আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মা'কে খুঁজছি

লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। মা'কে খুঁজছি মোহাম্মদ ইসহাক খান পল বসে বসে পিয়ানোতে একটা নতুন সুর তোলার চেষ্টা করছিলো। টুংটাং আওয়াজ আসছিল ওর ঘর থেকে।

আজকাল সময় পেলেই সে এই কাজটা করে। নতুন নতুন সুর তৈরি করা, আর করেই সেটা বাবা-মাকে বাজিয়ে শোনানো। সবগুলো যে খুব সুন্দর হয়েছে তা নয়, বরং বেসুরো হয়েছে স্বীকার করতেই হয়, তবে কয়েকটি বেশ ভাল হয়েছে। বাবা মিস্টার উইল এবং মা মিসেস লিলি কিছু মনে করেন না। তরুণ বয়েস, এই বয়সের ধর্মই হচ্ছে কিছুদিন পর পর নতুন কোন শখ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়া।

পল এর বাইরে নয়, উঠতি বয়সের হুজুগে কিছুদিন সে জিমে গিয়ে শরীর গঠনের চেষ্টা করেছে, মাটির জিনিসপত্র বানানোর প্রশিক্ষণ নিয়েছে; এক কথায় লেখাপড়ার পাশাপাশি অন্য কিছু চেষ্টা করা তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। এই তো সেদিন বলে-কয়ে কিনল পিয়ানো, তারপর যখনই সময় পায় ঐ নিয়েই পড়ে আছে, নিজের স্বল্প বিদ্যে দিয়ে তৈরি করে চলেছে আজব আজব সব সুর। পিয়ানোর বাজনা শুনে শুনে মিস্টার উইল এবং মিসেস লিলির মাথা ধরে গেছে, কিন্তু কিছু বলছেন না। ছেলে নতুন নতুন জিনিস নেড়েচেড়ে দেখুক, পরিচয় হোক সবকিছুর সাথে, চোখ ফুটুক, অভিজ্ঞতা হোক, তারপর একদিন এভাবেই নিজের জীবনের পথটি ঠিকই চিনে নেবে। ধমক দিয়ে ওকে থামিয়ে দিতে ওঁরা চান না।

পলের ইচ্ছে ছিল নতুন সুরটি পুরোপুরি তৈরি করে তবে খেতে যাবে, কিন্তু লিলি ওকে জোর করে ধরে খাবার টেবিলে নিয়ে গেলেন। ছোট-বড় সবকিছুই ঠিক সময়ে করা চাই, মিস্টার উইল বেশ কড়া করেই এই নিয়মটা বাড়িতে চালু রেখেছেন। তিনজনে মিলে খেয়ে নিলেন রাতের খাবার। সারাদিন পর এই একটিবারই তিনটি প্রাণী এক হতে পারেন, এটা-সেটা নিয়ে গল্প করেন। হাসি-ঠাট্টায় মেতে ওঠেন, খুনসুটি বাদ যায় না কখনো।

মিস্টার উইল বলেন তাঁর ব্যবসা কেমন যাচ্ছে, মিসেস লিলি বলেন তাঁর স্কুলে বাচ্চারা কেমন দুষ্টুমি করেছে, আর পল বলে ওর বন্ধুবান্ধবেরা কে কেমন আছে, এসব। বেশীরভাগই হালকা বিষয়। কিন্তু আজ যেন কী হয়েছে, মিস্টার উইলের মুখ বেশ গম্ভীর। কথাবার্তা বিশেষ বলছেন না। পল বেশীক্ষণ চুপ করে থাকতে পারে না, নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে বাবা? তোমার মুখ গোমড়া কেন? মিসেস লিলির দিকে তাকিয়ে আরও বিস্মিত হল সে, তাঁর গোলগাল সুশ্রী মুখেও কীসের যেন একটা ছায়া পড়েছে।

পল ঢোক গিলল। এমন কিছু কি সে করে ফেলেছে, যাতে তাঁরা কষ্ট পেয়েছেন? না, মনে তো হয় না। বাবা-মাকে সে খুব ভালোবাসে, দুজনের সাথেই খুব খোলামেলা সে, কিছু গোপন করে না, আর সজ্ঞানে তাঁদের জন্য কষ্টদায়ক, এমন কিছু সে করে না। তারপরও সে জিজ্ঞেস করলো আবার। কী হয়েছে বাবা? মা, বাবা কিছু বলছে না কেন? মিস্টার উইলের খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, তিনি বেশ ভারী কণ্ঠে বললেন, পল, খাওয়া শেষ কর।

তোমার সাথে কিছু কথা বলবো। এমন করে কথা বলছ কেন, বাবা? খারাপ কিছু হয়েছে? মিস্টার উইল জবাব না দিয়ে লিলির দিকে তাকান। লিলি অদ্ভুত দৃষ্টিতে পলের দিকে তাকালেন, তারপর স্বামীকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি নিশ্চিৎ উইল, আমরা ওকে এটা বলবো? মিস্টার উইল প্লেট আর চামচ গুছিয়ে নিতে নিতে বললেন, হ্যাঁ, লিলি, ওকে বলতেই হবে। পলের মনে অনেকগুলো প্রশ্ন একসাথে দানা বেঁধে ওঠে, সে ব্যগ্র কণ্ঠে বলে, কী বলতেই হবে বাবা? বলছি, পল। তুমি খাওয়া সেরে ওঠ।

নাকেমুখে খাবার গুঁজে নেয় পল, মিস্টার উইল এক কথার মানুষ, কাজেই খাওয়া শেষ না করলে তিনি একটি কথাও মুখ থেকে বের করবেন না। *** বসার ঘরে তারা তিনজন এসেছেন। মিস্টার উইল পায়চারি করছেন, আর হঠাৎ হঠাৎ থেমে দাঁড়াচ্ছেন। মিসেস লিলি পলের কাঁধে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন। পল আবার বলল, বাবা, তোমার আচরণ খুবই রহস্যময় ঠেকছে।

এবার একটু খুলে বলবে? মিস্টার উইল আবার দাঁড়িয়ে পড়লেন, দু'চোখে তাঁর স্পষ্ট দ্বিধা। কিছু একটা বলতে চাইছেন, কিন্তু বলতে পারছেন না। গলা খাঁকারি দিলেন তিনি, মন স্থির করলেন। এবার তিনি কিছু একটা বলবেন। কথা শুরু করতে যাবার আগেই লিলি বলে উঠলেন, উইল, প্লীজ, আরেকবার ভেবে দেখো।

মিস্টার উইল দীর্ঘ একটা মুহূর্ত লিলির দিকে তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, আমি বলবো, লিলি, বলতেই হবে। আর ওর কাছে গোপন করার কোন অধিকার আমাদের নেই। পল কিছু বুঝতে পারছে না। একবার বাবার দিকে, আরেকবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। দু'জনকেই খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে।

নিশ্চয়ই বড় কোন ব্যাপার হবে, তাই তাঁরা এত দ্বিধা করছেন। মিস্টার উইল আবার গলা খাঁকারি দিলেন। বললেন, পল, তোমাকে যে কথাটা বলবো, সেটা শুনে তুমি অনেকটা শক পাবে। কাজেই মনটাকে শক্ত কর। পলের হাসি পেয়ে যায়।

বাবা, যথেষ্ট তামাশা করেছ, এবার খোলাসা কর তো। মিস্টার উইল কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন পলের দিকে, এক দৃষ্টিতে। পল ভীষণ অবাক হয়ে দেখল, তাঁর চোখে জমে উঠেছে পানি। সে বলল, বাবা! মিস্টার উইল ওকে কথা বলার সুযোগ দিলেন না, বললেন, আমরা তোমার বাবা-মা নই, পল। বলেই হাঁপাতে লাগলেন, যেন তাঁর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।

পল কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। মিস্টার উইলের গলার স্বরে কোন ছেলেমানুষি কিংবা তামাশার সুর নেই, থাকলে বোঝা যেত। কাজেই কোন প্রশ্ন চলে না। সামান্য একটা কথা, অথচ কেমন অদ্ভুত, কেমন অবাস্তব শোনায়, আমরা তোমার বাবা-মা নই! সহসা পলের মনে হল, গলায় কিছু একটা বিঁধে আছে, ধীরে ধীরে দলা পাকাচ্ছে। সে মিসেস লিলির দিকে তাকাল, তিনি নীরবে কাঁদছেন।

পলের দিকে তাকাচ্ছেন না। পলের গলাও ধরে আসে, সে থেমে থেমে বলে, সত্যি বলছ বাবা? মিস্টার উইল বলেন, সত্যি বলছি পল। আমরা তোমার কেউ না। কেউ না। দু'বার বললেন বলেই যেন কথাটাকে বহুগুণ শক্তিশালী বলে মনে হল।

পল বলল, তাহলে আমি কে? মিস্টার উইলকে নয়, নিজেকেই যেন জিজ্ঞেস করে সে। মিস্টার উইলের কথাগুলো যেন ওকে খুব দুর্বল আর অসহায় করে দিয়েছে, পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যেতে শুরু করেছে ওর। মিস্টার উইল অনেকক্ষণ ধরে কিছু বলতে পারলেন না, রুমাল দিয়ে চোখ মুছতে লাগলেন। লিলিও নীরব। অবশেষে তিনি বলতে শুরু করলেন, তুমি ডগলাস ইনগ্রাম এবং লরা ইনগ্রামের ছেলে।

পল মাটির দিকে তাকিয়ে আছে, মুখ তুলতে পারছে না। দুই ঠোঁট জোরে চেপে রেখেছে সে, মুখ খুললেই চোখের পানি গড়িয়ে পড়বে। বহু কষ্টে নিজেকে ধরে রেখেছে সে। ওর মাথার ভেতর রেকর্ডের মতো বেজে চলেছে, আমরা তোমার কেউ না, কেউ না! সে এদের কেউ না? মিস্টার উইল এবং মিসেস লিলি ওর কেউ না? অথচ যাঁদেরকে সে ছোটবেলা থেকেই বাবা আর মা বলে জেনে এসেছে, যাঁদেরকে নিজের সব বলে ধরে নিয়েছে। তাহলে সবই মিথ্যে, সবই ফাঁকি? মিস্টার উইল ওকে সংক্ষেপে জানালেন, মাত্র তিন বছর বয়সে কী করে সে হারিয়ে গিয়েছিলো, দূরের এক প্রদেশে আনন্দভ্রমণে এসে বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো, তারপর ছোটাছুটি করে তাঁদেরকে না পেয়ে রাস্তার এক কোণে বসে কাঁদছিল।

মিস্টার উইল এবং মিসেস লিলি ওকে কুড়িয়ে পেয়ে নিজের কাছে এনে রেখেছেন, নিঃসন্তান এই দম্পতি ওকে নিজেদের ছেলে বলেই পরিচয় দিয়েছেন। তাঁদের আঁধার ঘরে পল ছিল এক ঝলক আলোর মতো। বহু চেষ্টা করেছেন তাঁরা, থানাপুলিশ করেছেন, কিন্তু আর ওর আসল যে বাবা-মা, অর্থাৎ মিস্টার ডগলাস ইনগ্রাম আর লরা ইনগ্রামের কোন খোঁজ পান নি। ব্যাপারটা রহস্যময় তো বটেই, যখন দীর্ঘ এক মাস খবরের কাগজে বিজ্ঞপ্তি দিয়েও তাঁদেরকে পাওয়া গেল না, এই যুগে এটা অস্বাভাবিক। নিশ্চয়ই তাঁরা শিশুসন্তানটিকে হারিয়ে পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন, হন্যে হয়ে ঘুরেছিলেন পথে পথে।

পুলিশ আর কিছু বলতে পারলো না, বোধহয় অনুসন্ধান থামিয়ে দিলো। সেই থেকে পল আছে মিস্টার উইল এবং মিসেস লিলির ছেলে হয়ে, কচি মাথার স্মৃতি থেকে বহু আগেই মুছে গেছে যে সে হারিয়ে গেছে; মুছে গেছে যে সে যাদের কাছে আছে, তাঁরা ওর আসল পিতামাতা নন। কে জানে, এতে হয়তো ভেতরে ভেতরে উইল আর লিলি খুশীই হয়েছিলেন। হারিয়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের জন্য এদেশে এক ধরণের জায়গা আছে, সোজা কথায় এক ধরণের এতিমখানা। প্রাণে ধরে পলকে সেখানে রেখে আসতে পারেননি তাঁরা।

এই বাড়িকে পল নিজের ঘর বলেই জানত, জানত যে সে নিজের বাবা-মায়ের সাথেই আছে। মিস্টার উইল কিংবা মিসেস লিলিও ভাবেন নি যে কখনো এই সুখী পরিবারটিতে বিনামেঘে বজ্রপাত হবে। বরং এখন হয়তো তাঁরা অপরাধী বলে সাব্যস্ত হবেন, সত্য গোপন করার জন্য, অন্যের সন্তান বিনা অনুমতিতে নিজেদের বলে লালন করার জন্য, তা-ও আবার এত বছর ধরে। সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা পলের জন্য অপেক্ষা করছিলো। পল এবার মুখ খুলল, জিজ্ঞেস করলো, আমার বাবা-মা কোথায় থাকেন? বেঁচে আছেন? মিস্টার উইল ধরা গলায় বললেন, তোমার মা বেঁচে আছেন।

অনেকদিন আগেই তোমার বাবার সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছিলো, তারপর থেকে তিনি একাই থাকেন। কয়েকদিন হয় একটা চিঠি এসেছে আমার কাছে, তোমার মায়ের ঠিকানা পেয়েছি, সেই সাথে অল্পবিস্তর খবরাখবর। তোমার বাবার খবর জানি না, কিন্তু তোমার মা নিশ্চয়ই বলতে পারবেন। পলের হাতে তিনি চিঠিটি তুলে দেন। কোন এক অচেনা লোকের চিঠি, হয়তো আইনজীবীর সাথে যোগাযোগ আছে তার।

সে অল্প কথায় জানিয়েছে মিসেস লরা ইনগ্রাম এখন কোথায় আছেন। টেলিফোন নম্বর দেয় নি, শুধু ঠিকানা, কাজেই নিজে যেতে হবে। মিস্টার উইল এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছেন, বললেন, তোমাকে কাল রাতের প্লেনে শিকাগো যেতে হবে, পল। তৈরি হয়ে নাও। *** পল ব্যস্ত এয়ারপোর্টে ঢুকে যাচ্ছে, ইমিগ্রেশনে যাবার আগে সে কিছুক্ষণ মা'কে জড়িয়ে ধরে রইলো।

মিস্টার উইল আর মিসেস লিলি এখন আর কাঁদছেন না, এটা বরং খুশির ব্যাপার যে পল ওর আসল মা'কে দেখতে পাবে। মিসেস লিলি ওর কপালে চুমু খেলেন। বললেন, যাও, তোমার মা'কে খুঁজে বের কর। পল কিছু বলল না। ওর "এতদিনের বাবা-মা" বেশ স্থির আছেন, ভেঙে পড়েন নি, কিন্তু পলের মনে হচ্ছে, যেকোনো মুহূর্তে সে হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে।

এতকিছুর মধ্যেও সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে, কিন্তু বারবার চোখে পানি চলে আসছে। মিস্টার উইলকে আলিঙ্গন করে ইমিগ্রেশনে ঢুকে গেল সে। হাত নেড়ে সম্ভাষণ জানালেন এই দম্পতি। মিস্টার উইলের মনে হল, বুকটা ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে। মনে হচ্ছে, আর পল ফিরে আসবে না, এই দেখাই শেষ দেখা।

মিসেস লিলি স্বামীর হাত ধরে বললেন, দেখো, আমাদের পল কখনো আমাদেরকে ভুলে যাবে না। ফিরে আসবে। আমার মন বলছে, ওর মা'কে নিয়েই আসবে। *** চিঠির দিকনির্দেশনা অনুযায়ী রুডলফ স্কোয়ার থেকে বাঁয়ে যেতে হবে, তারপর লিজ স্ট্রিটের দু'পাশে যেসব বাড়ি সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোর মধ্যে আঠারো নম্বরটাতেই থাকেন মিসেস লরা ইনগ্রাম। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল পল।

এক তলায় শুধু গ্যারেজ, দোতলায় লোকজন থাকে। নিশ্চয়ই বলতে পারবে তারা। দু'বার ডোরবেল বাজতে খুলে গেল দরজা। উঁকি দিলেন মোটাসোটা বাদামী চামড়ার এক মহিলা। কাকে চাই? মিসেস লরা ইনগ্রাম কি এখানে থাকেন? ব্যগ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে পল।

তার মন বলছে, খুব কাছে এসে গেছে সে। কয়েক ঘণ্টার প্লেন জার্নির ধকল ভুলে গেছে এখানে এসেই। মহিলা কিছুক্ষণ চোখমুখ কুঁচকে ভাবার চেষ্টা করলেন। লরা? লরা ইনগ্রাম? লরা ... ... লরা ... ... লরা। উঁহু, এখানে তো এই নামে কেউ থাকে না।

এটা লিজ স্ট্রিট, আঠারো নম্বর বাড়ি নয়? হ্যাঁ হ্যাঁ। এটাই। তাহলে তো এখানেই হবার কথা। প্লীজ, একটু মনে করার চেষ্টা করুন। হয়তো তিনি এখানে থাকতেন, পরে চলে গেছেন, এমনও তো হতে পারে? ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণ ভেবে আবার বললেন, না, তুমি বোধহয় ভুল করছ বাছা।

পেছন থেকে আরও মোটা একজন মহিলা উঁকি দিলেন। কে এসেছে, মার্থা? এই ছেলেটি মিসেস লরা ইনগ্রাম নামের একজন মহিলাকে খুঁজছে। লরা ইনগ্রাম? সে তোমার কী হয়? পল এক মুহূর্ত দ্বিধা করে। তারপর বলে, তিনি আমার খুব কাছের একজন মানুষ। "তিনি আমার মা" বলতে কেন যেন বাধ-বাধ ঠেকল ওর।

কেন ঠেকল জানে না। কিছু মনে কোরো না বাছা, মার্থা মেয়েটা বেশিদিন হয় নি এখানে এসেছে। লরা এখানেই থাকতো, আমার সাথে বেশ কিছুদিন কথা হয়েছে। কিন্তু সে তো অনেকদিন হয় এখান থেকে চলে গেছে। পলের বুকটা ধক করে উঠলো।

চলে গেছেন? হ্যাঁ। কোথায় গেছে বলতে পারেন? ঠিকানা অথবা ফোন নম্বর নেই? না, তা তো বলে যায় নি। কিন্তু একটা কার্ড আছে আমার কাছে। দেখো, একটা কোম্পানির অফিসের ঠিকানা। এখানেই চাকরি করতো বোধহয়।

বয়স্ক মহিলাটি একটা কার্ড নিয়ে আসেন। সাদা রঙয়ে লেখা আছে মিসেস লরা ইনগ্রামের নাম। একটি বহুজাতিক কোম্পানির কন্সালট্যান্ট হিসেবে কাজ করেন। পল কার্ডটা ছোঁ মেরে নিয়ে নেয়। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

বড় উপকার করলেন। ধুপধাপ করে নেমে যায় পল, পেছনে তাকালে দেখতে পেত, দু'জন মহিলা ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। কেন ছেলেটা এমন তাড়াহুড়ো করছে? *** রিসিপশনে সবসময় সুদর্শনা মেয়েদেরকে বসানো হয়। এটা আর কিছু নয়, যেকোন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কৌশল। যদি কোন অফিসে ঢুকেই কেউ কপালে চারটে বিশ্রী ভাঁজ ওয়ালা বিকটদর্শন লোকের সামনে পড়ে, তাহলে সে আর এখানে আসতে চাইবে না।

কাজেই রিসিপশনের টেবিলগুলোতে টেলিফোন হাতে যারা হাসিমুখে সারাদিন শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে আর নানারকম তথ্য দিয়ে গ্রাহকদের সাহায্য করে, তাদের প্রায় সবাই কম বয়সী মিষ্টি চেহারার মেয়ে। তেমনি একটি মেয়ের দিকে এগিয়ে গেল সে। মেয়েটির দিকে কোন নজর নেই তার, সে মা'কে খুঁজতে এসেছে। টেলিফোনটা কান থেকে নামিয়ে একটা সুন্দর হাসি উপহার দিলো মেয়েটি। আপনার জন্য কী করতে পারি, স্যার? কার্ডটা বাড়িয়ে দিলো পল।

মিসেস লরা ইনগ্রাম আপনাদের এখানে চাকরি করেন? মেয়েটি কার্ডটি নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল। হ্যাঁ, তাই তো দেখা যাচ্ছে। কেন, কোন সমস্যা স্যার? না। তাঁর সাথে একটু দেখা করা দরকার। জরুরী।

গলা খাঁকারি দিলো পল। অস্বস্তিকর প্রশ্নটা আসবে কীনা তাই ভাবছে। মেয়েটা নিশ্চয়ই জিজ্ঞেস করে বসবে, তিনি আপনার কে হন? অতি স্বাভাবিক প্রশ্ন, কিন্তু পলের কেন যেন এটা শুনলেই অস্বস্তি লাগে। কিন্তু মেয়েটি এমন কিছু জিজ্ঞেস করলো না, নিশ্চয়ই কর্মক্ষেত্রে এসব ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা বারণ। সে কম্পিউটার স্ক্রিনে ঝুঁকে পড়েছে।

কিছুক্ষণ খুটখাট করে বলল, সরি স্যার, মিসেস লরা ইনগ্রাম তো আমাদের আটলান্টা শাখায় চলে গেছেন। চোয়াল ঝুলে পড়লো পলের। কতদিন আগে? আবার স্ক্রিন চেক করে বলল মেয়েটি, তা প্রায় সাড়ে আট মাস হবে, গত বছরের জুলাই মাসে। এখন মনে পড়লো স্যার, তাঁর মন টিকছিল না এখানে, নিজেই দরখাস্ত করেছিলেন বদলির জন্য। তাছাড়া ওখান থেকে একজন কনসাল্ট্যান্ট এই শাখায় চলে এসেছিলেন বলে কোন অসুবিধা হয় নি, বদলাবদলি করে নেয়া হয়েছে।

বলেই জিভ কাটল সে, একজন অচেনা লোককে নিজেদের কর্মী সম্পর্কে এত তথ্য দেয়ার নিয়ম নেই। নিশ্চয়ই মেয়েগুলো সারাদিন কাজের চাপে সে কারো সাথে একটু কথা বলার ফুরসতও পায় না, সুযোগ পেয়ে তাই হড়হড় করে কথা বলছে। ওদের ওপরমহলের লোকগুলো জানতে পারলে নিশ্চয়ই অনর্থ ঘটবে। পল মেয়েটির কাছ থেকে কোম্পানির আটলান্টা শাখার ঠিকানা নিয়ে যখন বেরিয়ে এলো, তখন সে মনে মনে বলছে, ঈশ্বর! আমার সাথে এভাবে খেলা কোরো না। মায়ের দেখা পাইয়ে দাও।

*** মিস্টার উইল ওকে বলেছেন, মাথা ঠাণ্ডা রাখতে। একবার যখন সন্ধান পাওয়া গেছে, তখন নিশ্চয়ই তাঁর দেখা মিলবে। বলেছেন টিকেট কেটে যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, আটলান্টা চলে যেতে। তাই করেছে পল। এখন সে বিমানে।

সারা শরীরে ক্লান্তি, কিন্তু মা'কে দেখার জন্য তার মন-প্রাণ উন্মুখ হয়ে আছে। প্লেনে ওঠার আগে একটা ঘটনা ঘটেছে। শিকাগো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশনে আটকে গিয়েছিলো সে। লাইন ধরে দাঁড়ানো মানুষগুলোর কেউ ছিল ব্যস্ত, কেউ বা ঢিলেঢালা। তাদের সারিতে অনেকক্ষণ ধরে একটু একটু করে এগিয়ে যখন সে ইউনিফর্ম পরা শুঁটকো লোকটার কাছে গিয়ে পৌঁছল, তখন লোকটি তার পাসপোর্ট খুলে দেখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল পলের দিকে।

বলল, সরি স্যার, আপনার পাসপোর্টের মেয়াদ গতকাল শেষ হয়ে গেছে। পলের হাতে ফিরিয়ে দিলো সে পাসপোর্টটা, পল উল্টেপাল্টে দেখল। ঠিকই বলছে সে। হায় কপাল। ইচ্ছে হল লোকটার ভাবলেশহীন মুখে কষে একটা ঘুষি মারে, কিন্তু এর তো কোন দোষ নেই।

কাজেই মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসতে হল। লাগেজ আর পাঠানো হল না জায়গামত, ফেরত নিয়ে বেরিয়ে এলো সে। এবার উপায়? ফোন করেছিল সে বাল্টিমোরে, মিস্টার উইলের কাছে। মিস্টার উইল খুব ঠাণ্ডা মাথার মানুষ, আগেই বলেছিলেন, যেকোনো অসুবিধে হলে যেন সাথে সাথে জানায় পল। ক্লান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো পল, মায়ের দেখা পাবো তো, বাবা? মিস্টার উইল আশা দিলেন ওকে, বললেন, ভেঙে পড় না।

অবশ্যই পাবে। বুকে সাহস রাখো। শুধু সাবধানে থেকো, লিলি বারবার জিজ্ঞেস করছে তুমি ঠিকমতো পৌঁছেছ কীনা। তিনি কার সাথে যোগাযোগ করলেন পল জানে না, কিন্তু বারো ঘণ্টার মধ্যেই ওর হাতে এসে গেল একটা অস্থায়ী পাসপোর্ট, যার মেয়াদ সাত দিন। যথেষ্ট সময়।

মনে মনে অসংখ্যবার ঈশ্বর আর মিস্টার উইলকে ধন্যবাদ দিলো সে। আবার ইমিগ্রেশন, আবার প্লেনে ওঠা। এবার ইমিগ্রেশনের লোকটা আর আটকাল না, ছেড়ে দিলো ওকে। পল একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, লোকটি ওর দিকেই তাকিয়ে আছে, মুখে একটা সুন্দর হাসি ফুটেছে। পলকে চিনতে পেরেছে সে, গতকালই ফিরিয়ে দিয়েছিলো।

হাসিমুখে মাথা ঝোঁকাল পল। লাইনে দাঁড়ানো পরের মানুষটি তাড়া দিলো লোকটিকে, সে আবার কাজ শুরু করলো। এই মানুষগুলোর সময়ের বড় অভাব। *** জি ইনকর্পোরেটেডের আটলান্টা শাখার রিসিপশনে বসে থাকা সুন্দরী মেয়েটি এবার আর পলকে নিরাশ করলো না। সহজেই পাওয়া গেল মিসেস লরা ইনগ্রামের ঠিকানা।

কোম্পানি অনেক কর্মীকেই থাকার জায়গা দেয়, মিসেস লরা ইনগ্রাম একজন সিনিয়র অফিসার বলে বেশ বড় একটা বাড়ি পেয়েছেন। এখান থেকে আধঘণ্টার পথ। ট্রামে, বাসে কিংবা ট্যাক্সিতে যাওয়া যেতে পারে। খসখস করে কাগজে ঠিকানা লিখে দেয় মেয়েটা। কাগজটা হাতে নিয়ে পল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

ভাবে, মায়ের কাছ থেকে আর মাত্র কয়েক পা দূরে আমি। বেরিয়ে আসার সময় মেয়েটি পেছন থেকে ডাকে ওকে। বলে, আপনার দিনটি শুভ হোক, স্যার। পেছনে তাকায় পল, চোখে অদ্ভুত দৃষ্টি। মেয়েটি অবশ্য হেসে মাথা নিচু করে, কিন্তু পল স্পষ্ট বুঝতে পারে, মেয়েটি বুঝতে পেরেছে, সে কেন এখানে এসেছে।

হাঁক দিয়ে একটা ট্যাক্সি থামায় পল, কোথায় যেতে হবে বলে চড়ে বসে। খোলা জানালা দিয়ে চলতি পথের বাতাস গায়ে লাগতেই পলের মনে হল, সবকিছু আবার ওর অনুকূলে আসতে শুরু করেছে, ভাগ্য ভাল হতে শুরু করেছে। আর হয়তো ঘুরপাক খেতে হবে না। সে যেখানে যাচ্ছে, সেখানেই মিসেস লরা ইনগ্রাম, অর্থাৎ ওর মায়ের দেখা মিলবে। *** পল নিজের কাঁধের ভারী ব্যাগটা নামিয়ে রেখেছে, মাটিতেই।

ওর এখন কোনদিকে খেয়াল নেই, সে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে বেশ খানিকটা দূরে, টলটলে পুকুরটার ধারে যে বেঞ্চি, তার ওপর ওর দিকে পেছন করে বসে থাকা মধ্যবয়সী নারীটির দিকে। তিনি নড়ছেন না, স্থির হয়ে আছেন, নিশ্চয়ই বই পড়ছেন গাছের ছায়ায় বসে। আজ কি ছুটির দিন? মনেই ছিল না, আজ শনিবার। যাক, ভাল হল। তাহলে শনিবার অফিস খোলা ছিল কেন, আর মিসেস লরা বাড়িতে কেন? যাক গে, তা দিয়ে পলের কোন দরকার নেই।

পল তাঁর কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, খুব কাছে। সে অবাক হয়ে খেয়াল করেছে, ওর নিজে হেঁটে আসতে হচ্ছে না, কেউ একজন, কোন অদৃশ্য সত্তা যেন ওকে হাত ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে আসছে। একেই বোধহয় বলে নাড়ির টান, পল মনে মনে ভাবে। ভদ্রমহিলা বই-ই পড়ছিলেন। পায়ের আওয়াজ পেয়ে ওর দিকে তাকালেন।

বছর পঁয়তাল্লিশ তাঁর বয়স হবে, একটু এদিক-ওদিক হতে পারে। তবে এখনো সুশ্রী দেখতে, শরীর ভেঙে পড়তে শুরু করেনি। পলের বুক ঢিপঢিপ করছে। যদি তিনি মিসেস লরা ইনগ্রাম না হন, যদি অন্য কেউ হন? ভদ্রমহিলা পলকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করলেন। কৌতূহলী হয়েছেন তো বটেই, তাঁর কাছে মনে হচ্ছে তাঁর স্বামীর যৌবন বয়সের একটা কার্বন কপি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

তাঁর ঠোঁটে ধীরে ধীরে কাঁপন ধরল। তিনি নিশ্চয়ই চিনতে পেরেছেন ওকে। কিন্তু কী বলে ডাকবেন ঠিক করতে পারছেন না। সহসা বলে উঠলেন, হ্যারি! তাঁর নীল চোখ চিকচিক করছে। পল চমকে গেল।

নিশ্চয়ই ছোটবেলায় ওর নাম ছিল হ্যারি। কী আশ্চর্য, ছোটবেলায় সে হারিয়ে গিয়েছিলো, এতটুকু ছিল তখন। এখন সে এত বড় হয়েছে, পরিপূর্ণ যুবক। অথচ এই ভদ্রমহিলা তাঁকে কত সহজেই না চিনে ফেললেন। পলের আর কোন সন্দেহ রইলো না ইনিই তার মা।

কিন্তু সে বোকার মতো জিজ্ঞেস করলো, মিসেস লরা ইনগ্রাম! তিনি জবাব না দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, পলের মুখখানি নিজের হাত দুটোর মধ্যে নিয়ে বললেন, আমার ছেলে! হ্যারি! সোনামানিক আমার! ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন তিনি, ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেই থাকলেন, কাঁদতেই থাকলেন। পল বুঝে গেল, আর নিজেকে লুকিয়ে রাখার কোন প্রয়োজন নেই। সে নিজেও শিশুর মতো কেঁদে উঠলো, মা! *** একটি কবরের সামনে মা-ছেলে দাঁড়িয়ে আছেন। দুজনের মুখ শান্ত, সৌম্য। কবরের ফলকে খোদাই করে লেখা আছে, "ডগলাস ইনগ্রাম।

" হাতে করে নিয়ে আসা ফুলের তোড়াটা কবরে নামিয়ে রাখল পল। পল নামটিতে আপত্তি নেই লরার, তিনি এখন ওকে এই নামেই ডাকছেন। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে লরা প্রার্থনা করলেন ডগলাস ইনগ্রামের বিদেহী আত্মার জন্য। না হয় তাঁদের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলো, সেজন্য কে দায়ী ছিল তা আর ভাবতে চান না তিনি। একমাত্র সন্তানকে ফিরে পেয়েছেন, সেটাকেই পরম পাওয়া বলে মনে করবেন তিনি, খুশির দিনটিতে কারো ওপরে রাগ পুষে রাখবেন না তিনি।

আজ আর তিনি একা নন। বিষণ্ণতা এবং একাকীত্বের জন্য আর কোন থেরাপি প্রয়োজন নেই তাঁর। বুকে ক্রস আঁকলেন তিনি, তারপর পলের হাত ধরে হেঁটে হেঁটে রাস্তায় উঠে এলেন। পল ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করে, মা, একটা কথা বলি? নিশ্চয়ই বলবি। বাল্টিমোরে আমার যে বাবা-মা এতদিন আমাকে বড় করেছেন, তাঁদের সাথে দেখা করতে তুমি যাবে না? সত্যি বলতে, আমি ছাড়া ওঁদের আর কেউ নেই।

লরা কিছুক্ষণ ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন, তারপর বলেন, তুই লজ্জা পাচ্ছিস কেন? ওঁদেরকে কৃতজ্ঞতা জানাতে হলেও আমি অবশ্যই যাবো। আমি, মানে আমরা তো হারিয়ে বসেছিলাম তোকে, কিন্তু ওঁরা তো পরম যত্নে তোকে বাবা-মায়ের স্নেহ দিয়েছেন, এই ঋণ শোধ করবো কী করে? পল তাঁদেরকে এখনো "বাবা-মা" বলে সম্বোধন করছে, তাতে রাগ করেন না তিনি। (৬-৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।