আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাহাড় চূড়ার পথে...২

When it comes my time I'll leave this old world with a satisfied mind.' মাঝে মাঝে বসে যখন বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, পাশে খাদে তাকালে অনেক নিচে সবুজের সমারোহ দেখা যাচ্ছে,উপরে নীল আকাশ,একপাশে খাড়াপাহাড় বেয়ে ওঠা জঙ্গল!আর সামনে সরু পথ! মনে হচ্ছিলো এখানেই, এ জাগাটাতেই, সারাজীবন থেকে যাই। একটা ব্যাপার আমি খেয়াল করেছি যে, এরকম কিছু কিছু অদ্ভুত সুন্দর জাগায় আমরা সকলে চুপ করে বসে থাকতাম। কেউ কোন কথা বলতাম না! সকলকেই এক অন্যরকম ভাললাগা ঘিরে ধরত। এমনিতে পুরো সময় কাটত আমাদের ঠাট্টা মশকরা,আজাইরা ফাজলামো আর গাল গল্পের ভেতর দিয়ে। আমি পড়ে গেলেই দীপ হেসে খুন,কিন্তু আমার খারাপ লাগত না কারণ তার একটু পরেই ও নিজেই পড়ত।

দীপের কাণ্ড কারখানা এমন অদ্ভুত ছিল যে ওর আর কিছু করা লাগত না,নুর ভাই ওকে দেখলেই অটো হাসা শুরু করে দিত। আরেফিনের সাথে সারা রাস্তা মজার মজার গল্প চলতে থাকত। ফয়সাল ভাই এমনিতে প্রায় এগিয়েই থাকত,তাও কখনও পিছে পড়ে গেলে বলতে থাকত ঃ "আমার বয়স হয়ে গেছে,বুড়ো হাড়ে আর সয় না!" আবারও হেঁটে চলা, আবারও সামনে এগিয়ে চলা! সকাল থেকে টানা হাঁটার উপর আছি। হালকা ক্লান্তি ধরে আসছিল সারা শরীরে। তখন পথ খুব দীর্ঘ মনে হচ্ছিল।

তবে পথে জুম ঘর পেলে বিশ্রাম নিয়ে নিতাম মাঝে মাঝে। পথে এক জুম ঘরে যখন একটু থামলাম। এরই মাঝে ফয়সাল ভাই বললেন যে সামনেই সিপলামপি পাড়া। সেখানে বিশ্রাম নিতে পারব। আমি একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম।

সামনে পাড়া পাব শুনে খুশি হয়ে গেলাম। সিপলামপি পাড়ায় পৌঁছলাম যখন, তখন ঠিক সন্ধ্যা। একটু পরেই সূর্যাস্ত। অদ্ভুত এক কমলা আলোয় জ্ব্লছিল পুরো পাড়া। হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ।

যেহেতু আমি একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম তাই পাড়ায় ঢুকলামও সবার শেষে। বাকি সবাই ততক্ষণে একটা বাসার উঠানে বসে গল্প করছে। এই পাড়াটা এতো বেশি সুন্দর!দেখেই থেকে যেতে ইচ্ছা করে। কমলা আলোতে আলকিত একটা লোকালয়। চারপাশে ছোট ছোট ছেলে মেয়ে ছুটোছুটি করছে।

আর আমাদের দেখলেই দৌড়ে পালাচ্ছে। মন খারাপ হয়ে গেল যখন ভাবলাম এখানে থাকা হবে না! সিপলামপি পাড়া। যে ঘরের উঠানে সবাই বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল,সেখানে গিয়ে ধপ করে বসে পরলাম। হাত পা ছড়িয়ে বসে আছি তখন দীপ বলল যে এখানেই নাকি আজ থাকা হবে। যেহেতু আজ অনেক হাঁটা হয়েছে আর সবাই মোটামুটি ক্লান্ত,তাই এই সিদ্ধান্ত! কি যে খুশি লাগল কথাটা শুনে!শরীরের ক্লান্তি কোথায় যেন হারিয়ে গেল।

ব্যাগ রেখে উঠে দৌড় দিলাম পাড়া ঘুরে দেখার জন্যে। বেশ গোছানো পাড়া। একটা ইস্কুল ঘর ও আছে। সিপলামপি পাড়া (দীপের তোলা ছবি ) সূর্যাস্তের সময় ঘনিয়ে আসল। কমলা থেকে আলোটা সোনালি হয়ে গেল।

কি যে এক মায়া ঘিরে ধরল আমাদেরকে!অনেকক্ষণ হেঁটে বেরালাম,একেকজন একেক দিকে,কখনও একসাথে কখনও আলাদা। সিপলামপি থেকে সূর্যাস্ত। সূর্যাস্তের অন্যরকম আলোয় সিপলামপি থেকে তোলা দুরের পাহাড়! সূর্যাস্তের একটু পর। সৌন্দর্য দেখে যতই ক্লান্তি চলে যাক না কেন,ক্ষুধা তো আর মিটে না। তাই সূর্য ডোবার বেশ কিছুক্ষন পর খাবার বন্দবস্ত করা শুরু করলাম।

এবারও মুরগি যোগাড়। এত ক্ষুধা লেগেছিল যে ঠিক করা হল ২ টা মুরগি রান্না হবে। মুরগি যোগাড় হল ঠিকই, আর তা জবাই দিল নূর ভাই আর আরেফিন। মুরগি কাটার দায়িত্ব নিয়েছিলেন নূর ভাই আর বাঁধন। রান্নার আয়োজন।

এবার রান্নার সময় নতুনভাবে রান্না করার বুদ্ধি দিল আরেফিন। ওর কথা অনুসারে মুরগিতে ডাল দেয়া হল। গুড়ো মশলা তো ছিলই,সেই সাথে পেয়াজ আর পাহাড়ি মরিচ। মরিচ পেয়াজ কাটতে যাব তখন দেখলাম সেই বাসার কর্তা ১টা বাঁশের খোল দিল যেখানে পেয়াজ মরিচ ও অন্যান্য মশলা দিয়ে তা ১টা লাঠির মত জিনিস দিয়ে চূর্ণ করে। (বেসিরভাগ পাহাড়ি দের বাসাতেই মশলা চূর্ণ করার এই জিনিসটা থাকে।

) রান্না চাপিয়ে দিয়ে তো দিলাম,কিন্তু রান্না না হওয়া পর্যন্ত ক্ষুধা সামলাই কি করে!অবশেষে আমি আর দীপ মিলে চা বানালাম। চা খেতে খেতে বাসার মানুষের সাথে তাদের দৈনন্দিন জীবন, আয় ইনকাম ,চাষাবাদ ইত্যাদি ব্যাপার নিয়ে আড্ডা দিলাম আমরা। ভাষা ভিন্ন হওয়ার পরেও ভাবের আদান প্রদান থেমে থাকেনি আমাদের। অবশেষে রান্না হল। সারাদিনের খাটুনির পর যাই খাব ভাল লাগার কথা।

কিন্তু সেদিনের রান্না আসলেই অসাধারণ হয়েছিল। ফাটায় খেলাম সবাই। খাবার শেষে সেই রাতে বেশ মজার আড্ডা জমেছিল। কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম! টের পাইনি। ভোরবেলা চোখ খুলে দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘরে বেড়ার ফাঁক গলে আলো ঢুকে পরছে!এত সুন্দর লাগল! চটপট ক্যামেরা নিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে ফেললাম।

তারপর ক্যামেরা হাতে বের হয়ে গেলাম। ভোরে ঘরে আলো এসে বেড়ার ফাঁক গলে ঢুকে পড়ছিল ঘরের ভেতর। ভোরে কুয়াশায় পাহাড়ি লোকালয়ে অন্যরকম ভাললাগায় ঘিরে ধরে। সিপলামপি পাড়া টা একটু উঁচু তে। তাই এখান থেকে ভিউ অনেক মজার।

একটু পরেই পাড়ার সামনের ঝিরি তে গিয়ে আমরা সবাই হাতমুখ ধুয়ে সেইদিনের যাত্রার জন্যে তৈরি হচ্ছিলাম। একটা জিনিস হয়তো খেয়াল করেছেন যে, সকল পাড়ার কাছাকাছি সবসময় ১ টা ঝিরি থাকে। পাহাড়ে যে পানির সমস্যা,তাই পানির উৎস ঘিরে লোকালয় গড়ে উঠে। পানি শুকিয়ে আসলে অথবা উৎস নষ্ট হয়ে উঠলে লোকালয় উঠে যায়। মানব সভ্যতা গড়ে ওঠার কতগুলো মৌলিক কারণ এখনও এসব জাগায় অনেক ভূমিকা রাখে।

একটা উৎস কে ঘিরে সভ্যতা তৈরি হয়,সেখানে আশেপাশের পাহাড়ে জুম করে এরা অনেক স্বাবলম্বী , আত্মনির্ভর একটা সমাজ গড়ে তোলে। নিজেদের প্রয়োজনীয় প্রায় সবকিছুর চাহিদা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরা নিজেরাই পূরণ করে। আমাদের সেইদিনের রূট টা একটু বড় ছিল। সিপলামপি থেকে নেমে,তান্দুই পার করে,একটা বিশাল ঝিরিপথ পাড়ি দিতে হবে। অতঃপর রেমাক্রি খাল ক্রস করে মোটামুটি উঠে যেতে হবে নেফিউ এর জঙ্গল ধরে।

তারপরে নেফিউ পাড়া হয়ে সাকা সামিট। এবং পুনরায় নেফিউ পাড়া। বেশ দীর্ঘ পথ! পথ যেহেতু একটু দীর্ঘ আর আমাদের সময় হাতে কম,আর আমরা যেহেতু ফেরার পথে সিপলামপি হয়েই ফিরব,তাই ঠিক করা হল যে আমরা আমাদের বেসিরভাগ জিনিস এখানে রেখে দিয়ে তারপর আগাব। এই বুদ্ধিটা অনেক ভাল ছিল। কাঁধের ভারী ব্যাগ মাঝে মাঝে অর্ধেক শক্তি শুষে ফেলে।

একেবারে প্রয়োজনীয় জিনিস ,যেমন স্লিপিং বাআগ,পানির বোতল, শুকনো খাবার,অসুধ ইত্যাদি ১ টা ব্যাগ এ ভরা হল। ঐ ব্যাগ পালা করে একেকজন নিবে। আরেফিন,দীপ আর আমি তারপরেও আলাদা ব্যাগ নিসি যেহেতু আমাদের ক্যামেরা নেয়ার জন্যে ব্যাগ নেয়া লাগবেই। কিন্তু অনেক হালকা করে নিয়েছিলাম ব্যাগ গুলো। ভারী বড় ব্যাগ টা ফয়সাল ভাই ই নিলেন।

এরপর শুরু হল বিরতিহীন যাত্রা। সিপলামপি এর একপাশ দিয়ে খাড়া ঢাল নিচে নেমে গেছে। ঐদিক থেকে নামার পথ আমাদের। নামতে যদিও মজাই লাগছিল (ওঠার চেয়ে নামা সবসময় বেশি মজার) , তারপরেও ভাবতে ভয় লাগছিল যে ফিরে আসার সময় এই পথে উঠতে খবর হয়ে যাবে!ঢাল বেয়ে অনেকক্ষণ খালি নেমে যাওয়া, হাঁটু ব্যথা হয়ে যায়! তবে আশেপাশের দৃশ্য কিন্তু চমৎকার ছিল। সিপলামপি থেকে একটু পরেই এই ছবি।

নিচে নামা শুরু করেছি মাত্র। (ছবি তুলেছে দীপ ) শেষপর্যন্ত যখন নামা শেষ, পেছনে তাকায় অবাক হয়ে দেখলাম যে কম খাড়া ছিল না রাস্তা টা! এরপরে শুরু হল অনেক মজার ট্রেইল। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে প্রায় সমান অথবা হালকা উঁচু নিচু রাস্তা। একেবেঁকে এগিয়ে চলা। গান করতে করতে আর আড্ডা দিতে দিতে আমরা ক্রমাগত এগিয়ে চললাম।

পথে একটা জুম ঘর পরল। জায়গাটা কি যে মজার, ক্যাম্পিং এর জন্যে আদর্শ!হাতে সময় নেই দেখে আফসোস করতে করতে এগিয়ে চললাম। জঙ্গলের ভেতরের রাস্তা অনেক অন্যরকম ছিল। ঘন পাতার ফাঁক গলে এবড়ো থেবড়ো সূর্য রস্মি,সবুজের নানা রূপ, সু উচ্চ গাছগাছালি!হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে এখানে এসে। এই সেই জঙ্গল! এরপরে আসল তান্দুই পাড়া।

হাতে সময় নেই তাই থামাথামি নেই কোন। সোজা এগিয়ে পাড়ার একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যপাশ দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছি,দেখি ২ টো বিশালাকৃতির গয়াল একে অপরের দিকে প্রচণ্ড বেগে তেড়ে আসছে!তারপর শুরু হল লড়াই!অতিকায় দুটো প্রাণী যেন আক্রোশে ফেটে পরছে! সত্যি বলতে লজ্জা নেই, কলিজা কেঁপে উঠেছিল আমার! একেকটা গয়াল যে কি বিশাল! যেমন লম্বা, তেমন স্বাস্হ!পেশীগুলো দেখলে শিউরে উঠতে হয়! গয়াল! গয়ালের লড়াই! ফয়সাল ভাই সামনে গিয়ে ভিডিও করেছিলেন পুরো লড়াই টা!আমি দূর থেকে ছবি তুলেছি মাত্র। লড়াই এর মাঝখানে হঠাৎ আরেকটা গয়াল মাঝখান থেকে তেড়ে আসলো! ঐ মাঝের গয়াল টা বোধকরি মধ্যস্ততা করিয়ে দিল, লড়াই থেমে গেল। গয়ালগুলো সেখানে দাড়িয়ে থাকল আর এর মাঝ দিয়েই দেখি ফয়সাল ভাই এর নেতৃত্বে বীর বিক্রম বেশে সবাই চলে গেল!আমি দুরু দুরু বুকে কোনমতে জায়গাটা পার হলাম। তাকাতেও ভয় লাগছিল গয়ালগুলোর দিকে! তান্দুই এর পরে আসে রেমাক্রি ঝিরিপথ।

উফ!কি ভীষণ সুন্দর যে এই ঝিরিপথ। অনেক টা দীর্ঘ!কিন্তু অদ্ভুত সুন্দর। কালচে সবুজ শ্যাওলা,হাজার বছর পুরনো গাছ গাছালি,ঘন সবুজের মাঝে দিয়ে কোনমতে প্রবেশ করা একমুঠো আলো! আর নিটোল পানি!সমস্ত সবুজের ছায়া পরেছে ঐ পানিতে!একেকপাশে নুয়ে পড়া কিংবা ভেঙে পড়া বিশাল বিশাল গাছ কিংবা গাছের ফসিল!আর হাজার রকমের হাজার আকৃতির পাথরের উপর দিয়ে আমাদের লাফিয়ে চলা। সেই অদ্ভুত সুন্দর ঝিরিপথের মুখ । শ্যাওলা মাখা পাথরের উপর দিয়ে চলার সময় কতো যে আছাড় খেয়েছি ইয়াত্তা নেই।

তাতে কি! এমন সুন্দরের সাথে পরিচয়ের জন্যে আরও শ'য়েক আছাড় খেতে রাজী । সেই ঝিরি পথ (দীপের তোলা ছবি এটা) অনেকক্ষণ পর ঝিরিপথ থেকে বের হয়ে আসলাম। সামনে তাকিয়ে চক্ষু চড়কগাছ! এ যে রেমাক্রি খাল! শীত কালেও এত পানি!এটা পাড়ি দিয়ে আগাতে তো খবর আছে! [চলবে] পাহাড় চূড়ার পথে...১ পাহাড় চূড়ার পথে...৩ ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।