আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রশাসনে উত্তাপ বাড়াল পাবনা

good

'পাবনা পরিস্থিতি' সামাল দিতে ডিসি, এসপি ও ইউএনও প্রত্যাহার করাকে সরকারের 'রাজনৈতিক কৌশল' আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এমনিতেই কেন্দ্র ও মাঠ প্রশাসনে মন্ত্রী, এমপি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের অযাচিত হস্তক্ষেপের কারণে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ রয়েছে, তার সঙ্গে এবার ঘৃতাহুতির মতো যোগ হলো পাবনার ঘটনা। গতকাল সচিবালয়সহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তর ঘুরে কর্মকর্তাদের দিনভর এসব বিষয় নিয়েই আলোচনা করে অনানুষ্ঠানিক ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। অধিকাংশ সচিব বিষয়টি নিয়ে মেপে মেপে কথা বললেও যুগ্ম সচিব, উপসচিব এবং সিনিয়র সহকারী সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই প্রকাশ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। কর্মকর্তাদের মতে, পাবনায় বদলিকে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কৌশল হিসেবে নিয়ে জেলা প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোর অবমূল্যায়ন করা হয়েছে।

সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিব ইকবাল মাহমুদ গতকাল বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা নিয়ম মেনে চলেন বলেই বিভিন্ন দিক থেকে তদবির আসে। সরকারও চায়, নিয়ম অনুযায়ীই সব কিছু হোক। পাবনা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বদলি জনপ্রশাসনে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, এটা চলতেই থাকবে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীদের তদবির না শোনায় পাবনা জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ওপর প্রথমে হামলা, পরে বদলির খৰ নেমে আসে। তাঁরা সরকারি দিকনির্দেশনা অনুযায়ী নিয়োগপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন।

এ পরিস্থিতিতে সরকারের নীতিনির্ধারকরা কর্মকর্তাদের আস্থায় না নিয়ে তাঁদের বদলির মাধ্যমে দলীয় নেতা-কর্মীদেরই উৎসাহিত করেছেন বলে কেন্দ্রীয় প্রশাসনের একাধিক সচিব অভিযোগ করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে তাঁরা বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে তাতে জেলা প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বদলি করতেই হবে। কিন্তু সেই বদলি বা প্রত্যাহারকে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কৌশল হিসেবে নেওয়ায় ডিসি, এসপি, ইউএনওর মতো পদগুলোকে অবমূল্যায়িত করা হয়েছে। উৎসাহিত করা হয়েছে অসাধু দলীয় নেতা-কর্মীদের। এটা কোনো সরকারের জন্যই শুভ নয়।

তাঁরা বলেন, পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর এসব কর্মকর্তাকে বদলি করা হলে দলের স্থানীয় নেতা-কর্মীরা অন্তত বুঝতে পারত, সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করলে বা দলীয় লোকজনের কথামতো না চললেই কাউকে শাস্তি দেওয়া যায় না। এতে ডিসি, এসপি, ইউএনওর মতো পদগুলোর সম্মানও রক্ষা হতো। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে যাঁরা এসব পদে নিয়োগ পাবেন, তাঁরাও সম্মান ও স্বস্তির সঙ্গে কাজ করতে পারতেন। কিন্তু এখন যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হলো, তাতে ভবিষ্যতে যাঁরা এসব পদে যাবেন তাঁরাও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবেন না। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মন্ত্রী, এমপি ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের অযাচিত হস্তক্ষেপে অস্থির হয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের প্রশাসন।

মন্ত্রণালয়ের সচিব থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসকরা নানা বিষয়ে রাজনৈতিক তদবিরের জাঁতাকলে রয়েছেন। ক্রমবর্ধমান চাপের কারণে আতঙ্কিত কর্মকর্তারা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র অসন্তোষ। এসব কারণে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নেও বিলম্ব হচ্ছে। তদবির, চাপ, হস্তক্ষেপসহ বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এরই মধ্যে প্রায় ২০টি জেলায় জেলা প্রশাসকরা মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিয়ে গোপন বৈঠক করেছেন।

পর্যায়ক্রমে সব জেলায় এ ধরনের বৈঠক শেষ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দিয়ে মতামতগুলো অবহিত করা হবে। মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সচিবালয়েও প্রশাসনের মাঝারি পর্যায়ের কর্মকর্তারা যেকোনো দিন নিজেদের মধ্যে গোপন বৈঠক করে করণীয় ঠিক করতে পারেন বলে আভাস পাওয়া গেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব ড. আকবর আলি খান এ প্রসঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, তদবির অধিকাংশ সময়ই আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। তদবির নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি পর্যন্ত হয়ে থাকে। তিনি বলেন, নিয়োগের তদবির নিয়ে যা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক।

সংবিধান অনুযায়ী যেকোনো নিয়োগ দিতে হবে মেধার ভিত্তিতে, দলীয় ভিত্তিতে নয়। অসাংবিধানিকভাবে যাঁরা নিয়োগ পাবেন, পরবর্তী সরকার এসে তাঁদের নিয়োগ অবৈধ ঘোষণা করতে পারে বা সরাসরি চাকরি থেকে বাদ দিয়ে দিতে পারে। টেন্ডার, সাপ্লাই, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের বরাদ্দ, নিয়োগ, বদলি, পদায়ন_সব কিছুতেই তদবির আসছে বলে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। তদবিরের প্রায় প্রতিটি কাজ থেকে অবৈধভাবে অর্থ আয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্য সরকারি দলের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীসহ অনেকেই এ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। যেসব জেলায় তদবির বা চাপ কিছুতেই কাজ হচ্ছে না, সেখানেই বিস্ফোরণ ঘটছে।

সৃষ্টি হচ্ছে 'পাবনা পরিস্থিতি'। চট্টগ্রাম বিভাগের অধীন একটি জেলার ডিসি ক্ষোভের সঙ্গে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মন্ত্রণালয় থেকে দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য একের পর এক চিঠি দেওয়া হয়। কিন্তু মাঠ প্রশাসনে আমরা কতটা প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে কাজ করি, সে বিষয়টি কখনো বিবেচনায় নেওয়া হয় না। ' গত এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেন্ডার-চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িতদের কঠোরভাবে দমন করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেন।

এর পর থেকে টেন্ডারের দখল নিয়ে প্রকাশ্যে সংঘর্ষ বন্ধ হয়। কিন্তু টেন্ডারের দখল বন্ধ হয়নি। এখন একই ব্যক্তিরা গোপনে তদবির বা সরাসরি চাপ দিয়ে কাজ আদায় করে নিচ্ছে বলে জানা গেছে। টেন্ডারের আদলেই নিয়োগসহ অন্যান্য বিষয়েও এখন গোপন তদবির চলছে। টিআর, কাজের বিনিময়ে খাদ্য, ভিজিডিসহ এ ধরনের প্রকল্পে চাল-গম বেশি বরাদ্দ পাওয়া নিয়েও চলে তদবির।

অতিষ্ঠ হয়ে এ ধরনের কাজের জন্য বরাদ্দসংক্রান্ত বিষয়গুলো দেখভালের দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে জেলাপর্যায়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে বলে খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি মন্ত্রণালয়ের সচিব কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার মন্ত্রণালয়ের অধীন দপ্তর-অধিদপ্তরের নিয়োগ শেষ। কোনো ঝামেলা হয়নি। আগে থেকেই এমপিদের কাছ থেকে চাকরিপ্রার্থীর তালিকা নেওয়া হয়েছিল। সেই তালিকা সংশ্লিষ্ট দপ্তরের প্রধানদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

ওইসব প্রার্থীর খাতাপত্র সেভাবে মূল্যায়ন করে তাদের চাকরি দেওয়া হয়েছে। ' তিনি বলেন, "এ ক্ষেত্রে আমরা 'সূক্ষ্ম কারচুপি' করেছি। এমপিদের কথা না শুনলে আমাদের মতো কর্মকর্তাদের বিএনপিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। চাকরিজীবনের শেষ প্রান্তে এসে দলীয় কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত হতে চাই না। নির্বিঘ্নে শেষ সময়টুকু পার করতে চাই বলেই এ ধরনের কাজ করেছি।

" মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, জেলা প্রশাসক নিয়োগের আগে একটি ফিটলিস্ট তৈরি করা হয়। সেই তালিকা প্রধানমন্ত্রী অনুমোদনের পর সেখান থেকে জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। কয়েক বছর ধরে অলিখিতভাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার রাজনৈতিক পরিচয়ও দেখা হয়। পাবনাসহ সব জেলার প্রশাসককে এভাবেই নিয়োগ দেওয়া হয়। তা সত্ত্বেও 'পাবনা পরিস্থিতি' সৃষ্টি হওয়া থেকেই বোঝা যায়, তদবিরের চাপ কতটা ভয়ঙ্কর।

কালের কণ্ঠ, Thu 30 Sep 2010

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.