আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পায়ের নলা শুকানো, হাটু ভাঙ্গা, কোমর ভাঙ্গা, নড়বড়ে কশেরুকার মেরুদন্ডসম্পন্ন এবং শুষ্ক মস্তিষ্কের বিএনপি

মিলে মিশে করি কাজ, হারি জিতি নাহি লাজ!

সেই ছোটবেলায় যখন থেকে বানান করে পড়তে পারতাম, স্কুলে আসা-যাওয়া করি, ছড়া-কবিতা পড়ি, তখন আমাদের পাড়ার দেয়াল লিখনগুলো পড়তাম। চোখের সামনে আজো ভাসে বড় বড় অক্ষরের “B N P”, “দেশ গড়েছেন শহীদ জিয়া, নেত্রী মোদের খালেদা জিয়া। ” “আমরা শক্তি, আমরা বল, আমরা ছাত্রদল। ” ঐ বয়সটায় “রাজনীতি” শব্দের সাথে পরিচিত ছিলাম না মোটেও। দেখতাম পাড়ার স্কুলের উপরের ক্লাসে পড়ুয়া বা কলেজে পড়ুয়া সবাই বিএনপি করে, সবাই ছাত্রদল।

আমরা পিচ্চিরাও তালে তালে ছাত্রদল, কিছু না বুঝেই ছাত্রদল। ছাত্রদল খায় না মাথায় দেয় জানি না। তবে আশির দশকের সে সময়গুলোতে মাঝে মাঝেই শুনতাম হরতাল। আব্বা সাথে করে স্কুলে নিয়ে যেত, চোখে-মুখে একটা টেনশান। ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ছাত্রদল নামধারী কলেজের ছেলেরা মিছিল নিয়ে এসে স্কুলের গেটের সামনে চিল্লাচিল্লি।

আপারা সবাই দৌড়াদৌড়ি করে বিভিন্ন ক্লাস রুমের সামনে গিয়ে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়াতেন, মেয়েদের নিরাপত্তা বিধানের উদ্দেশ্যে। সবার চোখেমুখে একটা উৎকন্ঠা। বড় আপা আরো দুই-চারজন সিনিয়র টিচারদের নিয়ে গেটে গিয়ে ছেলেদের অনুনয়-বিনয় করতেন, বাবারা আমরা কি করবো? সরকারী সিদ্ধান্ত স্কুল খোলা রাখতে হবে। ছাত্রদের চাপ, না স্কুলে আজ ক্লাস নেয়া যাবে না, হরতাল মানতে হবে। ছাত্ররা হুমকি-ধমকি দিতো, এক্ষুণি স্কুলে ঢুকে পড়বে, ভাংচুর করবে......কিছুক্ষণ এরকম দরকষাকষি পর আপারা বাধ্য হতেন স্কুল ছুটি দিয়ে দিতে।

আমরা মাঝ দুপুরেই আবার বাসায় ফিরে আসতাম। এরশাদের আমলে এরকম তামাশা যে কতবার হয়েছে! শেখ হাসিনা নামে যে কেউ বাংলাদেশে আছেন এটা আমি ৯০ এর গণআন্দোলনের আগে কখনো জানিনি, শুনিইনি কখনো ঐ নাম আমাদের আশেপাশে। পত্রিকা তখন তেমন একটা পড়তাম না। টিভিতে তো কেবল ফার্স্ট লেডি, আর সাদ এরশাদরে দেখতে দেখতেই বিরক্ত। এ হলো আমার আশির দশকের রাজনৈতিক জ্ঞান! ৯০ এর গণআন্দোলনটাই মূলত আমাকে “রাজনীতি” শব্দের সাথে পরিচিত করলো, তখন থেকে একটু একটু করে জানতে লাগলাম বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কথা, বিভিন্ন নেতা-নেত্রীর কথা, বিভিন্ন ঘটনা- ঘনঘটা সম্পর্কে।

পত্রিকা পড়া, টিভির খবর মনোযোগ দিয়ে শোনা এবং চোখ দিয়ে সবাইকে ভাল করে দেখা মানে চেহারা পড়া, আউটলুক, ইনার লুক বোঝার চেষ্টা শুরু হয়েছে তখন থেকে। ৯১ এর নির্বাচনের রাতে তো আমরা সারারাত জেগে ছিলাম টিভি সেটের সামনে, সে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি! টের পেলাম বুঝে না বুঝে বিএনপির প্রতি একটা ভালোবাসা তৈরী হয়ে গেছে মনের ভিতরে যার উপর কোন হাতই ছিল না আমার। বিএনপির কোন দোষ খুঁজে পাই না, আসলে বলা উচিত বড়রা খুঁজে পায় না, তাই আমিও পাই না। আমি তো আর ভাল-মন্দ খুঁজতে শিখিনি তখনো। সবাই আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করে বিএনপি জিতুক, আমিও করি।

বিএনপি জিতলো, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হলো। সবাই খুশী, কিন্তু যখন আমি টিভিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর চুল ফোলা বিদেশী জর্জেট শাড়ি পরা চেহারাটা দেখলাম, মুহূর্তেই নিজের ভিতরে একটা বিরক্তি টের পেলাম। নেতা-নেত্রীদের প্রতি আমার নিজস্ব একটা ভালো লাগা – খারাপ লাগার অনুভূতির শুরু তখন থেকেই। এরপর গোলাম আজমের দেশে ফেরা, জামাআতের আমির হওয়া নিয়ে যখন তোলপাড় সারা দেশ, বাসার সবার দেখি চরম বিরক্তি, সবাই টিভিতে খবর দেখছে আর রীতিমত খালেদা জিয়াকে গালিগালাজ করছে। তখন ভালমতো সবকিছু না বুঝলেও আরো বড় হয়ে যখন পুরো ব্যাপারটা বুঝলাম, ঐ ক্ষোভটাকে আমার অযৌক্তিক মনে হয়নি মোটেও! আবার সংসদীয় গণতন্ত্র সংক্রান্ত যে গণভোট হলো, খালেদা-হাসিনা গভীর রাতে সংসদে পরস্পরকে ফুলের তোড়া উপহার দিলো, কি আনন্দ সবার মাঝে! আমার অভ্যাস ছিল রেডিওতে নিয়মিত সংসদ অধিবেশন শোনা।

আমি যতদিন স্কুলে পড়েছি, আব্বা টিভি কেনেনি বাসায়, উনার ধারণা ছিল তাহলে আমার পড়াশোনা হবে না, সারাদিন টিভি নিয়ে বসে থাকবো। টিভি দেখতে হলে আশপাশের বাসাতে বা কাছেই ফুফুর বাসায় যেতে হতো। নানারকম ক্ষোভের কারণ থাকলেও ওই টার্মে বিএনপির প্রতি ভালোবাসা তখনো অবশিষ্ট ছিল। আমাদের পরিবারে কি না কি কারণে যেন প্রায় সবাই এন্টি-আওয়ামী। আমার আগের জেনারেশনদের কেউই দু চক্ষে আওয়ামী লীগকে দেখতে পারে না।

এর কারণ হিসেবে ৭৪ এর দুর্ভিক্ষ একটা বড় ফ্যাক্ট বোঝা যায়, মাঝে মাঝেই এটা নিয়ে আলোচনা উঠে ঘরোয়া আড্ডায়। কেউ কেউ ওই আমলে মনে হয় জাসদ রাজনীতির সাথেও জড়িত ছিল। অবশ্য বড় হয়ে ওই দুর্ভিক্ষ নিয়ে বিভিন্ন পড়াশোনার পর আমার মাঝে এতোটা আওয়ামী-বিদ্বেষ কাজ করে না। তবে আওয়ামী লীগের কট্টর এবং গায়ে পড়ে ঝামেলা করার স্বভাবটা আজো বিরক্তির উদ্রেক করে। ২০০১ সালে যখন প্রথম ভোটার হলাম, জীবনের প্রথম ভোটটা বিএনপিকেই দিয়েছিলাম।

বলাই বাহুল্য, একেবারেই আবেগ থেকে, কোনরকম চিন্তা-ভাবনা, যুক্তি-আলোচনা থেকে না। এরপরই মোহ কাটা শুরু হলো। প্রথমেই মনে হয় আহসানউল্ল্যাহ মাস্টার মারা যাওয়ার ঘটনা থেকে। সেটা আরো দৃঢ় হলো ৬৪ জেলায় একযোগে বোমা হামলার ঘটনায়। এরপর একে একে বাংলা ভাই, কিবরিয়া হত্যাসহ, অসহনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, হাওয়া ভবনের মাত্রাতিরিক্ত দাপট আর দূর্নীতি, সিনিয়র নেতাদের সাথে কারো কারো চরম বেয়াদপীর কথাও শুনতাম পত্র-পত্রিকায় বা নানাজনের কাছে, এগুলো শুনে ভাল লাগতো না।

তারপর ২১শে আগস্টের বোমা হামলা। ওই বোমা হামলার সময়ে আমি রোকেয়া হলে ছিলাম। আমাদের কোন কোন বান্ধবী রিকাশায় করে ঢাকা মেডিকেলে আসতে থাকা বিভিন্ন ছিন্ন-ভিন্ন হাত-পাসহ আহতদের দেখেই ভয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলো। ঐ বীভৎস লাশ আর আহতদের দৃশ্য দেখে অনেক মেয়েই হলের ভিতরে কাঁপতেছিল, কেউ কেউ মূর্চ্ছাও গিয়েছিল। টিভিতে খবর আসার আগেই আমরা জেনে গিয়েছিলাম সেই নারকীয় ঘটনার কথা।

সে কি অসহ্যকর! এরপরও আর কোন ভালোবাসা থাকে বিএনপি সরকারের প্রতি? অবশিষ্ট যেটুকু ছিল তাও গেছে ইয়াজুদ্দীনের প্রধান উপদেষ্টা হবার পর থেকে। ছি ছি কি লজ্জা! রাষ্ট্রপতির প্রধান উপদেষ্টা হওয়া! আমাদের রাষ্ট্রপতিদের কাছ থেকে আমরা আরো ব্যক্তিত্ব আর বিচক্ষণতা আশা করি। পুরষ্কার বা শাস্তি যা পাবার তা পেয়েছে বিএনপি। মাত্র ৩১টি আসন। একটাও না পেলে আরো খুশী হতাম।

কিন্তু তাতেও কি বিএনপির শিক্ষা হয়েছে? নিজেদের দোষ-ত্রুটির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সংশোধন হবার পথে বিএনপি কতদূর এগিয়েছে জানে কেউ? গত প্রায় দুবছর ধরে বিরোধীদল হিসেবে নিজেদের শক্ত ও স্বচ্ছ অভিব্যক্তি কি তারা গড়ে তুলতে পেরেছে? সরকার যত কায়দাই করুক না কেন, জনগণ তো সবই দেখতে পাচ্ছে। গত টার্মে বিএনপিকে যেমন সবাই দেখেছে, এ টার্মে আওয়ামী লীগকেও সবাই দেখছে। কেউ তো চোখ বন্ধ করে বসে নেই। এবারের সরকারের নানা কাজে যেসব গঠনমূলক গুণগত পরিবর্তন এসেছে বা হাসিনা এনেছেন, বিরোধী দল কি সেরকম কিছু করেছে? একটা ছায়া বাজেট দিয়েছিল বিএনপি এবার। আশান্বিত হয়েছিলাম, যাক্‌ বিএনপির বোধোদয় হলো বলে! এ পরামর্শ যিনি দিয়েছিলেন, তাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

কিন্তু কিসের কি! বাজেট অধিবেশনের সময়ে একদিন সংসদে গিয়েই লাপাত্তা বিএনপি। পঞ্চম আর সপ্তম সংশোধনীর মতো দুটো জরুরী রায় আমাদের দেশে হলো, যেটার ব্যাপারে সরাসরি বিএনপির অনেক কিছু বলার কথা, বলা উচিত, কিন্তু কৈ, এখনো পর্যন্ত এ ব্যাপারে বিএনপি গঠনমূলক কিছু বলতে পেরেছে কি? এখন নিশ্চয়ই সুরঞ্জিতের উপরে এক চোট নিবেন, আপনাদের সংবিধান সংশোধনী কমিটিতে কম সংখ্যক সদস্যপদ দেয়া হয়েছে, হেন তেন। বলি কি, আপনাদের বক্তব্য সুস্পষ্টভাবে জনগনের সামনে তুলে ধরুন। ২০১০ সালের বাংলাদেশে মিডিয়ার অভাব নেই, সংসদে আপনাদের মাইক বন্ধ রাখলে জনগণের সেটা দেখার চোখ আছে, আপনাদের যৌক্তিক পরামর্শ সরকার না শুনলে সেটা বোঝার মতো ক্ষমতাও জনগণের আছে। সরকারের উপর জ্ঞান-বুদ্ধি-যুক্তি দিয়ে চাপ তৈরী করুন, মিডিয়াকে সর্বোচ্চভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করুন, হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশের মুগুর হাসিনাকেই কায়দা করে ফিরিয়ে দিন না, একটু মাথা খাটান।

কেবল রাস্তায় হাত-পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে হরতাল বা মিছিল করাটাই একমাত্র পন্থা না। সেটাও তো ঠিকভাবে পারেন না। বাংলা মোটর পর্যন্ত আসতে না আসতেই আপনারা টায়ার্ড হয়ে পড়েন। মিছিলের জন্য আপনাদের শিবিরের ছেলেদের হায়ারে আনা লাগে। ৯৬তে একবার দেখেছিলাম বিএনপিপ্রধান এলাকায় ছাত্রলীগের ছেলেরা এসে কিভাবে ছাত্রদলের ছেলেদের ধাওয়া করলো।

ছাত্রদলের ছেলেরা পারে কি!? সোমবার থেকে সংসদ অধিবেশন। বিএনপির চীফ হুইপের শর্তের বাহার দেখে হাসবো না কাঁদবো ঠিক বুঝতে পারলাম না। বলি, হু ইজ কোকো? তার পেরোলে মুক্তি হবে কি হবে না তা দিয়ে প্রায় ২০ কোটি জনগণের কি যায় আসে? অথবা নিদেনপক্ষে ৩১ সীটে যারা আপনাদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে, তাদের কি যায় আসে এক কোকো জেলে থাকলে, পঁচে মরলে? তারেকের কোমর ভাংলে? তাতে ব্যক্তিগতভাবে খালেদা জিয়ার ক্ষতি হতে পারে, জনগণের বৃহত্তর স্বার্থে এসব ব্যক্তিগত অনুভূতির কি মূল্য আছে? বিএনপিতে কি আর কোন নেতা নেই খালেদার অনুপস্থিতিতে দলের হাল ধরার? পাশের দেশের সোনিয়া গান্ধীর কাছ থেকে কি আমাদের নেতা-নেত্রীদের কিছুই শেখার নেই? রাহুল গান্ধীর মতো ছেলে বলতে পারে, “প্রধানমন্ত্রী হওয়াই একজন রাজনীতিকের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না”। " এরকম কোন চিন্তা কি আমাদের তারেকের, কোকোর, জয়ের, পুতুলের হতে পারে না? আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে সারাদিনে যেকোন মুহূর্তে ভারতের কোন না কোন কিছু ব্যবহার করি। হয় টিভি চ্যানেল, নয়, জামা-শাড়ি, নয়তো পেঁয়াজ-চিনি, নয়তো ইন্ডিয়ান প্রিন্টের বই, নয়তো কোরবানীর গরু।

কিন্তু ভারতের রাজনীতিকদের প্রজ্ঞা, বুদ্ধি, ম্যাচিউরিটি, অভিজ্ঞতা, তাদের সাধারণ মানুষদের দেশপ্রেম, হিসেবী চালচলন এসব থেকে কিছু শিখতে বা ব্যবহার করতে আমাদের এতো অনীহা কেন? যেগুলো শিখলে বা ব্যবহার করলে আসলেই আমরা কিছু উপকৃত হতাম, নিজেদের কিছু উন্নতি হতো। আমরা কি কেবল কাজের চেয়ে অকাজই বেশি করবো?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।