আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কিংবদন্তী জেট ফাইটার - মিগ -২১

অলস মস্তিস্ক বহু বান্দরামীর উর্বর ভূমি
স্নায়ু যুদ্ধের প্রথম দিকে সোভিয়েত - আমেরিকা বিরোধ যখন চরমে , তখন সোভিয়েত এবং আমেরিকা দুদলই নিজেদের অস্ত্র ভান্ডার সমৃদ্ধ করতে শুরু করে। দুদেশই নতুন মডেলের ট্যাংক, এপিসি,এয়ারক্রাফট ইত্যাদি তৈরিতে ব্যাপক মনোযোগ দেয়। সেই সময় এয়ারক্রাফটের দিকে এগিয়ে থাকা আমেরিকাকে ধরতে সোভিয়েতরা প্রানপন চেষ্টা শুরু করে। এবং তারই ফলাফল মিগ ২১। মিগ ২১ এর পুরো নাম Mikoyan-Gurevich MiG-21 এর ন্যাটো কমান্ডনেম ফিসবেড।

মিগ ২১ এর জন্ম ইতিহাস বেশ পর্যায়ক্রমিক। যা শুরু হয়েছিলো সনিক (শব্দের সমান গতি সম্পন্ন) মিগ ১৫ এবং মিগ ১৭ দিয়ে এরপরে আসে সুপারসনিক (শব্দের চেয়ে বেশি গতিবেগ সম্পন্ন) মিগ ১৯ যা ছিলো মূলত গ্রাউন্ড এট্যাক ফাইটার। ১৯৪৮ -৪৯ সালে সোভিরেতরা মিগ ১৯,১৭ এবং সুখোই ৭ এর সমন্বয়ে একটা বৃহদাকৃতির সুপারসনিক মাল্টিরোল ফাইটার তৈরির ডিজাইন সম্পন্ন করে। সেই প্রযেক্টের প্রটোটাইপের নাম ছিলো Ye-1। Ye-1 এর টেষ্টিং এর পরে সোভিয়েতরা বুঝতে পারে যে ফাইটার অনুপাতে ইন্জিন এর ক্ষমতা কম।

তখন এই ঝামেলা সারিয়ে তৈরি করা Ye-2 প্রটোটাইপ। এই প্রটোটাইপও উইংস এর ঝামেলার কারনে ফেল মারে। একই অবস্থায় পড়ে Ye-3 প্রটোটাইপ। পরে শেষে ১৬ জুন ১৯৫৫ সালে Ye-4 প্রটোটাইপ ফাইনাল প্রোডাকশন এর অনুমতি পায়। এবং এই ফাইটার সার্ভিসে আসে ১৯৫৯ সালে।

১৯৫৯ সালে সার্ভিসে আসার পরে এই বিমানের ব্যাপারে তেমন কিছুই জানতে পারে নি পশ্চিমা বিশ্ব। এই বিমান কে ন্যাটো তাচ্ছিল্য করে কোডনেম দেয় "ফিসবেড" বা মাছের বিছানা । তবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে এই মাছের বিছানাই আমেরিকানদের বাদর নাচ নাচিয়ে ছাড়ে । মিগ ২১ একটি মাল্টিরোল ফাইটার। এটি এয়ার টু এয়ার, এয়ার টু গ্রাউন্ড সবদিকেই কার্যকরি।

মিগ ২১ এর কোয়ালিফিকেশন এর অন্যতম হলো এর শক্তিশালী ইন্জিন,হালকা বডি এবং ডেল্টা উইং । এর শক্তশালী ইন্জিন এর শক্তি এই ফাইটার এর গতি কে ম্যাক ২.২ তে পৌছে দেয়। এছাড়া উন্নত ম্যানুভারিটি পাওয়ার এই ফাইটারকে তৎকালীন অন্যসব ফাইটার গুলো থেকে আলাদা করে দিয়েছিলো। উল্লেখ্য মিগ ২১ এর মটো হল Attak and Keep Going অর্থ "হামলা করো এবং উড়ে যাও"। মিগ ২১ কে বলা হয় পাইলটের বিমান।

একজন দক্ষ পাইলটের হাতে এই বিমান খুবই মারাত্বক অষ্ত্র। সে অবষ্তায় এই বিমান যেকোন আধুনিক বিমানের দিকে চ্যালেন্জ ছুড়ে দিতে সক্ষম। যেমন কারগিল যুদ্ধে ভারতীয় পাইলটরা মিগ ২১ দিয়েই পাকিস্থানি এফ ১৬ কে ধাওয়া করেছিলো। মিগ ২১ এর রক্ষনাবেক্ষন খরচ বেশ কম। এই বিমানের জন্য আলাদা শেড এর দরকার হয় না ।

খোলা আকাশের নিচে এই বিমান বিনা দ্বিধায় ফেলে রাখা যায়। ২ ইন্চি বরফ বা ধূলার আস্তর কোন কিছুই এর জন্য কোন সমস্যা নয়। বিবরন : (বেসিক মডেল) পাইলট : ১ বা ২ জন দৈর্ঘ্য: 14.5 m উচ্চতা: 4.125 m বোঝা ভরা অবস্হায় ওজন : 8,825 kg শক্তির উৎস : 1 × Tumanskiy R25-300, 40.21 kN (9,040 lbf) thrust dry, 69.62 kN (15,650 lbf) with afterburner each সর্বোচ্চ গতি: 2,350 km/h (1,468 mph) Mach 2.05 পাল্লা: 1,210 km আর্মামেন্ট ২ টি ৫০০ কজি ড্রপ ডাউন বম্ব ৪টা Vympel R-77 অথবা ৪টা R-60M ১৯৫৯ সালে সার্ভিসে আসার ৫০ বছর পরেও মিগ ২১ এবং লাইসেন্সড চাইনিজ কপি J-7 / F-7 Airguard বিশ্বের প্রায় ৩০ দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। যার প্রধান কারন এর আপগেড প্যাকেজ। এই ফাইটার এর বডি বাদে মোটামুটি সব পার্টসই কমবেশি আপগেড হয়েছে।

আর এই আপগেডেশন এই ফাইটার কে আপটুডেট রাখতে সাহায্য করেছে। যুদ্ধের পারফরমেন্স : উত্তর ভিয়েতনামে আমেরিকার বিরুদ্ধে মিগ ২১ এর ব্যবহার শুরু হয় ১৯৬৭ সালে। যদিও প্রথম দিকে ভাবা হয়েছিলো আমেরিকান এফ ৪ এর সাথে মিগ ২১ পরে উঠবে না। কারন ২ ইন্জিনের এফ ৪ সাইজে বড় এবং ঐ বিমান ট্যেকনিক্যালই উন্নত ছিলো। কিন্তু তা মার খেয়ে যায় মিগ ২১ এর উন্নত ম্যনুভারিটি এবং জোরালো গতির কাছে।

১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত আমেরিকা ৬২টা মিগ ২১ ধ্বংসের বিপরীতে বিভিন্ন জাতের ১২১ টা ফাইটার হারায়। ১৯৬৭ সালে আরব ইসরাইল যুদ্ধেও এই বিমানে পারফরমেন্স ভালো ছিলো না মূলত আরবদের অদক্ষতার কারণে। মিশরের কাছে থাকা ৪-৫ স্কোয়াড্রন বিমানের মধ্যে আকাশে ডগফাইট করে ছিলো মাত্র ৪ টি, বাকি গুলো মাটিতে থাকা অবস্থাতেই ইসরাইলি বিমানের হাতে ধ্বংশ হয়। পরে অবশ্য রাশানদের সহযোগিতায় ১৯৭৩ সাল নাগাদ তার কিছুটা উন্নতি হয়। তবে এর মধ্যে একটা ঘটনা ঘটে তা হল ,প্রশিক্ষন দিতে আসা রাশিয়ান পাইলটরা ২টি ইসরাইলি বিমান ধ্বংশের পর ইসরাইল ফাদে ফেলে ৩ জন রাশিয়ান পাইলটকে বিমানসহ হত্যা করে।

তার প্রতিশোধ নিতে সোভিয়েত পাইলটরা ২ দিনে ক্রমাগত হামলা চালিয়ে ২১ টি ইসরাইলি ফাইটার ধ্বংশ করে । এতে ইসরাইল ভয় পেয়ে সীজফায়ার চুক্তি করে ও রাশিয়ান পাইলটরা ঠান্ডা হয়। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও মিগ ২১ এর বড় ভূমিকা আছে । ১৯৭১ সালে ভারতীয় মিগ ২১ এর স্কোয়াড্রনের সামনে পাকিস্তানিদের বিমান তেমন সুবিধা করতে পারেনি। যুদ্ধে ডগফাইটে পাকিস্তানী পাইলটদের হাতে ২টি মিগ ২১ হারানোর বিপরীতে ভারতীয় পাইলটরা মিগ ২১ দিয়ে পাকিস্তানীদের ৮ টি যুদ্ধবিমান এবং ২টি ট্রান্সপোর্টার বিমান হারকিউলিস সি-১৩০ ধ্বংস করে।

মিগ ২১ হল বিশ্বের সবচেয়ে বেশি উৎপাদিত এবং সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত জন্গি বিমান। সারা বিশ্বে প্রায় ১১,৬৫০ পিস মিগ এবং এর লাইসেন্সড কপি J-7 / F-7 Airguard তৈরি হয়েছে অবশ্য এর পেছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের অবদান অনেকখানি। তারা ১৯৫৯ সার্ভিসে আনার পর থেকেই এই বিমান কে বহিবিশ্বের কাছে ছড়িয়ে দিতে শুরু করে। ১৯৬৬ সালে নগাদ এই বিমান উত্তর ভিয়েতনামে পৌছে যায় যখন তখন স্বয়ং আমেরিকার কাছেই মিগ ২১ কে ফাইট দেয়ার উপযোগী পর্যাপ্ত বিমান ছিলো না। বিশেষ করে ১৯৭১ এ ভারতের কাছে মিগ ২১ পৌছে যায় যখন সাউথ এশিয়ার অন্যকোন দেশের কাছে এই মানের সুপারসনিক ফাইটার ছিলো নাহ।

বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সের প্রথম ফাইটার ছিলো এই মিগ ২১ যা কিনা উপহার দিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। বর্তমানে বাংলাদেশ এয়ার ফোর্সে মিগ ২১ এর চীনা ভার্সন J-7 / F-7 Airguard ফাইটার হিসাবে ব্যবহৃত হচ্চে। J-7 / F-7 Airguard তবে সব মিলিয়ে জেট ফাইটার বিমানের ইতিহাসে মিগ ২১ একটি আইকন।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।