আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমরা হতবাক হই, বিস্মিত হই, কখনো প্রতিবাদ করি, কখনো করিনা।

------

নারীর প্রতি ভাষিক নিপীড়ন দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। সেই সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে যৌন নিপীড়ন। আমার হাতে এই মূহুর্তে সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই কত জন এমন নির্মোহ অযাচিত বিড়ম্বনায় শিকার হচ্ছেন প্রতিদিন। অথচ অহরহই আমাদের চোখে পড়ে এইসব পরিচিত ঘটনা। আমরা হতবাক হই, বিস্মিত হই, কখনো প্রতিবাদ করি, কখনো করিনা।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে পুরুষের শক্তিশালী অবস্থানের মতই তার ভাষাও শক্তিশালী, পেশল, দৃঢ় ও দম্ভপ্রকাশক। এর কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীর সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান। পুরুষ নারীকে আজ কেবল পেশীশক্তি দিয়ে নির্যাতন করে তা নয়, বরং ভাষাশক্তি দিয়েও নির্যাতন করে। আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে আমাদের সমাজব্যবস্থা এমনই এক পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে যেখানে প্রায় সব বয়সের সব শ্রেণীর পরিচিত অপরিচিত সকল পুরুষই নারীকে ভাষাশক্তি দিয়ে নির্যাতনের ক্ষমতা রাখে। এই যে ভাষিক নিপীড়ন।

ভাষিক নিপীড়নের বিষয়টা আসলে কেমন? একটু লক্ষ করলেই দেখা যায়, বাংলা ভাষায় প্রায় সকল গালিই তৈরী হয়েছে একজন নারীকে কেন্দ্র করে। বেশ্যা, পতিতা, রক্ষিতা, কুটনী, খানকি, মাগী, অসতী, বাইজী, বন্ধ্যা, মাল, চেসিস প্রভৃতি শব্দ তথা গালিসমূহ শুধু নারীর জন্যই প্রযোজ্য যেগুলোর কোন পুরুষবাচক শব্দ নেই। বাংলাদেশে প্রচলিত গালিগুলো খেয়াল করলে দেখা যাবে, তা নারী বা পুরুষ যার উদ্দেশ্যেই নিক্ষিপ্ত হোক না কেন , গালির মাধ্যমে যাকে আক্রমণ করা হয় সে একজন নারী, হতে পারে সে মা, বোন, বা স্ত্রী। কোন পুরুষকেও অপদস্ত করার সবচেয়ে কার্যকরী পথ হচ্ছে তার মা, বোন, কন্যা বা স্ত্রীর সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন বা তাদের সাথে কারও যৌন সম্পর্ক স্থাপনের ইঙ্গিত। ভাষিক নিপীড়নের সাথে আমরা ইদানীং দেখছি কর্মক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন।

Sexual harassment অন্যান্য দেশগুলোর মত বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে এবং আশঙ্কাজনক ভাবে বাড়ছে দিনের পর দিন। মেয়েরা এখন কেবল রাস্তায় নয়, ঝুঁকির সম্মুখীন বাসায়,ক্যাম্পাসে, অফিসে বা যে কোনও জায়গায়। আর তাই এই নীরব অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে সবার। ক'দিন আগে খবরের কাগজে একটা উপ-শিরোনাম দেখে (http://www.bd-pratidin.com/2013/08/12/10095) চোখ আটকে যায় আমার। একটা বেসরকারী কোম্পানীর সর্বোচ্চ কর্মকর্তা ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যক্তিগত সহকারীর সাথে যে মানসিকতার পরিচয় দিয়েছেন।

তা দেখে আমরা বিস্ময় না হয়ে পারিনা। আমরা কোন সমাজে বড় হচ্ছি। আমাদের বিবেক কেন জাগ্রত হয়না। এই সব তথাকথিত ভদ্রলোকদের কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে আমাদের শিক্ষা, সামাজিকতা, অধস্তন করে দিচ্ছে একটা মেয়ের যোগ্যতার মাপকাঠি। কয়েকটা উদাহরন দিলে সহজেই অনুমেয় হবে- (এক) দিলু।

ঢাবি থেকে পাশ করে তার চাকুরি জীবন শুরু করে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে ফিল্ড রিসার্চার হিসেবে। কাজের নিমগ্নতায় ভালোই কাটছিল তার প্রবেশনের দিনগুলি। কর্মস্হল তার চাঁদপুর। পরিবারের সবার মতামত উপেক্ষা করে তাকে ঢাকা ছাড়তে হয়েছিল। আমাদের চারপাশের সামাজিক অস্হিরতা, নিরাপত্তার অভাব..এই বিষয়গুলো প্রতিটি বাবা মাকে ভাবিয়ে তোলে।

তারপরও দিলু তার সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করে। কিন্তু তার সহকর্মীদের অপ্রত্যাশিত আচরনে আর গবেষনার কাজ করা হয়ে উঠলো না। ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। (দুই) জিনাত। গেল বছর তার উচ্চ মাধ্যমিক পরিক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হবার পরপরই ভর্তি হয় ফার্মগেটের গ্রিন রোডে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংএ।

মনে প্রানে সে স্বপ্নে বিভোর ভালো কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার। যে তারুন্যের উদ্যমতা নিয়ে জিনাত তার পড়াশোনা শুরু করেছিল, তা আর হয়ে উঠলো না। তাকে তাড়া করে ফিরে ইভ টিজাররা। উত্যক্ততা আর হুমকির ভয়ে আর ক্লাশে যাওয়া হয়ে উঠেনা। স্বপ্ন গুলো অধরা, ডানাহীন।

এরকম অসংখ্য সমস্যাবহুল জীবনের গল্পের শুরু দেখি প্রতিদিন। আমরা আর এ রকম দেখতে চাইনা। মেয়েয়া যেমন নিরাপদ বোধ করেনা তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, না তার কর্মক্ষেত্রে। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে আমরা স্কুল ও মাদ্রাসাগুলোতে যৌন নিপীড়নের বিভৎস ছবি দেখেছি অনেকবার। আমাদের একটা সামাজিক আন্দোলন এখন একেবারেই জরুরী হয়ে পড়েছে।

একটা সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটের কথা বলি। ঢাকা শহরের বস্তি এলাকায় বসবাসরত যেসব কিশোরী মেয়ে আছে, যার স্কুলগামী। তাদের অনেকের সাথে আমি অনেকবার কথা বলেছি। যারা কিনা বাসা থেকে বের হয়ে স্কুলে যাবার পথটুকুতেও নিরাপদ বোধ করেনা একটি বারের জন্যও। প্রতিনিয়ত তারা ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছে।

আর স্বাভাবিক কারনেই তাদের বাবামা্য়েরা নিরাপদ বোধ করেননা। সেটার ফলাফল দেখছি অসংখ্য বাল্যবিবাহ। আমরা এর পরিবর্তন চাই। আজ- এখন থেকেই। আর যেন এরকম কবিতাও কারো না লিখতে হয়।

। । একটি স্নিগ্ধ ভোরের প্রতিক্ষায়। । (ইভ-টিজিংয়ে উক্তত্যতার শিকার হয়ে আমার ছোটবোন টুনি যখন হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে) আমার বুকের ভেতর গোপন প্রকোষ্টে যে ব্যাথা জমা হয়ে আছে তা নেভাতে গিয়ে দাবানল হয়ে প্রজ্বলিত হয়ে উঠল নিমিষে তা পা থেকে মাথা, আপাদমস্তক আমি শিহরিত হলাম অদ্ভুত এক চৈতন্যতায়।

আমার গভীর ঘুমের আচ্ছন্নতায় দেখতে পেলাম আমার গরিয়সী মায়ের মলিন মুখ, ভাই-বোন, আমার প্রিয়তমা স্ত্রী’র আকুলতা। হাসপাতালের আইসিইউ’র বেডে শুয়ে অবচেতন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা যন্ত্রনাকাতর আমার প্রিয় ছোটবোন টুনির মুখ। কি নিষ্ঠুর অপেক্ষা, কখন জ্ঞান ফিরবে, দারোয়ান থেকে শুরু করে নার্স, ডিউটি ডক্টর, তাদের কাছে কেন যেন কৃপা খুঁজি বারবার। ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন। অনেক শুষ্ক মুখে হাসি ফুটে উঠে, আবার কেউ নিয়ে চলে আপন স্বজনের লাশ।

ক্রন্দন ধ্বনিতে অট্রহাসি হাসে হাসপাতালের দেয়াল। ঘন কাঁচের সীমানা ভেদ করে ঊঁকি মারে আমার মা কখন শুনতে পাবে একটি সুমধুর ডাক, একটি উৎফুল্ল মধুর সময়ের অপেক্ষার আকুপাকু আমাদের প্রতিটি নিউরণ। কতটা নিলর্জ হলে মানুষ এতটা নির্মম হতে পারে, আমার বোনের বাক স্বাধীনতাকে তুচ্ছ করে শুধু হুমকি, খুন, অপহরণ অথবা টাকা দিয়ে বেঁচে থাকার এক নতুন সমীকরন আমার স্বাধীন এই বাংলাদেশে। জ্ঞান ফিরবে বলে বসে থাকা হাসপাতালের সিঁড়ি, বেলকনি অথবা আইসিইউ’র সামনে। কি অদ্ভুত এক অন্তমিল।

হাসপাতালে যারা আছে সবাই আমারি মতো আপনজনের জন্য নিংড়ানো ভালোবাসা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা, জেগে থাকা রাতের পর রাত। কখন ভোর হবে কেউ জানেনা, উকি মেরে দেখি এক অদ্ভুত নিরবতা এক মৃত্যুপুরীর মতো।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।