আয়োজন করে ভ্রমণে গেলে সেটা অনেকটা শিক্ষাসফরের মতো হয়ে যায়। অনেকদিন আগে থেকে প্রস্তুতির মধ্যে থাকলে এক ধরণের শিথিলতা চলে আসে। যতবার ভ্রমণ সংক্রান্ত আলোচনা হয় ততবারই এটা করা যাবেনা, ওটা করা যাবেনা টাইপ শেকলে আটকে যায় ভ্রমণটা। বিধিনিষেধের বেড়াজালে উদার মনের ভ্রমণ ক্রমাগত সংকুচিত হতে থাকে।
আমার কাছে ভ্রমণ মানে, ধর তক্তা মারো পেরেক টাইপ।
তার মানে যে বিচার বিবেচনা থাকতে পারবেনা তা না। কিন্তু সেটা খুবই সীমিত আলোচনার ভেতরে হতে হবে।
তেমনি একটা ধর তক্তা মারো পেরেক মানে হুটহাট টাইপ ভ্রমণ হলো আমাদের সিলেট তথা লাউয়াছড়ার ভ্রমণ।
দুই ছোট ভাই সাংবাদিক লুৎফর রহমান কাকন এবং মার্চেণ্ডইজার জোবায়ের রিংকুর সাথে দিনভর আড্ডার শেষ প্রান্তে এসে কী এক বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে ঠিক করা হলো সিলেট যাবো।
কবে?
পরদিনই।
একজন রাজী হলে আরেকজন দমে যায়। আবার অন্যজন যাবার ব্যাপারে হাত মেলালে অন্যজন হাত সরিয়ে অজুহাত নিয়ে আসে। মোট কথা পাঁচবছর পর পর নির্বাচনের আগে ত্বত্তাবধায়ক সরকারের প্রধান বানানো নিয়ে যতটুকু অনিশ্চয়তা দেখা দেয় তার চেয়ে বেশি অনিশ্চয়তার ভেতরে থেকে একটা সময় সিদ্ধান্ত চলে আসে, আমরা যাচ্ছি।
২.
সময়ের ব্যাপারে চিরকালই আমি এত বেশি সচেতন যে সচেতনতার দিকে নজর দিতে দিতে আর সময়ের দিকে নজর দেয়া হয়ে ওঠেনা। ফলে স্বাভাবিক নিয়মে আমি কিছুটা দেরি করে ফেলি।
যা অনেকের কাছে অনেক বেশি দেরী মনে হয়। রাত নয়টায় আমাদের একসাথে হবার কথা থাকলেও মার্চেণ্ডাইজার রিংকু সাতটা থেকে উপস্থিত। বোঝা গেল বিদেশী বায়ারদের সাথে থাকতে থাকতে তার এই সময়জ্ঞানের উন্নতি। দুই ঘন্টা আগেই উপস্থিত।
সাংবাদিক কাকন সাড়ে নয়টার দিকে এসে ঠিক নয়টায় আসার জোরালো দাবীতে প্রকম্পিত করছিল আকাশ বাতাস, মোবাইলের নেটওয়ার্ক এবং উপস্থিত অনেকের কান।
আর এসবে যাতে কান দিতে না হয় তাই আমি উপস্থিত হলাম সোয়া এগারোটায়।
আসার পর কোথায় একটু তারা শুভেচ্ছা জানাবে তা না করে তিরস্কারের ঝড় শুরু করে দিল, আর এসে কী করবেন? এখন গিয়ে কোন লাভ নেই। বাস পাবোনা। বাদ দেন যাবোনা। যাত্রাবাড়ী পার হতেই দুই ঘন্টা লাগবে...।
আরো অনেক কথা।
আমি সকল কিছুকেই তুচ্ছ করে একগুচ্ছ আধ্যাত্মিক কথা ঝেড়ে বললাম, মিয়া আমার সাথে আসছো, চিন্তা আমার। তোমরা খালি দেখানো পথ ধরে হাটবা। এই সময়ে গিয়েও বাস পাবো। যাত্রাবাড়ির জ্যামও আমাদের আটকাতে পারবেনা।
উপরে বড় বড় কথা বললেও ভেতরে ভেতরে আত্মা শুকিয়ে আসছিল। আল্লাহকে ডাকছিলাম, আল্লাহ মানির মান তোমার হাতে। আমারে বাঁচাও।
আল্লাহ আমাকে বাঁচালো। ৪৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা পৌছে গেলাম মালিবাগস্থ বাস কাউন্টারে।
গিয়েই আমরা বাসের দিকে মন না দিয়ে ব্যাপক মনোযোগীতার সাথে আড্ডায় ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম।
এর মাঝখান দিয়ে কখন যে ড্রাইভার মহোদয় আমাদের বাস নিয়ে কাউন্টার ত্যাগ করল তা আমাদের অজানাই রয়ে গেল। টের পেলাম যখন ধীরে ধীরে কাউন্টার খালি হয়ে গেল।
কাকন ভীতু চেহারা নিয়ে প্রশ্ন করলো ভাই, কাহিনী কি? বাস কী চইলা গেছে নাকি?
আমি তার আশংকা নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধানের মতো উড়িয়ে দিয়ে বললাম, আরে না মিয়া আমি আছিনা। আমার সাথে আসছো, চিন্তা আমার।
তোমরা খালি দেখানো পথ ধরে হাটবা।
তারপরও নিশ্চিন্ত হতে পারলো না রিংকু। সে উঠে গিয়ে কাউন্টারে কথা বলল। আমরা দূর থেকে তার ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া চেহারা দেখে দৌড়ে গেলাম। গিয়ে যা শুনলাম তারপর দেখলাম কাকনের চেহারাও ফ্যাকাশে হয়ে গেল।
আমারটা হয়েছে কিনা তা আশেপাশে কোনও আয়না না থাকায় বুঝতে পারলামনা।
গাড়ী আমাদের চোখের সামনে একদল যাত্রী নিয়ে দশ মিনিট আগে চলে গেছে। চোখে অন্ধকার দেখা সেই সময় কিছুটা আলোর সন্ধান দিলেন কাউন্টারে বসা প্রধান কর্মকর্তা। তিনি মালিবাগ থেকে আমারবাগে ফোন দিলেন। বাসটাকে একটু রাখতে।
আর আমাদের বললেন, দশ মিনিটের মধ্যে আরামবাগ চলে যান।
আমরা দৌড়ে কাউন্টার থেকে বের হয়ে আরাম করে বাসে সিলেট যাবার স্বপ্ন নিয়ে আরামবাগের পথে সিএনজিতে উঠলাম।
সিএনজিতে উঠেই নিজের আধ্যাত্মিকতা ঝাড়া শুরু করলাম, আমার সাথে যখন এসেছ...
কথা শেষ না হতেই সিএনজি চালকের গতি সূত্রে আমরা আরামবাগ এসে পড়লাম। বাস দেখেই আমাদের আত্মা নামক বায়বীয় স্থানটায় পুনরায় তরল পানি প্রবাহ শুরু হল।
(চলবে)
ছবি : ১. মাজার গেইট
২. শ্রীমঙ্গল রোড
৩. চা বাগান
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।