আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জন্মদিনে ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত ফেব্রুয়ারির ফেরারী পাখি কবি আল মাহমুদ : মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে চাই : বাংলাদেশ আমার কবিতায়

দেশের প্রধান কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও ছোটগল্পকার আল মাহমুদের ৭৬তম জন্মদিন ছিল গতকাল। বরাবরের মতো এবারও কোনো আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন ছিল না দেশবরেণ্য এই কবির জন্মদিনে। তবে দেশের খ্যাতিমান কবি, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, ছড়াকার এবং কবির শুভাকাঙ্ক্ষী, সতীর্থ, শিষ্য ও বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে তার মগবাজারের বাসায় গিয়ে ফুলেল শুভেচ্ছা আর অকৃত্রিম ভালোবাসায় সিক্ত করেন তাকে। দিনটি হয়ে ওঠে বাংলা কবিতানুরাগীদের জন্য উত্সবের দিন। কেক কাটা, তাকে শ্রদ্ধা-শুভেচ্ছা জানানো, আলোচনা, তাকে নিয়ে স্মৃতিচারণে উত্সবমুখর পরিবেশ চলে দিনভর।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি আল মাহমুদকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। দলের সহ-দফতর সম্পাদক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান এদিন কবিকে ফুলের তোড়া উপহার দিয়ে খালেদা জিয়ার শুভেচ্ছা পৌঁছে দেন। খালেদা জিয়া ফোন করেও কবি আল মাহমুদকে জন্মদিনের অভিনন্দন জানান এবং তার দীর্ঘায়ু কামনা করেন। দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কবির বাসায় গিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান এবং কবির দীর্ঘায়ু কামনা করেন। এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট কবি আবদুল হাই শিকদার, আবৃত্তি শিল্পী নাসিম আহমেদ ও শায়লা আহমদ।

প্রতিদিনের মতো গতকাল ৭৬তম জন্মদিনেও খুব ভোরে ঘুম ভাঙে কবি আল মাহমুদের। ঘুম থেকে জেগে দেখেন শিয়রের পাশে বেশ কয়েকটা কাঁচা ফুলের তোড়া, ফুলগুলো গন্ধ ছড়াচ্ছে ঘরময়। তার শোবার ঘরে ভোর থেকেই ভিড় জমাতে থাকেন ভক্ত-অনুরাগীরা। সমকালীন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অন্যতম প্রধান এ কবির জন্য ফুল, অকৃত্রিম শুভেচ্ছা, সবই আছে। কেবল নেই কবির প্রিয়তমা স্ত্রী।

গত দু’বছর থেকে স্ত্রীকে ছাড়া এভাবেই কাটে জন্মদিনটি। তবে ভক্ত, শুভাকাঙ্ক্ষী, অনুরাগী ও পাঠকের শ্রদ্ধা-ভালোবাসা-শুভেচ্ছায় স্ত্রীর শোক অনেকটাই কাটে বলে জানান আল মাহমুদ। এবারের জন্মদিন উদযাপন উপলক্ষে কবিদের সংগঠন ‘কবিতা’ ও কবি পরিবার যৌথভাবে গতকাল প্রীতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ঢাকার বড় মগবাজারে আয়েশা গোমতি ভিলায় কবির ফ্ল্যাটে সকালে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন কবি আসাদ চৌধুরী।

অনুষ্ঠান সহযোগিতায় ছিল লিটল ম্যাগাজিন ‘ডাকটিকিট’। জন্মদিনের অনুভূতি জানিয়ে আল মাহমুদ বলেন, ‘সবার ভালোবাসায় আমি কৃতার্থ। আমার জন্মদিনে আসায় ব্যক্তিগতভাবে সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি দীর্ঘজীবন পেয়েছি। আমার পুরো জীবনই সার্থক।

এ জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কবিতা লিখে যেতে চাই, মানুষকে স্বপ্ন দেখাতে চাই। আমি কেমন বাংলাদেশ দেখতে চাই তা আমার কবিতায় প্রকাশ করেছি’। ধন্যবাদ দেয়া শেষ করে বৈশ্বিক অস্থিরতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মানব সভ্যতা আজ কোথায় যাচ্ছে? চারপাশে কেবল হানাহানি, সংঘাত। আজ থেকে ৫০ বছর আগে কবিতায় পরিবেশ বিপর্যয়ের কথা লিখেছিলাম। বর্তমানে উন্নত বিশ্বের সৃষ্ট জলবায়ু দূষণের কারণে পুরো পৃথিবী ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

বিশ্বটা যেন অস্থিরতায় ভুগছে’। প্রীতি অনুষ্ঠান শুরুর আগে সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আসাদ চৌধুরী কবি সম্পর্কে মূল্যায়ন করে বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন ও বাংলা সাহিত্যে আল মাহমুদের অবদান অসামান্য। তিনি আমাদের প্রতিটি সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। নিজের জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আল মাহমুদ আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথ পাড়ি দেয়া কতটা কঠিন’। আসাদ চৌধুরী আরও বলেন, ‘আল মাহমুদের জন্মদিন বাংলা কবিতারানুরাগীদের জন্য উত্সবের দিন।

তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার মৌলিক প্রতিভাবান কবি। এককথায়, তিনি দেশপ্রেমিক কবি’। গতকাল ভোর থেকে কবির ভক্ত-শুভানুধ্যায়ীদের সরব পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে ৮৮, মগবাজারের বাড়িটি। জন্মদিনের মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল এগারোটা থেকে। এর আগে সকালে কবি তার পরিবারের সদস্য ও ভক্তদের নিয়ে জন্মদিনের কেক কাটেন।

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আসতে থাকেন অতিথিরা। দৈনিক আমার দেশ’র পক্ষ থেকে তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান কবি আবদুল হাই শিকদার, কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ, ফিচার ও সাহিত্য সম্পাদক কবি হাসান হাফিজ। তারা ফুলেল শুভেচ্ছার সঙ্গে কবির দীর্ঘ জীবন কামনা করেন। অন্যান্যের মধ্যে কবিকে শুভেচ্ছা জানাতে আসেন আলোকচিত্র শিল্পী নাসির আলী মামুন, কবি জুবায়দা গুলশান আরা, কবি নাসির আহমেদ, কবি জাকির আবু জাফর, ছড়াকার আনজীর লিটন, জাফর আহমদ রাশেদ, সাংবাদিক আখতার হোসেন প্রমুখ। সংগঠনের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানান সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র, উত্সঙ্গ সৃজন চিন্তন, বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্র, শেকড় সাংস্কৃতিক সংগঠন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ জিয়া হল, ফুলকুঁড়ি, সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠী, ম্যাজিক লুণ্ঠন, নিমন্ত্রণ সাংস্কৃতিক সংসদ, অনুপম সাংস্কৃতিক সংসদ, সন্দীপন শিল্পী গোষ্ঠী, সাপ্তাহিক সোনার বাংলা, বৈচিত্র্য, ফুলকুঁড়ি আসর ইত্যাদি সংগঠনের প্রতিনিধিরা।

জন্মদিনের কেক কাটার আনুষ্ঠানিকতা শেষে কবিকে নিয়ে জমে ওঠে আড্ডা। সহযাত্রী কবি, শুভানুধ্যায়ী, স্বজন ও ভক্তরা আল মাহমুদকে ঘিরে মেতে ওঠেন আনন্দময় আড্ডায়। এসময় কবির কালজয়ী কবিতার বই ‘সোনালী কাবিন’সহ বিভিন্ন কবিতার বই থেকে আবৃত্তি করা হয়। সঙ্গে ছিল কবির জীবনের নানা পর্বের স্মৃতিচারণ। কবি ও কথাসাহিত্যিক আল মাহমুদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের এক ব্যবসায়ী পরিবারে।

২১ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি এ শহরে এবং কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি থানার অন্তর্গত জগত্পুর গাঁয়ের সাধনা হাইস্কুলে এবং পরে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড হাইস্কুলে লেখাপড়া করেন। এ সময়ই তার সাহিত্য সাধনার শুরু। ঢাকা ও কোলকাতার সাহিত্য সাময়িকীগুলোতে ১৯৫৪ সাল থেকে তার কবিতা প্রকাশ পেতে থাকে। কোলকাতার নতুন সাহিত্য— চতুষ্কোণ, চতুরঙ্গ, ময়ূখ ও কৃত্তিবাসে লেখালেখির সুবাদে ঢাকা ও কোলকাতার পাঠকদের কাছে তার নাম পরিচিত হয়ে ওঠে। এ সময় বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত ‘কবিতা’ পত্রিকায় তার কয়েকটি কবিতা ছাপা হলে সমসাময়িক কবি মহলে তাকে নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত হয়।

ঢাকা থেকে প্রকাশিত সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকাল’ পত্রিকায় তখন তিনি নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার তিরিশ দশকীয় প্রবণতার মধ্যেই ভাটিবাংলার জীবন, গ্রামীণ দৃশ্যপট, নদীনির্ভর জনপদ, চরাঞ্চলের কর্মমুখর জীবন-চাঞ্চল্য ও নর-নারীর চিরন্তন প্রেম-বিরহের বিষয়কে অবলম্বন করেন। আধুনিক বাংলাভাষার প্রচলিত কাঠামোর মধ্যেই অত্যন্ত স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ততায় আঞ্চলিক শব্দের সুন্দর প্রয়োগে কাব্য রসিকদের মধ্যে আল মাহমুদ নতুন আনন্দ ও অনুভূতির সৃষ্টি করেন। সমালোচকরা তাকে জসীমউদ্দীন ও জীবনানন্দ দাশ থেকে সম্পূর্ণ এক ভিন্নধারার কবি প্রতিভা বলে উল্লেখ করে থাকেন। এ সময় ‘লোকান্তর’ ও ‘কালের কলস’ প্রকাশিত হয়।

আল মাহমুদ মাত্র দুটি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমী পুরস্কারে ভূষিত হন। ’৫২ সালে বাড়ি থেকে পালিয়ে সক্রিয়ভাবে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যুক্ত হন তিনি। সেই পালানোর পর থেকে প্রকৃত অর্থে তিনি আর বাড়িতে ফিরতে পারেননি। এজন্য তাকে বলা হয় ‘ফেব্রুয়ারির ফেরারি পাখি’। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মুক্তিযুদ্ধে আল মাহমুদ সরাসরি অংশগ্রহণ করেন এবং বিজয়ের বেশে দেশে ফিরে ‘গণকণ্ঠ’ নামের একটি দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন।

এ সময় তিনি দেশে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের বৈপ্লবিক আন্দোলনকে সমর্থন করার অপরাধে গ্রেফতার হন। তার আটকাবস্থায় পত্রিকাটি তত্কালনী সরকার বন্ধ করে দেয়। ১৯৭৫ সালে আল মাহমুদ জেল থেকে ছাড়া পেয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর গবেষণা ও প্রকাশন বিভাগের সহ-পরিচালক পদে যোগ দেন। পরে ওই বিভাগের পরিচালকরূপে ১৯৯৩ সালের এপ্রিলে অবসর নেন। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প ও প্রবন্ধের বই মিলিয়ে আল মাহমুদের বইয়ের সংখ্যা প্রায় একশ’।

তিনি বহু পত্রপত্রিকা ও সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন। কবির শখ বই পড়া ও ভ্রমণ। তার দেখা শহরগুলোর মধ্যে ফ্রান্সের প্যারিস, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, শিকাগো, ভারতের কোলকাতা, দিল্লি, ভূপাল, বাঙ্গালোর, আজমীর, সউদি আরবের মক্কা, মদিনা ও জেদ্দা, আরব আমিরাতের দুবাই, আবুধাবী, শারজাহ্ ও বনিয়াস, ইরানের তেহরান, ইস্পাহান ও মাশহাদ, যুক্তরাজ্যের লন্ডন, ম্যানচেস্টার, গ্লাসগো, ব্রেডফোর্ড ও ওল্ডহাম অন্যতম। আল মাহমুদ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার একুশে পদকসহ বেশ কিছু সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এর মধ্যে ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক শিশু সাহিত্য পুরস্কার, অলক্ত সাহিত্য পুরস্কার, সুফী মোতাহের হোসেন সাহিত্য স্বর্ণপদক, লেখিকা সংঘ পুরস্কার, ফররুখ স্মৃতি পুরস্কার, হরফ সাহিত্য পুরস্কার ও জীবনানন্দ দাশ স্মৃতি পুরস্কার অন্যতম।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।