূর্যের নিচে টানা হাঁটা,তাই শুরুটা একটু কষ্টের ছিল। কিন্তু কিছুক্ষন পরেই সবাই মানিয়ে গেল।

অনেক দ্রুতই আমরা কমলাবাগানে পৌঁছে গেলাম। তখন ফয়সাল ভাই বললেন আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় আছে বোর্ডিং পাড়ায় চলে যাওয়ার। এক কথায় সবাই রাজি। বোর্ডিং পাড়ার রাস্তাটা অনেক মজার.। হাল্কা উঁচু নিচু, মাঝে ঝিরি পথ।

অনেক রকম ভিউ পাওয়া যায়। তাছাড়া ঝিরিপথে ট্র্যাকিং আমার সবসময়ই বেশ মজা লাগে। ঠাণ্ডা পরিবেশ,সবুজ চারপাশ, নিরব প্রকৃতি আর মাঝ দিয়ে পাথুরে ঝিরিপথ!ক্লান্তি দূর করে দেয়া একটা ট্রেইল!পানির উপর সবুজের ছায়া পড়ে! কি অদ্ভুত রাস্তা! ঝিরিপথ ধরে আগাতে থাকলে বামে ঝোপ দিয়ে একটা ট্রেইল চলে গেসে বোর্ডিং পাড়ার দিকে। অনেকদিন পর এইপথে আসায় আমরা সেই বামের ট্রেইলটা মিস করে আরও এগিয়ে গিয়েছিলাম। পরে GPS এ দেখি বোর্ডিং পাড়া পিছে ফেলে অনেকদূর ডানে চলে এসেছি আমরা।

হাসান ভাই আর ফয়সাল ভাই তখন এগিয়ে গিয়ে ২জন পাহাড়ির সাহায্যে রাস্তা বুঝে নিলেন। তারপর আমরা আগালাম। ঝিরিপথে আমরা! এটা সেই ঝিরিপথ! বোর্ডিং পাড়া পৌঁছলাম সন্ধ্যার ঠিক পর পর। বোর্ডিং পাড়ার মুখে যেই ঝিরি তা বেশ বড়। বড় বড় পাথরের চাই গলে অবিরাম পানি পড়ছে! শীতকাল তাই পানি কম! তাতেই এই রূপ!পাড়াতে ঢুকতেই দেখি কিছুদূর পরপর আগুণ জালিয়ে তাপ নিচ্ছে পাড়ার বড়মানুষ আর বাচ্চাদের দল।

অন্ধকার চারিদিক, মাঝে মাঝে আগুনের টিমটিমে আলো! স্বপ্নের মতো লাগছিল যেন! ওহ,বলতেত ভুলেই গেসি যে আমরা গেসিলাম এ বছর জানুয়ারির শেষের দিকে। শীতকাল ছিল। আর সন্ধ্যা হয়ে গেলেই পাহাড়ে জাঁকিয়ে শীত পড়ত। আর বোর্ডিং পাড়াটা হল ১টা ভ্যালির মত জাগায়.। ৩পাস দিয়ে পাহাড় উঠে গেসে।

মারাত্মক ঠাণ্ডা পড়ে সেখানে। তাই বোর্ডিং পাড়ায় পৌঁছে হাতমুখ ধুতেই আমাদের মনে হল জমে যাচ্ছি। বোর্ডিং এ থেকেছিলাম ওখানকার কারবারির বাসায়। তাদের অনেক অনুরোধ করে একটা মুরগি আর ১ কেজি চাল যোগাড় করলাম। এরপর রান্না! কেউ তো রান্না পারি না।

কোনমতে পানি ,লবন আর প্যাকেট গুড়ো মশলা ঢেলে মুরগি রাঁধলাম সবাই মিলে। কি যে ক্ষুধা পেয়েছিল!পারলে কাঁচা খেয়ে ফেলি। নূরভাই তো নাকি চুলায় মাংস চড়ানোর সাথে সাথেই সুগন্ধ পান। রাতে কি অসম্ভব ঠাণ্ডা পড়েছিল বলে বোঝানো যাবে না!স্লীপিং ব্যাগে কম্বল নিয়ে শুয়েও শান্তি পাইনি। কাঠের মেঝের ফাঁক গলে ঠাণ্ডা বাতাস ঢুকছিল!ঠক ঠক করে কেঁপেছি সারারাত! অবশেষে সকাল হল।

ভোরের আগেই উঠে আমি আর আরেফিন চুলা ধরাতে লেগে গেলাম। তানাহলে ঠাণ্ডায় মারা পড়তাম। এত ঠাণ্ডায় কোনরকমে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে রেডি হওয়া শুরু করলাম। ঠান্ডায় আর কেউ দাঁতব্রাশের কষ্ট নিতে চাইল না। মজা লাগল নূর ভাই কে দেখে।

উনি ব্রাশে পেস্ট নিয়েও ঠান্ডার ভয়ে শেষ পর্যন্ত ব্রাশ করেন নাই। পেস্ট থেকে গেছে টুথব্রাস পর্যন্তই। ভোরে বোর্ডিং পাড়া পুরো কুয়াশায় ঢাকা!আর অবিরাম ঝিরির শব্দ!অন্যরকম এক পরিবেশ! সকালে নাস্তা করেছিলাম noodles দিয়ে। আমাদের চামচ আর ব্যাগ থেকে বের করা হয়নি। বাশের কাঠি আর হাত দিয়ে সবাই কোনরকমে খাবারের ঝামেলা সারলাম।

আবার হাঁটা শুরু করলাম ৭টার সময়। হাসান ভাই তখন চলে গেলেন। যাওয়ার আগে উনি একটা কথা বলেছিলেন যা আমার সারাজিবন মনে থাকবে। উনি বলেছিলেন যে ''একে অপরকে দেখে রেখ। টীম ওয়ার্কের উপর কিছু নাই।

'' শুধু ঐ ট্রিপ না, জীবনের সকল ট্রিপেই এ কথা আমি মাথায় রাখি। সকাল ৭ টা হলে কি হবে, কুয়াশা আর এত ঠাণ্ডা যে পা চালানও কষ্ট। কিন্তু বোর্ডিং পাড়া থেকে প্রথম কয়েক ঘণ্টা কিছুটা খাড়া উঠে যাওয়া। তাই ঘাম ছুটতেও সময় লাগল না বেশিক্ষণ। ফয়সাল ভাই বার বার আমাদের বলছিলেন যেন সকাল সকাল রোদ ওঠার আগেই যত পারি পা চালিয়ে এগিয়ে যাই।

কারণ একবার রোদ উঠলে আগানোর গতি কমে তো যায়ই সেই সাথে কষ্টটাও দ্বিগুন হয়। ক্রমাগত উঠা, দুপাশে ঝোপ। একপাশে ঝোপের পরে জঙ্গল,আর আরেক পাশে খাদ। মাঝে মাঝে জুমের পাহাড় পরে। দেখলেই ভাবি এভাবে খাড়া জাগায় পাহাড়িরা কিভাবে চাষ বাস করে!!কখনও মাটির রাস্তা, কখনও নূড়ির পথ,কখন হালকা কাদা,এভাবেই এগিয়ে চলা বিভিন্ন পথ ধরে।

এই ছবিটা শেরকরে পৌঁছানোর একটু আগের। তো আমরা এভাবে এগিয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে হালকা বিরতি, আড্ডা, খাওয়া দাওয়া , ঠাট্টা মশকরা --সব মিলে মজায় কাটছিল পুরাটা সময়। শেরকর পাড়ার কাছাকাছি আগাতে থাকলাম আর রাস্তাটা অনেক সুন্দর হতে থাকল। যেন সবুজের সমারোহ!নুড়ির পথে দীর্ঘ সময় এগিয়ে চলা।

কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রোদ বাড়ল,আর বাড়ল আমাদের ক্লান্তি। রাস্তা মজার ছিল কিন্তু তেতে ওঠা রৌদ্র আর সহ্য হচ্ছিল না। ভাবছিলাম কখন একটু পানি পাব!এরকম একটা সময়ে হঠাৎ একটা ঝিরি পড়ল রাস্তায়। শেরকরের সামনের ঝিরি। মনে হল যেন বেহেশত এ এসে পরলেও এত খুশি হতাম না।

চাঁদি ফাটা রৌদ্রে হঠাৎ ঠাণ্ডা ঝিরি!মাথা তো খারাপ হয়ে যাওয়ার অবস্থা! ঝিরির পানি দেখে সবাই সব কিছু ভুলে গোসল দেয়া শুরু করলাম। মজার বেপার হল,এত সময় আর পরিচর্যা করে গোসল আমরা বাসাবাড়িতেও দেই কিনা সন্দেহ। আমি শ্যাম্পু আর লোশান বের করলাম,নূর ভাই দেখি কন্ডিশনার ও আনসেন!আরেফিন বের করল বডি স্প্রে! দীপ গোসল শেষে বলে আমরা নাকি নতুন হয়ে গেলাম!!একটা বাঁশ রাখা ছিল যেখান দিয়ে ঝিরির পানি কলের মত পড়ছিল!বাঁধন গোসল শেষে বার বার নিজের অজান্তেই অভ্যাস বশে কলের চাবি খুঁজছিল কল বন্ধ করার জন্যে! কাহিনী দেখে তো আমরা হাসতে হাসতে শেষ! গোসলের পর পেট পুরে খাওয়া দাওয়া করলাম। চিড়া আর গুর। আর ছিল পাউরুটি আর মধু!এত তৃপ্তি নিয়ে আগে কখনও খেয়েছি বলে মনে হয় না! শেরকর পাড়ায় পৌঁছে ভাল লাগলো।

এতো সুন্দর আর ছীমছাম একটা পাড়া। কিন্তু যেহেতু আমাদের হাঁটার গতি ভাল ছিল, আমরা ঠিক করলাম পারলে আজ তান্দুই পর্যন্ত টানা মারব। এটা শেরকর পাড়া তাই শেরকরে আর না থেমে আগাতে থাকলাম। পথে তাজিনডং সামিট করলাম। তাজিনডং এ ঊঠাটা কিছুটা কঠিন জানলেও তেমন কঠিন কিছুই ছিল না।

তবে সামিট করার আনন্দ তো ছিলই। তাজিনডং এর চূড়া থেকে তোলা তাজিনডং এর চূড়ায় আমরা এরপরের পথটা অনেক সুন্দর। একদিকে পাহাড়,একদিকে খাদ আর মাঝে চিকন ট্রেইল এ আমরা। অসম্ভব সুন্দর ছিল চারপাশ। মাঝখানে খাদগুলোতে তাকালে কেমন জানি শুন্যতা ঘিরে ধরত।

মাঝে মাঝে বসে যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, পাশে খাদে তাকালে অনেক নিচে সবুজের সমারোহ দেখা যাচ্ছে,উপরে নীল আকাশ,একপাশে খাড়াপাহাড় বেয়ে ওঠা জঙ্গল!আর সামনে সরু পথ! মনে হচ্ছিলো এখানেই, এ জাগাটাতেই, সারাজীবন থেকে যাই। [চলবে] পাহাড় চূড়ার পথে...২ পাহাড় চূড়ার পথে...৩ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।