আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কিংবদন্তী আজম খান

আমাকে যদি পৃথিবির যেকোন দেশে থাকার সুযোগ দেয়া হয় ...তবুও আমি বলবো ...আমি এদেশে থাকতে চাই ... আমি জানি আমার দেশ ঘুনে ধরা ... মরচে পড়া ... তবুও ... আমার দেশ যদি পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে দেশ হয় ... এটা আমার ( তরুন সমাজের ) দ্বায়িত্ব আমার দেশকে সুন্দর করে গড়ে তোলা জানি না কেন ... আজকাল আর সামুতে লিখতে ভালো লাগে না ... প্রিয় যে মানুষগুলোর লেখা পড়ার জন্য আসতাম তারাও আজকাল লেখে না খুব একটা ... দিন দিন সামু জানি কেমন হয়ে যাচ্ছে ... খালি আজেবাজে পোষ্ট ... রাজনৈতিক কাদাছোড়াছুড়ি ... আস্তিক নাস্তিক গালাগালি ... আর না হলে সাহায্য পোষ্ট ... দম বন্ধ হয়ে আসতে চাই ... তবুও আমার খুব প্রিয় একজন মানুষের চির প্রস্থানের সময়ে ... তাকে নিয়ে কিছু লিখতে ইচ্ছা হলো ... ... ... কিংবদন্তী আজম খানঃ ‘ও রে সালেকা, ও রে মালেকা, ও রে সালেকা, ও রে মালেকা, ও রে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে...’- আশির দশকে দেশ মাতানো পপগান....... বাংলা সঙ্গীতের ব্যান্ডধারার অন্যতম পথিকৃৎ তিনি। কিংবদন্তীতুল্য এই পুরুষকে তরুণ সমাজ চেনে ‘পপগুরু’ হিসেবেই। এখনো আগের মতোই তরুণ রয়ে গেছেন তিনি! সাহসী, উদ্যমী ও চিরতরুণ এই প্রতিভার নাম- আজম খান। বাংলা গানের অনন্য এক ধ্রুপদী তারকা। পাকিস্তান আমলের কথা।

কমলাপুরের পৈত্রিক বাড়িতে বাবা-মা-ভাই-বোনদের সাথে বসবাস। বাড়ির পাশেরই টিএনটি কলেজের ছাত্র। মাথার ভেতর কিলবিল করে দেশের জন্য কিছু করার চিন্তা। বুঝতে পারেন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণকাহিনী। এক পর্যায়ে জড়িয়ে পড়েন আইউব-বিরোধী আন্দোলনে।

‘ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী’ নিয়ে বিভিন্ন জেলায় চলে যান গণসঙ্গীত গাইতে। কখনো বন্ধুরা মিলে নৌকায় যমুনা নদী পাড়ি দেওয়া আর গানের আসর বসানো। তারপর এলো ১৯৬৯ সাল। উত্তাল সারাদেশ। চারিদিকে প্রতিবাদের ঝড়, মিছিল, মিটিং আরো কত কী! অগণিত মানুষের সাথে একাত্ম হয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন তরুণ বিদ্রোহী আজম খান।

প্রতিবাদ মিছিল, ব্যারিকেড আর পুলিশের ধাওয়া- এভাবেই পার করেন ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান। এসব করতে করতে মহল্লাতে তখনই হিরো বনে গিয়েছেন আজম খান ও তার বন্ধুরা। এক বন্ধু ছিলো আলাউদ্দিন। ডাক নাম ‘ক্যানেডি’। ,‘ক্যানেডি, ক্যানেডি, ক্যানেডি, তোর মা তোরে ডাকে ছোটখাটো ক্যানেডি।

ঢিক ঢিক ঢিক...!’ গানটি তাৎক্ষণিকভাবে দারুণ জনপ্রিয় হয় বন্ধুমহলে। সেই থেকেই শুরু। ‘এভাবে টেবিল চাপড়াতে চাপড়াতেই আমার গানের হাতেখড়ি। ছেলেবেলা থেকে সেইভাবে গানের তালিম নেইনি কোথাও। এমনকি কোনো প্রতিষ্ঠান বা গুরুর কাছেও কখনো সারেগামা শেখা হয়নি।

গাইতে গাইতেই আমি গায়েন। কখনো হাতে-কলমে কোন গান লিখেছি কিনা তা মনে পড়ে না। আমার অধিকাংশ গানই মুখে মুখে বানানো। জনপ্রিয় অনেক গানের নেপথ্য ঘটনাটা এমনই! যেমন, একদিন বন্ধুদের সাথে হাঁটছি। রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে এক ভিখিরি।

তাকে লক্ষ্য করে বন্ধুরা গেয়ে উঠলো ‘এতো সুন্দর দুনিয়ার কিছুই রবে না রে, হেই আল্লা হেই আল্লা রে’, কিংবা পাড়ার বন্ধু আলাল ও তার ভাই দুলাল- ওদেরকে নিয়ে দুষ্টুমি করতে করতেই গান হয়ে গেলো, ‘আলালও দুলাল, আলাল ও দুলাল, তাদের বাবা হাজীচাঁন, চাঁনখার পুলে প্যাডেল মেরে পৌঁছে বাড়ি’। আরেকদিন সবাই মিলে বাড়ির পাশে টাওয়ার হোটেলের ছাদে একত্রিত হলাম গান গাওয়ার জন্য। তো একজন পানির ট্যাঙ্কটাকে ড্রাম বানিয়ে পেটাতে শুরু করলো। লোহার রড হয়ে গেলো গিটার, ফাটা পাইপ হয়ে উঠলো মাইক্রোফোন। শুরু হয়ে গেলো আমাদের গানের অনুষ্ঠান! এভাবেই হঠাৎ একদিন মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো- ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা’ গানটি।

বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে সুপারহিট। সারা বাংলায় মানুষের মুখে মুখে উঠে গেলো এই গান। এক গানেই মাতোয়ারা হলো বাংলাদেশ। ’ ‘তারপর একদিন শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সাল।

বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যুদ্ধে ঝাঁপ দিলো অগণিত মানুষ। তখন আমার একুশ । টগবগে তরুণ। পাড়ার বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম যুদ্ধে যাবো। মায়ের কাছে এসে ভয়ে ভয়ে জানালাম।

মা তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। সাহসে ভর করে চলে গেলাম বাবার কাছে। বাবা ছিলেন কিছুটা গম্ভীর প্রকৃতির। শুধু বললেন, যুদ্ধে যাবি, ভাল কথা। তবে দেশ স্বাধীন না করে ঘরে ফিরতে পারবি না।

ব্যস, আর পায় কে! পরদিন সকালবেলা পাড়ার বন্ধু ফুয়াদ, জিন্নাহ, শফি, সাদেক হোসেন খোকাসহ আরো অনেকে মিলে রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য বর্ডার ক্রস করে ভারতে পৌঁছানো এবং যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং নেয়া। মাইল মাইল পায়ে হেঁটে নবীনগর, নরসিংদী হয়ে ভারতের ত্রিপুরায়। টানা দেড়দিন খাওয়া-বিশ্রাম বলে কিছু নেই। একটানা অবশেষে পৌঁছে গেলাম মেলাঘর।

পরদিনই আমাদের পাঠিয়ে দেয়া হলো কুমিল্লায় সালদাহ ফ্রন্টে। এখানেই জীবনের প্রথম সামরিক যুদ্ধ। এই যুদ্ধে হারাই আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে। পরবর্তীতে অনেক গেরিলা অপারেশন চালিয়েছি। আমি ছিলাম আমাদের গ্রুপের সেকশন কমান্ডার।

দ্রুতই পারদর্শী হয়ে উঠি নানা রকম অস্ত্র চালনায়। সখ্য গড়ে ওঠে রাইফেল, স্টেনগান, থ্রিনটথ্রি, এসএলআর, এলএমজি, গ্রেনেড এমন নানান রকম অস্ত্রের সাথে। ক্যাম্পেই আমার সাথে পরিচয় হয় রুমির- শহীদ জননী জাহানারা ইমামের ছেলে রুমি ইমাম। দ্রুতই বন্ধুত্বটা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, এক সাথে খাওয়া, একসাথে ঘুমানো। আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে যায় রুমি।

অসম্ভব মেধাবী ছিলো রুমি। অস্ত্রচালনা ও গেরিলা কৌশলে অসম্ভব দক্ষ। প্রচন্ড সাহসী। এ কারণেই হয়তো আগেই ওকে বড় বড় অপারেশনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আমার মতে রুমিকে অত তাড়াতাড়ি অপারেশনে পাঠানোটা একদমই ভুল সিদ্ধান্ত ছিলো।

সেজন্যেই হয়তো অকালে প্রাণ হারাতে হলো ছেলেটাকে। ’ ‘একটি বিশেষ অপারেশনের কথা এখনো মনে পড়ে। ডেমরার কোনাপাড়া ছিলো শহরের প্রধান গ্যাস লাইন। বোমা মেরে গ্যাস লাইন উড়িয়ে দিলে পাক আর্মি বিপদে পড়বে- এই ভাবনা থেকেই আমরা জড়ো হলাম সেখানে। যাতায়াত ব্যবস্থা- নদীপথ।

সন্ধ্যাবেলা নৌকাভর্তি লাইন ওড়ানোর সকল সরঞ্জাম নিয়ে রওয়ানা হলাম আমি ও আমার দুই সহযোদ্ধা। দু’জনের নামই খুরশিদ। অপারেশন সফল করে যখন পালিয়ে আসছি তখন বিকট বিস্ফোরণে চমকে ওঠে চারদিক। অন্ধকার আকাশে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুনের লেলিহান শিখা। এমনি সময় বৈঠার বেচালে নৌকা ডুবে গেলো আমাদের।

ভীষণ মুশকিলে পড়লাম। কোনোরকমে সাঁতার কেটে পাড়ে এসে পৌঁছালাম। তারপর কবরস্থান, ধানক্ষেতের মধ্য দিয়ে পালিয়ে এলাম পাইদি গ্রাম। নিরাপদ শেল্টারে পৌঁছেই অজ্ঞান। গ্রামবাসীর সেবাযত্নে সুস্থ হয়ে উঠি।

পরদিন সকালে দেখি সারা শরীরে লাল লাল দাগ। ধানের শীষ লেগে শরীর কেটে গেছে সবারই। ’ ‘একটু একটু করে একদিন চলে এলো ডিসেম্বর। ১৬ তারিখে স্বাধীন হলো বাংলাদেশ। ক্যাম্পে বসে বেলা এগারটার দিকে রেডিওতে সে খবর জানতে পারি আমরা।

আনন্দে আবেগে দিশেহারা হয়ে গেলাম সবাই। কিন্তু তখনো অনেক কাজ বাকি। এরই মধ্যে কেউ কেউ দেশ স্বাধীন হয়েছে শুনে খুশিতে দিগ্বিদিক হারিয়ে ছুট লাগিয়েছে বাড়ির পথে। কিন্তু সেদিন পথে যতোজনকে সামনে পেয়েছে, সবাইকে গুলি করে মেরেছে ‘কুত্তা’ পাকবাহিনী। পরিস্থিতি খুব সাবধানে রওনা দিলাম বাড়ির পথে।

বাড়ি পৌঁছে মাকে জড়িয়ে ধরি। কী এক অনুভূতি! বাবার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলাম। মনে মনে খুশি হলেও বাবা কিন্তু তখনো গম্ভীর। সেদিন মনের মাঝে ছিলো অদ্ভূত এক অনুভূতি। দেশ স্বাধীন করতে পেরেছি।

বাবার কথা রাখতে পেরেছি। এর চেয়ে বড় ভালো লাগা আর কী হতে পারে। ’ ‘স্বাধীন দেশে ফিরে আবার সেই আগের মতোই বন্ধুদের নিয়ে উদ্দাম জীবন। একসাথে হৈ-হল্লা, মুখে মুখে গান বাঁধা- চলছে জীবন। একদিন পাড়ার কিছু ছেলে মিলে বিটিভিতে একটা লাইভ অনুষ্ঠান করলো।

কিন্তু অনুষ্ঠান ফ্লপ! একেকজনের মুখ হাঁড়ির মতে কালো। ঘটনা দেখে মনে মনে একটু জিদ হলো আমার। ঠিক করলাম, গিটার-ড্রাম বাজিয়ে একটা চোখ ধাঁধানো অনুষ্ঠান করবো। সবাইকে দেখিয়ে দেবো কিভাবে অনুষ্ঠান করতে হয়! বন্ধু নিলু আর মনসুরকে দিলাম গিটারে, সাদেক থাকলো ড্রামে। আমি প্রধান ভোকাল।

টানা চললো প্র্যাকটিস। তারপর একদিন বিটিভিতে প্রচার হলো সেই অনুষ্ঠান। সেটা ৭২ সালের কথা। ‘এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে’ আর ‘চার কালেমা সাক্ষী দেবে’ গান দুটি সরাসরি প্রচার হলো বিটিভিতে। ব্যাপক প্রশংসা আর তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দিলো এ দুটো গান।

দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়ে গেলো আমাদের দল। পাড়া-মহল্লা থেকে শুরু করে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, বিশেষত তহবিল গঠন- ইত্যাদি নানা উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রস্তাব আসতে থাকলো শো করার জন্য। তখনো আমি কিন্তু শিল্পী হওয়ার জন্য গান করিনি। আমার ইচ্ছে ছিল সিএ পড়ব। বড় চাকরি করবো বাবার মতো।

বড় বড় অফিসাররা তখন ক্যাপ্টেন সিগারেট খেতো। ওদের দেখাদেখি আমারও ইচ্ছে হতো বড় অফিসার হবো। আর তারপর প্রাণ ভরে ক্যাপ্টেন সিগারেট খাবো! কিন্তু সখের বশে গাওয়া দুটি গানের সৌজন্যেই রাতারাতি এসে গেলো তারকাখ্যাতি। এরপর যখনই কোনো নতুন শোর প্রস্তাব আসতো তখনই তৈরি হয়ে যেতো একটা করে নতুন গান! এভাবেই এক এক করে তৈরি হয়ে যায় ‘অভিমানী’, ‘আসি আসি বলে তুমি’, ‘আমি যারে চাই রে’, ‘জীবনে কিছু পাবো না হে’ ইত্যাদি তুমুল জনপ্রিয় সব গান। যেখানেই যাই, শ্রোতাদের ‘ওয়ান মোর, ওয়ান মোর’ ধ্বনিতে কান পাতা দায়!’ ‘পাড়ার বন্ধু ছিলেন ফিরোজ সাঁই।

পরবর্তীতে ওর মাধ্যমে পরিচিত হই ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজ এদের সাথে। এক সাথে বেশ কয়েকটা জনপ্রিয় গান করি আমরা। এরই মধ্যে আরেক বন্ধু ইশতিয়াকের পরামর্শে সৃষ্টি করলাম একটি এসিড-রক ঘরানার ‘জীবনে কিছু পাবোনা এ হে হে!’ এটি ছিলো বাংলা গানের ইতিহাসে- প্রথম হার্ডরক! সেই ১৯৭২ সালে শুরু। আজও অব্যাহত তার সৃজনী কার্যক্রম। একের পর এক নতুন গানের অ্যালবাম এসেছে বাজারে।

প্রতিটি গান পেয়েছে অবিশ্বাস্য জনপ্রিয়তা। ঈদে আসছে আরেকটি নতুন অ্যালবাম। সম্ভাব্য নাম ‘নীলনয়না’। এখানে দশটা গানের মধ্যে এই প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ওপর দুটি গান করেছেন তিনি। বাকিগুলোর ভেতর দুটি ফোক, একটি মাদকবিরোধী আর পাঁচটা আধুনিক গান।

সামনে করতে যাচ্ছেন কোবরা ড্রিংকসের একটি বিজ্ঞাপন। গান-বিজ্ঞাপন-অভিনয় নিয়ে এখনও তুমুল ব্যস্ত। অবসর পেলেই চলে যান পাড়ার মাঠে। ছেলেপুলেদের ক্রিকেট খেলা শেখান। কখনোবা চলে যান সুইমিং পুলে।

আর এসব কারণেই এই বয়সেও দারুণ ফিট আছেন আজম খান! রক কিংবা পপসঙ্গীতের অদ্বিতীয় গুরু তিনি। আজকাল অনেক ছেলেমেয়েই বাংলা ভাষাকে বিকৃত করে গান গাইছে, এটা খুবই দুঃখজনক। আমাদের ভাষাকে ব্যঙ্গ করা যাবে না। অনেক রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই অর্জন। একে সম্মান দিতেই হবে।

গানের ক্ষেত্রে আমি পাশ্চাত্যের অনুকরণেরও বিরোধী। বাঙালিরা এমনিতেই সমৃদ্ধ। আমাদের কাউকে অনুকরণ করার দরকার নেই। আমাদের গানে আমাদের সংস্কৃতির প্রতিফলন থাকতে হবে। আমাদের আকাশ বাতাসের কথা, আমাদের গণমানুষের কথা বলতে হবে আমাদের গানে।

প্রত্যেক শিল্পীরই নিজস্বতা থাকা উচিত। আজকাল সবক্ষেত্রে মৌলিকতার বড়ই অভাব। ’ ‘আমি কাউকে আমার গুরু মনে করি না। নিজেকেও কারো গুরু বলে মানতে নারাজ। আমার মনে হয় নিজের গুরু নিজে হওয়াই সবচাইতে ভালো।

’ ‘ছোটবেলায় পাড়ার সবাই মিলে চাঁদা তুলতাম। আর ঈদের সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান করতাম মহল্লাতেই। সেখানে মঞ্চস্ত হতো বিভিন্ন বিখ্যাত নাটক। অনেক নাটকে অভিনয় করেছি ওই মঞ্চে। সবচাইতে করুণ ঈদের স্মৃতি একাত্তর সালের।

দেশে যুদ্ধ চলছে। বাড়ির জন্য, মায়ের জন্য কেঁদে উঠলো মন। বড় ঝুঁকি নিয়ে ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এলাম ঢাকা। অনেক অলিগলি ঘুরে পাক আর্মির চোখ ফাঁকি দিয়ে বাড়িতে। কিন্তু বাবা-মাকে সালাম করে এক চামচ সেমাই মুখে দিতে না দিতেই খবর এলো দালালের নির্দেশনায় পাক আর্মি আসছে বাড়িতে।

আধখাওয়া সেমাই রেখেই পালিয়ে ফের ক্যাম্পে। ঈদের স্মৃতি মনে হলেই এই ঘটনাটা খুব নাড়া দেয়। আর এখনকার ঈদ কাটে ছেলেমেয়ে, নাতিনাতনিদের মাঝে। মা এখনো বেঁচে আছেন। ঈদের সকালে সেই ছোটবেলার মতো প্রথমেই মাকে সালাম করি।

তারপর নামাজ। ফিরে এসে বন্ধু বান্ধবদের সাথে কিছুটা সময় কাটানো। এভাবেই চলে যায় ঈদ। ’ শিল্পের বিভিন্ন শাখায় এক নিবিষ্ট কারিগর আজম খান ভবিষ্যতে একটি সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার স্বপ্ন দেখেন। ‘আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রক বা পপ সঙ্গীত শেখার তেমন কোন সুব্যবস্থা নেই।

বিষয়টা মাথায় রেখে উন্নত সুযোগ-সুবিধা সমন্বিত আধুনিক একটি সঙ্গীত একাডেমি খোলার কথা ভাবছেন তিনি। রক, পপ ও আন্ডারগ্রাউন্ডের পর বাংলাসঙ্গীতে আরো এক নতুন মাত্রা যোগ করতে চলেছেন আমাদের সবার প্রিয় এই জীবন্ত কিংবদন্তী। মুক্তিযোদ্ধা গায়ক গুরু আজম খান: পুরো নাম: মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান। মায়ের নাম: মৃত জোবেদা খানম। বাবার নাম: মৃত মোহাম্মদ আফতাব উদ্দিন খান।

বাবার পেশা: অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার, সেক্রেটারিয়েট হোম ডিপার্টমেন্ট। ব্যক্তিগতভাবে হোমিওপ্যাথির চিকিৎসক ছিলেন। জন্ম ও জন্মস্থান: জন্ম: ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০ জন্মস্থান: ১০ নম্বর সরকারি কোয়ার্টার, আজিমপুর কলোনি, ঢাকা। ছেলেবেলা ১৯৫৫ সালে প্রথমে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে বেবিতে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে প্রাইমারিতে ভর্তি হন।

১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৫৬তে তার বাবা কমলাপুরে বাড়ি বানান পারিবারিক জীবন: বিয়ে করেছিলেন ১৯৮১ সালের ১৪ জানুয়ারি ঢাকার মাদারটেকে। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩১ বছর।

স্ত্রীর নাম: সাহেদা বেগম। প্রথম সন্তান: ইমা খান। নাতনি: কায়নাত ফাইরুজ বিনতে হাসান। দ্বিতীয় সন্তান: হূদয় খান। তৃতীয় সন্তান: অরণী খান।

বর্তমান ঠিকানা: ২ নম্বর কবি জসীমউদ্দীন রোড, কমলাপুর, ঢাকা-১২১৭। বড় ভাই: সাইদ খান। পেশা: সরকারি চাকরিজীবী। মেজো ভাই: আলম খান। পেশা: গীতিকার ও সুরকার।

ছোট ভাই: লিয়াকত আলী খান। মুক্তিযোদ্ধা। পেশা: ব্যবসায়ী। ছোট বোন: শামীমা আক্তার খানম। সহধর্মিনী মারা যাবার পর থেকে একাকী জীবন।

উপাধি: পপসম্রাট আজম খান কিংবদন্তি আজম খান গুরু নামে খ্যাত। মুক্তিযোদ্ধা আজম খান: ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানের সময়ে আজম খান পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তখন তিনি ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর শোষণের বিরুদ্ধে গণসঙ্গীত প্রচার করেন। ১৯৭১ সাকে আজম খানের বাবা আফতাব উদ্দিন খান সচিবালয়ে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বাবার অনুপ্রেরণায় যুদ্ধে যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন আজম খান।

১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরু হলে তিনি পায়ে হেঁটে আগরতলা চলে যান। আগরতলার পথে তার সঙ্গী হন তার দুই বন্ধু। এসময় তার লক্ষ্য ছিল সেক্টর ২ এ খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধে যোগদান করা। আজম খান মুক্তি যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন ২১ বছর বয়সে। তার গাওয়া গান প্রশিক্ষণ শিবিরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণ যোগাতো।

তিনি প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন ভারতের মেলাঘরের শিবিরে। যুদ্ধ প্রশিক্ষণ শেষে তিনি তিনি কুমিল্লায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সমুখ সমরে অংশ নেয়া শুরু করেন। কুমিল্লার সালদায় প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করেন। এর কিছুদিন পর তিনি পুনরায় আগরতলায় ফিরে আসেন। এরপর তাকে পাঠানো হয় ঢাকায় গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য।

আজম খান ছিলেন দুই নম্বর সেক্টরের একটা সেকশনের ইনচার্জ। আর সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল খালেদ মোশাররফ। ঢাকায় তিনি সেকশান কমান্ডার হিসেবে ঢাকা ও এর আশেপাশে বেশ কয়েকটি গেরিলা আক্রমণে অংশ নেন। আজম খান মূলত যাত্রাবাড়ি-গুলশান এলাকার গেরিলা অপারেশান গুলো পরিচালনার দায়িত্ব পান। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল তার নেতৃত্বে সংঘটিত "অপারেশান তিতাস" ।

তাদের দায়িত্ব ছিল ঢাকার কিছু গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করার মাধ্যমে বিশেষ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমান শেরাটন হোটেল) , হোটেল পূর্বানীর গ্যাস সরবরাহে বিঘ্ন ঘটানো। তাদের লক্ষ্য, ঐ সকল হোটেলে অবস্থানরত বিদেশি রা যাতে বুঝতে পারে যে দেশে একটা যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধে তিনি তার বাম কানে আঘাতপ্রাপ্ত হন সেটি এখনো তার শ্রবণক্ষমতায় বিঘ্ন ঘটায়। আজম খান তার সঙ্গীদের নিয়ে পুরোপুরি ঢাকায় প্রবেশ করেন ১৯৭১ এর ডিসেম্বারের মাঝামাঝি। এর আগে তারা মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনী তে সংগঠিত যুদ্ধে পাক সেনাদের পরাজিত করেন।

বাংলাদেশ যতদিন টিকে থাকবে, যতবার রচিত হবে বাংলার ইতিহাস, তার সাথে সাথেও আজম খান ও তাঁর গানগুলো মিশে রবে। মূল লেখাঃ কিংবদন্তী আজম খান (মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান)  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।