আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যেখানে সচিবের চেয়ে একজন ড্রাইভার এর বেতন বেশী .. ঢাকা ওয়াসা



কাজ না করেই ওয়াসার তিন হাজার কর্মচারী ওভারটাইমের বিল হিসেবে মাসে কোটি কোটি টাকা তুলে নিচ্ছেন। তারা প্রতি মাসে যে ওভারটাইমের বিল তুলছেন, তা তাদের মোট বেতনের তিন-চার গুণ। এ নিয়ে ওয়াসায় তোলপাড় চলছে। ঢাকা ওয়াসার এই পুকুরচুরির ঘটনা স্বীকার করেছেন প্রতিষ্ঠানটির বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক উত্তম রায়। তবে তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

ঢাকা ওয়াসার উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (অর্থ) সৈয়দ গোলাম আহমেদ বলেন, অনেক দিন ধরেই এ রকম অবস্থা চলে আসছে। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। এটা নিয়ে আলাপও হয়েছে, কিভাবে ভারসাম্য আনা যায়। জানা গেছে, ঢাকা ওয়াসার ৬ নম্বর জোনের পাম্প অপারেটর ইসমাইল হোসেনের মূল বেতন স্কেল ৭ হাজার ৫৭০ টাকা। সাকূল্যে তিনি বেতন পান ১৩ হাজার ৭৬২ টাকা।

এই বেতন ছাড়াও গত জুলাই মাসে তিনি ওভারটাইম পেয়েছেন ৩৪ হাজার ৯৮ টাকা। মোট বেতনের প্রায় তিন গুণ অর্থ পেয়েছেন ওভারটাইম বাবদ। ওভারটাইম ও বেতন মিলে পেয়েছেন ৪৭ হাজার ৮৬০ টাকা। কেবল ইসমাইল হোসেনই নন, তার মতো ঢাকা ওয়াসার ৩ হাজার কর্মচারী বেতনের দ্বিগুণ, তিন গুণ বা চার গুণ অর্থ ওভারটাইম হিসেবে নিয়ে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। অনেক ক্ষেত্রে কোনো কাজ না করেও তারা ওভারটাইম তুলে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ এসব কর্মচারীর প্রতি মাসের ওভারটাইমের পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। কাজ করুক, আর নাই করুক নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ওভারটাইম হিসেবে মাস শেষে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে যাচ্ছে। প্রতি মাসে ওভারটাইম বাবদ ঢাকা ওয়াসার ব্যয় হচ্ছে অন্তত ৫ কোটি টাকা। এ ব্যাপারে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. তাকসিম এ খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান রহমতউল্লাহ জানান, কিছু দিন আগে আমিই বিষয়টি প্রথম বোর্ড মিটিংয়ে তুলি।

এর আগে কেউ এ নিয়ে মাথা ঘামাননি। বোর্ডে তোলার পর একজন অতিরিক্ত সচিব বললেন, আমরা তো কল্পনাই করতে পারিনি ওয়াসায় এভাবে বেতনের তিন-চার গুণ টাকা ওভারটাইম হিসেবে দেওয়া হয়। আরেকজন অতিরিক্ত সচিব বললেন, ওয়াসার পাম্প অপারেটররা তো দেখছি, সচিবের চেয়ে বেশি বেতন পাচ্ছেন। তারা বিস্মিত হলেন। তখন তারা ওয়াসার এমডির কাছে এর ব্যাখ্যা চাইলেন।

এমডি বললেন, দীর্ঘ দিন ধরেই এমনটা চলে আসছে। তখন সিদ্ধান্ত হলো, এই তুঘলকি ওভারটাইম বন্ধ করতে হবে। বছরের পর বছর এটা চলতে পারে না। তখন বলা হলো, এটা বন্ধ করতে হলে শূন্য পদগুলোতে জনবল নিয়োগ দিতে হবে। তখন প্রশ্ন উঠল জনবল নিয়োগ দিতে গেলেই সিবিএ নেতারা বাধা দেন।

তখন সিবিএ নেতাদের সঙ্গে আমি কথা বললাম। তাদের বললাম, এখানে চাকরি যারা পাবেন, তারা তো এ দেশেরই মানুষ। আপনাদের আমাদেরই আত্মীয়। তারা আমার কথায় একমত হলেন। তখন মন্ত্রণালয় বললো, আগে যাই হয়ে থাক, এটা তো বছরের পর বছর চলতে পারে না।

এই অবৈধ ওভারটাইম বন্ধ করতে হবে। কারণ, তারা কাজ না করেও ওভারটাইম নিচ্ছেন বলে অভিযোগও আছে। পরে বোর্ডে ওয়াসার শূন্য পদ পূরণেরও সিদ্ধান্ত হলো। পরে এমডিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ওয়াসা চেয়ারম্যান আরও বলেন, একজন ১১ হাজার টাকার চাকুরে মাসে ৩৩ হাজার টাকা ওভারটাইম নেবেন- এটা হতে পারে না।

বছরের পর বছর এটা চলতে দেওয়া যায় না। এখন এটাকে প্রক্রিয়ার মধ্যে আনতে হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা ওয়াসার একজন সাবেক প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা বলেন, এই ওভারটাইম ঢাকা ওয়াসার ঘাড়ে বিষফোঁড়ার মতো জেঁকে বসেছে। এমনও ঘটনা আছে, প্রতিদিন ডিউটি ৮ ঘণ্টা। কিন্তু ওই দিনই একজনের নামে ১৪ ঘণ্টা ওভারটাইমের বিল যোগ হয়েছে।

এ নিয়ে প্রতিবাদ করতে গেলেই তোপের মুখে পড়তে হতো। হিসাব বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা সুবিধা নিয়ে এ ব্যাপারে চুপ থাকছেন। তিনি আরো জানান, শ্রম আইন অনুযায়ী একজনের ওভারটাইম প্রতিদিন ৬ ঘণ্টার বেশি হতে পারে না। এছাড়া প্রতি ঘণ্টায় মূল বেতন স্কেলের আট ভাগের দেড়গুণ অর্থ ওভারটাইম হিসেবে একজন কর্মচারী পেতে পারেন। অথচ ওয়াসায় এ নিয়ম মানা হয় না।

ওভারটাইমের ক্ষেত্রে দ্বিগুণ অর্থ নির্ধারণ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ফলে একজন কর্মচারীর দৈনিক কর্মঘণ্টার চেয়ে ওভারটাইমই বেশি হয়। ঢাকা ওয়াসার এক কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা ওয়াসায় বর্তমানে প্রায় ২ হাজার শূন্য পদ রয়েছে। এসব শূন্য পদের বিপরীতে বিভিন্ন সময়ে লোক নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। যখনই উদ্যোগ নেয়, তখনই সিবিএ নেতারা প্রশাসনকে জিম্মি করে ফেলেন।

ওয়াসা কর্তৃপক্ষ আর লোক নিয়োগ দিতে পারে না। আর শূন্য পদের বিপরীতে ওভারটাইম বাণিজ্য করে নেন কর্মচারীরা। এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসা শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়নের (সিবিএ) সভাপতি মোঃ হাফিজউদ্দিন বলেন, মনে করেন, একটি পাম্পের জন্য তিনজন পাম্প অপারেটর প্রয়োজন। ওয়াসার আছে একজন। তার ডিউটি আট ঘণ্টা।

তারপর পাম্পে থাকবেন কে? এখন বাকি ১৬ ঘন্টা যদি তাকেই থাকতে হয়, তাহলে তো তাকে বাড়তি ১৬ ঘণ্টার ওভারটাইম দিতে হবে। আর ওয়াসার সঙ্গে আমাদের সিবিএর একটি চুক্তি আছে, ডিউটির দ্বিগুণ অর্থ ওভারটাইম হিসেবে দেওয়ার। এ জন্যই শ্রমিকরা বেতনের চেয়ে কয়েক গুণ অর্থ ওভারটাইম হিসেবে পান। গাড়িচালকদের ক্ষেত্রেও এমনটা হতে পারে। কোনো অফিসার যদি অতিরিক্ত সময় ডিউটি করেন, তাহলে তার গাড়িচালককেও থাকতে হয়।

কাজেই গাড়িচালক বা অফিস সহকারীও বেতনের চেয়ে বেশি ওভারটাইম পেতে পারেন। আমরা শ্রমিক রাজনীতি করি। আমাদেরকে শ্রমিকদের স্বার্থই দেখতে হবে। আমি তো চাই, শ্রমিকরা আরো বেশি বেতন পাক। ঢাকা ওয়াসার আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঢাকা ওয়াসায় কাজ নাই, মজুরি নাই (কানামনা) ভিত্তিতে সাড়ে তিনশ’র মতো কর্মচারী আছেন।

এসব কর্মচারীর কোনো ওভারটাইম দেওয়া হয়নি। তারা চাকরি স্থায়ী করার জন্য অনেকে চেষ্টা-তদবির করছেন। কিন্তু ওয়াসা কর্তৃপক্ষ উল্টো তাদের চাকরি থেকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কারণ, স্থায়ী লোক নিয়োগ দিলে স্থায়ী কর্মচারীদের ওভারটাইম সঙ্কুচিত হতে পারে। বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের ওয়াসা শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতায় আসার আগে প্রতি ঘরে একজন নারী/পুরুষকে চাকরি দেওয়ার ওয়াদা দিয়েছিলেন।

এই ওভারটাইম বাণিজ্যের কারণে কিছুটা হলেও প্রধানমন্ত্রীর ওয়াদা বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অন্যদিকে যাদের নামে ওভারটাইমের বিল হচ্ছে, তাদের কাউকেই বিকেল ৫টার পর কর্মস্থলে পাওয়া যায় না। কিন্তু মাস শেষে দেখা যায়, সকাল ৯টায় অফিস শুরুর আগে দুই ঘন্টা ওভারটাইম ও অফিস শেষ হওয়ার পর পাঁচ ঘণ্টা ওভারটাইমের বিল তার নামে যোগ হয়েছে। আরেক কর্মকর্তা বলেন, গত আট-দশ মাস হলো প্রত্যেক কর্মচারীর ওভারটাইমের বিল ফিক্সড করে দিয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। যে যাই ওভারটাইম করুক না কেন, প্রত্যেক বিভাগীয় প্রধান প্রতি মাসে ওই পরিমাণ সময়ের ওভারটাইম লিখে দেন।

এই ওভারটাইমের পেছনে ঢাকা ওয়াসার প্রতি মাসে ব্যয় হচ্ছে অন্তত ৫ কোটি টাকা। তিনি জানান, একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা বেতন পাচ্ছেন ২৫ হাজার টাকা। তার ওভারটাইমের কোনো বিল হয় না। অথচ ওভারটাইম ও বেতন মিলিয়ে তার ড্রাইভার পান ৬০ হাজার টাকা। এতে অফিস শৃঙ্খলা রক্ষা করাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে।

আর কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষের তৈরি হয়েছে। গত কয়েক মাসের কর্মচারীদের মাসিক বেতন ও ওভারটাইমের নথি থেকে দেখা গেছে, মোঃ আলী নামের একজন গাড়িচালকের মূল বেতন স্কেল ১১ হাজার ৫৫৫ টাকা। সর্বসাকূল্যে তিনি বেতন পান ১৯ হাজার ২৮০ টাকা। অথচ এ মাসগুলোতে তিনি ওভারটাইম পেয়েছেন ৩৯ হাজার ৪৩৬ টাকা। বেতন ও ওভারটাইমসহ প্রতি মাসে তিনি তুলেছেন ৫৮ হাজার ৭১৬ টাকা।

আলমগীর হোসেন মোল্লা নামের একজন ফোরম্যানের বর্তমান বেতন স্কেল ১৩ হাজার ১১০ টাকা। মোট বেতন ১৯ হাজার ১৩০ টাকা। অথচ ওভারটাইম পাচ্ছেন ৩৭ হাজার ৯০০ টাকা। একইভাবে দেখা গেছে, গাড়িচালক মণ্ডল মিয়ার সর্বমোট বেতন ১৯ হাজার ১৩০ টাকা। অথচ তিনি ওভারটাইম পাচ্ছেন ৩৭ হাজার ৯০০ টাকা।

পাম্প অপারেটর মোঃ হারুনের বেতন ১৬ হাজার ৭২১ টাকা। ওভারটাইম পাচ্ছেন ২৯ হাজার ৪৮৭ টাকা। ফোরম্যান মজিবুর রহমানের বেতন ২১ হাজার ৫৪৫ টাকা। ওভারটাইম পাচ্ছেন ৩৫ হাজার ২৫১ টাকা। পাম্প অপারেটর আলী আহমেদ ভূঁইয়ার বেতন ১৬ হাজার ১১৩ টাকা।

ওভারটাইম পাচ্ছেন ৩৩ হাজার ২৯৫ টাকা। অন্য কর্মচারীদেরও ওভারটাইম পাওয়ার চিত্র একই রকমView this link

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.