আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রসঙ্গঃ তত্বাবধায়ক সরকারের মারপ্যাচে বিচার বিভাগের দলীয়করণ এবং আরেকটি ১/১১ এর আগমনী বার্তা

সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!!

আমাদের দেশের তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একটি অভিনব ব্যবস্থা। অভিনব বলা হলো এ কারণে যে, এমন সাংবিধানীক তত্বাবধায়ক সরকারের সিস্টেম পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সরকার আইন সভার আস্থা হারালে, পদত্যাগ করলে অথবা মেয়াদ শেষ করলে নতুন আইনসভা গঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত সর্বশেষ সরকার তত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে কাজ করে এবং শুধুমাত্র সরকারের রুটিন কাজগুলো পরিচালনা করেন। সে সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। অর্থ্যাৎ এক্ষেত্রে সর্বশেষ নির্বাচিত সরকারই তত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা পালন করেন।

কিন্তু আমরা ব্যতিক্রম। মেয়াদ শেষ হলে একটি অনির্বাচিত তত্বাবধায়ক সরকার আসেন। নির্বাচন সম্পন্ন করে আবার চলে যান। বাংলাদেশে তত্তাবধায়ক সরকারের পটভূমি সৃষ্টি হয় জেনারেল এরশাদের পতনের পর অস্থাযী রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তখন হয়তো একটি কেয়ারটেকার সরকারের অনিবার্য্যতা ছিল।

সে সরকার কর্তৃক একটি সফল ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করার ফলে দেশের বেশিরভাগ রাজনীতিবিদ ও সম্ভবতো বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও তখন একটি ধারণা জন্মে যে, এদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন করতে নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের কোন বিকল্প নেই। ধারণাটি আরো পোক্ত হয় যখন পরবর্তীতে ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার মাগুরার একটি উপনির্বাচনে কারচুপির মাধ্যমে জয়ী হয়। বিএনপি সরকারের প্রশাসিনক ব্যর্থতা ও জনবিমুখতার কারণে আওয়ামী লীগ নিশ্চিত ছিল যে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন যদি নিরপেক্ষ হয় তবে তাঁরা ক্ষমতায় আসবেন। ঠিক সে কারণে নগদ লাভের আশায় আওয়ামী লীগ নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। জামায়াতে ইসলাম, জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টিও এর সমর্থনে এগিয়ে আসে।

দেশের বেশিরভাগ জনগণও হয়তো তেমনটা চাইছিল। অবশেষে সম্মিলিত আন্দোলনের কাছে নতি স্বীকার করে বিএনপি সাংবিধানীকভাবে নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকার-কে স্বীকৃতি দেয়। পূর্ব ধারণা অনুযায়ী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। অর্থাৎ নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের ফায়দাটা আওয়ামী লীগ নগদেই পেয়ে যায়। কিন্তু এই নগদ লাভের প্রক্রিয়াটা যে পরবর্তীতে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি কতোটা বিপদজনক হতে পারে তা আওয়ামী লীগ কেন আমাদের বুদ্ধিজীবীরাও তখন ভেবে দেখেননি।

আমাদের সংবিধানের ২ক পরিচ্ছেদের ৫৮গ অনুচ্ছেদের ১ থেকে ১২ ধারায় তত্বাবধায়ক সরকারের যে রূপরেখা দেওয়া আছে তাতে দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট কোন ব্যক্তিরই এ সরকারের প্রধান পদটি পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কাজেই তত্বাবধায়ক সরকার সংশ্লিষ্ট পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াগুলো বিচার বিভাগের উপরে পতিত হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। হয়েছেও তাই। তত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার পরই রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্টরা বুঝতে পারলেন যিনি পরবর্তীতে তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হবেন তিনি যদি তাদের দলের প্রতি বিশ্বস্ত হন তবে নির্বাচনে সুবিধা পাওয়া যাবে। বিষয়টা ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী সরকার উপলব্ধি করতে পারলেও তাঁরা বাস্তবায়ন করতে পারেননি বা প্রয়োজন বোধ করেনি।

কিন্তু দলবদলে চ্যাম্পিয়ন বিএনপি সরকারের ২০০১-২০০৬ সালের আইনমন্ত্রী ব্যরিস্টার মওদুদ আহমেদ ঠিকই এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। পছন্দের লোককে প্রধান উপদেষ্টা বানানোর তাগিদে তিনি বিচারকদের বয়স বাড়িয়ে এমন একজন লোককে প্রধান বিচারপতি (পরবর্তী প্রধান উপদেষ্টা) হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন যিনি এক সময়ে বিএনপির রাজনীতির সাথে খুবই ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। বিরোধী দল এতো বোকা নয়। তাঁরা বিষয়টা ঠিকই আঁচ করতে পারল। এরপরের ইতিহাস সবারই জানা।

তত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপি'র গোয়ার্তুমি আর তার ফলে সৃষ্ট ১/১১ দেশের গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার আর ব্যক্তিস্বাধীনতাকে কি পরিমান ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল তা নতুন করে বলার কোন প্রয়োজন নেই। তবে ১/১১ থেকে আমাদের রাজনীতিবিদরা শিক্ষা নিয়েছেন বলে মনে করার কোন কারণ নেই। তাঁরা পুরনো পথেই হাটছেন। সরকার জ্যেষ্ঠতা লংঘন করে একজনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করেছেন। বলাবাহুল্য, তিনিই সম্ভাব্য পরবর্তী প্রধান উপদেষ্টা।

বিরোধী দল বলছে পরবর্তী নির্বাচনে সুবিধা পাওয়ার জন্য দলীয় আনুগত্যের ভিত্তিতে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগটা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। শুধু তাই নয়, বিচারক হিসেবেও এমন লোকদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার যথেষ্ট সুযোগ আছে। বলা হচ্ছে কোনরূপ যোগ্যতা যাচাই না করেই শুধুমাত্র দলীয় বিবেচনায় এদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তির কাছ থেকে ন্যায়বিচার আশা করা যায়না।

দেশের প্রতিথযশা এবং মোটের উপর সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য একজন আইনজীবী যখন জনসমক্ষে বলেন যে, সরকার বদলের সাথে বিচারকদের রায়ও বদলে যায় তখন আমাদের বিচারব্যবস্থা যে প্রশাসনের মতোই দলীয়করণের স্বীকার হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলা অবান্তর। কারো বক্তব্য বা পর্যবেক্ষণ আমলে না নিয়েও বলা যায় আমাদের বিচার ব্যবস্থায় কোথাও সংকট সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্টবিজ্ঞানী বা আইনজীবীরা কি বলবেন জানিনা তবে আমি দ্বিধাহীনচিত্তে বলতে পারি আমাদের বিচার বিভাগের এ সংকটের জন্য দাযী তত্বাবধায়ক সরকার। তত্বাবধায়ক সরকার থেকে অনৈতিক সুবিধা পাওয়ার জন্যই সরকার বিচারকার্যে নিজের পছন্দের লোকদের নিয়োগ দিচ্ছে, বিচার বিভাগ দলীয় অংগ সংগঠনে পরিনত করার চেষ্টা করছে। তত্বাবধায়ক সরকারের চক্র থেকে বিচার বিভাগ-কে আলাদা না করতে পারলে একটা সময়ে সর্বোচ্চ আদালতের প্রতি মানুষের আস্থার কোন অংশই অবশিষ্ট থাকবেনা।

তত্বাবধায়ক সরকার শুধু বিচার বিভাগই নয়, এটা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানীক রূপদানের ক্ষেত্রেও বিরাট বাধা। গণতন্ত্রের মানে শুধু পাঁচ বছর অন্তর অন্তর ভোট দিয়ে কাউকে নির্বাচিত করা নয়। গণতন্ত্র একটি প্রাতিষ্ঠানীক বিষয়। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী ও অর্থবহ করতে হলে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় সরকার আর আইনসভা।

যেহেতু একটি নির্বিঘ্ন ওসুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রধান দায়িত্ব সরাসরি নির্বাচন কমিশনের। সে কারণে সুষ্ঠূ নির্বাচনের স্বার্থে আমাদের রাজনীতিবিদদের প্রধান দায়িত্ব ছিল নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা। কিন্তু তাঁরা তা না করে তত্বাবধায়ক সরকারের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। নির্বাচন কমিশনের দিকে মনোযোগ না দেয়ার কারণে এটি একটি ঠুটো জগন্নাথে পরিনত। কোন কিছু করার ক্ষমতাই এর নেই।

প্রতিটি সরকার তার মেয়াদকালে নির্বাচন কমিশনারদের নিয়োগ দেন। আবার রাজনৈতিক দলের চাপে পড়ে তত্বাবধায়ক সরকার পূর্বের নিয়োগপ্রাপ্তদের সরে যেতে বাধ্য করেন এবং নতুন করে নিয়োগ দেয়। এরফলে নিয়োগপ্রাপ্তরা কখনই স্বাধীন বা নিশ্চিন্তে কাজ করতে পারেন না। রাজনৈতিক সরকারের নিয়োগপ্রাপ্তরা জানেন নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকার আসলে তাদের চলে যেতে হবে। আবার নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নিয়োগপ্রাপ্তরা দলীয় সরকারের পর্যাপ্ত সহায়তা পাননা।

ফলে সংস্থাটি সব সময়ে একটি অস্থির পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চলে। গণতন্ত্র মানে শুধু কেন্দ্রে একটি নির্বাচিত সরকার থাকবে তা নয়, বরং প্রশাসনের সবক্ষেত্রে জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সংবিধানেও সে নির্দেশনা দেয়া আছে। গণতন্ত্রের স্বার্থেই স্থানীয় সরকারগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। স্থানীয় সরকারের মাধ্যমেই জনগণ সরাসরি সরকারের প্রশাসনিক কার্যাদিতে অংশগ্রহণ করে।

তত্বাবধায়ক সরকার শুধু একটি জাতীয় নির্বাচন করে দিয়েই তার দায়িত্ব শেষ করেন। স্থানীয় সব নির্বাচনগুলো এককভাবে নির্বাচন কমিশনকে করতে হয়। কিন্তু কমিশনের শক্তিহীনতা ও সরকারের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতার কারণে নির্বাচন কমিশন কোন সময়েই নির্ধারিত সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো সম্পন্ন করতে পারছেনা। এরফলে আমাদের স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাও অকার্যকর হয়ে পড়ছে। আমাদের আইনসভা অকার্যকর থাকার পিছনেও তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার একটি বড় ভূমিকা রয়েছে।

১৯৯০ সালের পর থেকে আমাদের আইনসভার ইতিহাস যদি আপনি পর্যালোচনা করেন তাহলে দেখবেন বেশিরভাগ সময়ে সংসদ বর্জনের পিছনে বিরোধীদলের দাবি ছিল তত্বাবধায়ক সরকার বা প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে সুনির্দিষ্ট কোন ব্যক্তিকে নিয়োগ না দেয়া। কাজেই বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় সরকার, আইনসভা ও স্থানীয় সরকার শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল করার স্বার্থেই আমাদের তত্বাবধায়ক সরকার নামক এই উদ্ভদ ব্যবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আমরা আর কোন ১/১১ দেখতে চাইনা। রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে নির্বাচন নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠানের দায়িত্বটিও তাঁদের। সরকার ও বিরোধীদলকে পরস্পরের প্রতি অবশ্যই সহানুভতিশীল হতে হবে।

দায়িত্বটা সরকারেরই বেশি। তাঁদের অবশ্যই নমনীয় হতে হবে। এমন কোন আচরণ করা উচিত না যাতে সরকারের উপর থেকে বিরোধী দলের আস্থা চলে যায়। এ আস্থার লক্ষ্যে উপনির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলো সরকারকে সঠিক সময়ে ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে হবে। অপরদিকে বিরোধীদলকেও বুঝতে হবে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষে কোনরকমেই ভোট জালিয়াতি করে নির্বাচন প্রভাবিত করা সম্ভব নয়।

বর্তমানে মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, নির্বাচকমন্ডলী ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এতোটাই সচেতন এবং সংবেদনশীল যে সরকার ইচ্ছা করলেই তা করতে পারবেনা। ভোটকেন্দ্রগুলোতে যদি ভোটারের সরব উপস্থিতি থাকে তাহলে কারো পক্ষেই নির্বাচনে জালিয়াতি করা সম্ভব নয়। সবচেয়ে বড়কথা সারাবিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে যেখানে জাতীয় নির্বাচন রাজনৈতিক সরকারের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেখানে আমাদের পক্ষে তা করতে না পারার কোন যুক্তিসংগত কারণ নেই। পাটটিকাঃ কিছুদিন আগে সম্পন্ন হওয়া চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন রাজনৈতিক সরকারের অধীনেও যে নিরপেক্ষ নির্বাচন হওয়া সম্ভব তার একটি বড় উদাহরণ। সরকার দলীয় একজন হেভিওয়েট প্রার্থী সেখানে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন।

তাছাড়া পরাজিত হতে পারেন এই ভয়ে সরকার ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠানেও আগ্রহী নয়। মোটামোটিভাবে সরকার বুঝে গেছে বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে জালিয়াতির মাধ্যমে নির্বাচনে জয়ী হওয়া সম্ভব নয়। জনগণের রায় নিয়েই জয়ী হতে হবে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।