আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মধ্যরাতের টকশো এত জনপ্রিয় কেন

১. মধ্যরাতের টকশোর জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বাড়ছে সন্ধ্যারাতের টকশোর প্রতি গ্রাম-গঞ্জের মানুষের আকর্ষণ। কেন টকশো এত জনপ্রিয়? কারণ এখানে মানুষের মনের ভাষায় কথা বলেন অতিথিরা। দলকানারা আলাদা। টকশোতে তিন পক্ষ আসে।

দুই পক্ষ দুই রাজনীতির ধারায় অন্ধের মতো তাদের মনের মাধুরীতে যুক্তিতর্ক তুলে জিততে চায়। আরেক পক্ষ দেশ-মানুষের হয়ে নির্মোহচিত্তে সত্য বলে। এই শিবিরে আবার কিছু বর্ণচোরা যেমন থাকেন তেমনি বিশেষজ্ঞরাও ঠাঁই পান। দর্শক বিচার করতে ভুল করেন না। টকশোতে সঞ্চালক বা সরকারি দলের যাদের ডাকেন তাদের অনেকে আসেন না।

তারা মিথ্যা দিয়ে সত্য ডাকতে চান না অথবা ভুলের দায় নিতে নারাজ। দুই দলে আরেক পক্ষ আছে তদবির করে আসে। এসে যার যার দলের জন্য ঝগড়া বাধান। কেউ কারও কথা শোনেন না। দর্শক বিরক্ত হলে দল তাদের বাহবা দেয়।

একসময় সন্ধ্যা নামলেই বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা শুনতে মানুষ ভিড় জমাত চায়ের দোকান থেকে নানা স্থানে। নগর থেকে শহর, শহর থেকে গ্রাম মানুষ জটলা বেঁধে টান টান উত্তেজনা নিয়ে দেশের খবর শুনত। সেই খবরে সত্য থাকত। দেশের সরকারি বিটিভি ও বেতারে দেশের খবর ব্লাক আউট থাকত। যেন কিছুই ঘটেনি।

তাই বিশ্বাসই ছিল না। এখনো নেই। বিটিভি মানে জনগণের টাকায় সরকার ও তার দলের প্রচারবাহন। আজ্ঞাবহদের গুণকীর্তন। দলদাসদের নিয়োগ।

যাক জটলায় বসে বা দাঁড়িয়ে বিবিসি বা ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদ তুমুল উত্তেজনা নিয়ে শোনার দিন অনেক আগেই বাসি হয়েছে। সেসব এখন ইতিহাস। সেনাশাসকদের জমানায় বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সংবাদ প্রচারে সেনাশাসনবিরোধী গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা ও চেতনার প্রতিফলন ঘটেনি বলে বিবিসি খ্যাত প্রথিতযশা সাংবাদিক মার্ক টালিকে খুঁজতে গিয়ে আন্দোলনের অগ্রভাগে ঠাঁই পাওয়া পথকলি বা টোকাইরা সাদা চামড়ার কাউকে দেখলেই তাড়া করত এরশাদ জমানার একটা সময়। তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার সময় আরিচা ফেরি দিয়ে তিন ঘণ্টায় যমুনা পাড়ি দিতে হতো।

এখন বঙ্গবন্ধু সেতু হওয়ার সুবাদে তা লাগে না। সেই সময় আরিচা ফেরিঘাটের ভাতের হোটেল থেকে চায়ের স্টল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের হলগেট থেকে ক্যাম্পাসজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা দোকান ও ঝুপড়িতে বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকা শোনার জন্য রেডিও রাখা হতো। আমাদের বাড়িতেও একটা অনেক পুরনো রেডিও ছিল। ওটা বিবিসি শোনার রেডিও। মাঝে-মধ্যে ঝামেলা করলে থাবা দিলেই ঠিক হয়ে যেত।

সেই সময়ে গোটা বাংলাদেশের সর্বত্র ছিল একই চিত্রপট। দেশের একমাত্র টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতার সরকার নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় দর্শকরা সেখানে গান শুনত আর নাটক দেখত। ফজলে লোহানীর ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান 'যদি কিছু মনে না করেন' ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সেই সাদাকালো টেলিভিশন যুগের নাটকগুলো ছিল দর্শকনন্দিত। এখন কেউ নাটক দেখে না, রিমোট কন্ট্রোল ঘুরায়।

তখন মুগ্ধ হয়ে সবাই নাটক দেখার জন্য টিভির সামনে নির্দিষ্ট সময়ে বসে থাকত। সংবাদে সরকারের সব খবর থাকত, আন্তর্জাতিক খবর প্রাধান্য পেত। কিন্তু সারা দেশে সরকারবিরোধী আন্দোলনের উত্তাল দৃশ্য বা হরতালের স্বতঃস্ফূর্ত চিত্র কিংবা বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার মিছিল ঠাঁই পেত না। সেখানে প্রাধান্য পেত সরকারের ঊধর্্বতনদের নানা কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি। স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকে '৯৬ সাল পর্যন্ত এ ছিল চিরচেনা দৃশ্য।

তবে সেই সময় সংবাদ পাঠকের ক্ষেত্রে সরকার কবির উদ্দীন থেকে আসমা আহমেদ মাসুদসহ অনেকেই যারা এখন প্রবাসী তারা তারকা খ্যাতি কুড়িয়েছিলেন। সেই সময়ের সংবাদের কারণেই বিরোধী দল থেকে টেলিভিশনকে বলা হতো সাহেব-বিবি-গোলামের বাঙ্। এরশাদ জমানার পর হয়ে যায় বিবি-গোলামের বাঙ্। সরকারি টেলিভিশন ও বেতার এখনো পাল্টায়নি। বহু রক্তে অর্জিত আন্দোলনে তিন জোটের রূপরেখায় টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হলেও কেউ কথা রাখেনি।

আওয়ামী লীগ-বিএনপি তো নয়ই, তৎকালীন পাঁচ দলের নেতারা ক্ষমতার অংশীদার হয়েও তা দেননি। বিটিভির সামনে সেই বিবিসি-ভয়েস অব আমেরিকার খবর শোনার শ্রোতারা আর বসেন না। তাদের আস্থা কুড়িয়েছে বেসরকারি স্যাটেলাইট টিভি ও বেতারের সংবাদ। তাদের আস্থার জায়গায় সংবাদ আর প্রবল আকর্ষণের মধ্যমণি মধ্যরাতের টকশো।

 

২. ১৯৯৬ সালে মুজিবকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে বেসরকারি টেলিভিশনের লাইসেন্স দানের মাধ্যমে আকাশ সংস্কৃতির দিগন্ত খুলে দেয়।

এই প্রথম মানুষ বিটিভি থেকে মুখ ঘুরিয়ে সংবাদ শোনার জন্য ওইসব স্যাটেলাইট টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রাখতে শুরু করে। বেসরকারি টিভির সংবাদ জনপ্রিয় হতে থাকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিবিসি শোনার বদলে মানুষ টিভির সামনে দাঁড়াতে থাকে। ২০০১ সালে বিএনপি জোট ক্ষমতায় এসে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই লাইসেন্স দান অব্যাহত রাখে। টিভির শেয়ার বেচাকেনা হলেও একদিকে সংবাদকর্মীদের কর্মসংস্থানের জায়গা বাড়ে, টিভি চ্যানেলের মানের উৎকর্ষতা বৃদ্ধির প্রশ্নে বাড়ে প্রতিযোগিতা।

বিএনপি জমানায় একুশে টেলিভিশন বন্ধ করে দেওয়া ছিল রাজনৈতিক প্রতিহিংসার এক অমার্জনীয় অপরাধ। সৃজনশীল সংবাদকর্মী, কলাকুশলীই নন, দর্শকরাও সেদিন ব্যথিত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ জোট ক্ষমতায় এসে সেই শোধ নিতে গিয়েই হোক বা অন্য কারণেই হোক চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেওয়া এবং যমুনা টিভিকে সম্প্রচারে আসতে না দেওয়া ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আওয়ামী লীগ সরকারও অনেক দলীয় লোককে টিভি লাইসেন্স দিয়েছে, যার মধ্য থেকে '৭১ না দেখা কেউ কেউ জামায়াতের কাছেও শেয়ার বিক্রি করেছেন। সময়ের কথা বিবেচনায় না নিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের হাতে লাইসেন্সপ্রাপ্তরা শেয়ার বিক্রি করলেও দেশের স্বনামধন্য ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের একসময়ের নেতা ডা. আবু শামীমের বিনিয়োগে প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসার টিভি লাইসেন্সের আবেদনে সরকারের অনুমতি না দেওয়ায় অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন।

আওয়ামী লীগ ও কবি-সাহিত্যিকদের পাশে ল্যাবএইড মানবিকতার হাতটিও আগে বাড়ায়। এমনকি যারা টিভি লাইসেন্স পেয়েছেন তাদের অনেকের আগে নঈম নিজামেরই পাওয়ার যোগ্যতা এবং অধিকার ছিল। তিনি পাননি। কেন পাননি সেই উত্তর কেউ দিতে পারেননি। সরকারদলীয় বিবেচনায় না দিয়ে নীতিমালার আলোকে লাইসেন্স দান উন্মুক্ত করে দিলেই পারত।

যা করে তাতে কি সরকারের লাভ হয়? আলাপ শুরু করেছিলাম সেই সময়ের বিবিসি সংবাদ শোনার প্রতি মানুষের আগ্রহ নিয়ে। দেশের খবর বিদেশি মিডিয়ায় মানুষ সেদিন শুনেছে। দেশি সরকারি মিডিয়ার ওপর মানুষের আস্থা ছিল না বলেই ভয়েস অব আমেরিকা ও বিবিসির সংবাদের প্রতি ছিল যত আকর্ষণ। সেই সময়ের ভয়েস অব আমেরিকার ঢাকা থেকে গিয়াস কামাল চৌধুরী ও আতাউস সামাদের কণ্ঠ এখনো মানুষের কানে বাজে। একজন রোগশয্যায়, আরেকজন ইন্তেকাল করেছেন।

বর্তমানে দেশের বেসরকারি টিভি ও বেতারের প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস বেড়ে যাওয়ায় আর কোথাও জটলা করে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা শুনতে হচ্ছে না। বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারের সংবাদ মানুষের আস্থার জায়গায় আগের তিমিরেই আছে। বলা যেতে পারে, বিটিভির খবর মানে যখন যে দল ক্ষমতায় জনগণের ট্যাঙ্রে টাকায় তাদের চেহারা ও সংবাদ পরিবেশন মাত্র।

 

৩. তবে এখন মানুষ গাড়িতে বসে বেসরকারি বেতারগুলোর সংবাদ শোনে। ট্রাফিক অবস্থার খবর জেনে নেয়।

এখন মানুষ বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদ আগ্রহভরে দেখে ও শোনে। আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্গে নেয়। যারা একচোখা নীতি অবলম্বন করে তাদেরটা থেকেও জানতে পারে কী হচ্ছে। সেই সঙ্গে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও প্রতিদিনের ঘটনাবলী নিয়ে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সন্ধ্যারাত থেকে মধ্যরাতের টকশোর জনপ্রিয়তা দিন দিন বাড়ছে। দর্শকরা রিমোট কন্ট্রোল টিপে টিপে এক চ্যানেল থেকে আরেক চ্যানেলে যান, যে টকশো ভালো লাগে সেটিই দেখেন।

এটিএন বাংলায় নির্মাণ পর্ব থেকে বন্ধুবর নঈম নিজাম জড়িয়ে ছিলেন। সেই সময় আমাকে ও রাশেদ চৌধুরীকে নিয়ে প্রথম সাবেক প্রেসিডেন্ট এইচ এম এরশাদের একটি টকশো করেছিলেন, যা দেশজুড়ে আলোচিত হয়। পরে 'অন্য দৃষ্টি' নামে সেটি স্থায়ী রূপ পায়। সংবাদপত্র নিয়ে নাঈমুল ইসলাম খান প্রথম চ্যানেল আইয়ে দিনের বেলা টকশো করেছিলেন। পরে প্রখ্যাত সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী রাত ১২টায় চ্যানেল আইয়ে 'গ্রামীণফোন আজকের সংবাদপত্র' অর্থাৎ পর দিনের সংবাদপত্র নিয়ে ১৬-১৮ মিনিটের টকশো উপস্থাপনায় এলে দর্শকরা শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনা নিয়ে তা দেখতে শুরু করেন।

দেশের টেলিভিশন চ্যানেলগুলো এমনকি সরকারি বিটিভিও সেটি অনুসরণ করে। যদিও কেউ দেখেন না বিটিভির মধ্যরাতের টকশোর দলকানা সুবিধাভোগীদের কীর্তি। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, একজন উপস্থাপক হিসেবে অল্পস্বল্প শব্দ খরচ করে মানুষের মনের কথা টেনে আনার সম্মোহনী ক্ষমতা দিয়ে মতিউর রহমান চৌধুরী যেমন সবচেয়ে সফল জনপ্রিয় উপস্থাপক তেমনি তার এই টকশোটিও দর্শকপ্রিয়তায় শীর্ষে। গজল সম্রাট জগজিৎ সিংয়ের একটি গজলের চরণ মনে পড়ে যায় মতিউর রহমান চৌধুরীর সংবাদপত্র নিয়ে চ্যানেল আইয়ের অনুষ্ঠানটি 'দেখলেই ছোটি ছে রাত... লাম্বিছে কাহিনী'। ছোট্ট অনুষ্ঠান এত এত সংবাদপত্র নিয়ে কত বড় বড় ঘটনা উঠে আসে এ অনুষ্ঠানে! উপস্থাপক মাঝে-মধ্যে মিটিমিটি হাসেন, শোনেন, কখনো লিঙ্ক ধরিয়ে দিয়ে, চোখের শক্তি দিয়ে মনের ভেতর থেকে কথা বের করে আনতে তার জুড়ি নেই।

মানুষ এটি দেখে ঘুমাতে যায়, না হয় এটি শেষ হলে অন্য কোনো টকশোয় চোখ রাখে। বউ-ভাগ্য ভালো না হলে নিয়মিত মধ্যরাতের এমন টকশো অব্যাহত রাখা সম্ভব হতো না। চ্যানেল আইয়ের 'তৃতীয় মাত্রা' জিল্লুর রহমানের উপস্থাপনায় সিরিজ রেকর্ড করেছে। তিনিও উপস্থাপক হিসেবে অল্প কথা বলেন। রাজনীতির অন্দর জানাশোনা থাকায় সূত্র ধরিয়ে দিতে পারেন।

অতিথিদের কথা বলতে দেন। নানামতের বিশেষ করে দুই রাজনৈতিক দলের মানুষদের একটেবিলে এনে টকশোকে মিনি পার্লামেন্টের বিতর্কের জায়গায় তিনি দাঁড় করান। এখন এ ধরনের অনুষ্ঠান প্রায় সব টিভি চ্যানেলই করে। একাত্তর টিভির টকশো দর্শকনন্দিত হয়েছে। উত্তরের আগেই অতিথির কাছে প্রশ্ন ছুড়ে দেন সঞ্চালকরা।

এ নিয়ে সমালোচনা আছে। তবু নতুনত্বের মাত্রা থাকায় সামিয়া জামান বা নবনীতা চৌধুরীদের মুনশিয়ানা স্মার্টনেসে তাদের টকশোটিও দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে টকশো সঞ্চালনা যে কী কঠিন হাতেগোনা কয়েক মাস এক টেলিভিশনের মধ্যরাতের টকশো করতে গিয়ে বুঝেছি। যারা সঞ্চালকের দায়িত্বে থেকে অধিক কথা বলেন তাদের প্রতি আমার রাগ নেই। চুপ করে বসে থাকার কষ্ট অন্য রকম।

মাহমুদুর রহমান মান্নার টকশো 'মুক্তবাক' অন্য মেজাজের। গল্পের ছলে ছলে তিনি এগিয়ে নিয়ে যান। অনুজপ্রতিম খালেদ মুহিউদ্দিন কথা বেশি বললেও তার হাসিমুখ, স্মার্টনেস ও প্রাণবন্ত হাউ টকশো মেজাজের সঞ্চালনায় টকশোটি জমিয়ে ফেলেছেন। শ্যামল দত্ত, জ ই মামুন, অঞ্জন রায়, রাহুল রাহাসহ অনেকেই টকশো সঞ্চালনায় দর্শকনন্দিত হয়েছেন। আমার অতি অনুজ স্নেহের দুই সংবাদকর্মীর অনুরোধে একটি টেলিভিশন চ্যানেলে হাতেগোনা কয়েক মাস মধ্যরাতের টকশো উপস্থাপনা করেছি।

সপ্তাহে চার দিন করে ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত ২টা বাজত। সংসারজীবন বলে কিছু থাকত না। সংবাদপত্র অফিসে কাজ শেষে রাতে বেরিয়ে কোথাও খানিক আড্ডা দিয়ে ওখানে চলে যেতাম। ড. আসিফ নজরুলসহ আমার অসংখ্য শুভাকাঙ্ক্ষী এ উপস্থাপনায় যাওয়া পছন্দ করেননি। তারা বলতেন, উপস্থাপনা করলে কথা বলতে পারেন না।

আপনার কথা বলা দরকার। উপস্থাপনা ছেড়ে আপনি কথা বলুন। আপনার কাছে রাজনীতির অন্দরের অনেক তথ্য রয়েছে। এই কয়েক দিনের উপস্থাপনায় অভিজ্ঞতা অনেক। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা নূরে আলম সিদ্দিকী, একাত্তরের টাইগার সিদ্দিকী খ্যাত বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম ও সাবেক ডাকসু ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর আহমদের টকশো করার সময় অন্য কোনো অতিথি রাখিনি।

কর্তৃপক্ষ একক টকশো পছন্দ না করলেও এগুলো দর্শকনন্দিত হয়েছিল। যে কদিন টকশো করেছি নিজের মানসম্মান নিয়েই করেছি। কারও কাছে কৈফিয়ত দিইনি, কারও সঙ্গে দহরম-মহরম করে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করিনি। অনুষ্ঠানের ৩০ মিনিট আগে গেছি, আমার জন্য নির্ধারিত রুমটিতে বসেছি অতিথিদের নিয়ে। মেকআপ নিয়ে স্টুডিওতে যাওয়া, টকশো শেষে বাড়িতে চলে আসা।

অবশ্য ওই টিভির মালিক আমাকে সহযোগিতা, সম্মান দুটোই দিয়েছেন। প্রযোজক ও তার টিমের সদস্যরা আন্তরিকতার সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। প্রযোজক ভীষণ পরিশ্রমী। একবার এক টিভি টকশোতে অতিথি হয়ে গিয়ে বিচ্ছিরি অবস্থায় পড়েছিলাম। আমার ডানে বিএনপির এক নেতা।

বামে আওয়ামী লীগ নেতা। তুমুল ঝগড়া। সঞ্চালক থামাতে পারেন না। কেউ কাউকে কথা বলতে দেন না। আমার কথাও দুজন কেড়ে নেন।

সেই মুহূর্তে মাত্র এক মিনিট পেলাম। বললাম, দর্শক এতক্ষণ দেখলেন এই আওয়ামী লীগ আর এই বিএনপি। কেমন তাদের রাজনীতি। কেমন আছি আমরা ভাবুন।

 

৪. যাক, যা বলছিলাম, বেশ কিছু দিন আগে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ যাওয়ার পথে বা ঢাকা থেকে রাজশাহী, আবার নওগাঁ থেকে বগুড়া-নাটোর ঘুরে আসতে দেখেছি পথে পথে চায়ের স্টলে টেলিভিশন রাখা হয়েছে।

একসময় বিশ্বকাপ ফুটবলের জন্য রাখা হতো। একসময় বিবিসি শোনার জন্য রেডিও রাখা হতো। এখন সেই জায়গা দখল করেছে টেলিভিশন। কারণ চায়ের দোকানের আড্ডায় যারা বসেন তাদের বেসরকারি টেলিভিশনের সংবাদ ও টকশোর নেশা প্রবল। তাই তাদের ধরে রাখতে চায়ের দোকানের মালিকরা এ আয়োজন করেছেন।

মার্চ মাসে সুনামগঞ্জের এক অবহেলিত উপজেলা জামালগঞ্জের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের এক গ্রামে প্রায় পাঁচ হাজার মানুষের উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। একদিকে সুরমা আরেকদিকে হাওর। জোছনা রাতের নান্দনিক সৌন্দর্যের সেই সন্ধ্যা রাতের দর্শকরা অনেকেই বলেছিলেন তারা টকশোয় আসফউদ্দৌলা, নূরুল কবীর ও ড. আসিফ নজরুলসহ অনেকের ভক্ত। সরকারের সমালোচনা মধ্যরাতের টকশোয় হয়। অতিথিরা রাজনীতিবিদদের, প্রশাসনের কর্তাদের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেন।

শাসকরা ভুল শোধরানোর বদলে সমালোচনা ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করেন। সমালোচনার ক্ষেত্রে দেখেছি বড় দলের নেতাদের চেয়ে ছোট দলের নেতারা আরও অসহনীয়। সেনাশাসক এরশাদের দলের চেয়ে গণতান্ত্রিক দলগুলোর সহনীয়তা অনেক কম। টকশো মানুষ এ কারণেই পছন্দ করে। সেখানে অতিথিরা যা বলেন তা তাদের মনের কথা বলেই মনে করেন।

ইনিয়ে-বিনিয়ে, ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নানা কায়দায় পেঁচিয়ে কথা বলার ধরন টকশো দর্শকরা পছন্দ করেন না। সোজাসাপ্টা প্রশ্ন, সাফ সাফ জবাব মানুষ খুব পছন্দ করছে। ঠিক তাদের পছন্দমতো যারা কথা বলতে পারছেন রিমোট ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাদের অনুষ্ঠানই তারা শুনছেন। সরকারের সমালোচনা গ্রামীণ জনপদের চায়ের দোকানের সাধারণ মানুষ কেন পছন্দ করে? পছন্দ করে বলেই ওইসব টকশো তন্ময় হয়ে শোনে। মুগ্ধ হয়ে দেখে।

এসব টকশোতে যুক্তিতর্ক থাকে। অতর্ক থাকে না। একমুখো কথা হয় না। নানা মত সব চোখ খুলে দেয়। সবাই নিজের আখের গোছানোর হিসাব-নিকাশ, কারও আনুগত্য মাথায় নিয়ে কথা বলেন না।

তাই মানুষ টকশো দেখে। টকশো এখন দর্শকদের বড় প্রিয়। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবার পছন্দ টকশো।

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।