আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রসঙ্গ ‘মেহেরজান’-২



"ওইখানে আমিও আছি, যেইখানে সূর্য উদয় প্রিয়দেশ, পাল্টে দেবো, তুমি আর আমি বোধহয় কমরেড, তৈরি থেকো,গায়ে মাখো আলতা বরণ আমি তুমি, আমি তুমি, এভাবেই লক্ষ চরণ। " মেহেরজান ছবির পরিচালক রুবাইয়াতের লেখা “Trauma of the Women, Trauma of the Nation: A Feminist Discourse on Izzat” আর্টিকেলটি বিভ্রান্তিমূলক ও বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে লেখা। লেখায় কিন্তু মলম মাখানো কিছু কথা আছে, আছে দরদ উথলানো কাঁদুনী। কিন্তু আমি লেখাটি পড়ে হতবাক হলাম তার কৌশল দেখে - কীভাবে তিনি চতুর বাক্যবিন্যাসে পাঠকমনে ধোঁয়াশা তৈরি করেছেন। তার লেখার কিছু অংশ তুলে ধরছি - The national rhetoric is:our sovereignty or swadhinota has cost us three million lives and two hundred thousand women’s ‘izzat. Page:1 Susan Brownmiller-এর লেখাটা পড়ে আমার মনে হয়েছে, আমরা সেই ইতিহাসের কিছুই ঠিকমত জেনে উঠি নি।

পৃথিবীর সব চাইতে চরম নির্যাতিত, অবহেলিত, অভাগা জাতি হচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীরাঙ্গনারা। অামার কথা বিশ্বাস না হলে লেখায় শুভাশীষ ভাইয়ের ব-e-এর লিংক থেকে লেখাটি পড়ে নিন। প্লিজ পড়ুন। আমরা মুক্তিযুদ্ধের গৌরব গাঁথা ঠিক যতটা শুনেছি, বীরাঙ্গনাদের গল্প ঠিক ততটা এড়িয়েছি। হুমায়ূন আহমেদ তার জননী ও জ্যোছনার গল্পে নারী অত্যাচারের বিষয়ে কিছু লেখার ব্যাপারে নিজের অনুভূতিগত অপারগতা প্রকাশ করেন।

হুমায়ূন আহমেদের সেই অপারগতা, আমাদের সবার এই ভুলে থাকারই প্রতিনিধি। এই সিনেমা কি নিষিদ্ধ করা উচিত? দরকার নেই। প্রভাব বিস্তার করার মতো শক্তিশালী কোনো শিল্পকীর্তি এটা না। তবে রুবাইয়াতের দর্শনবিচারে তার হাত থেকে ইতিহাসকে নিরাপদ দূরত্বে রাখাই মঙ্গলজনক। কিন্তু হ্যাঁ, আজ রুবাইয়াত পারেন নি, কাল অন্য কেউ হয়ত পারবেন।

ভবিষ্যতে কেউ হয়ত বেশ মুন্সিয়ানার সাথেই ইতিহাসের বিকৃতি ঘটাবে। সে হিসেবে মেহেরজান নিয়ে আরেকবার ভাবনার দরকার আছে। যিনি থিসিস করেছেন “বীরাঙ্গনা” নিয়ে, তার বানানো ছবির মূল চরিত্র প্রেমে পড়েন এক পাকিস্তানি সেনার। তার থিসিসের সেই দুই লাখ বা চার লাখ বীরাঙ্গনা কোথায় গেল, যারা দিনের পর দিন অকথ্য নির্যাতন সহ্য করেছেন? তিনি বলেছেন, তার উদ্দেশ্য যুদ্ধে নারীর অভিজ্ঞতা তুলে আনা, নারীর চোখে যুদ্ধ কে দেখা। এবং তা করতে গিয়ে, নারীর যে টিপিক্যাল রূপ আমরা দেখে থাকি সবসময়, রাজনীতি-বিমুখ, দর্শন-বিমুখ, গোলাপি জামাকাপড় পরা, আলগা রোমান্টিকতায় ভাসতে থাকা নারী, তারই চূড়ান্ত রিপ্রেজেন্টেশন “মেহের” চরিত্রটি।

যে বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে ডায়রির সাথে ন্যাকামি করে, দেশে কেন যুদ্ধ হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধ কেন সে সময়ের দাবী ছিল, এসব কোনকিছুই তার জানার বা বোঝার আগ্রহ নেই, বরং বারবার বলে চলে, যুদ্ধ তার পছন্দ নয়। বামপন্থী রাজনীতি কী ও কেন, কেন মস্কোপন্থী আর চীনপন্থীর বিভাজন এসব নিয়েও তার কোন আগ্রহ নেই। “মেহের” চরিত্রটি একজন সংবেদনশীল মানুষ হিসেবেও ব্যর্থ। তার বোন “নীলা” র পাকিস্তানি ক্যাম্পের অসহনীয় অভিজ্ঞতা নিজের চোখের সামনে দেখেও ওয়াসিম কে নিয়ে ফ্যান্টাসি করতে তার বাধে না। ধরে নিলাম, যুদ্ধ মেহেরের পছন্দ নয়, কিন্তু মেহেরের কোনও ফ্যান্টাসিতে কি “স্বাধীন দেশ” দেখেছি আমরা? লাল-সবুজ পতাকা উড়ছে, হাজার হাজার মুক্ত মানুষ রাস্তায় নেমে উল্লাস করছেন, তেমন কোন ফ্যান্টাসি কি দেখেছি মেহেরের ভাবনায়? না, লাল-সবুজ পতাকা নয়, দেখেছি পাকসেনার সাথে জলকেলি।

"শান্তি"র তরিকা হিসেবে “মুক্ত স্বদেশ” ভাবনা কেন আসেনা মেহেরের ভাবা কল্পদৃশ্যে? Even though I wanted to highlight the Birangonas, the violence of rape, and the indifference towards female experiences of war, I strongly felt that the film had to end on a positive note. I wanted my film to heal the wounds of 1971." [2] পরিচালকের বলা শেষ লাইনটিই পুরো সিনেমার মূল উদ্দেশ্য বলে মনে হয়। বাংলাদেশ যখন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন বিগ বাজেট, বিগ কাস্টের এবং “হৃদয়ে বাংলাদেশ” ট্যাগিং পেছনে নিয়ে মুক্তি পাওয়া এই ছবি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে হয়। পুরো সিনেমায় পজিটিভ পুরুষ চরিত্র দুটিঃ একজন মুসলিম লীগার শান্তিপ্রিয় নানাজান এবং পাকিস্তানি সেনা। বাংলাদেশে ভালো সিনেমার আকালে, ভালো সিনেমাটোগ্রাফি, সুন্দরী নায়িকা, জয়া বচ্চন, মিডিয়ার প্রবল মার্কেটিং ইত্যাদি কারণে মানুষ হলে যাবে, সিনেমাটি দেখবে, এবং বাড়ি ফিরবে নানাজান এবং পাকসেনার জন্য সহানুভূতি মাথায় নিয়ে। সিনেমা দেখে এটাও মনে হতে পারে এই ফাউল মুক্তিযুদ্ধটার জন্যই মেহের-ওয়াসিমের "অমর প্রেম" পরিপূর্ণতা পেল না।

যুদ্ধাপরাধীর বিচারের সময় যখন আরো এগিয়ে আসবে, তখন “শান্তি”, “ক্ষমা” এসব শব্দ বিনা প্রতিরোধে মাথায় জায়গা করে নেবে আস্তে আস্তে। মহৎ হয়ে “heal the wounds” করতে চাই না আমরা। বিচার চাই, শাস্তি চাই। বর্জন করুন মেহেরজান। যুদ্ধাপরাধী প্রসঙ্গ এই ব্যাপারে অতি অবশ্যই একটি প্রাসঙ্গিক বিষয়।

মেহেরজান যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে সফট কর্নার সৃষ্টির উদ্যোগ। একটা যুদ্ধে অনেক রকম ঘটনা থাকে। তারপরও মূল ঘটনা একটাই। ২য় বিশ্বযুদ্ধ মানেই যেমন ইহুদীদের নির্মুল করা। বসনিয়ার যুদ্ধ মানেই বসনিয়ান মুসলিমদের নির্মূল করা।

নিশ্চয়ই জার্মান বা সার্ব (বসনিয়া যুদ্ধে) সৈন্যদের মধ্যে ২/৪ জন ভালো মানুষ ছিলো। ২য় বিশ্বযুদ্ধে ভালো নাজী সৈন‌্য নিয়ে কি হলিউডে (ফ্রান্স/ইংল্যান্ড/রাশিয়াও পড়তে পারেন) মুভি করা যায়? পাকিস্তানে কি ভারত/পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভালো ভারতীয় সৈন্য দেখায় মুভি বানানো যায়? আরব দেশে ভালো ইসরাইলী সৈনিক নিয়ে মুভি? শুধু বাংলাদেশ, শুধু বাংলাদেশেই এসব সম্ভব। ক্ষমা করবেন, কিছু কিছু ব্যাপারে বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী নই। ওয়াসিম আকরামের ইয়র্কার দেখে তালি দিতে পারি, ৭১ সালে মহান পাকি সৈন্য নিয়া সিনেমা বানানোর রাইট কাউকে দিতে চাইনা। এই সিনেমা হৈলো পাকি রেসিপিতে বলিউডি মশলায় বানানো কুখাদ্য যেটা ডাস্টবিন ছাড়া আর কোথাও রাখা উচিত না।

সিনেমা একটি অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম, এর ভুল ব্যবহার বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহারের জবাবদিহিতা পরিচালক বা চিত্রনাট্যকারের করতেই হবে, বিশেষ করে যখন একটি দেশের মুক্তিযুদ্ধ তার বিষয় হয়, সেটা নিয়ে ফাজলামি করা ঠিক না। পরিচালক বলেন নি এটা একটি যে কোন প্রেমের গল্প, বরং বলেছেন, এটা একাত্তরের প্রেক্ষাপটে একটি প্রেমের গল্প, এখন সেই "প্রেক্ষাপট" নির্মাণ যখন ভুল এবং অবাস্তব হয়, তার সমালোচনা আমরা করবোই। এই সিনেমাকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য এক পাকিস্তানী অভিনেতাকে ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু সে পাকিস্তানী হানাদার নয়, পাকিস্তানী রেপিস্ট নয়, পাকিস্তানী আর্সনিস্ট নয়, পাকিস্তানী শিশুহত্যাকারী নয়, সে পাকিস্তানী প্রেমিক। একই সাথে কাহিনীর আঁশটে গন্ধ ঢাকার জন্যই কি বলিউডের জয়া বচ্চন আর টালিগঞ্জের ভিক্টর ব্যানার্জিকে আনা হলো? নাকি এটা সিনেমাকে "জাতে" তোলার সস্তা স্টান্ট? আমাদের সিনেমাগুলিকে কি এখন থেকে ভারত-পাকিস্তানের অভিনেতাদের গুঁজে দিয়ে এক পরোক্ষ ছাড়পত্র নিতে হবে?মুক্তিযুদ্ধ নিয়া সিনেমা বা নাটক বানানোর জন্য কোনো গল্প লেখার প্রয়োজন তো নাই... লাখ লাখ সত্য ঘটনা আছে যেগুলার প্রত্যেকটারে নিয়াই অসাধারণ সব সিনেমা বানানো সম্ভব। তবু যারাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়া সিনেমা বানায় তারা কেন কষ্ট করে রূপকথা লেখে বুঝি না...।

এইসব ইতিহাস বিকৃত সিনেমার বিরুদ্ধে জোড়ালো অবস্থান নিতে হবে। নাইলে তারা ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে এক করে ফেলবে অচিরেই...। হায়রে সেন্সরবোর্ড!! মুক্তিযুদ্ধকে বলা হচ্ছে এমন একটি "যুদ্ধ" যা কিনা খাঁটি(জেনুইনলি!!!) প্রেমকে পরিপূর্নতা পেতে দিলনা? সেন্সরবোর্ডের কর্তারা কি শুধু মেয়েদের বিকিনি পড়া দৃশ্যকেই আপত্তিকর মনে করেন?প্রেম সত্য, প্রেম মহান। প্রেমের কাছে কিসের মুক্তিযুদ্ধ কিসের কি?সঙ্গমসুখ বিশেষত পাকিসঙ্গমসুখের সাথে বোধ হয় আর কোনকিছুই তুলনীয় নয়। তবে একটা জাতির কখনোই সেন্সরবোর্ড নির্ভর হয়ে ওঠা উচিত না।

সেন্সর জিনিসটা বাচ্চাপোলাপাইনের দরকার, প্রাপ্তবয়স্কের না। সেন্সরে খারাপ কথা আটকাইয়া দিলে সাময়িক জয়লাভ আর শক্তিপ্রয়োগের সুখ পাওয়া যায়। কিন্তু প্রতিটা সেন্সরশিপ প্রতিপক্ষকে প্রত্যয় আর সংগঠনে শক্তিশালী করে। খারাপ জিনিসকে যুক্তি দিয়ে মোকাবিলা করার যে চর্চা, সেন্সরশিপ সেটাকে ব্যাহত করে। আপনার এই লেখাটা একটা সেন্সরবোর্ডের চেয়ে শতগুণ ক্ষমতাশালী আর কার্যকর, এই আস্হা রাখেন।

শক্তি নয়, যুক্তিকে সহায় করে যারা চলতে শেখে, তাদের বিনাশ নাই। সুনীল তার উপন্যাসের নারীচরিত্রকে এক বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধা তরুনের যৌনআকাঙ্খা থেকে কৌশলে বাঁচিয়ে দেন এই বলে যে, "শুধু জড়াজড়ি হয়েছে"; সেখানে আমরা অবলীলাক্রমে আমাদের নারীকে পাকিস্তানী সৈনিকের আকাঙ্খারা কাছে সোপর্দ করে দেই। আমি ছবিটা যদিও দেখিনি তবুও অনিন্দ্যর রিভিউ থেকে যা বুঝলাম তা হলো এই ছবিটাতে আমাদের মেয়েদের পাকিস্তানীদের ভোগ্যপণ্যে উপস্থাপিত করা হয়েছে। পাকিস্তানী সৈনিকের ইশ্‌কে মাতওয়ারা তরুনী মেহেরজান অথবা হাই ড্রাইভে থাকা খাজা সাহেবের মেয়ে, "আব্বা, আমাকে সৈনিক এনে দেন"। একটু ঠাট্টা করেই বলি, এই ছবিতে বাংলার নারীজাতির চরম অবমাননার সাথে সাথে বাংলার পুরুষদের রোমান্টিকতার অযোগ্যতা, পুরুষত্বের ঘাটতি, এগুলোর ইঙ্গিতও কি একটুখানি পাওয়া যায়নি? যেহেতু আমি একজন পুরুষ, তাই একজন নারীর কাছে পাকিসঙ্গমের কি মজা তা আমি জানিনা।

যে পাকিসঙ্গম করেছে সে'ই ভালো বলতে পারবে। তবে পাকিসঙ্গম করতে চাইলে আমাদের তো আপত্তি থাকা উচিত না যদি যার খাউজ সে নিজেই নিরবে নিভৃতে নিবারণ করতে পারে। আমাদের আপত্তির জায়গাটা এইখানে যখন গোষ্ঠিবিশেষ তাদের পাকিসঙ্গমের অর্গাজম বাংলার মায়েদের-মেয়েদের উপর ফিসাবিলিল্লাহ্‌ বিতরন করার অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।