আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছন্নছাড়া কবি চার্লস বুকোওয়স্কি

We Are For All !

আমৃত্যু হৃদয়ে এক নীল পাখি ধারণ করে গিয়েছিলেন কবি। তার দর্শন তার, তার মননের সাথে একমাত্র আমাদের দেশে লালনেরই মিল খুঁজে পাওয়া যায়। যার কথা বলছি তিনি একজন মার্কিন কবি। ছন্নছাড়া এক মার্কিন কবি। আপনি বলতেই পারেন, যে কবি মাত্রই একটু খেয়ালি হয়, ছন্নছাড়া আবার কি? কিন্তু যিনি বলেন, যারা কখনোই উম্মননা হননা, তারা জানেন না কি ভয়ংকর জীবন তারা যাপন করছেন(সাম পিপল নেভার গো ক্রেজি, হোয়াট ট্রুলি হরিবল লাইভস দে মাস্ট লিভ)।

আর এই ব্যতিক্রমি চিন্তার কারণেই তিনি ছন্নছাড়া। বুকোওয়স্কির মা জার্মান। বাবা অবশ্য আমেরিকান। বুকোওয়স্কির জন্ম জার্মানিতে। ৩ বছর বয়েসে অবশ্য পরিবারটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসে।

প্রথমে বাল্টিমোর ম্যারিল্যান্ডে বসবাস করতে থাকে; পরে চলে আসে লস এঞ্জেলেস। বুকোওয়স্কির বাবার প্রায়শ চাকরি থাকত না। খুব মেজাজি ছিলেন ভদ্রলোক, ভীষণ রাগারাগি করতেন। বুকোওয়স্কির লেখা উপন্যাসে এসব তিক্ত অভিজ্ঞতা উঠে এসেছে। বুকোওয়স্কির শৈশব সুখকর ছিল না।

পাড়ার ছেলেপুলেরা ওকে ‘জার্মান’, ‘জার্মান’ বলে ক্ষেপাত। চর্মরোগ হয়েছিল হাইস্কুলে পড়ার সময়। ঘরে বন্দি থাকতে হত। এভাবেই স্কুল ও কলেজের গন্ডি পেরোয় কিশোর। বুকোওয়স্কির শহর মার্কিন দেশের লস এঞ্জেলেস।

সে শহরের মানুষজনের জীবনস্পন্দন ফুটে উঠেছে বুকোওয়স্কির লেখা গল্প, কবিতা ও উপন্যাসে; অবশ্য ধনাঢ্য ও সুখি মার্কিন জনগণের জীবন নয়, সমস্যাগ্রস্থ দরিদ্র মানুষের জীবনই বুকোওয়স্কির লেখায় খুঁজে পাওয়া যায়। কোণঠাসা লোকজনের প্রতি কেমন এক কবিসুলভ সহৃদয় প্রীতি ছিল বুকোওয়াস্কির। মনের এক রহস্যময় দিক রয়েছে। সে রহস্যময় মনের বোঝাপোড়ায় বাংলার বাউল লালন ও মার্কিন মুলুকের কবি বুকোওয়স্কি অভিন্ন। লালন লিখেছেন- কে কথা কয় রে দেখা দেয় না।

নড়েচড়ে হাতের কাছে খুঁজলে জনম-ভর মেলো না। আর, বুকোওয়স্কি ‘ব্লুবার্ড’ কবিতায় লিখেছেন, আমার হৃদয়ে আছে এক নীল রঙের পাখি আমায় ছেড়ে যে যেতে চায় চলে কিন্তু পাখিটিকে আমি কঠোর স্বরে বলি : আমার হৃদয়েই থাক তোমায় আমি দেখাব না কাউকে। তরুন বয়েসে (১৯৪০/১৯৪৫) ২য় মহাযুদ্ধে ডামাডোল। তখনকার দিনে মার্কিন তরুণদের যুদ্ধে যাওয়ার জন্য সরকারি খাতায় নাম লেখাতে হত। বুকোওয়স্কির ব্যাপারটা পছন্দ না হওয়ায় সরকারি খাতায় নাম না লিখিয়ে লুকিয়ে থাকল।

এফ বি আই তাকে ধরল। জিজ্ঞাসাবাদের পরে ছেড়ে দিল সতোর দিন পর। এসব বিস্ময়কর বোধ ও ব্যাতিক্রমী উপলব্ধিই হয়তো যুদ্ধে না যাবার জন্য কারণ হিসেবে কাজ করেছে। কী এক অস্থির অসহ্য সময়! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। নিহত হচ্ছে লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষ।

আহ্, যদি সব ভুলে থাকা যেত! মদ ধরল তরুণ কবি। আমৃত্যু মদ হয়ে থাকল সঙ্গী। এবং একজন অসুখি তরুণ বেড়ে উঠতে লাগলো লস এঞ্জেলেস শহরে । ৫০ এর দশক। অ্যান্ড দ্য মুন অ্যান্ড দ্য স্টারস অ্যান্ড দ্য ওয়ার্ল্ড কবিতায় তিনি লিখেছেন: রাত্রিতে অনেকক্ষণ হাঁটা- আত্মার জন্য ভালো: জানালায় উঁকি দিয়ে দেখা ক্লান্ত গৃহিনীদের বিয়ারআসক্ত স্বামীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে ... জীবনে এল বারবারা নামের এক নারী।

নারীটি কবি। দু-পক্ষের বিয়ে হল। তারপর ১৯৫৯ সালে ডিভোর্স। অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়ে ১৯৬০ সালে লস এঞ্জেলেস পোস্ট অফিসে চাকরি নিতে হল। এখানেই কেরানি হিসেবে কাজ করতে হয়েছে পরবর্তী ১২ বছর।

তাই বুকোওয়স্কির প্রথম উপন্যাসের নাম: ‘পোষ্ট অফিস। ’ ১৯৬৬ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় জন মার্টিন নামে একজন সাহিত্যপ্রেমিক ব্ল্যাক স্প্যারো প্রেস নামে একটি প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। সাহিত্য পত্রিকা ছেপে বের করত ব্ল্যাক স্প্যারো প্রেস । বুকোওয়স্কির কিছু লেখা চোখে পড়েছিল জন মার্টিনের। একদিন বুকোওয়স্কিকে ডেকে জন মার্টিন চাকরি ছাড়ার পরামর্শ দিলেন।

বললেন, আপনি কেবল লিখতে থাকুন। জন মার্টিন যে সময় বুকোওয়স্কির লেখা ছাপানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেসময় বুকোওয়স্কির তেমন নামডাক হয়নি- কৃতজ্ঞাসরূপ ব্ল্যাক স্প্যারো প্রেসকে প্রচুর লেখা দিয়েছেন বুকোওয়স্কির । অন্য ছোট ছোট প্রকাশনীর স্বাধীনতায় বিশ্বাস করতেন, তাদেরও আমৃত্যু লেখা দিয়েছেন বুকোওয়স্কি। পোষ্টঅফিসের চাকরি ছেড়ে ডুবে রইলেন লেখায়। কবিতা আসলে ব্যতিক্রমী ভাষায় জীবনেরই ব্যাখ্যা।

জীবনের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জীবন হয়ে উঠল উদ্দাম যেমন, মহত্তম কোনও কিছুর খোঁজে নিরাপদ সোজা রাস্তা ছেড়ে অনিরাপদ অজায়গাতেও যেতে হয়, অনেকটা সেইরকমই। তারপর অভিনেত্রী লিন্ডা লি-র সঙ্গে পরিচয় ১৯৭৬ সালে। ভিন্নধর্মী একটি রেস্তোঁরার মালিক লিন্ডা লি ছিল ভারতীয় গুরু মেহেরবাবার ভক্ত। দীর্ঘদিন টিকে থাকল তাদের ঘনিষ্ট সর্ম্পকটি । এরপর ১৯৮৫ সালে দুপক্ষের বিবাহপর্ব সম্পন্ন হল।

ততদিনে সানপেড্রো ক্যালির্ফোনিয়ায় স্থায়ীভাবে বাস করছেন বুকোওয়স্কি। সমুদ্র তীর ঘেঁষে বাংলো। উত্তাল বাতাস। অফুরন্ত অবসর। লিখে যাচ্ছেন।

কবিতা ছাড়াও ৬টি উপন্যাস ও অজস্র ছোট গল্প লিখেছেন। সে না হয় বোঝা গেল। কিন্তু কবিতা লিখে কী পেলেন ছন্নছাড়া লোকটি? বৌদ্ধদর্শন বাংলার বাউলদের জীবনধারায় সুগভীর প্রভাব রেখেছিলেন। বাউলশ্রেষ্ট হিসেবে লালনকেই গন্য করা হয়। লালনের আখড়াবাড়িটি কুষ্টিয়ার ছেঁউরিয়ায়-সেই আখড়াবাড়িটির আঙিনায় ২০০৩ সালের দিকে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা মার্কেট নির্মানের উদ্যেগ নিলে সংস্কৃতিকর্মীরা তুমুল আন্দোলন করে ব্যবসায়ীদের সেই উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেয়।

বুকোওয়স্কির ক্যালির্ফোনিয়াস্থ বাংলোটিও মার্কিন বহুতল নির্মানকারী ডেভেলাপারদের চোখে পড়েছিল। বহুতল নির্মানের উদ্দেশ্যে ২০০৭ সালে সেটি ভাঙার উদ্যোগ নিলে মার্কিন সংস্কৃতিকর্মীরা তুমুল আন্দোলন করে ব্যবসায়ীদের দুরভিসন্ধি রোধ করে। আমৃত্যু ধারণ করা সেই নীলপাখিটি কাউকে দেখতে দেননি ছন্নছাড়া কবিটি। ১৯৯৪। এক ধরনের রক্তের অসুখ লিউকেমিয়া ধরা পড়ল।

মাত্র ৭৩ বছর বয়েসে ৯ মার্চ নীলপাখিটি উড়ে গেল দেহখাঁচা ছেড়ে । অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় বিধবা স্ত্রী লিন্ডা লি ছাড়াও ক্যালির্ফোনিয়ায় বসবাসরত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সমবেত হয়েছিল। এই হল আমৃত্যু হৃদয়ে নীলপাখি লুকোনো ছন্নছাড়া এক মার্কিন কবি ..

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।