আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানবতার ভিন্নপক্ষ



গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মানবতার ভিন্নপক্ষ ফকির ইলিয়াস ======================================== নাটোরে একজন শিক্ষককে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। অধ্যাপক মিজানুর রহমান। তিনি ইভটিজিংয়ের প্রতিবাদ করেছিলেন। রসায়ন বিভাগের এ অধ্যাপক তার ক্লাসের ছাত্রীদের উত্ত্যক্ত করার জন্য বখাটেদের শাসিয়েছিলেন। পরে দু'জন পাষন্ড অধ্যাপকের ওপর দিয়ে মোটরসাইকেল তুলে দেয়।

তিনি মারাত্মকভাবে জখম হন। ১২ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে অতিসম্প্রতি হাসপাতালে মারা গেছেন তিনি। গোটা জাতির জন্য এটি একটি চরম দুঃখজনক সংবাদ। দেশ কোথায় চলেছে? প্রগতির চাকা কোন দিকে ঘুরছে বাংলাদেশে? এ কেমন আদিমতা, বর্বরতার দিকে ধাবিত হচ্ছে সমাজ। একটি রাষ্ট্রে একজন ছাত্রী তার শিক্ষাঙ্গনে গিয়ে সুষ্ঠুভাবে পড়াশোনা করতে পারবে না, তা কি কোন সমাজ মেনে নিতে পারে? বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি তা মানছে কী করে? ইভটিজিং বাংলাদেশে একটি প্রকট সমস্যা।

গেল কয়েক মাসে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এমন ন্যক্কারজনক ঘটনা অনেক ঘটেছে। কিন্তু গ্রেফতার, বিচার কিংবা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোন ঘটনা রাষ্ট্রের জনগণকে আশ্বস্ত করেনি। বরং প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে। তারপরও রাষ্ট্রপক্ষ নির্বিকার ভূমিকা পালন করছে। অথচ এ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে সম্মানিত কয়েকজন নারী ক্ষমতাসীন আছেন।

অথচ সেই রাষ্ট্রেই প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন এলাকায় বখাটেদের হীন মানসিকতা আর বিকারগ্রস্ততার শিকার হচ্ছেন নারী সমাজ। ইভটিজিং প্রতিরোধে সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে দেশে সেমিনার হচ্ছে। টিভিতে অনুষ্ঠান হচ্ছে। কলাম লেখা হচ্ছে। তারপরও পাষ-রা তাদের বিবেক, বুদ্ধি জাগ্রত করছে না।

এটি খুবই পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশের মানুষ মোবাইল ফোন প্রজন্মের দাবিদার হলেও এ মোবাইল ফোনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের প্রয়াসী হয়ে তাক করছে অন্য মানুষের ওপর। বখাটেদের উৎপাত প্রাচীন যুগে যে ছিল না, তেমন নয়। কিন্তু তা হালে নতুন মাত্রা পেয়ে আরও জঘন্য রূপ ধারণ করেছে। তাই বাংলাদেশে এ অপরাধ দমনে বিশেষ আইন প্রণয়ন করা খুবই ন্যায্য দাবি। তা না করতে পারলে মানবতাই শুধু বিপর্যস্ত হবে না, এ প্রজন্ম যুগ যুগ কুসংস্কারের আঁধারেই ডুবে থাকবে।

দুই. নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ভূমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ হয়েছে। সরকারি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে এলাকাবাসী। তারা সেনাক্যাম্পের ওপরও আক্রমণ করেছে। সরকার সেনাবাহিনীর আবাসন প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ করছিল। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট হওয়া দরকার, রাষ্ট্রপক্ষ কোন যৌক্তিক কারণে ভূমি অধিগ্রহণ করতে হলে প্রকৃত মালিককে উপযুক্ত মূল্য দেয়া অথবা অন্যত্র স্থানান্তরিত করার রেওয়াজ রয়েছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, রূপগঞ্জ এলাকাবাসীর সঙ্গে সরকার কি মর্যাদাসম্পন্ন আচরণ করেছে? তাদের কি তাদের ভূমির উপযুক্ত মূল্য দেয়া হচ্ছিল? রূপগঞ্জ ঘটনার পর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, এলাকাবাসীর এমন উচ্ছৃঙ্খল হওয়ার পেছনে নাকি প্রধান বিরোধীদল বিএনপির মদত রয়েছে। এ দাবি নাকচ করে দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। কথা হচ্ছে, রূপগঞ্জ এলাকাবাসী তাদের ভূমিশক্তি রক্ষার জন্যই প্রতিবাদ করেছে। সরকারের উচিত ছিল আগেই তাদের সঙ্গে দফারফা করে ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা। তা না করে এমন দাঙ্গাময় পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সরকার কি দায় এড়াতে পারে? না পারে না।

কারণ নিরীহ গ্রামবাসী যারা নিহত-আহত হয়েছেন তারা জেনেশুনেই আগুনে ঝাঁপ দিয়েছেন। সরকার এমন উত্তপ্ত পরিস্থিতি কেন সৃষ্টি করল তা ভেবে দেখার বিষয়। দেশে একটি বিষয় খুবই স্পষ্টভাবে চাউর হচ্ছে, বিভিন্ন এলাকায় এমপি বনাম উপজেলা চেয়ারম্যানদের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ। এমনও ঘটনা ঘটছে, বর্তমান মহাজোট সমর্থিত সরকারের এমপি-উপজেলা চেয়ারম্যানরাও মুখোমুখি দ্বন্দ্বে লিপ্ত হচ্ছেন কোথাও কোথাও। এটি রাষ্ট্র প্রশাসনের জন্য খুবই অশুভ ইঙ্গিত।

জাতিসংঘের একটি সহযোগী সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের জনসংখ্যা এখন প্রায় সাড়ে ১৬ কোটি। যদিও বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী তা অস্বীকার করার চেষ্টা করেছেন এক সেমিনারে। কিন্তু সন্দেহ নেই স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের লোকসংখ্যা একাত্তর থেকে আজ পর্যন্ত দ্বিগুণ হয়েছে। অথচ সে তুলনায় বাংলাদেশে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ কিংবা জনগণের ক্ষমতায়ন সুষ্ঠুভাবে হয়নি। বরং ক্ষমতাভোগীদের ভাগবাটোয়ারা হয়েছে নিজেদের মাঝেই।

রাষ্ট্রক্ষমতা ভোগ করতে গিয়ে অপশক্তিরাই আঁতাত করেছে বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে। এ আঁতাত করতে গিয়ে স্ববিরোধী অবস্থানেও দাঁড়াতে হয়েছে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে। মনে রাখা দরকার একটি রাষ্ট্রে তার বিভিন্ন বাহিনী, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর এবং সব কার্যনির্বাহী বিভাগ সরকারের সম্পূরক শক্তি। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার সেগুলোকে দরকার মতো কাজে লাগাবেই। অথচ চট্টগ্রাম বন্দর পরিচালনায় সেনাবাহিনী মোতায়েনের পর প্রধান বিরোধীদল বিএনপি বলল, সরকার নাকি ব্যর্থ হয়ে সেনাবাহিনী নামিয়েছে।

রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্যই তো সেনাবাহিনী। সরকার দরকার মতো সেনাবাহিনী যে কোন মাঠে নামাতে পারে। এ প্রসঙ্গে একটি কথা আমার প্রায়ই মনে পড়ে। ওয়ান-ইলেভেন পরিস্থিতির দায়ও ভবিষ্যৎ বিষয়ে বিএনপির একজন সিনিয়র নেতা নিউইয়র্কে একটি ঘরোয়া আড্ডায় একটি কথা বলেছিলেন। সাবেক সেনা কর্মকর্তা ওই প্রাজ্ঞ ব্যক্তি বলেছিলেন, 'দেশে জঙ্গিবাদ যখন চরমে, যখন দেশে একযোগে বোমা হামলা হলো তখন আমরা ম্যাডামকে বলেছিলাম, জঙ্গি দমনে সেনাবাহিনীর সাহায্য নেয়া হোক।

ম্যাডাম আমাদের কথা শোনেননি। শুনলে হয়তো ওয়ান-ইলেভেন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। ' হ্যাঁ, তা তো বটেই। ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য খালেদা জিয়া যতটা মরিয়া ছিলেন, জঙ্গিবাদ দমনে তিনি ছিলেন ততোধিক নির্বিকার। তাই জঙ্গিবাদীরা প্রশ্রয় পেয়েছিল সরাসরি তার মন্ত্রীবর্গ, হাওয়া ভবনধারীদের কাছ থেকে।

চারদলীয় জোট সরকারের সময় রাষ্ট্রীয় মানবতা এতটাই মারাত্মক বিপর্যস্ত ছিল যে, মানুষ ছিল সর্বাংশে আতঙ্কিত। খুবই পরিতাপের কথা, বর্তমান মহাজোট সরকার সেই চরম আতঙ্ক অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারছে না। খবর বেরিয়েছে, ঢাকার মিরপুরের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য কামাল মজুমদার নাকি আহছানিয়া ক্যান্সার হাসপাতালের কিছু জমি দখল করে রেখেছেন (দৈনিক প্রথম আলো, ২৫ অক্টোবর ২০১০ সোমবার)। সরকার অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে ধমক দিয়ে কথা বলবেন আর সরকারের এমপি, মন্ত্রীরা এমন হীন কর্মের মদত দেবেন- তা তো চলতে পারে না। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বখাটে, দখলদার, লুটেরা সবাই মানবতার ভিন্নপক্ষ।

এরা সব সময়ই সত্য এবং ন্যায়ের বিপক্ষে। বিএনপি-জামায়াতের অমানবিক কর্মকা- থেকে মুক্তি চেয়েছিল মানুষ। তাই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছিল মহাজোট সরকারকে। কিন্তু মহাজোটের হাইব্রিড লুটেরা ও বখাটে শ্রেণী রাষ্ট্রের মানুষকে আরও অতিষ্ঠ করে তুলছে। এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জরুরি ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

নিউইয়র্ক, ২৬ অক্টোবর ২০১০ ------------------------------------------------------------------------ দৈনিক সংবাদ / ঢাকা/ ২৯ অক্টোবর ২০১০ শুক্রবার ছবি- অ্যলেক্স অর্টিকোভস্কি


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.